সাগরের বুকে সকালেই দিনের তেজী সূর্যটা আলো ছড়াতে শুরু করে। আবার সন্ধ্যায় সাগরের পানিতে নিভে যায়। দিনের আলোয় কখনো লাল, কখনো সোনালি কিংবা নীল আকাশ সাগরের নোনা জলকেও ওই রঙে রাঙিয়ে তোলে। সারাক্ষণ পানির কসরত চলে সৈকতজুড়ে। দক্ষিণের মৃদু বাতাসে মন ও শরীর দুলিয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে। জেলের জালে দেখা যায় তাজা মাছের লম্ফঝম্প। দেখা মেলে দেশি-বিদেশি পাখির আপন উৎসব। পূর্ণিমার আলো রাঙিয়ে তোলে রাতের আঁধার। আছে লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি। দেখা মেলে হরিণ-বানরের লুকোচুরি। প্রকৃতি যেন দুই হাত মেলে তার রূপ-সৌন্দর্য উজাড় করে আছে উপকূলজুড়ে। কুয়াকাটা এবং এর আশপাশের চর ও দ্বীপগুলো এমন রূপ-রসের সৌন্দর্য বিলোচ্ছে বছরের পর বছর। প্রকৃতি কতটা উদার, তা পটুয়াখালীর উপকূল না ঘুরলে দেখা যাবে না।
কাউয়ার চর সৈকত
কুয়াকাটা সৈকত থেকে কাউয়ার চর সৈকতের দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার। কলাপাড়ার ধুলাসার ইউনিয়নের এই সৈকত স্থানীয়ভাবে গঙ্গামতি সৈকত নামেও পরিচিত। এ সৈকতের মূল বৈশিষ্ট্য হলো, চোখ জুড়ানো ঝাউবাগান। বন বিভাগের ঝাউগাছ দিয়ে সাজিয়ে রাখা আছে এই সৈকতটিকে। এ ছাড়া সকালবেলায় সৈকতের বালুকাবেলায় সারি সারি সাজানো থাকে জেলেদের নৌকার বহর, শেষ বিকালে তা সাগরে ভাসে মাছ শিকারের জন্য। এখান থেকেই অবলোকন করা যায় সাগরে সংগ্রামী জেলেদের জীবনযাত্রা।
যেভাবে যাবেন : গঙ্গামতি সৈকতে গিয়ে সূর্যোদয় উপভোগ করতে হলে খুব ভোরে কুয়াকাটা থেকে মোটরসাইকেল কিংবা অটোবাইক অথবা সংখ্যায় বেশি হলে বিচ কার নিয়ে যেতে পারবেন। যেহেতু কুয়াকাটা থেকে কাছেই, সেহেতু গঙ্গামতি ঘুরে আবার কুয়াকাটা চলে আসতে পারবেন।
চর বিজয় সৈকত
কুয়াকাটা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে উঠেছে একটি চর। বিজয়ের মাসে এর সন্ধান পাওয়ায় নাম রাখা হয় ‘চর বিজয়’। চরটি বর্ষার ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে। আবার পানি নেমে গেলে, বিশেষ করে শীত মৌসুমে চরের সৈকতে পুরো দখলে নিয়ে নেয় লাল কাঁকড়া। সৈকতজুড়ে দেখা যায় অসংখ্য পরিযায়ী পাখির ওড়াউড়ি। দুচোখ দিয়ে চারদিকে তাকালেই দেখা মেলে পানিতে ছোট বড় অসংখ্য মাছের নাচানাচি।
যেভাবে যাবেন: কুয়াকাটা সৈকত থেকে ট্যুরিস্ট বোর্ড কিংবা স্পিডবোট অথবা ট্রলার ভাড়া করে যেতে হবে ‘চর বিজয়’। যেহেতু দ্বীপটি বর্ষায় তলিয়ে যায়, তাই থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। সন্ধ্যায় আবার চলে আসতে হবে কুয়াকাটায়।
চর তুফানিয়া সৈকত
কুয়াকাটা থেকে থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে চর তুফানিয়া দ্বীপ। সাধারণত এটা লাল কাঁকড়ার নিরাপদ আবাসভূমি। ষাটের দশকে দ্বীপটি জেগে ওঠে। তুফানের সময় যেমন হয়, তেমনি বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ত বলে জেলেরাই নাম দিয়েছেন তুফানিয়া। এখানে রয়েছে ৫০০ একর বনাঞ্চল।
যেভাবে যাবেন : কুয়াকাটা থেকে সরাসরি ট্যুরিস্ট বোট কিংবা স্পিড বোট অথবা ট্রলারে করে আসতে হয় এ দ্বীপে। তবে এখানে কোনো থাকার ব্যবস্থা না থাকায় দুই কিলোমিটার দূরেই রয়েছে জাহাজমারা দ্বীপ, সেখানে যেতে হবে।
জাহাজমারা সৈকত
সৈকত লাগোয়া জলে নির্বিঘ্নে সাঁতার কাটছে মাছের দল। সাগরের ঢেউয়ের তালে তালে ছোট ছোট বিভিন্ন প্রজাতির মাছের দলের ছোটাছুটি চোখে পড়ে। এমন একটি জায়গার নাম জাহাজমারা। স্থানীয়দের দাবি, অনেক বছর আগে এই সৈকতে একটি জাহাজ আটকে পড়ে এবং ধীরে ধীরে সেই জাহাজটি বালুতে ডুবে যায়। এরপর থেকেই স্থানীয়রা জাহাজমারা সৈকত নামকরণ করে। চর তুফানিয়া থেকে ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জাহাজমারা সৈকত। পটুয়াখালীর সাগরঘেঁষা রাঙ্গাবালী উপজেলায় মৌডুবী ইউনিয়নে সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাহাজমারার প্রধান আকর্ষণ সূর্যাস্ত। এ ছাড়া সৈকতজুড়ে তরমুজের বিস্তীর্ণ মাঠ।
যেভাবে যাবেন: চর তুফানিয়া থেকে ওই পদ্ধতিতেই আসতে হবে এখানে। আর থাকতে চাইলে যেতে হবে রাঙ্গাবালীতে, ওখানে ডাকবাংলোসহ রয়েছে স্থানীয় কিছু হোটেলে থাকার ব্যবস্থা। অথবা ক্যাম্প করেও থাকা যাবে এখানে। এখান থেকে যাওয়া যাবে আর এক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সোনারচর সৈকতে।
সোনার চর সৈকত
এ জেলায় অবস্থিত আরেকটি নয়নাভিরাম সৈকতের নাম সোনার চর। সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময় লাল রং ধারণ করে এই সৈকত। তাই এর নামকরণ করা হয় সোনার চর। কুয়াকাটা সৈকত থেকে দক্ষিণে ১০ কিলোমিটার দূরে সাগরের মাঝে অবস্থিত সোনার চরের সৌন্দর্য।
সোনার চরে সুন্দরবনের মতোই রয়েছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এবং এর ভেতরে ছোট ছোট খাল। গোটা দ্বীপটি যেন সাজানো-গোছানো এক বনভূমি। রয়েছে কেওড়া, সুন্দরী, গড়ান, হেঁতাল, গোলপাতাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। নিভৃত সোনার চরে শুধু নানা ধরনের বৃক্ষের সমাহারই নয়, রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রাণীও। হরিণ, শিয়াল, মহিষ, বন্য শুয়োর, বানর এ বনের বাসিন্দা। রয়েছে চার কিলোমিটার সমুদ্রসৈকত। নগরের কর্মচাঞ্চল্য থেকে বহুদূরে এই সৈকতের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য এখনো অনেকের কাছে অজানা।
যেভাবে যাবেন: জাহাজমারা দ্বীপ থেকে সোনারচরের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। জাহাজমারা থেকে সরাসরি নদীপথে আসতে হবে সোনার চরে। চাইলে এখানে রাত যাপন করতে পারবেন তাঁবু করে। আর সোনার চর থেকে ১ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে আরেকটি দ্বীপ ‘চর হেয়ার’। সোনার চরের সৌন্দর্য উপভোগ করে চলে যাওয়া যাবে সেখানে।
‘চর হেয়ার’ সৈকত
এ দ্বীপটি গুগলে সার্চ করলে ‘চর হেয়ার’ নামে এলেও স্থানীয়দের কাছে একটি কলাগাছিয়ার চর নামে পরিচিত। চর হেয়ারের ভেতরটা পাখিদের কিচিরমিচির ও ঝরা পাতা দিয়ে ঢেলে সাজানো। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য রয়েছে এক বিশাল সৈকত।
যেভাবে যাবেন : সোনার চরের মতোই একইভাবে আসতে হবে এর হেয়ার দ্বীপে। তবে সোনার চর ও এখানে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই, তবে এর অধিকাংশ পর্যটক তাঁবু করে থাকেন। আর হোটেলে থাকতে চাইলে যেতে হবে ৫ কিলোমিটার দূরে চরমন্তাজ ইউনিয়নে। সেখানে রয়েছে কয়েকটি থাকার হোটেল এবং খাওয়ার ব্যবস্থা।
লেম্বুর চর সৈকত
কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্বে লেবুর বন অবস্থিত, যা স্থানীয়দের কাছে লেম্বুর চর বা নেম্বুর চর নামেও পরিচিত। এবং তিন নদীর মোহনায় এ সৈকতটি অবস্থিত হওয়ায় সূর্যাস্ত দেখার জন্য পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় জায়গা এই লেবুর চর। ১ হাজার একর আয়তনের লেবুর চরে আছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ; যেমন- কেওড়া, গেওয়া, গোরান, কড়ই, গোলপাতা ইত্যাদি।
যেভাবে যাবেন: কুয়াকাটার পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত হওয়ায় এই চরে কুয়াকাটা থেকে সহজেই যাওয়া যায়। সৈকতসংলগ্ন বেড়িবাঁধের ওপর থেকে মোটরসাইকেল, ভ্যান কিংবা যেকোনো যানবাহনে চরে যেতে পারবেন। চাইলে হেঁটেও যাওয়া যায়। এ ছাড়া কুয়াকাটা সৈকত থেকে স্পিডবোট কিংবা ট্রলারে যাওয়া যায়।
ফাতরার চর সৈকত
কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের জিরো পয়েন্ট থেকে পশ্চিমে ১০ কিলোমিটার গেলে চোখে পড়বে সবুজে ঘেরা, নীল জলরাশি সাগর মোহনার বুকে জেগে ওঠা ফাতরার বন বা ফাতরার চর নামক সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। এ যেন সাগরের বুকে ভাসমান কোনো অরণ্য। এর পাশেই ট্রলারে চেপে যখনই আপনি ফাতরার চরের খালে ঢুকবেন, তখনই আপনাকে স্বাগত জানাবে দুপাশের ঘন সবুজ অরণ্য। ট্রলারের জেটি পেরিয়ে আপনি চরের ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে টেংরাগিরি অরণ্য। এর ভেতরেই শান বাঁধানো একটি পুকুর ও বন বিভাগ নির্মিত একটি রেস্ট হাউস। মূলত চরে অস্থায়ীভাবে বসবাস করা মানুষের মিঠাপানির জন্য করা হয়েছে এই পুকুর। পুকুরপাড় দিয়ে আপনি এবার প্রবেশ করবেন ঘন গহিন অরণ্যে। প্রকৃতির এই নিস্তব্ধতার মাঝে ক্ষণে ক্ষণে ডেকে ওঠা পাখির ডাক আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্য জগতে। চরের পূর্ব অংশে রয়েছে একটি ছোট সমুদ্রসৈকত, ভাটার সময়ে আপনি নামতে পারেন এই সৈকতটিতে।
যেভাবে যাবেন: কুয়াকাটা থেকে প্রতিদিন সকালে থেকে ট্যুরিস্ট বোট পর্যটকদের নিয়ে বনের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। চাইলে রিজার্ভ নিয়েও যাওয়া যায়। এ ছাড়া স্পিডবোট কিংবা ট্রলারেও আসতে পারবেন। তবে দৃষ্টিনন্দন এই চরটিতে এখনো পর্যটকদের জন্য থাকার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই চাইলে তাঁবু করে থাকতে পারবেন অথবা আপনাকে ওইদিনই আবার ফিরে যেতে হবে কুয়াকাটায়।
শুভসন্ধ্যা সৈকত
নিদ্রা সৈকত থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকতের সাগরতীরের মুক্ত বাতাস এবং চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট টেংরাগিরির অংশ হওয়ায় সাগরপাড়ে সবুজের সমারোহের সাথে সাথে বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ চোখে পড়ে। প্রচলিত সমুদ্রসৈকতের তুলনায় এখানে দর্শনার্থীদের ভিড় কম থাকায় নিরিবিলিতে সময় কাটাতে পর্যটকদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছে শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত। এ ছাড়া উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ জোছনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয় এ সৈকতেই।
যেভাবে যাবেন: নিদ্রা সৈকত থেকে থেকে সরাসরি বোট নিয়ে সাগরপথে যাওয়া যায় শুভসন্ধ্যা সৈকতে এবং সড়কপথেও যাওয়া যায়। এ ছাড়া হেঁটে যেতে সময় লাগে মাত্র ২০ মিনিট। তবে শুভসন্ধ্যা সৈকতে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। চাইলে তাঁবু করে থাকা যায় অথবা তালতলীতে হোটেলে থাকতে হবে।
এসব সৈকতের সৌন্দর্য সহজেই উপভোগ করতে চাইলে স্থানীয় ‘জল তরণী’ নামের একটি ভ্রমণ গাইড রয়েছে; তাদের সহযোগিতা নিলে এসব সৈকতের যে কোনো জায়গায় তাঁবু করে থাকা সম্ভব। এর জন্য ‘জল তরণী’র রয়েছে আকর্ষণীয় আয়োজন।