সন্ত্রাস ও অপরাধ দমনে সেনাবাহিনীর কঠোর ‘অ্যাকশন’ শুরু হয়েছে। চিহ্নিত সন্ত্রাসী বা অপরাধী, অস্ত্রবাজ ও সামাজিক বিশৃঙ্খলাকারীদের ধরতে নিয়মিত সাঁড়াশি অভিযান চলছে। গত কয়েক দিনে দুজন শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ বেশ কিছু চিহ্নিত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীকে আটক করেছে সেনাবাহিনী। অনেকে সেনা অভিযান টের পেয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে। কেউ কেউ ছদ্মবেশ ধারণ করে গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা করছে। কেউ কেউ আবার দেশের বাইরে পালানোরও সুযোগ খুঁজছে বলে জানা গেছে।
এদিকে একের পর এক চিহ্নিত ভয়ানক সন্ত্রাসী গ্রেপ্তারের ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে ধীরে ধীরে ফিরছে স্বস্তি। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অনন্য ভূমিকা পালন করে থাকে, তেমনি অপরাধ দমনেও তারা পরীক্ষিত বা দক্ষ। কোথায় কীভাবে কী করতে হবে, তা উচ্চপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী ভালোভাবেই জানে। কাজেই চিহ্নিত সন্ত্রাসী বা যারা সমাজকে অরাজকতার দিকে নিয়ে যাবে, তাদের জন্য সেনাবাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ সাধারণ মানুষের ভরসার প্রধান জায়গায় রয়েছে সেনাবাহিনী।
বৃহস্পতিবার (২৯ মে) দুপুরে বাংলামোটর এলাকায় অফিসের কাজে আসা রাজধানীর মালিবাগের প্রথম লেনের বাসিন্দা মাহমুদুল আলমের সঙ্গে কথা হয়।
চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলাপকালে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি খুব ভালো ব্যাপার। যেখানে মাঝখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতটা খারাপ দেখছিলাম, দিনে-দুপুরে কুপিয়ে ছিনতাই হচ্ছে, প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ মারা হচ্ছে, সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ চিহ্নিত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনে সেনাবাহিনীর কঠোর অভিযান একধরনের স্বস্তি এনেছে। এ ছাড়া সামনে ঈদুল আজহায় অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাবেন। এই যে যাতায়াত, ফাঁকা ঢাকার নিরাপত্তা বা চলাফেরায় যে ঝুঁকি আমাদের উদ্বেগ বাড়ায়, সেখানে সেনাবাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ বা সাঁড়াশি অভিযানকে সাধারণ মানুষ খুবই ভালোভাবে নিচ্ছেন।’
ঢাকার পান্থপথ সিগনাল এলাকায় কথা হয় একজন রিকশাচালকের সঙ্গে। পশ্চিম রাজাবাজারে বসবাস করা রিকশাচালক রমজান আলীও বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে খবরের কাগজকে বলেন, ‘মামা, আমরা গরিব মানুষ, হয়তো আমাদের কথার দাম নাই। কিন্তু আমরাও অনেক কিছু বুঝি। দিন-রাত বিভিন্ন এলাকায় চলাচল করি, বিভিন্ন মহল্লায় যেতে হয়। যেসব ঘটনা দেখি বা শুনি তাতে অনেক সময় ভয়ও লাগে। তবে সেনাবাহিনী যখন বেশি অ্যাকশনে থাকে, তখন আমরা শান্তিতে থাকি। ভয় লাগে না। শুনলাম দুইডা শীর্ষ সন্ত্রাসীকে (সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ) সেনাবাহিনী ধরে ফেলছে। আরও কয়েকটারে ধরার খবর টিভিতে দেখছি। এইবার সন্ত্রাসীরা বুঝব।’
এদিকে কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় তৎপর হয়েছে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। কোথাও কোথাও মব ভায়োলেন্স বা নৃশংস নানা ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এতে ঘটছে খুনোখুনিসহ সশস্ত্র হামলার ঘটনা। গত দুই মাসে রাজধানীতে ঘটা তিনটি খুনের নেপথ্যেও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম আসে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়। সর্বশেষ গত রবিবার রাতে বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় বিএনপি নেতা কামরুল আহসানকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এর আগে ১৯ এপ্রিল হাতিরঝিলে ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য আরিফ শিকদারকে গুলি ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। তার আগে এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের ব্যবসায়ীসহ কয়েকজনকে গুলি করাসহ বেশ কিছু ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম উঠে আসে। এসব হত্যাকাণ্ড বা গোলাগুলির নেপথ্যে সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, পিচ্চি হেলাল, ইমন, কিলার আব্বাস, টিটন, ফ্রিডম রাসু, ‘এক্সেল’ বাবুসহ এমন অনেকের নাম চলে আসে। যাদের বেশির ভাগই গত ৫ আগস্টের পর জামিনে মুক্ত হন। কিন্তু জামিনে বেরিয়েও তারা ফের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণের মরিয়া হয়ে ওঠেন বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। মগবাজার, মতিঝিল, বাড্ডা, গুলশানসহ আরও কিছু এলাকায় এসব সন্ত্রাসীর তৎপরতা দেখেছেন স্থানীয়রা।
এ পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীও অনেকটা ঘোষণা দিয়ে কঠোর অভিযান শুরু করেছে। গত ২০ মে রাজধানীর ভাসানটেক এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে চারটি বিদেশি পিস্তল, ২৮ রাউন্ড গুলিসহ স্থানীয় শীর্ষ সন্ত্রাসী হিটলু বাবুসহ তার গ্যাংয়ের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। এরপর গত মঙ্গলবার কুষ্টিয়া শহরের একটি বাসা থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। একই দিনে মোহাম্মদপুরের ত্রাস ও আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ‘এক্সেল’ বাবুকেও গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী।
এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. উমর ফারুক গতকাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা বা নিরাপত্তাব্যবস্থার শিথিলতার সুযোগে মূলত চিহ্নিত বা পেশাদার অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও আমরা তেমনটি দেখেছি। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্ন করাসহ প্রায় সর্বক্ষেত্রে অপরাধীদের অরাজক পরিস্থিতি আমরা দেখেছি বা দেখছি। সেখানে সেনাবাহিনীর বর্তমান পদক্ষেপ বা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মতো দুর্ধর্ষ অপরাধীদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি সত্যিকার অর্থেই খুবই প্রশংসার দাবি রাখে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে এই ধরনের অভিযান সেনাবাহিনীকে অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখতে হবে, যাতে গ্রেপ্তারের পর এসব চিহ্নিত বা দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি না পায়। আইনের নানা ব্যাখ্যায় যাতে ওই সন্ত্রাসীদের বের হওয়ার সুযোগ দেওয়া না হয়।’
অধ্যাপক ড. উমর ফারুক আরও বলেন, ‘যদি বিচারব্যবস্থা ভালো হতো তাহলে ওই সব সন্ত্রাসীর বিচার প্রক্রিয়া এতদিনে সম্পন্ন হতো। কিন্তু বিচার তো শেষ হয়নি, উল্টো শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরও ইচ্ছামতো জামিন দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জনগণের জানমালের ঝুঁকির দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাই এই জাতীয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সব সময়ই কঠোর পদক্ষেপ থাকতে হবে। সন্ত্রাসীরা বিচার প্রক্রিয়ায় কারাগারে থাকলে বা শাস্তির আওতায় আনা হলে রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণ থাকবে নিরাপত্তাবেষ্টনীতে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ী, মব সৃষ্টিকারী ও ডাকাত-ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে প্রধানত এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ, র্যাবসহ অন্য সংস্থাগুলো। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অভিযানেও বেশ কিছু চিহ্নিত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও যেন লাগাম টানা যাচ্ছিল না। তবে সেনাবাহিনী একধরনের জানান দিয়ে অভিযান শুরুর পর অপরাধ জগতে টনক নড়েছে। অনেক সন্ত্রাসী এখন পালানোর পথ খুঁজছে বলেও গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে। তাদের তথ্যমতে, সীমান্তের উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট ও বন্দরগুলোতে বাড়ানো হয়েছে বাড়তি নজরদারি। যাতে কোনো চিহ্নিত সন্ত্রাসী বা অপরাধী পালানোর সুযোগ না পায়।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যেভাবে অভিযান চালানো হচ্ছে, সেটা সেনাবাহিনীর খুব ভালো পদক্ষেপ। তা ছাড়া সেনাবাহিনী সব সময়ই তাদের কাজের ব্যাপারে অত্যন্ত মনোযোগী। তবে দীর্ঘ প্রায় ১০ মাস ধরে সেনাবাহিনী মাঠে আছে, নিরলসভাবে কাজ করছে, অথচ এটা সেনাবাহিনীর নিয়মিত কাজ নয়। তার পরও সেনাবাহিনী যেভাবে অপরাধ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কাজ করছে, সেটা সত্যি প্রশংসনীয়। এতে করে খুব স্বাভাবিকভাবেই আইনশৃঙ্খলার একটি স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে। সাধারণ মানুষও ভয়হীন পরিবেশ পাবে।’
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকারকর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিচারব্যবস্থা বা আইনের দুর্বলতার কারণে চিহ্নিত সন্ত্রাসী বা দুর্ধর্ষ অপরাধীরাও সহজে জামিন পেয়ে যায়। তারা এই সুবিধা পাওয়ার কারণে বাইরে গিয়ে আবার একই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। এই চিত্র আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দেখে আসছি। তবে ৫ আগস্টের পর সেটি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।’
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আইনজীবীরা যে কারও (আসামি বা বন্দি) বিষয়েই আদালতে আবেদন জানাতে পারেন। কিন্তু জামিন বা মুক্তির বিষয়টি সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার। কিন্তু সেখানেও সবকিছু যথাযথভাবে হচ্ছে না। আদালত অঙ্গনেও মব ভায়োলেন্স হচ্ছে। মব করে বিচারকদের বাধ্য বা প্রভাবিত করা হচ্ছে। এগুলো বন্ধ হওয়া জরুরি।’
সেনাবাহিনী জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ
গত সোমবার সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে সেনা সদরের অপারেশনস পরিদপ্তরের কর্নেল স্টাফ মো. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘ভবিষ্যতের দিনগুলোতে জানমালের ক্ষতিসাধন, মব ভায়োলেন্স ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারে এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নেবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একতাবদ্ধ হয়ে সর্বদা দেশের জনসাধারণের পাশে থেকে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বদ্ধপরিকর।’
এর বাইরেও গত কয়েক দিন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) একাধিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। যেকোনো ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রমের তথ্য নিকটস্থ সেনাক্যাম্প অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করার জন্য সর্বসাধারণকে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।’
সেনা অভিযানে গত এক মাসে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার ১ হাজার ৯৬৯
সেনা সদরের অপারেশনস পরিদপ্তরের কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম গত সোমবারের ব্রিফিংয়ে জানান, গত ৪০ দিনে (সোমবার পর্যন্ত) সেনাবাহিনী ২৪১টি অবৈধ অস্ত্র ও ৭০৯ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে।
অন্যদিকে গত বছরের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত (সোমবার) সর্বমোট ৯৬১টি অবৈধ অস্ত্র ও ২ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬১ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া গত এক মাসে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ১ হাজার ৯৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মোট ১৪ হাজার ২৬৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে কিশোর গ্যাং, তালিকাভুক্ত অপরাধী (সন্ত্রাসী), অপহরণকারী, চোরাচালানকারী, প্রতারক, দালাল চক্র, চাঁদাবাজ, ডাকাত, ছিনতাইকারী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।’