আপনার বেড়াতে যাওয়ার তালিকায় যদি বগুড়ার মহাস্থানগড়, ভাসুবিহার অথবা বেহুলার বাসরঘর থাকে, তবে হাতে সময় নিয়ে আসাই ভালো হবে। কারণ এসব প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট ছাড়াও এ মৌসুমে বেড়াতে পারেন সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর চরেও। তবে বেড়াতে এসে কোথায় থাকবেন, কেমনভাবে আসবেন আর কত টাকা খরচ হতে পারে- এ রকম তথ্য জানা থাকা প্রয়োজন সব ভ্রমণকারী অথবা দর্শনার্থীর।
মৌর্যপূর্ব, মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন ও মুসলিমসহ বিভিন্ন আমলের নিদর্শন নিয়ে গড়ে তোলা মহাস্থান জাদুঘরের পাশাপাশি প্রাচীরঘেরা দুর্গনগরীর ভেতর আর বাইরে আছে নানা ধরনের ঐতিহাসিক নিদর্শন। যীশুখ্রিষ্টের জন্মের অন্তত ৩ বছর আগে গড়ে তোলা এ দুর্গনগরীর কাছেই পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে টিকে থাকা আরেক প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট বেহুলার বাসরঘর। সেখানে গেলে আপনার মনে হতে পারে, সত্যি এখানে বহু বছর আগে কোন এক দম্পতির জন্য তৈরি করা হয় বাসরঘর! এখানে কারও বাসরঘর ছিল কি না, এ তথ্যের কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই। তবে এখানে টিকে থাকা ঢিবিটি যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ছিল, সে ব্যাপারে রয়েছে অনেক প্রমাণ।
বেহুলার বাসরঘরের মতোই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ভাসুবিহার। চীনের পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বাংলা ভ্রমণের সময় এখানে অনেক বৌদ্ধভিক্ষু দেখতে পান। এর পাশেই আছে বিহার ধাপ নামে আরেকটি সাইট। শুধু তাই নয়, শেরপুরে আছে খেরুয়া মসজিদসহ দেখার অনেক কিছু। বগুড়া থেকে সুযোগ বুঝে যেতে পারেন নাটোরের উত্তরা গণভবন বা নাটোর রাজবাড়িতে। সহজেই যেতে পারেন নওগাঁয় বৌদ্ধবিহার বা পাহাড়পুরেও, যেখানে আছে পাল আমলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নিদর্শন। পাহাড়পুড়ের জাদুঘরটিও বেশ সমৃদ্ধ। এসব সাইটে বেড়াতে আপনি ঢাকা থেকে চাইলে আসতে পারেন ব্যক্তিগত গাড়ি বা কোচে। কোচের মান এবং কোম্পানিভেদে ভাড়া লাগতে পারে ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। তবে কখনো কখনো রাস্তায় যানজট হয়। সে কারণে হাতে সময় নিয়ে বের হওয়াই ভালো। ঢাকা থেকে বগুড়ায় আসতে সময় লাগে সাধারণত সাড়ে ৩ ঘণ্টা থেকে ৪ ঘণ্টা।
থাকার জন্য ভালো ভালো অনেক হোটেল-মোটেল আছে বগুড়ায়। পাঁচ তারকা হোটেল মম ইন, বনানী এলাকায় পর্যটন করপোরেশনের মোটেল, হোটেল ক্যাসেল সোয়াত, রেড চিলিজ, রোচাচ, ম্যাক্স মোটেলসহ শহর ও শহরতলিতে আছে অন্তত একশ হোটেল-মোটেল। মম ইন ছাড়া অধিকাংশ হোটেলের ভাড়া ডবল রুম ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যেই। মম ইন হোটেলে বেড়ানো এবং বিনোদনের অনেক রকম ব্যবস্থা আছে। রুম ভাড়ায় সাধারণত ৫০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়। তবে বিশেষ ছাড়ও থাকে দিবস ও মৌসুমকে কেন্দ্র করে। মম ইন হোটেলে বিনোদনের অন্যতম একটি আকর্ষণ হেলিকপ্টারে ভ্রমণ। ওয়াটার পার্কসহ বিভিন্ন রাইডারও আছে এই পাঁচ তারকা হোটেলে।
বগুড়া থেকেই থেকে যেতে পারেন নওগাঁয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজস্ব জমিদারি পতিসর কাছারিবাড়ি। কবি নোবেল বিজয়ের টাকায় এখানেই প্রথম গড়ে তোলেন কৃষি সমবায় ব্যাংক। তার স্মৃতি নিয়েই এখানে গড়ে তোলা হয়েছে দুটি জাদুঘর। জাদুঘরগুলোতে দেখা যাবে কবির স্মৃতিবিজড়িত নানা নিদর্শন।
নওগাঁর মান্দা উপজেলায় অপূর্ব নির্মাণশৈলীতে নির্মিত পাথরের তৈরি কুসুম্বা মসজিদ কয়েকশ বছরের ইতিহাস ধরে রেখেছে এখনো। এ ছাড়া আলতাদীঘি, মঙ্গলবাড়ি শিবমন্দির, আর জগদ্দল বিহারসহ প্রাচীন অনেক অবকাঠামো দেখা যাবে। জয়পুরহাটে আছে তাজপুর ধাপ।
সবচেয়ে বেশি ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং বেড়ানোর স্থান আছে বগুড়ায়। বগুড়ায় যেসব স্থানে বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেড়াতে পারেন তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ খোদার পাথর ভিটা, মানকালির মন্দির, জীয়ত কুণ্ড, বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা, শিলাদেবীর ঘাটসহ আরও অনেক স্থান। তবে বগুড়ায় বেড়াতে এলে সময় বেশি দিতে হবে পুণ্ড্রনগর ও মহাস্থানগড়কে কেন্দ্র করে থাকা অন্তত ৪৫টি প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে। ইতিহাস আর ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ওই সব স্থানের আছে নানা গল্প। তবে এসব স্থানে বেড়ানোর সময় ঐহিত্যবাহী খাদ্য যেমন দই ও কটকটির কথা ভুলবেন না।
বগুড়ায় এসে প্রথম যে স্থানে আপনি যেতে পারেন সেটা হলো মহাস্থান দুর্গনগরী ও জাদুঘর। জাদুঘরে যেসব নিদর্শন খুবই আকর্ষণীয় তার মধ্যে অন্যতম মাটির তৈরি একটি চুলা। এ চুলাটি যীশুখ্রিষ্টের জন্মের অনেক আগে তৈরি করা হয়। ফ্রান্স ও বাংলাদেশের যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া যায় এ চুলাটি।
জাদুঘরে থাকা নিদর্শনগুলো দেখতে হবে মনোযোগ দিয়ে; তা হলে কিছুটা হলেও বোঝা যাবে আমাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্য সম্পর্কে। করতোয়া নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পুণ্ড্রনগরকে যে দেয়ালটি ঘিরে রেখেছে, তারও গুরুত্ব অসাধারণ। দেয়ালের অনেক স্থানেই পাওয়া যায় ১০টি বসতির চিহ্ন। ফ্রান্স ও বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিকরা যৌথভাবে এ নগরীর বিভিন্ন স্থান খনন করে পেয়েছেন প্রাচীন অবকাঠামোর পাশাপাশি নানা ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।