কক্সবাজারকে বলা হয় দেশের পর্যটন রাজধানী। এই কক্সবাজারকে ঘিরে পর্যটনবলয় তৈরি করা হলে এ অঞ্চলে পর্যটকদের সমাগম বাড়বে। আকৃষ্ট করা যাবে বিদেশি পর্যটকদেরও। তেমনি এক আকর্ষণীয় স্থান হতে পারে মহেশখালী দ্বীপ। জানাচ্ছেন জাজাফী
বিশাল সাগরের জলরাশির মাঝে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি মহেশখালী দ্বীপ। বাঁকখালী নদীর কিছু অংশ এবং বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যেতে হয় মহেশখালী। আবার চকরিয়া উপজেলার বদরখালী-মহেশখালী সংযোগ ব্রিজ হয়ে সড়কপথেও যাওয়া যায় এই দ্বীপে।
কক্সবাজার থেকে এটি মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরত্বে প্রায় ৩৬২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের মহেশখালী উপজেলায় সোনাদিয়া, মাতারবাড়ী, ধলঘাটা নামে তিনটি দ্বীপ রয়েছে। ১৮৫৪ সালে গড়ে ওঠে এই দ্বীপ। তবে জনশ্রুতি আছে, ১৫৫৯ সালের প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়। কক্সবাজার থেকে ৪-৫ ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেই মহেশখালী দ্বীপ থেকে ঘুরে আসা যায়।
গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য সারি সারি পানের বরজ আর সুপারি বাগান, পাহাড়ি কাঠ, ফল-ফলাদির বাগান, লবণের মাঠ, মাছের ঘেরের নয়নাভিরাম দৃশ্য, ফসলের সবুজ-শ্যামল মাঠ ও প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য সবাইকে আনমনা করে। সোনাদিয়ার শুঁটকি উৎপাদন ক্ষেত্র ও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা জেলেদের হৈ-হুল্লোড়, সৈকতে ঝুড়ি হাতে শামুক কুড়ানো বালক-বালিকাদের চপলতা, ধান ও লবণচাষিদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির ফাঁকে ফাঁকে ক্লান্তিনাশী ভাটিয়ালি এবং আঞ্চলিক গান আর ভরা জোয়ারে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ মনকে আন্দোলিত করে।
মহেশখালী বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়িয়া দ্বীপ। এ দ্বীপের মৈনাক পর্বতের ওপরে রয়েছে আদিনাথ মন্দির। এ দ্বীপের কারুকার্য এখানে আসা দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। এ ছাড়াও বছরের ফাল্গুন মাসে এখানে আদিনাথ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে রয়েছে বেশকিছু বৌদ্ধবিহার, জলাবন ও নানা প্রজাতির পশুপাখি। এ ছাড়াও আছে রাখাইনপাড়া ও স্বর্ণমন্দির। চলতি পথেই দেখা মিলবে পান-বাগান আর লবণের মাঠ। মহেশখালীর পানের সুনাম সারা বাংলাদেশে।
পযর্টন ও অর্থনৈতিকভাবে অপার সম্ভাবনাময় মহেশখালী দ্বীপের রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা, যোগাযোগব্যবস্থার বেহাল অবস্থা, স্বাস্থ্য খাতে অরাজকতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এ অঞ্চলের মানুষকে ব্যথিত করে। ফলে পযর্টনশিল্পের প্রসারও সেভাবে ঘটছে না। শহরের সঙ্গে এই দ্বীপের মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌকা বা স্পিডবোট।
তবে কক্সবাজারকে সত্যিকারের পর্যটননগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে কক্সবাজার শহরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে নতুন নতুন পর্যটন স্পট সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগর তনয়া মহেশখালীকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করতে হবে এবং মহেশখালীর পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। দ্বীপ অঞ্চলটিকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত করা যেতে পারে। মহেশখালীর রাখাইনপল্লী ও ক্যাংসমূহের প্রয়োজনীয় সংস্কার, রাখাইনদের হস্তশিল্প ও সংস্কৃতি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে একটি স্বতন্ত্র রাখাইন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে তাকে একটি পর্যটন স্পটে পরিণত করা যেতে পারে।
মহেশখালীর পর্যটন সম্ভাবনার অন্যতম প্রতিবন্ধক হলো দুর্গম যোগাযোগ ও অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আদিনাথ স্পটে প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক আগমন করে থাকেন। আসা-যাওয়ার পথে তাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়। মহেশখালীর প্রতি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে কক্সবাজার-মহেশখালী চ্যানেলে পর্যাপ্ত স্পিডবোট, নৌকা, লঞ্চ ও সি-ট্রাক চালুপূর্বক অস্বাভাবিক ভাড়া বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মহেশখালী থানা প্রশাসনকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে আদিনাথ অঞ্চলে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা যেতে পারে। বাঁকখালী ও মহেশখালী চ্যানেলের ভরাট হওয়া নদী ড্রেজিংয়ের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মহেশখালীতে স্থলপথে যাতায়াতের প্রধান সড়ক গোরকঘাটা-জনতা বাজার সড়কের ২৭ কি. মি. রাস্তা পাকা করতে হবে। মহেশখালীতে বাস্তবায়নাধীন কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প ও প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর পর্যটন সম্ভাবনার এক নবদ্বার উন্মুক্ত করবে। পর্যটনের ব্যবসায়িক সুবিধার্থে মহেশখালীর সঙ্গে কক্সবাজার শহরের সরাসরি স্থল যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে যমুনা কিংবা পদ্মা সেতুর ন্যায় একটি সেতু নির্মাণ করা যেতে পারে।
কক্সবাজার সদর থেকে মহেশখালী পর্যন্ত কেবল কারের ব্যবস্থা করলে পযর্টকদের আগ্রহ বাড়বে। এখান থেকে সরকারের বড় অংকের আয় হবে, যা পযর্টনশিল্পকে আরও এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে। তবে দ্বীপের অনন্য বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে অবশ্যই এখানে বড় বড় হোটেল-মোটেল করা যাবে না। তার বদলে কটেজ তৈরি করা যেতে পারে। যেহেতু কক্সবাজার শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয়, তাই পযর্টকরা অনায়াসেই মহেশখালী ঘুরে শহরে ফিরে আসতে পারবেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলে এবং যাতায়াত ব্যবস্থা ঠিক করতে পারলে সারা বছরই এই অঞ্চলটি হতে পারে পযর্টকদের জন্য শীর্ষ পছন্দের জায়গা।
জাহ্নবী