চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেছেন, চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে যে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তা ত্রুটিপূর্ণ। স্লুইস গেটগুলোর প্রশস্ততা কম। যে কারণে পানি নিষ্কাশন কম হবে। তা ছাড়া প্রকল্পের কাজ শেষে সেটির পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের বিষয়টি প্রকল্পের মধ্যে নেই। অথচ এটি পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে বিশাল অঙ্কের অর্থ এবং জনবলের প্রয়োজন, যা প্রকল্পটির বড় ত্রুটি। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা এবং তা নিরসনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নানা পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের চট্টগ্রামের ব্যুরোপ্রধান ইফতেখারুল ইসলাম।
খবরের কাগজ: কীভাবে চট্টগ্রাম মহানগরের জলাবদ্ধতা নিরসন করতে চান?
ডা. শাহাদাত হোসেন: তিন ধাপে জলাবদ্ধতা নিরসন করতে চাই। স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি। প্রাথমিক ধাপে শহরের ৫৬টি খালের মধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ৩৬টি খালের সংস্কারকাজ করছে। চসিক করছে বারৈপাড়া খাল খননের কাজ। বাকি খালগুলোও আমাদের সংস্কার করতে হবে। প্রাথমিক স্টেজে আমরা আবর্জনা পরিষ্কার করছি। যাতে আসন্ন বর্ষা আমরা সামাল দিতে পারি। আমাদের কাজ ঠিকমতো চলছে। এই কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারলে জলাবদ্ধতার অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের মধ্যে রয়েছে ২১টি খালের সংস্কারকাজ। এ নিয়ে চায়না পাওয়ারসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে আমরা আলোচনা করছি। তারা খাল সংস্কার করে দেবে।
খবরের কাগজ: চসিক শতভাগ আবর্জনা সংগ্রহ করতে পারে না। অন্যদিকে মানুষও খাল-নালায় ময়লা ফেলে। এ বিষয়ে চসিকের পরিকল্পনা কী?
ডা. শাহাদাত হোসেন: তৃতীয় পর্যায় তথা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই কাজটি করছি। আপনারা দেখেন, জনগণকে এত সচেতন করার পরও কোনো কাজ হচ্ছে না। জনগণ প্লাস্টিক, পলিথিন, ককশিট ব্যবহার করছে। খালকে গার্বেজ স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করছে। এটা আমাদের বড় সমস্যা। ময়লাকে সম্পদে পরিণত করতে হবে। এ নিয়ে বেশ কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের আলাপ-আলোচনা চলছে। দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস, জাপানের বেশ কিছু কোম্পানি এই কাজে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের সঙ্গে একমত হলে আমরা চুক্তিতে যাব। তারা আবর্জনা থেকে বায়ুগ্যাস এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। তখন আবর্জনা আর খালে পড়বে না। আমরা এ কাজে শিশুদেরও সম্পৃক্ত করতে চাই। তাদের হেলথ কার্ড দিচ্ছি। আবর্জনা কোথায় ফেলবে, কীভাবে পরিষ্কার হবে সেসব শেখানোর চেষ্টা করছি। এই কর্মসূচিতে সিটি করপোরেশনের স্কুলের পাশাপাশি বাইরের স্কুলের শিক্ষার্থীদেরও সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে শিশুরা সচেতন হলে তারা যখন বড় হবে নগরবাসী তখন এর সুফল পাবে। তা ছাড়া ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান করার চিন্তা করছি।
খবরের কাগজ: আমরা জানি সিডিএও মাস্টারপ্ল্যান করছে। তাতে কি চসিকের সঙ্গে সিডিএর কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি হবে না?
ডা. শাহাদাত হোসেন: আমাদের স্টাডিতে থাকবে কোন খাল কোন পয়েন্ট থেকে উৎপন্ন হয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে। তার শাখা খাল কী ছিল সব কটি বের করা। আমরা শুধু ৫৭টি খাল নিয়ে কাজ করব। পানিপ্রবাহের বাধা কোথায়। এসব বের করব। তাই দ্বন্দ্ব হওয়ার সুযোগ নেই।
খবরের কাগজ: শহরের খালে নৌযান চালানোর কোনো পরিকল্পনা আছে?
ডা. শাহাদাত হোসেন: আমার বাড়ি বাকলিয়া ডিসি রোডের পাশে। ছোটকাল থেকেই দেখেছি চাক্তাই খালে নৌযান প্রবেশ করছে। আমার আগে যারা মেয়র ছিলেন, তারা মনে করেছেন খালের তলা পাকা করলে আবর্জনা জমবে না। কিন্তু এই ভুল সিদ্ধান্ত খালের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তলা পাকা করার কারণে ভূগর্ভে পানি প্রবেশ করতে পারেনি। যে কারণে খালের চরিত্র পরিবর্তন হয়ে গেছে। আল্লাহ একেক জিনিসকে একেকভাবে সৃষ্টি করেছেন। নদী, খাল, পাহাড়, ছড়ার ওপর গবেষণা করতে গিয়ে যদি উল্টাপাল্টা করে ফেলি, তাহলে তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া হবে। নদীপ্রবাহ বন্ধ করছি, পাহাড় কাটছি, তার প্রতিশোধ প্রকৃতি নেবে। আমাদের দোষে আমরা কষ্ট পাচ্ছি। মহেশ খালে এখনো নৌযান চলে। অন্যান্য খালেও নৌযান চালানোর পরিকল্পনা আছে।
খবরের কাগজ: খাল বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়েছেন। এ নিয়ে আলোচনা এবং সমালোচনা দুটিই আছে।
ডা. শাহাদাত হোসেন: জিইসি মোড়ে জলাবদ্ধতা হয়। অনেক প্রকৌশলীকে সেখানে পাঠিয়েছি। তারা ধরতে পারেননি। খাল বিশেষজ্ঞ ঠিকই সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। আগ্রাবাদ বক্স কালভার্ট এবং নাসির খাল আগ্রাবাদ এলাকার পানি নিষ্কাশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বক্স কালভার্টটি নির্মাণের ২৭ বছর পর প্রথমবার পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে খাল বিশেষজ্ঞ শাহরিয়ার খালেদের পরামর্শে। তাকে নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন, তার পরামর্শ কেন নিচ্ছি। তিনি যা জানেন এখানে অনেক প্রকৌশলীও তা জানেন না। তিনি যদি খুনি না হন। রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর না হন। তাহলে নগরবাসীর স্বার্থে তার পরামর্শ নিতে অসুবিধা কোথায়। অতীতে খাল বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমরা নিইনি। অস্ট্রেলিয়ার ড্রেনেজ এবং জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক গবেষক ড. আবদুল্লাহ আল মামুনকে নিয়ে এসেছি। তাতে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি।
খবরের কাগজ: সিডিএর কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করেন?
ডা. শাহাদাত হোসেন: মানুষ এত বেড়ে গেছে যে, সড়ক এবং খাল দখল করে আমরা ভবন নির্মাণ করছি। সিডিএর একটি বিল্ডিং কোড আছে। কত শতাংশ জমি ছাড়তে হবে তা নির্ধারণ করা আছে। কেউ তা মানছে না। সিডিএকে শক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে। আজ অনেক জায়গায় ভবন হেলে পড়ছে। দেবে যাচ্ছে। কারণ ভূগর্ভ ফাঁপা হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানি ভেতরে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে না। সব পাকা করে ফেলছি। এখন আমরা খাবারের জন্য যুদ্ধ করছি। একসময় আমাদের পানির জন্য যুদ্ধ করতে হতে পারে।
খবরের কাগজ: মেগা প্রকল্পের সুফল নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
ডা. শাহাদাত হোসেন: স্লুইস গেটগুলো পরিকল্পিতভাবে হয়নি। আবার সব কটির কাজও শেষ হয়নি। সেগুলোর নির্মাণে ত্রুটি আছে। শেষ প্রান্তে গিয়ে খাল সংকুচিত হয়ে গেছে। তা ছাড়া স্লুইস গেটগুলো মেইনটেইন এবং ম্যানেজমেন্ট করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। লোকবল নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এই কাজের জন্য চসিকের একটি বিশাল বাজেট লাগবে। প্রকল্পে এই বিষয়টি নেই। সেটি কীভাবে আসবে, কোথা হতে আসবে তা আমার জানা নেই। খালগুলো চসিককে বুঝিয়ে দেওয়ার পর লোকবল প্রশিক্ষণের জন্য তারা কোনো বাজেটও দেয়নি। এটি প্রকল্পের বড় ধরনের ত্রুটি। অর্থ এবং লোকবল তারা প্রকল্পে রাখেনি। তা প্রকল্পের সাফল্যের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।
খবরের কাগজ: ২৯৮ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি না পাওয়ার জন্য সরকারকে দুষছেন?
ডা. শাহাদাত হোসেন: ২০২২ সালে ৩৯৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ১০০ কোটি টাকা কেটে ২৯৮ কোটি টাকা করা হয়। এই টাকা দিয়ে খাল-নালা পরিষ্কারের ইক্যুইপমেন্ট কেনার কথা ছিল। বর্তমানে চসিকে যেসব ইক্যুইপমেন্ট রয়েছে, সেগুলো বেশির ভাগ দুর্বল। এসব ঘন ঘন নষ্ট হয়। তা মেরামত করতে প্রচুর টাকা এবং সময় নষ্ট হয়। তারা যদি টাকা দিতে না চায়, তাহলে ইক্যুইপমেন্ট কিনে দিলেও হয়। কী কী জিনিস লাগবে প্রকল্পে সব লেখা আছে।
খবরের কাগজ: জলাবদ্ধতা সমস্যার আসল সমাধান কোথায়?
ডা. শাহাদাত হোসেন: এখন যে সমস্যাগুলো তার সব কটি মানবসৃষ্ট। খাল-নালায় আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। পাহাড় কাটার কারণে পাহাড় থেকে বালু এসে খাল ভরে যাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধান করতে সচেতনতার বিকল্প নেই। প্রকৃতিকে যত ধ্বংস করব, প্রকৃতি তত বেশি প্রতিশোধ নেবে। তবে শেষ কথা হলো শহরের খালগুলো চসিককেই পরিষ্কার করতে হবে। সিডিএকে সব দায়িত্ব দিলে হবে না। যার কাজ তাকে করতে হবে। বর্তমান জলবদ্ধতা হলো অপরিকল্পিত নগরয়াণের ফসল। এই সমস্যা সমাধানে দরকার নগর সরকার। নগর সরকার না হলে পরিকল্পিত নগরায়ণ সম্ভব নয়।