
শীতকাল শেষে গরম আসতে না আসতেই আবার আলোচনায় গরম হয়ে উঠছে ডেঙ্গু ইস্যু। গত বছর দেশে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল। এবার পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ ও ভয়ংকর হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই পরিস্থিতির জন্য সব মহল থেকেই প্রথমত দায়ী করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাবকে। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, একদিকে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, অন্যদিকে বিরতি দিয়ে বৃষ্টির কারণে যে পরিবেশ তৈরি হয়, তা মশার প্রজননবান্ধব। এমন পরিবেশ যেকোনো মশা ও পোকামাকড় বংশবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে মশা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হচ্ছে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস বা নষ্ট করে ফেলা। তা না হলে মশা থেকে কোনোমতেই সুরক্ষা মিলবে না বাংলাদেশের আবহাওয়ার কারণে। এবার উপকূলীয় অঞ্চলে ডেঙ্গুর বিস্তার বেশি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন একজন বিশেষজ্ঞ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডেঙ্গু হলো একটি ভাইরাল সংক্রমণ, যা সংক্রমিত হয় মশার কামড়ের মাধ্যমে। এটি বিশ্বব্যাপী গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে বেশি হয়ে থাকে। বেশির ভাগ শহুরে এবং আধা শহুরে এলাকায় এই মশার প্রজনন বেশি। ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক মশা হচ্ছে এডিস ইজিপ্টি মশা এবং কিছুটা হলেও এডিস অ্যালবোপিকটাস। এ ছাড়া অন্য মশাগুলোরও প্রজনন ও বংশবিস্তারে তাপমাত্রার বড় প্রভাব রয়েছে।
কীটতত্ত্ববিদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবার রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে আমাদের দেশে মশার বিস্তার ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তাপমাত্রা যত বাড়তে থাকবে, এই মশার বিস্তারও বাড়বে। এবার তো মনে হয় গতবারের চেয়েও বেশি বিস্তার ঘটতে পারে ডেঙ্গুর।’
ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘মশার সাইকেলটা হচ্ছে প্রথমে ডিম, তারপর লার্ভা, তারপর পিউপা, তারপর হচ্ছে অ্যাডাল্ট মশা। মশার প্রজনন ক্ষেত্রকে যদি আমরা বিচ্ছিন্ন না করতে পারি, তাহলে মশা নিধন সম্ভব নয়। প্রজনন ক্ষেত্রগুলোকে মশার জন্য প্রতিকূল করতে হবে। মশার বাসস্থানগুলো ধ্বংস করতে হবে। এটা না করলে যত ইচ্ছা ওষুধ ছিটালেও কাজ হবে না। টানা বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা কেটে যায়। তখন পানিটা থাকে পরিষ্কার। সেই পরিষ্কার পানিতে মশার লার্ভা জন্ম নিতে পারে না। কিন্তু এক দিন বৃষ্টি হলো, তার পরের দিন হলো না, এ সময় জায়গায় জায়গায় পানি জমে যায়। এই পানি মশা প্রজননের জন্য উপযুক্ত।’
আরেক কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা উপকূলীয় অঞ্চলের চট্টগ্রাম, বরগুনা, চাঁদপুর, পিরোজপুরসহ আরও কয়েকটি এলাকায় প্রাক-জরিপ করেছি। প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে, এবার এসব অঞ্চলে ডেঙ্গুর বিস্তার আগের তুলনায় অনেক বেশি হবে। ইতোমধ্যেই এর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তাপমাত্রার প্রভাব রয়েছে।’
ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘প্রধানত এডিস মশার প্রজননের জন্য ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (২ কম-বেশি) কাছাকাছি তাপমাত্রা সবচেয়ে উপযুক্ত। তবে ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রির মধ্যে তাপমাত্রা এডিসের প্রজননবান্ধব। আমাদের দেশে এই তাপমাত্রাই থাকে মৌসুমজুড়ে। এবারও কেবল রাজধানী ঢাকাতেই নয়, বাইরেও বিস্তার নিয়ে বড় আশঙ্কা রয়েছে।’
সামনে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে এরই মধ্যে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বড় এক বৈঠক করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। অংশ নেন ঢাকার দুই মেয়রসহ স্বাস্থ্য এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বৈঠকে ডেঙ্গুর উৎস এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যেমন কথা হয়েছে, তেমনি ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েও কথা হয়েছে। এর পরদিন উত্তরায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মশা নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। যেখানে তারা দুজন অনুষ্ঠান মঞ্চে বসেই বারবার মশার কামড়ের শিকার হন। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের তথ্য অনুসারে, ষাটের দশকে বর্তমান বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল, যা প্রথমে ‘ঢাকা জ্বর’ নামে পরিচিত ছিল। তবে ২০১০ সাল থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রায় ধারাবাহিক হয়ে উঠেছে প্রতিবছর। বিশেষ করে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষাকাল এবং উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ডেঙ্গুর বাহক হিসেবে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। অত্যধিক বৃষ্টিপাত, জলাবদ্ধতা, বন্যা, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং দেশের ঋতুচক্রে অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিস্থিতি ডেঙ্গু এবং ম্যালেরিয়া এবং চিকুনগুনিয়া ভাইরাসসহ অন্যান্য ভেক্টরবাহিত রোগের সংক্রমণের জন্য আরও অনুকূল হয়ে ওঠার কথা বলছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহম্মেদ খবরের কাগজকে বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ডেনভি১, ডেনভি২, ডেনভি৩ ও ডেনভি৪। প্রথম সেরোটাইপের সংক্রমণ হোমোলোগাস সেরোটাইপকে দীর্ঘমেয়াদি করে, কিন্তু অন্য সেরোটাইপগুলোতে তা নাও হতে পারে। ভিন্ন সেরোটাইপের অনুক্রমিক সংক্রমণগুলো মানুষকে মারাত্মক ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে ফেলে। ডেনভি১ ডেঙ্গুর সংক্রমণ শুধু হালকা ফ্লুর মতো অসুস্থতা তৈরি করে এবং ৮০ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে হয়ে থাকে উপসর্গবিহীন।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুর কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। সময়মতো কেস শনাক্ত করা, গুরুতর ডেঙ্গু সংক্রমণের কোনো সতর্কতা লক্ষণ শনাক্ত করা এবং উপযুক্ত কেস ম্যানেজমেন্ট হলে কেসের মৃত্যুর হার ১ শতাংশের নিচে রাখা যায়। কিন্তু পুরো ব্যবস্থাপনা যদি সমন্বিত না হয়, তবে বিপদ বাড়তে থাকে।
গত ১৯ মার্চ মন্ত্রণালয়ে ডেঙ্গুবিষয়ক সমন্বয় সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, বাংলাদেশে বিগত ২৩ বছরে যত ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, গত ২০২৩ সালে এক বছরেই তার থেকে বেশি রোগী আক্রান্ত হয়েছেন। অর্থাৎ গত ২৩ বছরে দেশে মোট ডেঙ্গু রোগী ছিলেন প্রায় আড়াই লাখ।
কিন্তু গত ২০২৩ সালে মাত্র এক বছরেই আক্রান্ত হন প্রায় ৩ লাখ। এই সংখ্যা শুধু হাসপাতালে ভর্তিকৃতদের। এর বাইরে তো আরও রোগী ছিলেনই। মন্ত্রী আরও বলেন, ‘এতেই বোঝা যায়, ডেঙ্গু রোগী নিয়ে আমাদের এবার আগে থেকেই সতর্ক না হয়ে কোনো উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে সব সেক্টরকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।’
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্দেশে বলেন, প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে লার্ভার তথ্য জানতে হবে। নিয়ম না মানলে জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় যারা বাধা হবে, তাদের জরিমানাসহ আরও কঠোর নিয়ম প্রয়োগ করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গতকাল শুক্রবার (২২ মার্চ) পাঠানো নিয়মিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির তথ্য অনুসারে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ১ হাজার ৬১৮ জন। এর মধ্যে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ২১ জন।
মতামত
>জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে মশার প্রজনন বাড়ছে
>সোচ্চার হতে হবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে
>কার্বন জিরোতে আনার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে