বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কী ধরনের কাঠামো তৈরি হবে, তা বোঝার জন্য সময় প্রয়োজন। কারণ নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই মাস পেরিছে। কাজেই এত তাড়াতাড়ি সবকিছু বোঝা সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে কয়েকটি বিষয় যদিও সামনে চলে এসেছে। তার মধ্যে একটি হলো- প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমেরিকা সফর। জাতীয় অধিবেশনে একাধিক নেতার সঙ্গে তার বৈঠক ইত্যাদি বিষয়কে নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার বড় আশা হলো, আমেরিকা বড় আকারে বাংলাদেশের সহযোগিতায় সঙ্গে থাকবে। বাংলাদেশের কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে তারা জড়িত থাকবে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটা স্থবিরতার মধ্যে চলছে। সে ক্ষেত্রে আমেরিকার মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশের সহায়তা নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ডায়নামিক করতে হলে বড় আকারে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। সেটি যতক্ষণ না হবে, ততক্ষণ কিছু বোঝা যাবে না। বিনিয়োগ কীভাবে হবে, কত বড় পরিমাণে হবে ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকার মূল বিনিয়োগ জ্বালানি খাতে থাকে। এ ছাড়া বাজেটারি সাপোর্টসহ সিওসি সাপোর্ট থাকে। কিন্তু এখন দেখা দরকার যে, বড় আকারে আমেরিকা সরকার বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে কতটুকু বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। যদি আমেরিকা নতুনত্ব আনতে পারে, তা দেশের জন্য নিশ্চয়ই ইতিবাচক হবে। তবে এটি একটি ‘দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া’।
যদি একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো করা যায়, তা অপেক্ষাকৃত ভালো হবে। কারণ আমরা ভালো করেই জানি যে, বড় অঙ্কের অর্থ যারা অন্যায়ভাবে উপার্জন করেছেন; তারা অন্যায়ভাবে পশ্চিমা দেশে, বিশেষ করে আমেরিকা, ইউকে, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় অর্থ পাচার করেছেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক বেশ ভালো ও বন্ধুপ্রতিম। কাজেই সেই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে একটি ‘বস্তুনিষ্ঠ ও গঠনমূলক কাঠামো’ করা যায়। জাতিসংঘ সফর নিয়ে যে আশা বাংলাদেশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তার একটি আশাপ্রদ ফল পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয়। সে জন্য আমাদের আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। কারণ মাত্র দুই মাস সময় খুব বেশি নয়। সে জন্য অন্তত কয়েক মাস গেলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে। বিশেষ করে বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভেতরে বড় ধরনের বিনিয়োগ কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। তা না হলে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহী হবেন না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যদি মনে করেন এখানে বিনিয়োগ করা ঝুঁকি হবে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এটিকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না। ব্যাপারটি খেয়াল রাখা দরকার। এই সম্পর্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকার ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং একই সঙ্গে সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারার দিকে নজর রাখতে হবে। কথা উঠেছে যে, আর্মি প্রধান বলেছেন, ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। এখন সময় যেহেতু খুব একটা পাওয়া যাবে না, তাহলে কী ধরনের সংস্কার করবে? এগুলো যদি পরিষ্কার না হয় এবং সংস্কারগুলোর রাজনৈতিকভাবেও গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে।
পররাষ্ট্রনীতি অনেকটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গেছে। যদি সংস্কারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ রীতিনীতিতে নতুনত্ব আনতে হয়, পররাষ্ট্রনীতির ভেতরে যে সংস্কার তা পরিষ্কার হওয়া দরকার। একটি বহুমাত্রিক কাঠামোর মধ্যে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। তাকে মাল্টিপোলার পৃথিবী বলা হয়। আমেরিকাই একমাত্র দেশ নয়, সেখানে একাধিক দেশ বড় ধরনের ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, রাশিয়া, জাপানসহ একাধিক দেশ কিন্তু একেকটি ছোট-বড় পোলার তৈরি করছে। এখন যতদিন আমেরিকার সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক জোরদার করা যায়; অর্থাৎ যদি বিনিয়োগ বাড়ানো যায়, তাহলে অন্য পোলারের সঙ্গে খুব একটা সাংঘর্ষিক পর্যায়ে যাবে না। তারাও দুশ্চিন্তায় থাকবে না। সংস্কারের মধ্যে বাংলাদেশের সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা বিশ্বায়নের যুগে খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশ যত বেশি পররাষ্ট্রনীতি নমনীয় রাখতে পারবে, সার্বভৌমত্ব তত বেশি জোরদার হবে, নির্ভরশীল হবে, এটাও খেয়াল রাখতে হবে। সব দেশের ব্যাপারেই তাই। যত বেশি পররাষ্ট্রনীতি স্থিতিশীল হবে, তত বেশি তার সার্বভৌমত্ব জোরদার হবে। সেটি করতে পেশাদারি মনোভাব থাকতে হবে।
যারা পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন, তাদেরও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কীভাবে সম্পর্ক করা যায়, সে ব্যাপারে পেশাদারি মনোভাব তৈরি করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। সব সময় সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মসৃণ রাখা অথবা পরিবর্তন করা যায় না। যেহেতু প্রতিবেশী পরিবর্তন করা যায় না, সেখানে অবশ্যই বড় ধরনের পেশাদারি মনোভাব প্রয়োজন। একই সঙ্গে সম্পর্কটি জনগণ থেকে জনগণের মধ্যে কীভাবে আনা যায়, সেটি দেখা দরকার। বিগত সরকারের মধ্যে আমরা ঘাটতি দেখেছি। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে যে ঘাটতি ছিল। তা হলো সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেও তা জনগণের মধ্যে পৌঁছায়নি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। কারণ একাধিক বিষয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি মসৃণ নয়। আরেকটি হলো রোহিঙ্গা বিষয়। সেটিও অনেক দিন থেকেই অনাকাঙ্ক্ষিত এক সমস্যা হয়ে আছে। এখন দেখা দরকার যে, অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে এর মধ্যে নতুনত্ব আনতে পারে। সে ক্ষেত্রে দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো আউট অব বক্সে কতগুলো চিন্তাভাবনা আনা দরকার। একটি কাঠামো তৈরি করা দরকার, যেখানে মায়ানমারের বিরাট অংশ আরাকান আর্মির দখলে, তাহলে কীভাবে বাংলাদেশ আরাকান আর্মির সঙ্গে এই নতুন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা তৈরি করবে। একই সঙ্গে ‘কীভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠালে উভয় পক্ষেরই’ লাভ হবে। সে লক্ষ্যে চিন্তাভাবনাসহ সুগঠিত পরিকল্পনা থাকা দরকার।
সার্বিকভাবে বলব, একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি সুগঠিত ও শক্তিশালী হলে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমরনীতিসহ সর্বত্রই একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কাজেই পররাষ্ট্রনীতি সংস্কারের মাধ্যমে তাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার পররাষ্ট্রনীতিকে নতুনভাবে সংস্কারের মাধ্যমে বিশ্বায়নের যুগে কতটা অগ্রসর হতে পারে, সেটিই এখন প্রধান বিবেচ্য।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক