ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেকগুলো অভিন্ন ইস্যু রয়েছে। তিস্তা চুক্তি ও অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহারের মতো ইস্যুগুলোর পাশাপাশি নতুন যুক্ত হয়েছে দেশটির নাগরিকত্ব আইন। এ অবস্থায় আজ শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম এই গণতান্ত্রিক দেশটির জাতীয় নির্বাচন। স্বভাবতই নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে দেশটির এই নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ সরকার, বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক কৌতূহল।
ভারতে নির্বাচন হয় প্রায় দেড় মাস ধরে। ৭ ধাপের এই নির্বাচন শেষ হবে ১ জুন। বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে ক্ষমতাসীন বিজেপি জোটই ক্ষমতায় থেকে যাবে।
ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টনের চুক্তি সই হলেও তিস্তাসহ আলোচনায় থাকা ৮ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের ব্যাপারে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। এ অবস্থায় ২০২৬ সালে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির মেয়াদও শেষ হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি বিজেপি জোট ক্ষমতায় থাকে বা না থাকে তারপরও বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি হবে বলে মনে হয় না। চুক্তি না হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ওপর দায় চাপাচ্ছে। কিন্তু এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় গেলে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি হবে।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘একরকম নিশ্চিত যে বিজেপি জোটই ক্ষমতায় আসছে। তবে কংগ্রেস বা বিজেপি যেই ক্ষমতায় আসুক, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো হেরফের হবে না।’
এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে না। ফলে যা করার বাংলাদেশকেই করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিকিমে প্রচুর পানি দিতে হয়। কাজেই তিস্তা প্রকল্প করার ব্যাপারে চীন আগ্রহ দেখিয়েছে। এটা স্বাভাবিক। ভারত যদি যোগ দিতে চায় দিতে পারে। সেক্ষেত্রে ত্রিপক্ষীয় একটা ব্যাপার থাকবে। জাপান বা অন্য কোনো দেশও যুক্ত হতে পারে। এটা কোনো সমস্যা না।’
ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহার
বাংলাদেশ ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু ভারতের স্থল, বিমান ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহনের সুবিধা বাংলাদেশকে দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় ভারতকে দেওয়া ও পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বন্ধুত্বের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যেমন পানি নিয়েও ২০ বছরে অগ্রগতি নেই। তারপরও কিন্তু আমরা কখনো বলিনি যে ভারত আমাদের বন্ধু না।’
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে নিরাপত্তার সমস্যা সমাধান করেছে বাংলাদেশ। সে হিসেবে ভারতও মনে করে যে বন্ধুরাষ্ট্র থাকাটা তাদের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি ট্রানজিট ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রেসার বাড়ানো দরকার। একতরফা ট্রানজিট হলে সেটা ভবিষ্যতে আর ট্রানজিট থাকবে না। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা লাভবান না হলে অন্য ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে জোর দেবে তারা। ফলে ব্যবসা কমে যাবে। তখন বাংলাদেশ ব্রাজিল, আফ্রিকার সঙ্গে ব্যবসা বাড়াবে। তাই ভারতেরও বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা দরকার। ভুটান ও নেপালকেও ট্রানজিট সুবিধা দিলে সব দেশেরই উপকার হবে।’
সীমান্তে হত্যাকাণ্ড
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটারের মতো। সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি নিয়মিত মারা যান। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক হিসাবে দেখা যায়, প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় সীমান্তে বিএসএফ বেশি মানুষ মারছে। ২০২১ সালে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারায় ১৭ বাংলাদেশি। ২০২২ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩-এ। ২০২৩ সালে মারা গেছেন ৩০ জন বাংলাদেশি। এ ছাড়া নিয়মিত বাংলাদেশিদের সীমান্ত থেকে অপহরণের মতো ঘটনা অহরহই ঘটে।
এ প্রসঙ্গে ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘সীমান্তে সমস্যা রয়ে গেছে। হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। তাই বিষয়টিতে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার যেটা এখনো দেওয়া হয়নি। নির্বাচনে কংগ্রেস এলেও যে বিষয়টিতে মনোযোগ দেবে তেমন নয়। চীন ও ভারতের মধ্যে চুক্তি আছে যে সীমান্তের দুই কিলোমিটারের মধ্যে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেও এমন চুক্তি হওয়া দরকার।’
নতুন মাথাব্যথা ভারতের নাগরিকত্ব আইন
ভারত সম্প্রতি কিছুটা সংশোধন করে নাগরিকত্ব আইন বা সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) কার্যকর করেছে। এই আইন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যেসব হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ও পারসি ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও নিপীড়নের কারণে ভারতে চলে আসাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তার মানে ২০১৪ সালের পর থেকে যারা বাংলাদেশ থেকে গিয়ে গত প্রায় সাড়ে নয় বছর ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের বাংলাদেশে ফেরত আসতে হবে। এই সংখ্যা কত সেটি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশ তাদের ফেরত নিতে রাজি হবে কী না।
ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সিএএ বাস্তবায়নের পর জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) বাস্তবায়নেরও পরিকল্পনা রয়েছে বিজেপির। এটি কার্যকর হলে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে বহু মুসলিম ভারতের নাগরিকত্ব হারাতে পারেন এবং এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশ সীমান্তে। এ কারণেই অতীতের যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে ভারতের এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশ ইস্যুটি জড়িয়ে আছে নিবিড়ভাবে।
এ ব্যাপারে ভারত সফর শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘নাগরিকত্ব আইন ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। প্রতিবেশী হিসেবে আমরা নজর রাখছি।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই আইনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে। আইনের প্রয়োগ শুরু হলে সীমান্তে এ প্রভাব পড়তে পারে।’