খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার দুই ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট (ভিডব্লিউবি) প্রকল্পে ৬৩৭ দুস্থ নারীর সঞ্চয়ের ১৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৮০ টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীন পরিচালিত এই প্রকল্পে প্রতি মাসে ২২০ টাকা সঞ্চয় জমা দেওয়ার বিপরীতে দুস্থ নারীদের ৩০ কেজি করে চাল দিচ্ছে সরকার। তবে পানছড়ি সদর ও চেঙ্গী ইউনিয়নের ৬৩৭ উপকারভোগীর টাকার বিষয়ে অবগত নন বলে জানান সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা।
পানছড়ি ইউএনও কার্যালয় সূত্র জানায়, হতদরিদ্র নারীদের স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীন দুই বছর (২০২৩-২০২৪) মেয়াদি ভিডব্লিউবি প্রকল্প চালু করে সরকার। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় পরিচালিত হয় এই প্রকল্প। প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী উপকারভোগীদের প্রত্যেকের নিজ নামে ব্যাংকে হিসাব খুলতে হবে। ওই নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, উপকারভোগীদের স্ব-স্ব ব্যাংক হিসাবে প্রতি মাসে ২২০ টাকা করে সঞ্চয় জমা দিতে হবে। এরপর সঞ্চয় জমাদানের রসিদ দিয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বরাদ্দকৃত ৩০ কেজি চাল বুঝে নেবেন তারা। আর জমাকৃত (সঞ্চয়) টাকা প্রকল্পের মেয়াদ শেষে (দুই বছর পর) সুদসমেত ফেরত পাবেন উপকারভোগীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পানছড়ি উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের মোট ১ হাজার ৩৬৩ জন অসহায় ও দুস্থ নারীকে উপকারভোগী হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এর মধ্যে পানছড়ি সদর ইউনিয়নে উপকারভোগী রয়েছেন ৪২৭ এবং চেঙ্গী ইউনিয়নের রয়েছেন ২১০ জন। উপজেলার অন্য তিনটি ইউনিয়নের ৭২৬ জন উপকারভোগী নিজেরাই নিজেদের অ্যাকাউন্টে সঞ্চয়ের টাকা জমা দিচ্ছেন। তবে পানছড়ি ইউনিয়ন ও চেঙ্গী ইউনিয়নে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। এই দুটি ইউনিয়নের ৬৩৭ জন উপকারভোগীর কাছ থেকে প্রতি মাসে সঞ্চয়ের টাকা নেওয়া হলেও গত এক বছরে তাদের ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা জমা দেওয়া হয়নি। প্রতি মাসে জনপ্রতি ২২০ টাকা করে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে উপকারভোগীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে মোট ১৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৮০ টাকা। আর তা লোপাট করেছেন সংশ্লিষ্ট দুই ইউপির চেয়ারম্যান। এ ছাড়া ব্যাংক হিসাব খোলার সময়ও অনিয়ম হয়েছে। ওই দুই ইউনিয়নের ৬৩৭ উপকারভোগীর ব্যাংক হিসাব খোলা হয় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পানছড়ি এজেন্ট শাখায়। চেঙ্গী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনন্দ জয় চাকমা নিজেই ব্যাংকের ওই এজেন্ট শাখাটি পরিচালনা করেন। প্রকল্পের নীতিমালায় উপকারভোগীরা নিজেদের সুবিধামতো নিকটস্থ যেকোনো ব্যাংকে হিসাব চালু করার কথা বলা হয়েছে। তবে পানছড়ি সদর ও চেঙ্গী ইউনিয়নের উপকারভোগীদের হিসাব খুলতে বাধ্য করা হয়েছে চেয়ারম্যান আনন্দ জয় চাকমার পরিচালনাধীন এজেন্ট ব্যাংকে। দুস্থ নারীদের ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও সে সময় জোরপূর্বক তিনি ৫০০ টাকা করে নিয়েছেন উপকারভোগীদের কাছ থেকে।
উপকারভোগীদের সঞ্চয়ের টাকা জমা না দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পানছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান উচিত মনি চাকমা বলেন, ‘উপকারভোগীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা রাখলে তারা সঞ্চয়ের টাকা তুলে ফেলতে পারেন। তাই টাকাগুলো অন্য একটা অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে।’
অন্য যে ব্যাংক হিসাবে টাকা রাখা হয় সেটি কার নামে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার ইউনিয়ন পরিষদের সচিব জানেন। আপনি তার সঙ্গে কথা বলুন।’
এদিকে পানছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, ‘চেয়ারম্যান উচিত মনি চাকমার নির্দেশ অনুযায়ী আমি ৪২৭ উপকারভোগীর কাছ থেকে প্রতি মাসে জনপ্রতি ২২০ টাকা করে মোট ৯৩ হাজার ৯৪০ টাকা উত্তোলন করি। সেই টাকা চেঙ্গী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনন্দ জয় চাকমার কাছে দিয়ে আসি। সেই টাকা তিনি কোন অ্যাকাউন্টে জমা রাখেন, সেটি আমার জানা নেই।’
একই বিষয়ে জানতে চাইলে চেঙ্গী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনন্দ জয় চাকমা বলেন, ‘দুই ইউনিয়নের অনেক উপকারভোগীর ব্যাংক হিসাব এখনো পরিপূর্ণভাবে চালু হয়নি। তাই অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা রেখেছি।’
তবে কার অ্যাকাউন্টে টাকা রেখেছেন, সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছুই বলেননি তিনি।
পানছড়ি উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মনিকা বড়ুয়া বলেন, ‘চেঙ্গী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনন্দ জয় চাকমা মৌখিকভাবে আমাকে জানিয়েছেন ব্যাংকে টাকা জমা হচ্ছে। তবে উপকারভোগীদের ব্যাংক হিসাবের স্টেটমেন্ট চাইলে তিনি (চেয়ারম্যান) পরে দেবেন বলে জানান।’
পানছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভিডব্লিউবি কমিটির সভাপতি অঞ্জন দাশ বলেন, ‘আমি এখানে নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’