
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) প্রশাসন আইন অমান্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন কিছু শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সুবিধা দিয়ে আসছে। এতে বছরে প্রায় ১ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আবাসিক ভবনগুলোতে নীতিমালা অনুযায়ী ভাড়া আদায় না করায় এ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
বেরোবির ২০১৯, ২০২১ ও ২০২৩ সালের বাজেট পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এতে ইউজিসির বাজেট পরীক্ষক দল বিভিন্ন অসংগতি খুঁজে পায় এবং সে অনুযায়ী রিপোর্ট দেয়। তবে তা তোয়াক্কা করছে না বেরোবি প্রশাসন। অবৈধ সুবিধা দেওয়ায় এ পর্যন্ত কয়েক কোটি টাকা গচ্চা গেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করেছে ইউজিসি।
পরীক্ষক দলের রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৯টি অসংগতির মধ্যে প্রথম অসংগতি হিসেবে বাড়ি ভাড়ায় অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনে বসবাসরত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছ থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে নির্দিষ্ট হারে বাড়ি ভাড়া কর্তন করা হচ্ছে। তদন্ত দল সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বাড়ি ভাড়া কর্তন করার জন্য অনুরোধ করে।
বাজেট পরীক্ষক দল ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৭টি আর্থিক অনিয়ম খুঁজে পায়। সেখানে ২ নম্বরে একই অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়। রিপোর্টে জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর অনুচ্ছেদ ১৭-এর উপ-অনুচ্ছেদ (২) অনুসরণ করে কোয়ার্টারে বসবাসরতদের থেকে পূর্ণ বাড়ি ভাড়া কর্তনের অনুরোধ করে। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত সুবোধাভোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা করার জন্য বলা হয়।
জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর অনুচ্ছেদ ১৭-এর উপ-অনুচ্ছেদ (২)-এ বলা আছে, যেসব কর্মকর্তা সরকারি বাসভবনে থাকবেন তারা বাসা ভাড়া প্রাপ্য হবেন না, সে অনুযায়ী আবাসিক ভবনে বসবাসকারী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বাড়ি ভাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাওয়ার কথা।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুরো টাকা আদায় না করে ৭৫০ থেকে ৮০০ স্কয়ার ফিটের বাসার জন্য নামমাত্র মূল্যে মাসিক ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা বাড়ি ভাড়া হিসেবে কর্তন করে থাকে। যেখানে মূল বেতনের ৪০-৫৫ শতাংশ পর্যন্ত কর্তন করার কথা, সেখানে নামমাত্র কর্তন করাকে অবৈধ মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইউজিসির বাজেট পরীক্ষক দল মোট ২৫টি আর্থিক অনিয়ম খুঁজে পায়। সেখানেও বিধিবহির্ভূতভাবে বাড়ি ভাড়া কম কর্তনের কথা উল্লেখ করে বছরে ৭৫ লাখ ২০ হাজার টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে বলে জানানো হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলা হয়, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাসা ভাড়া কর্তন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আবাস্থল নির্মিত না হওয়ায় সাময়িকভাবে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে সেখানেও ইউজিসি অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে। ইউজিসি তার ফিরতি চিঠিতে উচ্চ গ্রেডধারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাসা বরাদ্দ না দিয়ে নীতিমালা অনুযায়ী জুনিয়র শিক্ষক, কর্মকর্তাদের দিতে বলে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক বা জুনিয়র কর্মকর্তার মধ্যে কেউই বাসা বরাদ্দ পাননি। এমনকি সর্বশেষ নতুন উপাচার্য ড. মো. শওকাত আলী দায়িত্ব নেওয়ার পর নীতিমালা লঙ্ঘন করে আওয়ামীপন্থি সিনিয়র শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বাসা বরাদ্দ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সর্বশেষ আবাসন নীতিমালা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, নিয়ম অমান্য করে আওয়ামীপন্থি ৫ জন শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে ডরমেটরি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ডরমেটরি বরাদ্দের নীতিমালায় অবিবাহিত প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক এবং সহকারী রেজিস্ট্রারদের বাসা বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাদের আবাসিক হলে উচ্চ হারে ভাড়া আদায় করা হয়। অন্যদিকে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কম ভাড়া আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বৈষম্য সৃষ্টি করছে। শিক্ষার্থীরা যেখানে কোনো বরাদ্দ বা ভর্তুকিই পান না, সেখানে গুটিকয়েক শিক্ষক ও কর্মকর্তার জন্য বছরে কোটি টাকা গচ্চা দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
শহিদ মুখতার ইলাহী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সাকিব ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক হল রয়েছে তিনটি। এগুলোতে পর্যাপ্ত সিট না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী বাইরে মেস ভাড়া নিয়ে থাকেন। হলে নেই পর্যাপ্ত সুবিধা। কোনো ভর্তুকি নেই। আর এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডরমেটরিতে থাকা শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য বছরে কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। অন্যদিকে ডরমেটরিতে শুধু প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক থাকার কথা থাকলেও সেখানে উচ্চ গ্রেডের শিক্ষক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকরা থাকেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয় জুনিয়র শিক্ষকদের প্রতিও বৈষম্য করা হচ্ছে। তারা বাইরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন।’
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী শামসুর রহমান সুমন বলেন, ‘ডরমেটরি নিয়ে বিগত প্রশাসনের সময়ে যে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা এবং দুর্নীতি হয়েছে, সেটির পুনরাবৃত্তি চাই না। যথাযথ নীতিমালা অনুসরণ করে সেটির বরাদ্দ দেওয়া এবং যৌক্তিক ভাড়া গ্রহণ করতে হবে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজস্ব সমৃদ্ধ হয়।’
এ বিষয়ে উপাচার্য ড. মো. শওকাত আলী বলেন, ‘আবাসন নিয়ে আমরা নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ডরমেটরিতে কেউ থাকতে পারবেন না। আর ডরমেটরির ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা চলছে। পরবর্তী সেশন থেকে ভাড়া বৃদ্ধি করা হবে।’