ঢাকা ২৫ আষাঢ় ১৪৩২, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫
English

বংশলতিকা

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ১১:২৯ এএম
বংশলতিকা

তুমি কি আমার নামে বদনাম রটাও প্রত্যহ দিকে দিকে
দেখেছ কি প্রবল বর্ষণ ধারাজল 
কী লিখেছে শিয়রে তোমার গতকাল?
কাঁটাঝোপে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সকালের রোদ
ঘনমেঘ গিলেছে সময় সূর্যালোক- গিলেছে আকাশ;
ভাঙা জানলার কাচে দেখা যায়- ওই দূরে
প্রাগৈতিহাসিক রাজহাঁস উড়ে যায় ছায়াপথ ধরে। 

তুমি কি এখনো হাঁটো ছায়াঘন পল্লবের নিমগ্ন পথে     
চন্দ্রমল্লিকার বনে একা? 
কারা আজ পাতার আড়ালে বসে দলবদ্ধ মিথ্যাচার
বিলি করে অশ্বত্থের শাখায় শাখায়;
দেখোনি কি গতরাতে ধুয়ে গেছে 
তোমার পায়ের কারুকাজ প্রবল বর্ষণে-
তুমি কি এখনো হাঁটো ছায়ার আড়ালে?
বেনোজল পাড় ভাঙে দ্রুত 
দূরে খরস্রোতধারা ভেঙে দেয় হিংসার আকাশ;
ঝুমবৃষ্টিতে ধারাজল 
মানুষের বংশলতিকা লেখে দিবস-রজনী পালাক্রমে।

ষাটের দশকের জাতীয় জাগরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ০২:৩৩ পিএম
আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৫, ০২:৩৬ পিএম
ষাটের দশকের জাতীয় জাগরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জাতীয় আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলন অনেক সময় সবকিছু বুঝেও যেভাবে হওয়া দরকার ছিল সেভাবে হয়নি। ’৬০-এর দশকে মার্শাল ল উৎখাত করার জন্য আন্দোলন হয়েছে। সেই আন্দোলনে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র মারা যাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। আইয়ুব খান তখন ছাত্ররাজনীতি, হরতাল সব বন্ধ করে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন অনেক ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করেন। তখন সব আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নকে একসঙ্গে দেখা গেছে।…

জাতীয়তাবাদ বা জাতিরাষ্ট্র নিয়ে এখনো যারা লেখেন বা কথা বলেন, তারা ভালোভাবে ব্যক্ত করতে পারেন না। অনেকেই জাতীয়তাবাদ শব্দটা শুনতেই পারেন না। পাকিস্তান একটি অস্বাভাবিক রাষ্ট্র।  পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ সফল করার যে চেষ্টা তা কখনো সফল হবে না। আমরা পূর্ব বাংলার বাঙালি, পশ্চিম পাকিস্তানে আলাদা আলাদা ভাষা আছে। কিন্তু সেই ভাষাগুলো অনেক দুর্বল ছিল। তখন থেকেই আমাদের বাংলা ভাষা অনেক উন্নত ছিল। এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চীন, জাপান থেকে শুরু করে ইরাক, ইরান, লিবিয়া ও আরব এলাকার মধ্যে বাংলাভাষা ছিল সবচেয়ে উন্নত। আমি বুঝতে পারি না, কী কারণে রবীন্দ্রনাথ হিন্দি ভাষাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করতে সমর্থন দিলেন। জাতীয় জাগরণে ভাষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাকে মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন করে। এভাবে জাতীয় জাগরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বড় ভূমিকা রাখে। 

ইংরেজরা যেভাবে জাতীয়তাবাদ দেখাতে চেয়েছে, সেখানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও জওহরলাল নেহরু নিজেদের ধারণার বাইরে গিয়ে সেই চেতনা ধারণ করেছিলেন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী সেই ধারার বিরোধিতা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারেননি। তার পর ভারত ও বাংলা বিভক্ত হলো। পাঞ্জাব বিভক্ত হলো এবং ভারত থেকে পাকিস্তান সৃষ্টি হলো। 

সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি ইংরেজরাই প্রথম নিয়ে এল। ভারতবর্ষে অনেক আগে থেকেই হিন্দু-মুসলিম বিরোধ ছিল। সেই বিরোধকে একটি রায়টের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এবং জাতীয়তাবাদের বিষয়টিকে নষ্ট করে দেওয়া ইংরেজরাই করে। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ- এই তিনজনই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর  চেয়ে অনেক জ্ঞানী ছিলেন। তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শন ছিল অনেক প্রখর। সে কারণেই ইংরেজরা অনেক আগেই ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। ইংরেজরা অনেকদিন শাসন করেছে। তাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে তাদের হাতেই, যারা তাদের অনুগত। এভাবে ধীরে ধীরে পাকিস্তান ও ভারত ভাগ হয়ে গেল। বাংলা ভাষা অনেক উন্নত ছিল। সে কারণেই জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। 

জাতীয় জাগরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনেক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যেও এ বিভক্তি ছিল যে, পাকিস্তান নাকি অখণ্ড ভারত। এ বিভক্তির মধ্যে মুসলিম শিক্ষকদের সংখ্যা খুব কম ছিল। ছাত্রদের মধ্যেও মুসলিমদের চেয়ে হিন্দু ছাত্রদের সংখ্যা বেশি ছিল। ওই অবস্থার মধ্যে যারা ছিলেন তারা বেশির ভাগই পাকিস্তান সমর্থন করেছেন। হিন্দু শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই আন্ডারগ্রাউন্ড দল যেমন অনুশীলন, যুগান্তর-এ যোগ দেন। বিখ্যাত শিক্ষক যারা ছিলেন তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক কংগ্রেসে নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। তারাও কমবেশি রাষ্ট্রীয় বিভক্তি স্বীকার করে নেন। মুসলিম শিক্ষক যারা ছিলেন তারা ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে। 

১৯৬০-এর দশকে পৃথিবীব্যাপী যারা পরাধীন জাতি ছিল তারা স্বাধীন হওয়ার জন্য সংগ্রাম করেছে। প্রত্যেক জাতি সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞান যে মানুষের উন্নত জীবন যাপনের অবলম্বন, তা এ দেশের ছাত্র-শিক্ষকরা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তারা আরও বুঝতে পারেন, শুধু নিজেদের রাষ্ট্র নিয়ে পড়ে থাকা আর সম্ভব নয়। এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য অবলম্বন করে জাতিকে রাজনীতি করতে হবে। আগে বেশির ভাগ রাষ্ট্র ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল ও ইতালি অন্য রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের অধীনে পরাধীন করে রাখত এবং তাদের সম্পদ লুটে নিত। এভাবে ইংরেজ সরকার দেখল জাতীয়তাবাদ একটা বিশাল ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। ইংরেজরা তখন ভেবেছিল জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠলে তারা শান্তিমতো বিদায়ও নিতে পারবে না। তখন ইংরেজরা বুদ্ধি করে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস গঠন করল। 

বঙ্গভঙ্গের পর যখন আন্দোলন শুরু হয় তখন মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৬ সালে। বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভেদ একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায়। ন্যাশনালিজম কথাটির পরিবর্তে কমিউনালিজম শব্দের ব্যবহার ইংরেজরাই চালু করে। সেই কমিউনালিজম থেকে এখনো ভারত ও বাংলাদেশ পৃথক হতে পারেনি। ’৬০-এর দশকে জাগরণের বিষয়টা ছিল গণজাগরণ। বেগম রোকেয়া, এস ওয়াজেদ আলী ও কাজী নজরুল ইসলাম- এরা কেউ চাননি পাকিস্তান হোক। অখণ্ড ভারতের মধ্য থেকেই মুসলমানরা কীভাবে শিক্ষাদীক্ষা, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে উন্নতি করতে পারে, সেটাই ছিল মূল লক্ষ্য। হিন্দু ও মুসলমানদের সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য আছে। এ পার্থক্য ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে হবে। সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়নি। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও জওহরলাল নেহরু ইংরেজদের সঙ্গে অনেকবার বৈঠকের মাধ্যমে প্রতিঠিত হয়েছে। বড় লাট মাউন্ট ব্যাটেনের সঙ্গে কখনো কখনো মহাত্মা গান্ধীর কথা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ইউনিয়ন ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যাক্ট পাকিস্তানের মাধ্যমে তিনজনের স্বাক্ষরে পাকিস্তান সষ্টি হয়। 

পাকিস্তান সৃষ্টির পর ‘তমুদ্দিন মজলিস’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম লীগের রাজনীতিকে তুমুলভাবে সমালোচনা করেছে ‘তমুদ্দিন মজলিস’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাশেম তমুদ্দিন মজলিসের প্রধান ছিলেন। 
আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সবসময় ভিন্ন ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদের চেতনা নিয়ে সবসময় সম্মুখভাগে এগিয়ে এসেছে। গণতন্ত্রের কথা সব সময় এগিয়ে নিয়ে এসেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। গণতান্ত্রিক রাজনীতি কেমন হবে এসব বিষয় নিয়ে কেউ লেখননি। এস ওয়াজেদ আলীর লেখা ‘ভবিষ্যতের বাঙালী’ বইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক শিক্ষা ও জ্ঞানের খুব অভাব ছিল রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে। এখনো আমাদের দেশে রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে। যদিও ঐক্যের চিন্তা করছে। রাজনীতি কী? গণতন্ত্র কী নয়? এ ধরনের মৌলিক প্রশ্ন কোনো রাজনৈতিক নেতার মধ্যে এখন নেই। 

পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক এ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এতে দেশে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। মুসলমানদের মধ্য থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার মতো খুব কম লোকই ছিল। যারা একটু যোগ্য ছিলেন তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতার কারণে যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে তা মেনে নিয়েই পাকিস্তানকে কীভাবে গঠন করা যায়, সে লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছাত্রলীগ ছিল। 

ছাত্রলীগকে ভর করেই পরে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। আইযুব খান অনেক দূরদর্শী নেতা ছিলেন। তিনি দেশের রাজনীতি বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি সবসময় পাকিস্তান রক্ষা ও পাকিস্তানভিত্তিক সংস্কৃতি রক্ষা করতে চেয়েছেন। আমাদের পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদ এবং পশ্চিম বাংলার সংস্কৃতির মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। আমাদের জাতীয়তাবাদ রক্ষার্থে সব সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সোচ্চার ছিল। ছাত্ররা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। 

’৬০-এর দশকে আমাদের জাতীয় চেতনা প্রবল আকারে দেখা যায় শেখ মুজিবের মাধ্যমে। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ছয় দফা ঘোষণা করেন। ছয় দফার মাধ্যমেই শেখ মুজিব অনেক জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হন। তবে তিনি সবসময় হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীকে অনুসরণ করতেন। হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী মারা যাওয়ার পর শেখ মুজিব মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। কিছুদিন পরই তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। শেখ মুজিবের নানা গুণ ছিল। আবার নানা সীমাবদ্ধতাও ছিল। ভাসানী-মুজিবের রাজনীতি দেশকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর কারণে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে।    
  
জাতীয় আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলন অনেক সময় সবকিছু বুঝেও যেভাবে হওয়া দরকার ছিল সেভাবে হয়নি। ’৬০-এর দশকে মার্শাল ল উৎখাত করার জন্য আন্দোলন হয়েছে। সেই আন্দোলনে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র মারা যাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। আইয়ুব খান তখন ছাত্ররাজনীতি, হরতাল সব বন্ধ করে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন অনেক ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করেন। তখন সব আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নকে একসঙ্গে দেখা গেছে। 

লেখক: বাংলা একাডেমির সভাপতি ও রাষ্ট্রচিন্তক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিকি শতাব্দীর কথা

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ০২:১২ পিএম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিকি শতাব্দীর কথা
প্রচ্ছদ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমের শুরুতে হিন্দু শিক্ষকের সংখ্যাধিক্য থাকলেও তারা স্বীয় সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন না। ছিলেন শিক্ষক ও মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের অব্যাহত প্রবাহের সম্ভব হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ শ্রেণি চরিত্রের জন্য। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃসমাজেও প্রসারিত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুশীলনের দৃষ্টি ছিল ইহজাগতিক এবং অঙ্গীকার ছিল ধর্মকে ব্যক্তিগত আচার ও বিশ্বাসের ব্যাপার হিসেবে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় পরিচয় গ্রহণ থেকে বিরত রাখা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কৌলিন্যবোধ বড় প্রভাবক ছিল।...

শতকের পথ পরিক্রমণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে এ বিদ্যাপীঠ জাতীয় জীবনের প্রায় সব ঘটনাপ্রবাহের অংশীজন হতে পেরেছে। শুধু একটি বিদ্যাপীঠ নয়, জাতির গতি-প্রকৃতির যেন আঁতুড়ঘর এ প্রতিষ্ঠান। অনেকেই বিশ্বাস করতে চান ‘Dhaka University is a state With in the state’। এই বিশ্বাস নিয়ে অনেকের মধ্যে তৃপ্তির ঢেকুর থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক অবস্থান এখনো কাম্যমানের নয়। তবে যাত্রাপথের প্রথম সিকি শতাব্দীর অর্জন এখনো আমাদের স্বস্তির বার্তা দেয়।  

বঙ্গভঙ্গ রদপর্বে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ক্ষতি কিছুটা নিবারণ করতে ব্রিটিশরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে লর্ড লিটনের ভাষায় ‘বাংলা ভাগ রদের এক উজ্জ্বল রাজকীয় ক্ষতিপূরণ’ মনে করেন। লর্ড হার্ডিঞ্জের ভাষায়- রাজকীয় ছাড় হিসেবে উল্লেখ করেন। ঢাকার নবাব স্যার সলিমূল্লাহ ও ধনবাড়ীর নবাব ও বাংলার শিক্ষামন্ত্রী নওয়াব আলী চৌধুরীর নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের নেতা শেরেবাংলা ফজলুল হকের যৌথ প্রয়াসে নানা দ্যুতিয়ালির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আলোর পথ দেখে ১৯২১ সালের পয়লা জুলাই। 

পূর্ববঙ্গের নাগরিক সমাজের জাগরণের ফলে ব্রিটিশ সরকারের দীর্ঘমেয়াদি বোঝাপড়ার ফসল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শুরুতে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সৌহার্দ্য রক্ষা করে একটি অসাম্প্রদায়িক চালচিত্রে চলার পথ মসৃণ না হলেও অনেকাংশে সফল হয়েছিল প্রথম পর্যায়ের প্রশাসন। অক্সফোর্ডের আদলে হলগুলোকে কলেজের মতো ইউনিট বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিকতার ছাপ নিয়েই যাত্রা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্ট, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে উপমহাদেশের জ্ঞানী-গুণীদের সন্নিবেশ ঘটিয়ে একটি সুদূরপ্রসারী ও বড় পটভূমি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রেরণাদায়ী। এ জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো ‘অক্সফোর্ড অব দ্য ইস্ট’।

মুক্তবুদ্ধির চর্চা, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, পূর্ববাংলার উচ্চশিক্ষার প্যারাডাইমকে পালটে দিয়েছিল এ প্রতিষ্ঠান। পুরাতন পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ, বির্তক প্রতিযোগিতা, তাৎপর্যপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশ, মৌলিক গবেষণাকর্ম, ছাত্র সংসদ, সাহিত্য কর্মকাণ্ড- সবমিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় একটি গতিময় প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। রবীন্দ্র-নজরুল-শরৎ-সুভাষ বসু প্রমুখ বরেণ্যজনের আগমনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পায় সঞ্জিবনী শক্তি। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকলগ্নের আত্মসমীক্ষা করা হয় তবে অবলোকন করা যায়, বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতা বা একাডেমিক ফ্রিডম অনেকটাই ছিল। অর্থাৎ শিক্ষা দেওয়ার স্বাধীনতা ও জ্ঞানার্জনের স্বাধীনতা। 

যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অঙ্কুরলগ্নে বিরোধিতা তেতিয়ে ওঠে পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গের হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে। এ বিরোধিতা মূলত স্বার্থহানির বিরোধিতা। কারণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যে কৌলিন্য তৈরি হয়েছিল তা ক্ষতি হবে। পূর্ববঙ্গের মুসলিম শ্রেণির শিক্ষার অগ্রসর হলে হিন্দুদের প্রভাব কমে যাবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় কমে যাবে, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবও কমে যাবে। বলে রাখা প্রয়োজন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ছাত্রদের প্রবেশাধিকারের সুযোগ সীমিত ছিল। এ বিরোধিতার মূল কুশীলব ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। পূর্ববঙ্গের এলিট হিন্দু সমাজ কিছু ব্যতিক্রম বাদে নিজেদের শ্রেণি কৌলিন্য অটুট রাখতে অবধারিতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপরীত প্রান্তে দাঁড়ায়। 

যে নাথান কমিটির সুপারিশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিকাঠামো তৈরি হয়েছিল তা ছিল সুষম।

নাথান কমিটি ২৬টি অধ্যায়বিশিষ্ট একটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করে। এই ২৫টি অধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক বিষয় এবং ২৬তম অধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আর্থিক বিষয়-সংক্রান্ত। 

উল্লেখ্য, নাথান কমিশন ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯১৭ সালের ৬ জানুয়ারি ভারত সরকার উচ্চশিক্ষা বিস্তারে মাইকেল স্যাডলারের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করে বিদ্যালয়ের কর্মসূচি নির্ধারণের জন্য। স্যাডলার কমিশন নামে খ্যাত এ কমিশনের রিপোর্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। রিপোর্টে বলা হয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা ধারণক্ষমতার অধিক, তাই ঢাকায় একটি শিক্ষাঙ্গন ও আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এ বিশ্ববিদ্যালয় হবে স্বায়ত্তশাসিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বৈশিষ্ট্য হবে শিক্ষণ ও আবাসিকধর্মী।

উপমহাদেশের উচ্চশিক্ষা বিষয়ে এক অবিস্মরণীয় দলিল হলো স্যাডলার কমিশনের বিশাল রিপোর্টটি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ববর্তী ৬০ বছরের কার্যক্রম, দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা ও অর্জন পর্যালোচনা করে স্যাডলার কমিশন বাংলার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকে মূলগতবাবে ত্রুটিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছিল। কারণ, ওই শিক্ষা এমন একটি উচ্চশিক্ষিত শ্রেণি তৈরি করেছে, যারা পশ্চিমের শিল্প-সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করলেও, তারা সমাজ ও জীবনবিচ্ছিন্ন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিমার্জন-পূর্বক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকৌশলের যোজনা হয়েছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠিত কাঠামো নির্ধিারিত হলে প্রথমে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ (কার্যকাল: ১৯২০-১৯২৫) তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পান আইসিএস অফিসার জে এইচ লিন্ডসে এবং রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য ও বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের সদস্য খান বাহাদুর নাজির উদ্দিনকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন এইচ ই স্টেপলটন ও স্থপতি ছিলেন গ্যারেথ।  

১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে তিনটি অনুষদ (কলা, বিজ্ঞান, আইন), তিনটি হল, (মুসলিম হল, ঢাকা হল, জগন্নাথ হল) ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক ও ৮৭৭ জন ছাত্র সহযোগে পাতশাহী (বর্তমান শাহবাগ) ও রমণীয় রমণায় কমবেশি ৬০০ একর জমি বঙ্গবঙ্গের রদের ফলে এ অঞ্চলে অবস্থিত পরিত্যক্ত ভবন ও অট্টালিকা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা।

ভাইস চ্যান্সেলর ফিলিপ হার্টগ খুব দূরদর্শী ছিলেন। ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক ঢাকা শহরের মতো একটা মফস্বল শহরে নিয়ে আসতে হলে বেতন বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া দরকার। হার্টগ সেই পথেই অগ্রসর হন। প্রারাম্ভে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেশি ছিল। এর ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকজন শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যোগদান করেন। এর ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ বাড়তে থাকে। সূচনাপর্বে যুক্ত হয়েছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বোস, জ্ঞান ঘোষ, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, নরেশচন্দ্র সেন গুপ্ত, হরিদাস ভট্টাচার্য প্রমুখ। আরও এসেছিলেন মোহিতলাল মজুমদার ও চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছিল না। কিন্তু তারা ছিলেন উচ্চমানের শিক্ষক ও গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমের শুরুতে হিন্দু শিক্ষকের সংখ্যাধিক্য থাকলেও তারা স্বীয় সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন না। ছিলেন শিক্ষক ও মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের অব্যাহত প্রবাহের সম্ভব হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ শ্রেণি চরিত্রের জন্য। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃসমাজেও প্রসারিত হয়েছিল। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুশীলনের দৃষ্টি ছিল ইহজাগতিক এবং অঙ্গীকার ছিল ধর্মকে ব্যক্তিগত আচার ও বিশ্বাসের ব্যাপার হিসেবে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় পরিচয় গ্রহণ থেকে বিরত রাখা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কৌলিন্যবোধ বড় প্রভাবক ছিল।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় বিশ্বের খ্যাতনামা শিক্ষকদের ইনভাইট করে আনা হতো। এ কার্যক্রমে পরবর্তীতে যুক্ত হন অধ্যাপক নিউম্যান, ত্র্যামি জেরালিন্ড স্টকের মতো বিদেশি শিক্ষক। বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য পরর্বতীতে নির্মিত হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল হল। 

সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল-পূর্ববঙ্গের মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের একটি স্বশাসিত আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমাবে বলে কর্তৃপক্ষ মান্য করতেন। 

শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম একযুগ এ আন্দোলন জোরালো ছিল। ১৯২৬ সালের শুরু হওয়া ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এবং ১৯৩৯ সালে ঢাকা শহরে সৃজিত ‘প্রগতি লেখক আন্দোলন’ এই পর্বে মাইলফলক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক এ আন্দোলনের প্রাণসঞ্জিবনী।   

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ববাংলার উচ্চশিক্ষার প্যারাডাইমকে পালটে দিয়েছিল। এর আগে মধ্যযুগে এখানকার মুসলিম সুলতান এবং সুবেদাররা এ এলাকার মুসলিমদের উচ্চশিক্ষার জন্য কয়েকটি বড় মাদ্রাসা বা জামিয়া স্থাপন করেছিলেন। যেমন গৌড়, লখনৌতি, দারসবাড়ি, বাঘা, সোনারগাঁও ইত্যাদি উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যবঙ্গে স্থাপিত বড় মাদ্রাসাসমূহ। এসব মাদ্রাসায় তখনকার দারসে নিজামি কারিকুলাম ও সিলেবাসসহ ইউনানি চিকিৎসাবিদ্যাও পড়ানো হতো। তবে একথা ঠিক যে, এ মাদ্রাসাশিক্ষা ও জ্ঞানতত্ত্বে কোরআন ও সুন্নাহর একটা কেন্দ্রীয় ভূমিকা থাকত। ফলে এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি ইসলামিকতার প্যারাডাইমে গড়ে উঠেছিল। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের সমাজে পশ্চিম আধুনিক লিবারেল হিউম্যানিস্ট প্যারাডাইমেই সংযুক্ততা তৈরি হয়।  

রাজা কালী নারায়ণ বৃত্তি মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বীকৃতির একটি মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে গোড়ার ও প্রাথমিক বিকাশপর্বে। দেশের প্রথম উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সৌরভ ছড়িয়েছে চারদিকে। 

তৎসময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স কোর্স দুই বছর মেয়াদের হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাগ্রসর চিন্তা নিয়ে অনার্স কোর্স চালু করে তিন বছর মেয়াদি। এ বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কর্যক্রমের ইতিবাচক দিক। 

বলে রাখা প্রয়োজন, ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল কিন্তু ১৯০৪ অব্দি সেখানে স্নাতকোত্তর পড়ানো হতো না। তখন এমএ পড়ানো হতো কলেজে কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রথম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পড়ানোর রীতি চালু করলেন। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রাকাল থেকেই স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ানো হয়। 

প্রথমপর্বে পাঠদানের জন্য লেকচার থিয়েটার, ক্লাসরুম, গ্রন্থাগার, গবেষণাগার, পরীক্ষার হল এবং মিউজিয়াম সুপারিশ করা হয়। অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীর পাঠদানের জন্য লেকচার থিয়েটার এবং সীমিতসংখ্যক শিক্ষাার্থীর জন্য লেকচার এবং টিউটোরিয়াল কক্ষ ব্যবহার করা হতো। স্নাতক (জুনিয়র) পর্যায়ে কলেজসমূহ পাঠদান করবে। স্নাতক (সিনিয়র) পর্যায়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা পাঠদান করবেন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন ধরনের গ্রন্থাগারের প্রস্তাব দেওয়া হয়- (১) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, (২) সেমিনার গ্রন্থাগার ও (৩) কলেজসমূহে কলেজ গ্রন্থাগার।    
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক পর্বের শিক্ষা কার্যক্রমে প্রথম ভর্তির পর কিছুকালের মধ্যে ছাত্রদের একটি ‘ইংলিশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতো।  

উপাচার্য হার্টগের কর্মের প্রতিফলন ঘটে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের প্রথম দিকেই। উপাচার্য নিয়ম চালু করেন অনার্স ও এমএ পরীক্ষায় প্রত্যেক পেপার দুজন পরীক্ষক দেখবেন। উত্তরপত্রে কোনো নম্বর দেওয়া হতো না। পরীক্ষকের উত্তরপত্রে আলাদা কাগজে নম্বর লিখে বিভাগের প্রধানের কাছে পাঠাতে হতো। পরীক্ষাপদ্ধতি আধুনিকায়ন হলেও মূল কাঠামো পরীক্ষার এখনো অনেকটা এমনি রয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ও কৌলিন্যের বিষয়ে ছাত্ররা প্রথম থেকে সজাগ ছিলেন। ১৯২৬-১৯২৭ লর্ড লিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সভাপতি হওয়ার কথা ছিল। ঢাকা হলের ছাত্ররা লর্ড লিটনের হাত থেকে ডিপ্লোমা গ্রহণ করতে সম্মত হলো না, কারণ কিছুদিন আগে লাট সাহেব বার্ষিক পুলিশ কনফারেন্সে ভারতীয় নারীদের সম্মন্ধে অসৌজন্যসূচক মন্তব্য করেছিলেন। এর বিরুদ্ধে খবরের কাগজে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল। ঢাকা হলের ছাত্ররা তাদের সংকল্পে অটল থাকল, সমাবর্তন অনুষ্ঠান বয়কট করল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী নীলা নাগ ১৯২৩ সালে ইংরেজিতে এমএ পাস করেছিলেন। এমএ পাস করার পর তিনি শুরু করেছেন প্রদীপ জ্বালাবার কাজ। লীলা নাগ ‘শ্রীসংঘে’ যোগদান করে সাময়িকভাবে বিপ্লবী জীবনের সঙ্গে পরিচিত হন। এ সময়ে লীলা নাগ গড়ে তোলেন বাংলার প্রথম ছাত্রী সংগঠন, যা ‘দীপালি সংঘ’ নামে পরিচিত। এ সংঘ নারীশিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালায়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রী ‘দীপালি সংঘে’র সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে সুষমা সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৮৭), রেনুকা সেনগুপ্ত (১৯০৯-১৯৪১), লতিকা দাশ (১৯১১-১৯৪৯) ফজিলাতুন্নেছা (১৮৯৯-১৯৭৭) উল্লেখযোগ্য। লীলা নাগ জয়শ্রী নামে যে মাসিক পত্রিকা বের করেন তা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদধন্য হয়েছিল। 

বলাবাহুল্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনালগ্নের কুশীলবগণ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বজনীন জ্ঞানভাণ্ডার রূপে দেশের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে যেন বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে জ্ঞানসৃষ্টি ও প্রবাহবিস্তার করতে পারে, সে লক্ষ্যেই কাঠামো বিন্যাস ও কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল। 

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ১৯২০ সালের ১১-১২ মার্চ ‘ঢাকা সোশ্যাল সার্ভিস এক্সিবিউশন নর্থব্রুক হলে অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত ও কী রকম টিচিং অ্যান্ড রেসিডেন্সিয়াল’ বিশ্ববিদ্যালয় হতে যাচ্ছে তার একটি রূপরেখা। প্রধান আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিশেষ অফিসার এইচ ই স্টেপলটন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো সম্পর্কে বলেন, শিক্ষাদানে লেকচার ও সেমিনার কাজের জন্য থাকবেন অতি উঁচুমাপের সীমিত সংখ্যক প্রফেসর। শিক্ষদের ব্যক্তিত্বের ওপর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে। তাছাড়া থাকবেন রিডার, যারা হবেন ‘টিচার্স অব নোট’ এবং তাদের মূল্যবান গবেষণা থাকবেই। যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলে একপর্যায়ে তারা প্রফেসরশিপ পাবেন। আরও থাকবেন সুযোগ্য লেকচারার, সহকারী লেকচারার ও ডেমোনেস্ট্রেটর। ক্যাম্পাস অক্সফোর্ডের নিয়মকানুন অনুসারে চলবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শিক্ষাদানভিত্তিক নাকি গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে এ বিষয়ে দোলাচল থাকলেও দুইয়ের মিশেলে চলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিকি শতাব্দীর কার্যক্রম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রারম্ভিক শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন ইংরেজ অধ্যাপক জর্জ হ্যারি ল্যাংলি, পরবর্তীতে উপাচার্য ‘মিস্টার জোকিন্স, মিস্টার টমার, এ জি স্টক প্রমুখ একাডেমিক কাজে পারিদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রি পর্যায়ের ছাত্রদের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত করা হয়। দুটি কলেজের বেশ কিছু বই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে যুক্ত হয়। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের দুর্লভ সম্ভার নিয়ে আমাদের যে গৌরব তা সৃজিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পর্বে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রারম্ভে চড়াই-উতড়াই পেরোতে হয়েছে। কারণ সমাজে তখন ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে সমাজের ক্রিয়াশীল শ্রেণি নানামাত্রিক চাপ প্রয়োগ করে সামাজিক সংহতি বিনষ্ট করতে তৎপর হয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা তৎসময়ের বাস্তবতায় সত্যই দুরূহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন বিদ্যায়তন হিসেবে গড়তে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির নৈতিক সমর্থনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, রেজিস্ট্রার, ডিন, প্রভোস্টসহ এক্সিকিউটিভ কোর্টের অধিকাংশ সদস্যের ইতিবাচক দৃষ্টি ছিল। সর্বপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলীর অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ধর্মীয় ধোঁয়া তুলে আতর বা ধূপের গন্ধ মাখতে দেননি। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার জ্ঞান অন্বেষ চরিত্রের প্রকাশ ঘটায় প্রথম দশকেই। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয় রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রণীত ‘দ্য আর্লি হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’।

রমেশচন্দ্র বাংলার ইতিহাস লেখার কর্মে মনোনিবেশ করেন। এ ইতিহাস রচনার যে কমিটি গঠিত হয় সেই কমিটির সভাপতিও ছিলেন স্বয়ং রমেশচন্দ্র। এ ইতিহাস লেখার কর্মের জন্য আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এক হাজার টাকা এবং বাংলা সরকার এক হাজার টাকা চাঁদা দেন, আর এভাবেই আরম্ভ হয় বাংলার ইতিহাস লেখার কর্ম। ১৯৪৩ সালে বাংলার ইতিহাসের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। প্রকাশ হওয়ার পরপরই গ্রন্থটি খুব সমাদৃত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূচনাপর্বে প্রকাশিত হয় নিয়মিতভাবে ‘ঢাকা ইউনির্ভাসিটি বুলেটিন’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতামালার আয়োজন করে ১৯৩০-১৯৩১ শিক্ষাবর্ষে। 

প্রথমার্ধে ব্রিটিশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনকে অনুমোদন দেয়নি। এমনকি ছাত্ররা ‘কোনো আন্দোলনে যোগদান করবে না’ এই মর্মে মুচলেকা পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। অনিল রায়ের বিপ্লবী ‘শ্রীসংঘ’, ‘অনুশীলন সমিতি’, ‘যুগান্তর পার্টি’ ও ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ ইত্যাদি বিভিন্ন বৈপ্লবিক দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা গোপনে যোগদান করত। গত শতাব্দীর মধ্য দশকে পূর্ববঙ্গ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনীতির এক কেন্দ্র হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ভারত ও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মতো ঢাকায় ছাত্র ফেডারশনের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ঢাকা জেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এ সংগঠনে নেতৃত্ব দেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী বেশ কিছু দিকদিশারি কর্ম ছিল। যা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিধিবদ্ধ দায়বদ্ধতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯২৫ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম পিএইচডি অর্জন করেন বিনয় ঘোষ। ১৯২৫ সাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় এবং ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এ প্রচেষ্টা থাকে অব্যাহত। এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদগ্ধ পণ্ডিতরা এ সুমহান কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং এ সময়কালের মধ্যে বহুসংখ্যক পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। যদিও এসব দুষ্পাপ্য পাণ্ডুলিপি, পুথি এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে অনাদরে পড়ে আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানমনস্ক চরিত্রের পরিচয় প্রথম দিকেই বিকশিত হয়। এ প্রসঙ্গে ড. অমলেন্দু বসু ১৯২৬-৩০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র এবং পরে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেন, 
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক সপ্তাহ পড়ার পরেই বুঝতে পারলাম, এই বিশ্ববিদ্যালয় নেহাত গ্রাজুয়েট তৈরির কারখানা নয়, ...ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা নিরন্তর অগ্রসরমান। এখানে ব্যক্তিত্বের সংযত বিকাশের অমূল্য সংযোগ, এখানে জ্ঞানপথিক যুবজনচিত্ত ক্রমেই এগিয়ে যায়।’

ঢাকার মুসলিমরা খুব একটা অবস্থাপন্ন না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জায়গির হিসেবে রাখতেন। এ যেন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি মমত্ববোধ। এমনকি উপাচার্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনও জায়গির থেকে পড়েছেন। ঢাকার গরিবরাই জায়গির রাখত। কিন্তু তারা ছাত্র-মাস্টারসাবদের খুব ইজ্জত করত, খুব খাতির দেখাত। 

আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক আশার রাহাবার। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের কলানৈপুণ্যে অংশীজনদের অতৃপ্তি থেকেই যাচ্ছে। তাই বারবার ইতিহাসের খেরোখাতা উল্টিয়ে দেখতে হচ্ছে যাত্রাপথের প্রথম দিকের অর্জনকে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ০১:২৮ পিএম
ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার

খ্যাতনামা সাহিত্য সমালোচক ও গ্রন্থাগারিক লরেন্স ক্লার্ক পাওয়েল (১৯০৬-২০০১) মন্তব্য করেছিলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব ছাড়া মহত্ত্বের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। এটি যখন আর ঘটবে না তখন আমাদের সভ্যতারও অবসান ঘটবে।’ বাস্তবিকই, জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতা-ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভর করে এর গ্রন্থাগারটি কতটা সমৃদ্ধ ও সক্রিয় তার ওপর। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার বৃহত্তম ও প্রাচীনতম কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারটি সংগ্রহের বিবেচনায় দেশের বৃহত্তম। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা যেদিন শুরু হয়, গ্রন্থাগারের দ্বারোদ্ঘাটনও ঘটে সেদিনই। সময়ের পরিক্রমায় এটি কেবল দেশের সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগারই নয়, নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনশীল সেবার সমন্বয়ে এ দেশে গ্রন্থাগার আন্দোলন ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ যোগাযোগের (scholarly communication) ক্ষেত্রে অগ্রপথিক হিসেবেও কাজ করছে। গত এক শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে গ্রন্থাগার পরিসরে ঘটেছে নানা পালাবদল। গ্রন্থাগারের কাজ কী হওয়া উচিত সে ভাবনাতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। এ পালাবদলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে পাঠকের দ্রুত পরিবর্তমান তথ্যচাহিদা পূরণ করা একটি দুরূহ কাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার তার সব সীমাবদ্ধতার মধ্যেই নতুন কর্মকৌশল ও প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সেবাদানের নবতর পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে এসব পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে চলেছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার: উন্মেষপর্ব ও ক্রমবিকাশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বর্তমান ভবনের একটি অংশে। পরে এটি কার্জন হল এলাকায় স্থানান্তরিত হয়। দেশভাগের পর গ্রন্থাগারের সংগ্রহ ও ব্যবহারকারী দুটোরই ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে গ্রন্থাগারটিকে নতুন একটি স্থানে স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এ দেশের স্থাপত্যবিদ্যার পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাজহারুল ইসলামের নকশায় গ্রন্থাগারের নতুন ভবনের কাজ শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র ও কেন্দ্রীয় মসজিদের মধ্যবর্তী স্থানে। নবনির্মিত ভবনটির দ্বার উন্মোচন করা হয় ১৯৬৪-এর ১৫ ডিসেম্বর। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার তিনটি পৃথক ভবনে বিন্যস্ত: প্রশাসনিক ভবন, মূল গ্রন্থাগার ভবন ও বিজ্ঞান গ্রন্থাগার ভবন। সায়েন্স এনেক্স এলাকায় অবস্থিত বিজ্ঞান গ্রন্থাগার ভবনের যাত্রা শুরু ১৯৮২-এর মার্চে। প্রশাসনিক ভবনের মোট আয়তন ২৯, ৭২৪ বর্গফুট, মূল গ্রন্থাগার ভবন ৭১,১০৬ বর্গফুট আর বিজ্ঞান গ্রন্থাগার ভবন ৪০,০০০ বর্গফুট। মূল গ্রন্থাগার ভবনে এককালীন মোট ৭৪০ জন ও বিজ্ঞান গ্রন্থাগার ভবনে ৪২০ জনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে।

১৯২১ সালে ১৮,০০০ পুস্তক নিয়ে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, যার অধিকাংশই ঢাকা কলেজ ও ভূতপূর্ব ঢাকা ল কলেজ-এর সংগ্রহ থেকে প্রাপ্ত। শুরু থেকেই গ্রন্থাগারে বিভিন্ন বিষয়ে একটি সুষম সংগ্রহ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরই গড়ে তোলা হয় বাংলা ও সংস্কৃত পাণ্ডুলিপির সমৃদ্ধ একটি সংগ্রহ। এ উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠিত হয় যাতে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন খ্যাতনামা প্রত্নতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবেত্তা, মুদ্রাবিজ্ঞানী, লিপিবিশারদ, প্রাচীন হস্তলিপিবিশারদ ও পুঁথি সংগ্রাহক এবং ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর ডক্টর নলিনীকান্ত ভট্টশালী। বস্তুত, তার উদ্যোগেই গ্রন্থাগারে বাংলা ও সংস্কৃত বিষয়ে একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহ গড়ে ওঠে। এ সংগ্রহ তত্ত্বাবধানের জন্য ১৯২৫ সালে একজন কর্মীও নিয়োগ করা হয়। পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের বিস্তারিত সূচি তৈরি হয় এবং অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বাইরে থেকে অনেক গবেষক এ সংগ্রহের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯২৬ সালে কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটিতে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বাবু মথুরামোহন মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের পাণ্ডুলিপি শাখা তত্ত্বাবধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। শুরুর দিকে গ্রন্থাগার কর্মীর অপর্যাপ্ততা গ্রন্থাগারের একটি বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয় যেজন্য গ্রন্থাগার কর্মীদের ছুটির দিনেও কাজ করতে হতো। তবে কর্মীস্বল্পতা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের সেবাদানে গ্রন্থাগার কর্মীরা ছিলেন আন্তরিক। আগ্রহোদ্দীপক একটি তথ্য হচ্ছে, গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর কেবল দরিদ্র শিক্ষার্থীদের গ্রন্থাগার সেবাদানের জন্য একটি বিভাগ খোলা হয়েছিল যেটি অবশ্য পরে আর ক্রিয়াশীল থাকেনি। 

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই উপহার হিসেবে প্রাপ্ত সামগ্রী গ্রন্থাগার সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করেছে, গ্রন্থাগারের সূচনালগ্নে অপর্যাপ্ত তহবিলের কারণে সৃষ্ট সীমাবদ্ধতাকে যা কিছুটা হলেও প্রশমিত করেছিল। যেসব সমাজহিতৈষী ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি এ গ্রন্থাগারে বই উপহার দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ময়মনসিংহের কৃষ্ণদাস আচার্য চৌধূরী, পণ্ডিত যশোদাকান্ত চক্রবর্তী, খান বাহাদুর কাজিমুদ্দিন সিদ্দিকী, স্যার যদুনাথ সরকার, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী ও পরবর্তীকালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত ড. প্রসন্ন কুমার রায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহের একাংশও এ গ্রন্থাগারে দান করা হয় ১৯৩৩ সালে। আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা ও বিদেশি সরকারের কাছ থেকেও বই ও অন্যান্য সামগ্রী অনুদান হিসেবে গ্রহণ করা হয়। লন্ডনস্থ ইন্ডিয়া অফিস, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি ব্যুরো অব ব্রিটিশ এম্পায়ারসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রন্থাগারে পুস্তক ও অন্যান্য সামগ্রী অনুদান হিসেবে প্রদান করে। ১৯৬০-এর দশকের সূচনালগ্নেই প্রায় ২০ হাজার পাণ্ডুলিপিসমৃদ্ধ এ গ্রন্থাগারের সংগ্রহটি দেশের সর্ববৃহৎ পাণ্ডুলিপি সংগ্রহে পরিণত হয় যার ৯০ শতাংশই ছিল আরবি, উর্দু ও ফার্সি পাণ্ডুলিপি। ১৯৫৭ সালে গ্রন্থাগার থেকে একটি বুলেটিন প্রকাশিত হতে থাকে। এ ছাড়া সাউথইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গাইনাইজেশন (SEATO) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে গ্রন্থাগারে রক্ষিত আরবি, উর্দু ও অন্যান্য বিদেশি ভাষার পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের একটি বর্ণনামূলক সূচিও প্রকাশিত হয়। ১৯৫০-এর দশকে গ্রন্থাগার সংগ্রহের পরিমাণ এক লাখের কোঠা পার হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে গ্রন্থাগারের সংগ্রহে ছিল ২ লাখ ৩০ হাজার পুস্তক ও গ্রন্থাগার সামগ্রী। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের পরবর্তী সময়ে গ্রন্থাগারের আধুনিকায়ন ও সংগ্রহের বৈচিত্র্য ও ব্যাপকতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে এটি দেশের বৃহত্তম ও সমৃদ্ধতম গ্রন্থাগার হিসেবে সুদৃঢ় একটি অবস্থানে পৌঁছে যায়।

গ্রন্থাগার সংগ্রহের সম্প্রসারণ ও ক্রমবৈচিত্র্য

সংগ্রহের ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য উভয় বিচারেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার অনন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৭ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী, প্রায় ২ হাজার শিক্ষক এবং গবেষকদের নানামুখী প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করা হচ্ছে মুদ্রিত ও ইলেকট্রনিক উভয় ধরনের পাঠসামগ্রী। পাঠকচাহিদার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা এ সংগ্রহ বিষয় বৈচিত্র্যে ও আঙ্গিকের বহুমাত্রিকতায় কেবল বাংলাদেশ নয়, এতদঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার সংগ্রহগুলোর একটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে আছে দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ দুষ্প্রাপ্য সামগ্রীর সংগ্রহ, যার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এর মধ্যে এমন অনেক পুস্তক ও সাময়িকী আছে যেগুলো দুই থেকে আড়াই শ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরুর দিন থেকে এখন পর্যন্ত গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। সতেরো শতকে প্রকাশিত পুস্তকও বিশেষ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে গ্রন্থাগারে। দুষ্প্রাপ্য এসব গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে Robert Loveday কর্তৃক ফরাসি থেকে ইংরেজিত অনুদিত ÔCleopetraÕ (১৬৮৭), Warren Hastings-এর লেখা A Narrative of the Late Transactions at Benares (১৭৮২), Dacca Muslins and Cotton-Silk Manufacturers at Glasgow and Paisley (১৭৯৩) Buchanan’s Journey through Chittagong and Tiperah (১৭৯৮), James Boarden-এর লেখা Memoirs of the life of John Philip Kemble (১৮২৫) ইত্যাদি। গ্রন্থাগারের সমৃদ্ধ পাণ্ডুলিপি সংগ্রহটি এ দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অনন্য স্মারক। গ্রন্থাগারে মোট সংগৃহীত পাণ্ডুলিপির সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে ১৪৩৯ সালে গাছের বাকলে লেখা ‘সারদাতিলক’, ১৭০০ সালে মুদ্রিত ও স্বর্ণ দ্বারা অলঙ্কৃত ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ’, শাহ মুহাম্মদ সগীর রচিত কাব্য ইউসুফ-জুলেখা (পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতের সময়কাল ১৭৩২), ১৭ ও ১৮ শতকের বেশ কিছু চুক্তিপত্র, কলাপাতায় লেখা চিঠিপত্র ইত্যাদি। সর্বশেষ হিসাবে গ্রন্থাগারটিতে মোট ৭ লাখ বই ও বাউন্ড ভলিউম এবং ৫ হাজার মাইক্রোফিল্ম রয়েছে। বিশেষ সংগ্রহের মধ্যে আছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংগ্রহ, জাতিসংঘ বিষয়ক সংগ্রহ, আমেরিকান স্টাডিজ কর্নার, কোরিয়া কর্নার ইত্যাদি। 

গ্রন্থাগার প্রশাসন ও কর্মী

প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে কোনো পেশাদার গ্রন্থাগারিক ছিলেন না। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফ্রান্সিস চার্লস টার্নার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের প্রধান গ্রন্থাগারিক, যিনি একই সঙ্গে শহীদুল্লাহ হল (তৎকালীন লিটন হল, পরে ঢাকা হল)-এর প্রাধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্বপালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক পদে যোগদানের আগেই আধুনিক গ্রন্থাগারিকতা সম্বন্ধে হাতে-কলমে জ্ঞানার্জনের জন্য অধ্যাপক টার্নারকে যুক্তরাজ্যে প্রেরণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক হিসেবে তার মেয়াদকাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। ১৯২২ সালে তার স্থলাভিষিক্ত হন ফখরুদ্দিন আহমেদ। বিভিন্ন সময় অনেক খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ গ্রন্থাগার উপদেষ্টা ও গ্রন্থাগারিকের দায়িত্বপালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারও কোনো এক সময় গ্রন্থাগারিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশ ভারত ভাগ হওয়ার সময় ভারপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এ এইচ তালুকদার। ১৯৪৮-এর জানুয়ারিতে গ্রন্থাগারিক পদে নিয়োগ লাভ করেন আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রিডার ড. এ হক। ১৯৫৬ সালে যুক্তরাজ্যে দুই বছরব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ কোর্স শেষে দেশে আসার পর প্রখ্যাত গ্রন্থাগার বিজ্ঞানী মুহম্মদ সিদ্দিক খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক হিসেবে যোগদান করেন, যিনি এম এস খান নামেই সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গ্রন্থাগার বিজ্ঞান’ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলে এম এস খানই হন প্রথম বিভাগীয় প্রধান। এ বিভাগের প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে গ্রন্থাগার বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারেই কেবল নয়, গ্রন্থাগার আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এক নবযুগের সূচনা করে। এ বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জনকারী পেশাদার গ্রন্থাগারিকরা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আধুনিক গ্রন্থাগারিকতার গোড়াপত্তন করেন। ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক গ্রন্থাগারিক (ভারপ্রাপ্ত) পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

সুষ্ঠু কর্মপরিচালনার লক্ষ্যে গ্রন্থাগারটি বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত। এসব বিভাগ হচ্ছে: পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, প্রশাসন, কারিগরি প্রক্রিয়াকরণ, পাঠক সেবা, সামগী সংগ্রহ বা অ্যাকুইজিশন, রিপ্রোগ্রাফি, হিসাব বিভাগ, সাময়িকী এবং পাণ্ডুলিপি। সামগ্রিকভাবে গ্রন্থাগারের দায়িত্বে আছেন গ্রন্থাগারিক। পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্বে আছেন গ্রন্থাগারিক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন)। এ ছাড়া প্রতিটি বিভাগেরই দায়িত্বে আছেন একজন করে উপগ্রন্থাগারিক। একইভাবে বিজ্ঞান গ্রন্থাগারেরও দায়িত্বে আছেন একজন উপগ্রন্থাগারিক। জনবলের দিক দিয়ে গ্রন্থাগারের বৃহত্তম বিভাগ পাঠক সেবা বিভাগ, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের রিসোর্স সেন্টার ও সংবাদপত্র উপবিভাগ যার অন্তর্ভুক্ত। গ্রন্থাগার ও বিজ্ঞান গ্রন্থাগার মিলিয়ে পাঠক সেবায় নিয়োজিত আছেন মোট ৮৭ জন কর্মকর্তা ও কর্মী। জনবলের দিক দিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিভাগ প্রক্রিয়াকরণ শাখা, যাতে নিয়োজিত আছেন ২৫ জন কর্মী। বর্তমানে গ্রন্থাগারে উপগ্রন্থাগারিক, উপপরিচালক, প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা ও প্রধান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কর্মকর্তাসহ এ পর্যায়ের কর্মকর্তার সংখ্যা মোট ৩১ জন। সহকারী গ্রন্থাগারিক, জ্যেষ্ঠ কারিগরি কর্মকর্তা, সিনিয়র হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পর্যায়ের কর্মকর্তা মোট ৩২ জন। আর জুনিয়র গ্রন্থাগারিক, সেকশন অফিসার, কারিগরি কর্মকর্তা ও গবেষণা কর্মকর্তা পর্যায়ের কর্মকর্তার সংখ্যা ২৪ জন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘসময় ধরে এটি কর্মীস্বল্পতায়, বিশেষত প্রশিক্ষিত কর্মীর স্বল্পতায় ভুগেছে, যা গ্রন্থাগারের সুষ্ঠু কার্যসম্পাদনের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছে। সময়ের পরিক্রমায় গ্রন্থাগারে নতুন পদ সৃষ্টি ও কর্মীনিয়োগ হয়েছে। ফলে গ্রন্থাগারের কর্মকাণ্ডের পরিধি বেড়েছে এবং শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষকদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা গ্রন্থাগারে নিয়োগ লাভ করেছেন যার ফলে সুপ্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব অনেকটাই লাঘব হয়েছে। বর্তমানে (২০২০-২১) গ্রন্থাগারে মোট কর্মীসংখ্যা প্রায় ২০০, যাদের মধ্যে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা ৮৮ জন, তৃতীয় শ্রেণির কর্মী ৪৩ জন ও চতুর্থ শ্রেণির ৬৭ জন। 

গ্রন্থাগার সেবা

সময়ের প্রভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সেবার পরিসরই কেবল বাড়েনি, এতে যুক্ত হয়েছে বহুমাত্রিকতা। যুগের চাহিদা বিবেচনায় বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেবার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। গত এক দশকে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে প্রথাগত সেবা থেকে প্রযুক্তিভিত্তিক সেবায় স্থানান্তরের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণেও প্রযুক্তিভিত্তিক সেবার প্রয়োজনীয়তা আগের চেয়ে বহুগুণে বেড়েছে। বর্তমানে যেসব সেবা দেওয়া হচ্ছে সেগুলো হচ্ছে: ক) পাঠক সেবা, খ) রিপ্রোগ্রাফি সেবা, গ) সার্কুলেশন সেবা, ঘ) ইনস্টিটিউশনাল রিপোজিটরি সেবা, ঙ) অনলাইন জার্নাল সেবা, চ) ডিজিটাইশেন (ই-আর্কাইভস) সেবা, ছ) আইটি সেবা (রিমোট অ্যাকসেস ও ডাটা সেন্টার), জ) রেফারেন্স সেবা, ঝ) দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের জন্য রিসোর্স সেন্টার সেবা, ঞ) সংবাদপত্র সেবা, ট) প্লেজিয়ারিজম চেকিং সফটওয়্যার (Turnitin) সেবা। 

যেকোনো গ্রন্থাগারেই পাঠক সেবায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারেও পাঠক সেবায় নিযুক্ত আছেন সর্বোচ্চসংখ্যক কর্মী। চলমান ডিজিটাইজেশন কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে গ্রন্থাগারের ডিজিটাল ও অনলাইন সেবার পরিসর ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী, সংবাদপত্র, গবেষণাকর্ম ইত্যাদি নিয়মিতভাবে ডিজিটাইজেশন করা হচ্ছে, যা যুক্ত হচ্ছে গ্রন্থাগারের ই-আর্কাইভসে। দৈনিক আজাদ (১৯৩৬-১৯৯২), দৈনিক ইত্তেফাক (১৯৭৪-১৯৯৮), দৈনিক সংবাদ (১৯৮৪-১৯৯৫), দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস (১৯৭১-১৯৯৪), অমৃতবাজার পত্রিকা (১৯০৫-১৯৫০), টাইমস অব ইন্ডিয়া (১৯৬১-১৯৮১)-সহ মূলধারার বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সমৃদ্ধ সংগ্রহ গবেষকদের তথ্যসহায়তা জুগিয়ে চলেছে। গ্রন্থাগারের অন্যতম সেবা অনলাইন জার্নাল সেবা, যার আওতায় গ্রন্থাগারের শিক্ষকবৃন্দ ছাড়াও এমফিল ও পিএইচডি গবেষকবৃন্দ প্রায় ২২ হাজার জার্নাল অনলাইনে পাঠ করতে পারেন। উল্লেখ্য, ২০১৩-১৪ সেশন থেকে গ্রন্থাগারে মুদ্রিত সাময়িকী ক্রয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কেবল অনলাইন সাময়িকীর সাবস্ক্রিপশন চালু আছে। গ্রন্থাগার কর্তৃক প্রদত্ত Turnitin সফটওয়্যারের সেবা গবেষণায় চিন্তাচৌর্য তথা প্লেজিয়ারিজম প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়া বহিস্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুরোধের ভিত্তিতে বিশেষায়িত সেবা/অতিথি ব্যবহারকারী সেবাও প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রন্থাগার ওরিয়েন্টেশন কর্মসূচির আয়োজন করা হয় যাতে কেবল গ্রন্থাগারের পাঠসামগ্রী ও সেবা ব্যবহারই নয়, তথ্য অনুসন্ধান ও ব্যবহার সম্পর্কিত নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ধারণা দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত বিভিন্ন বিভাগ, ইনস্টিটিউট, গবেষণা কেন্দ্র ইত্যাদির পক্ষ থেকে গ্রন্থাগার ও তথ্য বিষয়ক অন্যান্য সেবাও চাহিদা অনুযায়ী প্রদান করা হয়। 

গ্রন্থাগার স্বয়ংক্রিয়করণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের ওয়েব সাইটটি গ্রন্থাগারের নানাবিধ সেবা ব্যবহারের জন্য একটি কেন্দ্রবিন্দু বা ÔhubÕ হিসেবে কাজ করে। গ্রন্থাগারের অনলাইন ক্যাটালগও ওয়েব সাইটটির সঙ্গে যুক্ত আছে, ফলে পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে যে কেউ ওয়েব সাইটের মাধ্যমে গ্রন্থাগার ক্যাটালগ অনুসন্ধান করতে পারেন। গ্রন্থাগারে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সংযোগসহ নানাবিধ প্রযুক্তি উপকরণের ব্যবহার বেশ আগে থেকেই শুরু হলেও একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার আওতায় স্বয়ংক্রিয় গ্রন্থাগার ব্যবস্থা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একুশ শতকের গোড়াতেই সমন্বিত গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়করণের পরিকল্পনা করা হয়। এ উদ্দেশ্যে ২০০৮ সালে গ্রাফিক্যাল লাইব্রেরি অটোমেশন সিস্টেম (GLAS) নামে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে শুরু হলেও সফটওয়্যারটির বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে বছরখানেকের মধ্যেই এটির ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন-হাউস সফটওয়্যার হিসেবে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষকদের মাধ্যমে DULIS (Dhaka University Library Integrated Software)  সফটওয়্যার উন্নয়নের কাজ হাতে নেওয়া হয়। এরপর ২০১৩ সালে শুরু হয় ওপেন সোর্সভিত্তিক গ্রন্থাগার স্বয়ংক্রিয়করণ সফটওয়্যার কোহা (Koha)-র ব্যবহার। কোহা একটি ওপেন সোর্স সমন্বিত গ্রন্থাগার সফটওয়্যার, যেটি নিউজিল্যান্ডের কাটিপো কমিউনিকেশনস-কর্তৃক তৈরি। এ সফটওয়্যারটির রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছে কোহা ডেভেলপারদের একটি অনলাইন কমিউনিটি যারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। বর্তমানে DULIS সফটওয়্যারের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ স্বয়ংক্রিয়করণ সেবা দেওয়ার প্রয়াস চলমান আছে। DULIS সফটওয়্যারটি মূলত সার্কুলেশন, বার কোডিং ও ব্যবহারীদের আইডি কার্য মুদ্রণের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, অন্যদিকে ক্যাটালগ অনুসন্ধানের কাজটি সম্পন্ন করা হচ্ছে কোহার মাধ্যমে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকদের বিভিন্ন গবেষণাকর্ম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২০১৩ সালে একটি ইনস্টিটিউশনাল রিপোজিটরি (repository.library.du.ac.bd) তৈরি করা হয়েছে যার ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে ডিস্পেস ((DSpace) সফটওয়্যারের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, ডিস্পেস একটি ওপেন সোর্স সফটওয়্যার যেটি তৈরি করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ও এইচপি ল্যাবস-এর যৌথ উদ্যোগে। এ রিপোজিটরিতে শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ প্রতিবেদন এবং মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডির গবেষণা অভিসন্দর্ভ ছাড়াও শিক্ষকদের গবেষণাকর্মও সংরক্ষিত হচ্ছে। 

উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক ও বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। সেবা, সংগ্রহ ও সামর্থ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারকে পরিপূর্ণভাবে একুশ শতকের উপযোগী একটি গ্রন্থাগার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। ব্যবহারকারীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি ও নিয়মিত জরিপ পরিচালনা, সেবাদানের উদ্ভাবনী কৌশল নিয়ে চিন্তাভাবনা ও কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রযুক্তি সতত পরিবর্তনশীল এবং বর্তমান বাস্তবতায় তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেবার বিকল্প নেই। কোভিড-১৯-এর কারণে সৃষ্ট মহামারি পরিস্থিতি তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারকে আরও অনিবার্য করে তুলেছে। এ কারণে তথ্যসেবার উদীয়মান নানা প্রযুক্তিতে গ্রন্থাগার কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রন্থাগারের তহবিল বৃদ্ধি ও প্রাপ্ত তহবিলের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের পাশাপাশি গ্রন্থাগারের অবকাঠামোগত সক্ষমতাকেও ক্রমাগত বৃদ্ধি করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার অন্যতম পীঠস্থান। গত এক শতাব্দীর অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় নতুন নতুন অর্জনকে সঙ্গী করে এ গ্রন্থাগার এগিয়ে যাবে, এটিই সবার কাম্য।

লেখক: অধ্যাপক, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: আরও মনোযোগ দিতে হবে গবেষণায়

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১২:৩৭ পিএম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: আরও মনোযোগ দিতে হবে গবেষণায়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে স্থান সংকুলানের তীব্র সমস্যার মধ্যে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত হবে বর্তমানে উন্নয়নশীল পূর্বাচল নতুন শহরে সরকারের কাছ থেকে কমপক্ষে ১০০ একর জমি বরাদ্দ নিয়ে আধুনিক গবেষণা ক্যাম্পাস গড়ে তোলা। সেখানে প্রধানত চিকিৎসাবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান ও আইটিবিষয়ক গবেষণার প্রাধান্য থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যার গবেষণা-অধ্যাপক বা রিসার্চ-প্রফেসর নিযুক্ত থাকবেন, যাদের মূল দায়িত্বই হবে পূর্ণকালীন গবেষণা, অবশ্য মাঝেমধ্যে তারা তাদের কাজনির্ভর কিছু গণ-বক্তৃতা দেবেন।...

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবর্ষপূর্তি হয়েছে ২০২১ সালে। আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের ও আনন্দময় ছিল বছরটি। নানা কর্মকাণ্ডে উদ্‌যাপিত হয়েছে বছরটি।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গরদ-পরবর্তী অস্থিরতার মধ্যে ১ জুলাই ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে মনে করা হয়েছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গবাসীর জন্য এক ‘চমৎকার রাজকীয় ক্ষতিপূরণ’।

প্রতিষ্ঠার পর প্রথম প্রায় তিন দশক ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয়টি ঈর্ষণীয় সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। পূর্ব বাংলার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এ অঞ্চলের শুধু উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তাই মেটাচ্ছিল তা নয়, সার্বিক অর্থে এখানকার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। 

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ভূমিকা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বাংলা ভাষার মর্যাদা সুরক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের তেজস্বী ভূমিকা ঐতিহাসিক তাৎপর্য লাভ করে। অতঃপর ক্রমশঃ পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধিকার আন্দোলনে তাদের অপরিহার্য ভূমিকা গ্রহণে রীতিমতো বাধ্য করে। যেন অনেকটা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই প্রথম উত্তোলিত হয়। 

পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় (পূর্ব পাকিস্তানে) আরও পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাধান্য কিছুটা হলেও সংকুচিত হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম (১৯৫৮-৬২), আইয়ুবি আমলের শুরু থেকে, ভূগোল বিভাগে শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলাম ১৯৬৩ সালে, দীর্ঘ ৪৪ বছর শিক্ষকতার পর ২০০৭ সালে অবসরে যাই। ২০০৭-২০১১-এ আমি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছি। তখন দেশের অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল। পরে কিছুটা সংযুক্ত ছিলাম পিএইচডি গবেষকের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে। অতঃপর ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হয়েছি ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ইমেরিটাস প্রফেসর পদে। অর্থাৎ বিগত ছয় দশকেরও বেশি সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালোমন্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। 

বিগত ১০০ বছরে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার অভাবনীয় সংখ্যাগত অগ্রগতি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও হয়েছে। ১৯২১ সালে শুরুতে ছিল তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৪৭ জন শিক্ষার্থী ও তিনটি হল। বর্তমানে অনুষদ ১০টি, বিভাগ ৮৩টি, শিক্ষক ১৯৮৬, শিক্ষার্থী প্রায় ৫০ হাজার, হল ২৩টি, বিভাগ ছাড়া ইনস্টিটিউট রয়েছে ১৩টি, গবেষণা ব্যুরো ও কেন্দ্র (কেন্দ্রীয় মর্যাদার ও বিভাগীয় পর্যায়ের) মোট প্রায় ৫৭টি (অধিভুক্ত কলেজের হিসাব এসবের বাইরে)। পক্ষান্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে জমির পরিমাণ শুরুর ৬০০ একর থেকে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৭৫ একরে।

জমি ছাড়া সব ক্ষেত্রেই সংখ্যা ও পরিমাণগত বৃদ্ধি সুস্পষ্ট। প্রশ্ন জাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও পরিচালন গুণমান নিয়ে। সাম্প্রতিককালে নানা ক্ষেত্রেই গুণমানের আন্তর্জাতিক তুলনা এবং তার ফলাফলের প্রচারের প্রচলন হয়েছে, জাতীয় উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন সূচক (বা ইন্ডিকেটর) নিয়ে। শিক্ষাদান, গবেষণা, প্রকাশনা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার বিভিন্ন উপাদান ও পরিচালনার (বা গভর্নেন্স) নানা দিক বিবেচনায় নিয়ে বৈশ্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘র‌্যাংকিং’ করার ব্যবস্থা রয়েছে। বস্তুত, বিশ্বে একাধিক র‌্যাংকিং অনুশীলন কার্যকর রয়েছে। পরিতাপের বিষয়, প্রায় কোনো র‌্যাংকিং অনুশীলনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আদৌ সম্মানজনক নয়। সম্প্রতি এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষক সমাজ তাদের নিজেদের অবস্থানের উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে আগ্রহী হচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন অবশ্যই বেশ কঠিন, তবে মোটেও অসম্ভব নয়।

ঐতিহাসিকভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা তথা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক বিশেষ অবস্থান দখল করে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তার দু-দুটো স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানে (২০০৬-২০২৬ ও ২০১৭-২০৩০) দেশে একটি স্নাতকোত্তর পর্যায়ের নতুন আলাদা ‘রিসার্চ ইউনিভার্সিটি’ প্রতিষ্ঠার কথা সুপারিশ করেছে এ জন্য যে, বিদ্যমান কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্পূর্ণভাবে গবেষণা-বিশ্ববিদ্যালয় করা বাস্তব কারণেই সম্ভব নয়। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও নয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রোগ্রাম চালু রেখেই এখানকার গবেষণা ও প্রকাশনা কার্যক্রম অনেক বেশি শক্তিশালী করা যায়। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান গবেষণা ইনস্টিটিউটগুলোকে সত্যিকার পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করতে হবে, প্রয়োজনে নতুন কিছু গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে হবে। বর্তমানের অসংখ্য ‘গবেষণা কেন্দ্র’ নামের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নামসর্বস্ব না রেখে হয় সত্যিকার কার্যকর করতে হবে, না হয় বন্ধ করে দিতে হবে।

বর্তমানের বিভাগগুলোর শিক্ষাদান মান উন্নত করতে হবে, পাশাপাশি স্নাতকোত্তর ডিগ্রিভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রমও শক্তিশালী করতে হবে। বলাবাহুল্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ মানদণ্ড প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নীতি থাকতেই পারে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে হতেই হবে সৃষ্টিশীল ও গবেষণামনস্ক, নিষ্ঠাবান, আন্তরিক, পরিশ্রমী ও উন্নত নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন। দেশপ্রেমিক তো বটেই। 

বিশ্বমঞ্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এগিয়ে নেওয়ার জন্য এর শিক্ষক ও গবেষকদের মানসম্পন্ন প্রকাশনার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য সব রকমের প্রাতিষ্ঠানিক ও পদ্ধতিগত উৎকর্ষ অর্জনের পরিকল্পনা থাকা অতি আবশ্যক। হাজার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তথা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রকৃত বিশ্বমানের গবেষক-শিক্ষক আছেন, যাদের সংখ্যা অবশ্য খুবই সীমিত, কিন্তু তারা তো দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। বিশ্ববিদ্যালয় তথা মঞ্জুরি কমিশন তাদের কথা তরুণ শিক্ষকদের সামনে তুলে ধরতে পারে। তারা অনেকেই স্বভাবগতভাবে প্রচারবিমুখ। 

আগামীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সর্বোচ্চ সুযোগ সৃষ্টি করতেই হবে। মঞ্জুরি কমিশন উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প বা HEQEP-এর মাধ্যমে (২০০৯ থেকে) এ দেশে প্রথম বড় রকমের গবেষণা প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও সে সুযোগ অনেকটা লাভ করেছে। ভবিষ্যতে গবেষণার সুযোগ আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। এ লক্ষ্যে আর্থিক বরাদ্দ বহু গুণ বাড়াতে হবে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে স্থান সংকুলানের তীব্র সমস্যার মধ্যে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত হবে বর্তমানে উন্নয়নশীল পূর্বাচল নতুন শহরে সরকারের কাছ থেকে কমপক্ষে ১০০ একর জমি বরাদ্দ নিয়ে আধুনিক গবেষণা ক্যাম্পাস গড়ে তোলা। সেখানে প্রধানত চিকিৎসাবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান ও আইটিবিষয়ক গবেষণার প্রাধান্য থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যার গবেষণা-অধ্যাপক বা রিসার্চ-প্রফেসর নিযুক্ত থাকবেন, যাদের মূল দায়িত্বই হবে পূর্ণকালীন গবেষণা, অবশ্য মাঝেমধ্যে তারা তাদের কাজনির্ভর কিছু গণ-বক্তৃতা দেবেন।

নতুন শহরে নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণ করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাসের পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। বস্তুত, ক্যাম্পাসের এক ধরনের ভৌত নবায়ন বা ‘রিনিউয়াল’ দরকার হবে, যা আগামী ২৫ বছরে (অর্থাৎ ২০৫০ সালের মধ্যে) ১০০ বছরের জন্য পরিকল্পিত ও বাস্তবায়িত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য একটি ‘মাস্টার প্ল্যান’ প্রস্তুতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান ক্যাম্পাসের কার্জন হল ক্যাম্পাস, এসএম হল, ফজলুল হক হল, শহীদুল্লাহ হল, উপাচার্য ভবন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, চারুকলা অনুষদ ভবন, টিএসসির সবুজ চত্বর, প্রাচীন বৃক্ষ শোভা ইত্যাদি সংরক্ষণ করে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সময়ানুগভাবে সুবিন্যস্ত করা প্রাসঙ্গিক হবে। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণে বাংলা বিভাগটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সমৃদ্ধ করা উচিত, যাতে এটি বিশ্বের সেরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র হতে পারে, হওয়া উচিত। এর জন্য নান্দনিক স্থাপত্য নকশাবিশিষ্ট আলাদা ভবন থাকা উচিত। 

ঔপনিবেশিক আমলে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন বাংলাদেশে পরিচালনগত দিক দিয়ে ব্যাপকভাবে বদলে গেছে। ১৯৭৩ অধ্যাদেশ যার মূল চালিকা শক্তি। অধ্যাদেশের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কথা নানা সময়ে, নানা মহল থেকে আলোচিত হয়েছে। আমরাও মনে করি অধ্যাদেশের পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন বা গভর্নেন্স এর মৌলিকত্ব যে গণতান্ত্রিক চেতনা তা বজায় রেখেই সময়োপযোগী করা সম্ভব হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গভর্নেন্স ব্যবস্থা, শিক্ষার্থী ও তরুণ শিক্ষকদের অধিকতর অংশগ্রহণ ও অবদান রাখার সুযোগ বাঞ্ছনীয়।

উপসংহারে বলা যায়, দেশের প্রাচীনতম ও মর্যাদাবান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা তথা সামগ্রিকভাবে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা অব্যাহত রাখবে। ১০৪তম প্রতিষ্ঠা দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক মঙ্গল কামনা করি। 

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান

শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক কার্যক্রম ও স্বজনপ্রীতি নয়

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১১:৪৭ এএম
শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক কার্যক্রম ও স্বজনপ্রীতি নয়
কলা ভবনের সামনে অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এখানে আগের মতো আর শিক্ষার পরিবেশ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন নষ্ট রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নগ্ন দলীয়করণ রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ’৬০-এর দশকের ছাত্ররা যে জ্ঞান আহরণ করেছে, এখন ছাত্ররা কি তা পারছে? ছাত্রদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা শিক্ষক যারা তারা কি সব কোর্স পড়িয়ে ছাত্রদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করতে পারছি। এর জন্য ছাত্রদের দায়ী করে লাভ নেই। শিক্ষকরাই দায়ী। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও নীতি দায়ী।…

শিক্ষাঙ্গনে স্বজনপ্রীতি একবারেই থাকা উচিত নয়। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রশাসন, বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে সর্বত্র স্বজনপ্রীতি দেখা যায়। স্বজনপ্রীতি একটা সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। নীতি হলো যোগ্যতাই হবে নিয়োগের একমাত্র মাপকাঠি। সেই নীতিই আমরা অতীতে ফলো করে এসেছি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতাই একমাত্র মাপকাঠি ছিল। যোগ্যতার ভিত্তিতেই পদোন্নতি হবে। কিন্তু পরবর্তীতে এই নীতি বহাল থাকেনি। বিশেষ করে গত ১৬ বছরে এই ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে কোনো ন্যায়নীতি অনুসরণ করা হয়নি। প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকলে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন যখন নিরপেক্ষ ছিল তখন শিক্ষাব্যবস্থা ভালো চলেছে। যখনই স্বজনপ্রীতি এসেছে তখন বিশ্ববিদ্যালয় ভালো চলেনি।   

আমি উপাচার্য থাকাকালে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিরপেক্ষভাবে চালানোর চেষ্টা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় নিরপেক্ষভাবে চললে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে। আমি প্রশাসনে থাকা অবস্থায় বারবার সরকারকে বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয় নিরপেক্ষ রাখলে আপনাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়কে কোনোভাবেই দলীয়করণ করা যাবে না। গত ১৬ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়কে নগ্ন দলীয়করণ করা হয়েছে। প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেয়। দেশের শিক্ষাবিদদের; যাদের প্রকাশিত বই ও পাঠক পরিচিতি আছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়েছে তারাই উপাচার্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়েছেন। আমি নিজেও যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলাম। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বিশেষ করে ২০১০ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এত নগ্ন দলীয়করণ হয়েছে যা ইতিহাসে বিরল। যিনি শেখ হাসিনাকে বেশি তোষামোদী করতে পেরেছেন, তাকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দেশে অনেক যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও যিনি সরকারের বেশি দালালি করতে পারবেন তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দলীয় লোকদের বেশি বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ হতে হবে মেধার ভিত্তিতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনও নজির আছে, যেখানে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট বাদ দিয়ে সেকেন্ড ক্লাসের কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দলীয় বিবেচনায় বহু নিয়োগ হয়েছে। এভাবে উচ্চশিক্ষায় বড় আকারে ধস নেমে এসেছে। শিক্ষকদের মধ্যে শুধু দলবাজি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যন্ত নিয়োগে দলীয়করণ হয়েছে। তাঁবেদার বা তোষামোদকারী শিক্ষক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি উপাচার্য হবেন তাকে একজন শিক্ষাবিদ হতে হবে। ভিসিকে অনেক দূরদর্শী হতে হবে। আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয় কোন পর্যায়ে যাবে তা নিয়ে ভিসিকে ভাবতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করতে হবে। যিনি লেখাপড়া করেন না, বরং দলবাজি করেন, তিনি শিক্ষার মানোন্নয়নে কীভাবে ভূমিকা রাখবেন। উচ্চশিক্ষায় আর শিক্ষা নেই, একদম ধস নেমে এসেছে। এমনকি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরেও দলীয়করণ হয়েছে। 

১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় অনেক স্বপ্ন নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। যারা ন্যায়নীতি বিশ্বাস করে না, পদলেহনকারী ও দলবাজি করে, সেসব লোক যেন কখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না পান। বিশ্ববিদ্যালয় হলো অধ্যায়নক্ষেত্র এবং জ্ঞানচর্চার জায়গা। কেউ যদি দলবাজি করেন, তাহলে তিনি কীভাবে শিক্ষাদান করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। আওয়ামী লীগের সময়ে তাদের দলের বাইরে কোনো কথা বলা যায়নি। চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বাধীনতা না থাকলে কীভাবে তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবসময় বুদ্ধির মুক্তি ও চিন্তার স্বাধীনতা থাকতে হবে। কীভাবে একটা জাতি উন্নতি করবে, যদি সেখানে চিন্তার স্বাধীনতা না থাকে। চিন্তার স্বধীনতা না থাকলে সেখানে গণতন্ত্র থাকে না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতি ও ছাত্ররাজনীতি একদম মিশে গেছে। লেজুরবৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি দূর করতে হবে। ছাত্ররাজনীতি থাকবে, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার পক্ষপাতি আমি নই। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি স্বাধীনভাবে থাকবে। ছাত্ররাজনীতি স্বচ্ছ থাকবে, সেখানে কোনো চাঁদাবাজি থাকবে না। তারা দেশে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে। এ জেনারেশনের ছাত্ররা আগস্ট মাসে বিপ্লব করে দেখিয়ে দিয়েছে। তারা ফ্যাসিবাদী সরকার দমন করেছে। আমাদের দেশের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে ছাত্ররা আন্দোলন করবে। গত ১৬ বছরে ছাত্ররা যে রাজনীতি করেছে, এটা কীসের রাজনীতি? এটা ছিল সন্ত্রাসী রাজনীতি। ছাত্রদের লেজুরবৃত্তিক ও দালালি রাজনীতি ছিল। এভাবে ছাত্ররাজনীতি হতে পারে না। ছাত্ররাজনীতি হবে আদর্শিক। মানুষের মঙ্গল কামনায় ও সুনাগরিক সৃষ্টির পক্ষে ছাত্ররাজনীতি হবে। আমরা ছোটবেলায় পড়েছি, ‘সদা সত্য কথা বলিবে’। এখন কি কেউ সদা সত্য কথা বলে। কারণ, এখন সত্য কথা বলে তেমন লাভ হয় না, মিথ্যা কথা বলে লাভ হয়। সত্য ও ন্যায়ের পথে কেউ থাকে না। অথচ ন্যায় ও সত্য ছাড়া কোনো সমাজ উন্নতি লাভ করতে পারে না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতিও এখন দূষণীয়। ১৯৭৩-এর আইনের সংশোধন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সারা বছরই শুধু রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এগুলো বন্ধ করতে হবে। সারা বছর শিক্ষক নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন শিক্ষকরা। এটার কী দরকার। নির্বাচন করতে গিয়েই দলীয় রাজনীতি করতে হয়। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন শিক্ষকরা। পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি শিক্ষক রাজনীতি আছে? নির্বাচন আছে? শিক্ষক নির্বাচন বন্ধ করতে পারলে শিক্ষক রাজনীতি কমে আসবে। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে শিক্ষক রাজনীতির যে মেলবন্ধন তা বন্ধ করতে হবে। এতে শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমি এ দেশের একজন প্রবীণ শিক্ষক হিসেবে বলব, ১৯৭৩-এর আইন সংশোধন করে শিক্ষকদের লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। শিক্ষকদের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে। কিন্তু গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা যাবে না। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এখানে আগের মতো আর শিক্ষার পরিবেশ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন নষ্ট রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নগ্ন দলীয়করণ রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ’৬০-এর দশকের ছাত্ররা যে জ্ঞান আহরণ করেছে, এখন ছাত্ররা কি তা পারছে? ছাত্রদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা শিক্ষক যারা তারা কি সব কোর্স পড়িয়ে ছাত্রদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করতে পারছি। এর জন্য ছাত্রদের দায়ী করে লাভ নেই। শিক্ষকরাই দায়ী। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও নীতি দায়ী। 

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সংস্কারে এতগুলো কাজ করেছে, শিক্ষার সংস্কার কী করতে পারছে। একটা শিক্ষা কমিশন এখন পর্যন্ত গঠন করতে পারেনি। সরকার শিক্ষা কমিশনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও এটা করেনি। শিক্ষা কমিশন সবার আগে করা দরকার ছিল, অথচ সেটাই করতে পারেনি। সবাই বলে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কীসের মেরুদণ্ড? জাতির মেরুদণ্ড কি আছে? নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘কোনো জাতিকে যদি ধ্বংস করতে হয় তাহলে কোনো গোলাবারুদের দরকার নেই। সেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দাও। তাহলেই জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে’। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা একদম ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশে যতটুকু শিক্ষাব্যবস্থা আছে, তাও আগামীতে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি একজন ছাত্রকে কীভাবে দোষ দেব যে, তুমি কেন অর্ধ শিক্ষিত হয়েছ? দেশে শিক্ষার যে ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে, তাতে অর্ধশিক্ষিত তো হবেই। দেশে সুনাগরিক তৈরি করতে হলে সবার আগে শিক্ষা কমিশন গঠন করে শিক্ষাসংস্কার করতে হবে। শিক্ষায় এগিয়ে গেলে জাতি উন্নত হবে। 

লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়