
‘আপনি নিজ যোগ্যতায় বসেননি, আপনাকে আমরা বসিয়েছি। তাই আপনি আমাদের কথা শুনতে বাধ্য।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতারের কক্ষে তার আসন ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী তার সঙ্গে বাকতিণ্ডার এক পর্যায়ে এই কথাগুলো বলেন।
শনিবার (৫ জুলাই) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া চার মিনিটের একটি ভিডিওতে এই কথপোকথন শোনা যায়।
উপাচার্যকে উদ্দেশ্য করে এই কথা যারা বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা শাখাওয়াত হোসেন ও শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক নেতা ও ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী তাহসান হাবীব।
ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে তাদের কথা মানতে বাধ্য বলে শাসালেও উপাচার্য না বলেন। উপাচার্যের মুখে না শুনলে উপস্থিত নেতা-কর্মীরা হট্টগোল শুরু করেন। এক পর্যায়ে ছাত্ররা উপাচার্যকে বলেন, ‘আমাদের রক্তের সঙ্গে, আমাদের বিপ্লবের সঙ্গে বেইমানি করে আপনি কেন ফ্যাসিবাদের দোসরদের প্রমোশন দিচ্ছেন।’
এসব নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে নেতা-কর্মীদের যখন তর্কাতর্কি চলছিল, তখন কয়েকজন নেতাকে আঙুল উঁচিয়ে চেঁচামেচি করতেও দেখা গেছে। একপর্যায়ে উপাচার্য উপস্থিত সাংবাদিকদের মুঠোফোনের ক্যামেরা বন্ধ করতে বলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কুশল বরণ চক্রবর্তীর পদোন্নতির সাক্ষাৎকার ছিল শুক্রবার (৪ জুলাই)। তার সাক্ষাৎকার বাতিল ও কুশল বরণকে চাকরিচ্যুত করার দাবিতে দুপুরের পর থেকেই প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবির ও ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক খান তালাত মাহমুদকেও ওই অবস্থান কর্মসূচিতে দেখা গেছে। সেখান থেকেই সাড়ে তিনটার দিকে উপাচার্য কার্যালয়ে যান তারা। উপাচার্যের কার্যালয়ে কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের হট্টগোল করেন দেখা গেছে। ওই সময় ভিডিওটি কেউ ধারণ করে শনিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেন।
এদিকে, শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. কুশল বরণ চক্রবর্ত্তীর পদোন্নতি বোর্ড প্রত্যাহার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই শিক্ষককে নিয়ে পদোন্নতি বোর্ড বসার ক্ষোভে প্রশাসনিক ভবনে তালা দেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। পরে প্রশাসনের আশ্বাসে তালা খুলে দেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
এর আগে শুক্রবার (৪ জুলাই) বিকেল তিনটার দিকে ড. কুশল বরণ চক্রবর্ত্তীর পদোন্নতি বোর্ড বসে। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনেই তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে অংশ নেয় ছাত্রশিবির, বাগছাস, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনসহ বেশ কিছু সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ সময় তাদেরকে ‘বাহ! ভিসি চমৎকার, স্বৈরাচারের পাহারাদার; একটা একটা লীগ ধর, ধরে ধরে জেলে ভর’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।
এদিকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উচ্চবাচ্যের সময় উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য ও দুই উপ-উপাচার্য। এক পর্যায়ে প্রশাসন ওই শিক্ষককে পাশের রুমে পাঠিয়ে দেওয়অ হয়। পরবর্তীতে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীদের একাংশ। আলোচনায় শিক্ষার্থী ও সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা ওই শিক্ষকের বোর্ড বাতিল ও দৃষ্টাতমূলক শাস্তিসহ চারদফা দাবি জানায়। টানা এক ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে প্রশাসনিক ভবনের তালা খুলে দেয় বিক্ষুব্ধরা।
শিক্ষার্থী তাহসান হাবীব বলেন, ‘যারা লীগের দোসর ও ভারতীয় আধিপাত্যবাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য এদেশে বারবার আগ্রাসন চালিয়েছে তাদেরকে কোনোভাবে আমরা ক্যাম্পাসে দেখতে চাইনা।’
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) সংগঠক আশিকুর রহমান বলেন, আমরা জানতে পারি জুলাইয়ের সঙ্গে গাদ্দারি করে প্রশাসন একজন হত্যা মামলার আসামির পদোন্নতি বোর্ড বসিয়েছে। যা কোনোভাবেই জুলাই যোদ্ধারা বেঁচে থাকতে হতে পারেনা।
ছাত্রশিবির চবি শাখার অফিস সম্পাদক হাবিবউল্লাহ খালেদ বলেন, ‘আজকের আন্দোলন নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলোচনার পরে চারটি সিদ্ধান্ত জানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রথমত, কুশল বরণের প্রমোশান বোর্ড প্রত্যাহার করা হয়েছে। দুই, ফ্যাসিবাদের দোসর শিক্ষকদেরকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়েছে। তিন, ফ্যাসিবাদের দোসর শিক্ষকদের একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে এবং আগামী ২৪ জুলাই সিন্ডিকেট এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সর্বশেষ, আগামী ৩৬ জুলাই এর মধ্যে ফ্যাসিবাদের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিচার নিশ্চিত করা হবে।’
হত্যাচেষ্টায় অভিযুক্ত শিক্ষক কুশল বরণ চক্রবর্তী বলেন, ‘জুলাই মাসে আমি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে ফ্যাসিবাদের পক্ষে কোনো কিছু করেছি- এমন প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ।’
আলিফ হত্যা মামলার প্রসঙ্গে কুশল চক্রবর্তী বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে, তা মিথ্যা। ঘটনার সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। আমি যদি সত্যিই ওই মামলার আসামি হতাম, তাহলে পুলিশ নিশ্চয়ই মামলা গ্রহণ করত। কিন্তু পুলিশ তা করেনি-কারণ এটি একটি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আজ সংস্কৃত বিভাগের কুশল বরণ চক্রবর্ত্তীর পদন্নোতি বোর্ড বসার কথা ছিল। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে তার বোর্ড প্রত্যাহার করা হয়েছে। গণমাধ্যমে ওই শিক্ষকের বিষয়ে কিছু সংবেদনশীল সংবাদ দেখতে পেয়েছি। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও সার্বিক বিষয় বিবেচনায় তার এই বোর্ড প্রত্যাহার করা হয়।’
বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেকোনো ব্যক্তিকে কোর্টের মতো বিচার করতে পারে না। আমরা কারও জেল জরিমানাও করতে পারি না। এটা আমাদের এখতিয়ারভুক্ত নয়।’
উল্লেখ্য, গত বছর ২৬ নভেম্বর হেফাজতে ইসলামের কর্মী এনামুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে চিন্ময় কৃষ্ণের অনুসারীদের হামলার শিকার হন। এ ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে চিন্ময় কৃষ্ণকে প্রধান আসামি করে ১৬৪ জনের নামে মামলার আবেদন করেন। এই মামলার ২০তম আসামি কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী।
সুমন/