মির্জা আব্বাস বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী, সাবেক মন্ত্রী এবং অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র। ২০০১ সালে তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী এবং ১৯৯১ সালে ঢাকার মেয়র নিযুক্ত হন। বর্তমানে তিনি বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম ‘জাতীয় স্থায়ী কমিটি’র সদস্য। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হাত ধরে এ দলে যোগদান করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির চলমান রাজনীতি, আন্দোলন-কর্মসূচি এবং সাম্প্রতিক নানা ইস্যু নিয়ে খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার মো. শফিকুল ইসলাম
খবরের কাগজ: ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন ও আন্দোলনে বিএনপির অর্জন সম্পর্কে জানতে চাই।
মির্জা আব্বাস: বিএনপি দেশের জনগণকে ভোট বর্জনের পক্ষে রায় দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং জনগণ আমাদের কথা শুনেছে। আমরা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় দেশের জনগণও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি।
সম্প্রতি ভারতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার-অন্যায়-অত্যাচার করে কারাগারে পাঠিয়ে নির্বাচন করেছে। এখন বাংলাদেশ স্টাইলে মোদি সরকারও ভারতে নির্বাচন করতে চায়। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে যে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হয়নি এবং বিএনপি সেখানে সফল হয়েছে।
খবরের কাগজ: সামগ্রিকভাবে দেশটি কোথায় আছে, কোন দিকে যাচ্ছে?
মির্জা আব্বাস: সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে দেশের বর্তমান অবস্থা খারাপ। একে কয়েক ভাগে ভাগ করা যাবে। এগুলো হলো- দেশের রাজনৈতিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থান, ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিস্থিতি এবং সামাজিক অবস্থান। বর্তমান পেক্ষাপটে দেশে যা হচ্ছে, এগুলো নিয়ে দেশ ও বিদেশে আমরা ভালো অবস্থানে নেই।
খবরের কাগজ: বর্তমান সরকারের সামনে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে?
মির্জা আব্বাস: সরকারের এখন টিকে থাকাটাই তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। ‘মারি অরি, যেভাবে পারি’- এটা একটা সাংস্কৃতিক শ্লোক। মারি অরি, যেভাবে পারি- শত্রুকে যেভাবে সম্ভব নিপীড়ন করে ক্ষমতায় থাকতে হবে, বিরোধীদের দমন করতে হবে- এটাই হলো বর্তমান সরকারের নীতি।
খবরের কাগজ: আপনাদের নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় হয়নি, এটি আন্দোলনের ব্যর্থতা নয় কি?
মির্জা আব্বাস: সরকার যেখানে অস্ত্রের মাধ্যমে টিকে থাকতে চায়, সেখানে ব্যর্থতার প্রশ্ন একেবারেই আসে না। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আমরা সফল। আমাদের যুদ্ধ সরকারে যাওয়ার জন্য নয়, দেশটাকে বাঁচানোর জন্য, দেশের মানুষকে গণতন্ত্রের স্বাদ দেওয়ার জন্য। কিন্তু সরকার তার লাঠিয়াল বাহিনী ও প্রাতিষ্ঠানিক বাহিনীগুলোকে অস্ত্র-লাঠি, বন্দুক-পিস্তল দিয়ে বিরোধী দল দমনে ব্যবহার করছে।
খবরের কাগজ: নির্বাচনের দিন হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি থাকলেও পরে আপনারা কঠিন কর্মসূচি থেকে সরে এসেছেন। এর কারণ কী?
মির্জা আব্বাস: হরতাল-অবরোধ রাজনৈতিক কর্মসূচি। এটা বিরোধী দলগুলোর একটা অস্ত্র। আমরা আমাদের প্রতিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহার করি। কিন্তু এই মারাত্মক অস্ত্র যথেচ্ছ ব্যবহার করা বিএনপি পছন্দ করে না। যখন যেখানে প্রয়োজন হবে, সেখানে ব্যবহার করবে।
খবরের কাগজ: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে, স্থায়ী কমিটির অনেকে অসুস্থ- এমন পরিস্থিতিতে নেতৃত্বের অভাব আছে কি না?
মির্জা আব্বাস: নেতা ও নেতৃত্ব এক জিনিস না। নেতা হয়তো চোখের দৃষ্টির বাইরে আছেন, কিন্তু তার নেতৃত্বে দল সঠিক পথেই আছে। আমি মনে করি, দলে নেতৃত্বের কোনো ব্যর্থতা নেই। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তার সঙ্গে আমাদের রেগুলার কথা হয়। দূর থেকে দল পরিচালনা করলেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কারণ এখন তো ডিজিটাল যুগ। যখন ডিজিটাল সিস্টেম ছিল না, প্রায় ৪০ বছর আগে- তখন আয়াতুল্লাহ খোমেনি ফ্রান্সে নির্বাসিত থেকেও ইরানের বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সম্প্রতি পাকিস্তানে ইমরান খান জেলে বসে নির্বাচন করেছেন, সেখানে তার দলের নেতারা নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেছেন। সুতরাং বিএনপিতে নেতৃত্বের কোনো সংকট নেই। বিএনপির নেতৃত্বের সংকট নিয়ে কথা বলছে সরকার। এর কারণ সরকার নিজেই সংকটে আছে। তো, আমাদের এত সংকট থেকে থাকলে সাহস করে সরকার একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন দিক না। দেখি কারা জয়লাভ করে।
খবরের কাগজ: পাঁচ বছর পর নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করবেন, নাকি আন্দোলনে যাবেন?
মির্জা আব্বাস: পাঁচ বছর তো অনেক দীর্ঘ সময়। পাঁচ বছর অপেক্ষা করার মতো অবস্থা আমাদের খুব একটা নেই। নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করা এক জিনিস, আর আন্দোলন করে সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো আরেক জিনিস। আমরা মনে করি, সরকারের ব্যর্থতার সুযোগে যদি আমরা আন্দোলন সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারি, তাহলে এ সরকার টিকে থাকতে পারবে না।
খবরের কাগজ: ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতারা আন্দোলনে সেভাবে কেন মাঠে থাকছেন না, কমিটি বারবার কেন ব্যর্থ হচ্ছে?
মির্জা আব্বাস: এ ব্যাপারে আমার কমেন্ট করা একটু ডিফিকাল্ট। কারণ ওই সময়ে আমিসহ সিনিয়র নেতারা কারাগারে ছিলাম। ২৮ অক্টোবরের পর সারা দেশের বহু লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। ফলে আন্দোলন কিছু সময়ের জন্য দিকনির্দেশনাহীন ছিল। সুতরাং আন্দোলনের সময় মহানগরের নেতারা যারা ছিলেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন। এটাকে আমরা ব্যর্থতা বলব না।
খবরের কাগজ: বিএনপির সামনে এখন কী চ্যালেঞ্জ আছে?
মির্জা আব্বাস: ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপির সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করে না। বিএনপি দেশের মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে আগ্রহী, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখা নিয়েই চিন্তিত বিএনপি।
খবরের কাগজ: বিগত সময়ে দল থেকে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদের ফেরানোর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত আছে কি না?
মির্জা আব্বাস: বহিষ্কৃতদের ফেরানোর ব্যাপারে দল এখনো পর্যন্ত কোনো চিন্তাভাবনা করেনি। যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদের আগে জানানো হয়েছিল যে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দলের কঠোর অবস্থানই বহাল রয়েছে। দল যদি কখনো মনে করে, তখন শিথিল করবে।
খবরের কাগজ: বিএনপির কাউন্সিল অনুষ্ঠানের কোনো চিন্তাভাবনা আছে কি?
মির্জা আব্বাস: আশা করি, বিএনপির কাউন্সিল যথাসময়ে হবে।
খবরের কাগজ: নিত্যপণ্যসহ সবকিছুর দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই ইস্যুতে আপনাদের দল আরও সক্রিয় আন্দোলন করছে না কেন?
মির্জা আব্বাস: আমরা প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির বিষয়টা জনগণের সামনে তুলে ধরছি। দলের পক্ষ থেকে নিয়মিত ব্রিফিং করা হচ্ছে। নেতারা তাদের বক্তৃতায় সেটা তুলে ধরছেন। এখন এ সরকারের কাছে আমরা যতই প্রতিবাদ করি না কেন, তাতে কোনো লাভ আছে কি? বর্তমানে ৩০ শতাংশ ট্যাক্সের স্লট বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, আর অর্থমন্ত্রী বলছেন এই ট্যাক্স ধনী শ্রেণির জন্য। আরে ভাই, ধনী লোক ট্যাক্স দেয়, তাদের এখন গরিব বানাতে হবে? সবচেয়ে মজার বিষয়, ট্যাক্স না দিয়ে এই বৈধ টাকাই যদি ধনীরা অবৈধ দেখায়, তখন তাদের ট্যাক্স হবে ১৫ শতাংশ।
খবরের কাগজ: কালোটাকা সাদা করার প্রচলন তো বিএনপিই প্রথম চালু করেছিল- এমন কথা তো শোনা যায়?
মির্জা আব্বাস: হ্যাঁ, এটা আমাদের সময়ে হয়েছিল। তবে ওই সময়ের প্রেক্ষাপট আর আজকের পেক্ষাপট এক না। ওই সময়ে এত দুর্নীতি ছিল না। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান অনেক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন, একজন ভিশনারি নেতা ও মন্ত্রী ছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, বহু লোকের কাছে টাকা আছে, তারা ভয়ে সিন্দুকে লুকিয়ে রেখেছেন।
তাই তিনি মানি সার্কুলেশন আনার জন্যই চালু করেছিলেন। বৈধ টাকাও যদি কেউ জমিয়ে রাখে, তাহলে তা মানুষের কাছে যাবে না। আজকে দেশে মানি সার্কুলেশন তো নেই। একশ্রেণির মানুষ বিদেশে সবকিছু নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন। আওয়ামী লীগের যারা অবৈধভাবে টাকা কামিয়েছেন, তাদের বৈধ করার একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
খবরের কাগজ: দলের ভেতরে কোন্দল-গ্রুপিংয়ের কথা শোনা যায়, এটি কোনো চ্যালেঞ্জ কি না?
মির্জা আব্বাস: দলের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা আছে, কিন্তু বিভাজন-কোন্দল নেই। এত বড় দলের ভেতরে একটা প্রতিযোগিতা থাকবে- এটা স্বাভাবিক। তবে প্রতিযোগিতা শত্রুতায় পরিণত হয়েছে, এমন নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি।
খবরের কাগজ: সরকার পাঁচ বছর পূর্ণ করতে পারলে বিএনপির ভূমিকা কী হবে?
মির্জা আব্বাস: সরকার টিকে গেছে, টিকে যাচ্ছে- যদি এমনই হয়, তাহলে আমাদের দায়িত্ব হবে জনগণকে আরও সচেতন করা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ দেশের সার্বিক অবস্থা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা এবং তাদের সচেতন করে তোলা হবে।
খবরের কাগজ: ভারতের কাছে বিএনপির প্রত্যাশা কী?
মির্জা আব্বাস: ভারত একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। বিশ্বের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ। আর বাংলাদেশ আলাদা স্বাধীন-সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশ। ভারতের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশকে তারা একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা দিয়ে পাশে থাকবে।
খবরের কাগজ: খবরের কাগজের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
মির্জা আব্বাস: খবরের কাগজকেও ধন্যবাদ।