হিমু আর রূপাকে কে না চেনে? জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি অনবদ্য দুই চরিত্র হিমু ও রূপা। অনেক টিনএজার তো হিমু বা রূপা হতে চায়। কিন্তু কেন? কী এমন জাদু আছে হিমু আর রূপার মধ্যে? হিমু ও রূপাকে নিয়ে তরুণ-তরুণীদের স্বপ্ন আর বাস্তবতার গল্প শোনাচ্ছেন রবিউল কমল।
নানাবাড়িতে বেড়াতে গেছে তৌশিয়াত শাইক। সবাই ওকে শাইক বলেই ডাকে। মামার রুমে ঢুকে রুমটা ঘুর দেখছিল। মামা অনেক বই পড়েন। টেবিলে বই, সেলফে বই, খাটের ওপরে বই, বালিশের পাশে বই...। হঠাৎ তার চোখ পড়ল সেলফের কর্নারে। সেখানে কালো প্রচ্ছদের একটি বই। হাত বাড়িয়ে বইটা নিল। তারপর বইয়ের নামটা দেখে অবাক হলো ‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’। লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। নাম প্রচ্ছদ ভালো লাগায় বই নিয়ে ছাদে উঠল। সেখানে এক কোনায় বসে পড়া শুরু করল। দেখতে দেখতে তিন ঘণ্টা কেটে গেল। বইটাও এক বসাতেই কখন শেষ হয়ে গেল বুঝতেই পারল না সে। এভাবেই শাইকের সঙ্গে হিমুর পরিচয় হয়।
তৌশিয়াত শাইক সেন্ট জোসেফ স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল হিমু সিরিজের বই পড়া হয়েছে কি না। প্রশ্ন শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে এভাবেই জবাব দিয়েছিল সে। শাইক জানায়, ওই বই দিয়েই হিমুর সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার বই পড়ার অভ্যাস ছিল না। কিন্তু হলুদ হিমু কালো র্যাব বইটি আমাকে বই পড়া অভ্যাস গড়তে সহায়তা করেছে। তারপর হিমুর সবগুলো বই এক এক করে পড়েছি। হিমু চরিত্রটি অসাধারণ। একদম অন্যরকম। বইটা পড়তে পড়তে অজান্তেই নিজেকে হিমু ভেবে ফেলা যায়। মনে হতো আমিই তো হিমু। কতবার যে নিজেকে হিমু ভেবেছি। মাঝে মাঝে স্কুলে গিয়ে হিমুর মতো কথা বলতাম। স্কুলের মাঠে খালি পায়ে হাঁটতাম। নিজেকে আধ্যাত্মিক চরিত্র মনে হতো।
শুধু শাইক নয়, হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্রের প্রেমে পড়েনি এমন টিনএজার হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। যারা একবার এই সিরিজের বই পড়েছে তারা সবাই চরিত্রের সঙ্গে মজেছে। বিশেষ করে টিনএজাদারদের ভীষণ প্রিয় একটি চরিত্র হিমু। শুধু হিমু বললে ভুল হবে, রূপাও কম প্রিয় নয়। এক সময় তরুণরা টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে হিমুর বই কিনেছে। বইয়ের ভাঁজে বই লুকিয়ে সেই বই পড়েছে। রাতের বেলা খালি পায়ে হেঁটেছে। হলুদ পাঞ্জাবি পরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে। এই পাগলামি ছিল অত্যন্ত আনন্দের।
এখনো হিমুর বইগুলো টিনএজারদের কাছে সমান জনপ্রিয়। যারা টিনএজ বয়স পার করে এসেছে তারাও যেমন হিমুতে মজেছিল, এখনকার তরুণদের কাছে হিমু জনপ্রিয়। কিন্তু, তরুণদের কাছে হিমু এত প্রিয় কেন?
এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হুমায়ূন আহমেদের লেখনির জাদু। তিনি এই চরিত্রকে এমনভাব চিত্রিত করেছেন যে কাউকে কল্পনার জগতে নিয়ে যাবে। পাঠক নিজের মধ্যে হিমুর ছায়া খুঁজে পাবেন। হুমায়ূন আহমেদ সব বয়সী মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয় ছিলেন। এই দেশের তরুণ প্রজন্মকে বইমুখী করার ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের বিরাট অবদান আছে। তরুণ প্রজন্মকে বইমুখী করার পেছনে হিমু কিংবা রূপা চরিত্রটি এগিয়ে থাকবে। বিশেষ করে হিমুর কথা বলতেই হবে।
মূলত ময়ূরাক্ষী হুমায়ুন আহমেদের লেখা হিমু সিরিজের প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাস থেকেই পাঠক হিমু ও রূপার দেখা পায়। হিমু নিয়ে অনেক কথাই বলা হলো। কিন্তু হিমুর পরিচয় জানানো হলো না। হিমু হলো বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ও কাল্পনিক একটি চরিত্র। যার স্রষ্টা হুমায়ুন আহমেদ। হিমু একজন বেকার ও বেখেয়ালি যুবক। ছন্নছাড়া ও উদাসীন জীবনযাপন করতে ভালো লাগে তার। এর বাইরে আর কিছু তাকে স্পর্শ করে না।
হিমুর আসল নাম হিমালয়। এ নামটি রেখেছিলেন তার বাবা। হুমায়ূন আহমেদের বর্ণনা অনুযায়ী, হিমুর বাবা মনে করতেন- যেভাবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হয়, ওই একইভাবে মহাপুরুষও তৈরি করা সম্ভব। তিনি হিমুকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। এজন্য একটি স্কুল খুলেছিলেন এবং সেখানের একমাত্র শিক্ষার্থী ছিল হিমু। হিমুর পোশাকও ছিল নির্দিষ্ট, পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি। কিন্তু কেন হলুদ রং বেছে নেওয়া হলো, কারণ হলুদ হলো বৈরাগের রং। তার অন্যতম কাজ হলো ঢাকা শহরের অলি-গলিতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো।
এই সিরিজের বিভিন্ন বইয়ে নানা সময়ে হিমুর মধ্যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রকাশ পেয়েছে। সব বইয়ে দেখা গেছে হিমুর আচার-আচরণ বিভ্রান্তিকর। অন্যদের বিভ্রান্ত করাই যেন তার প্রিয় একটি কাজ। আর কোনো উপন্যাসেই কোনো মায়া হিমুকে আটকাতে পারেনি। সে সবসময় প্রেম-ভালোবাসাকে উপেক্ষা করেছে।
আর এসবই কারণেই তরুণদের কাছে হিমু এত প্রিয়। কারণ তরুণরাও হিমুর মতো স্বাধীন জীবন পছন্দ করে। স্কুল-কলেজ কিংবা বাড়ির চার দেওয়ালের জীবন তাদের ভালো লাগে না। এজন্য তারা হিমুর মধ্যে নিজের ছায়া খুঁজে পায়। আর রূপা হলো হিমুর বান্ধবী। তাকে ঘিরে হিমুকে নিয়ে লেখা প্রায় সব উপন্যাসে রহস্য দেখা যায়। সে সবসময় হিমুর জন্য অপেক্ষা করে। রূপা হিমুকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু হিমু আগ্রহ দেখায় না। তবে হিমু মাঝে মাঝে রূপার সঙ্গে দেখা করতে তাদের বাড়ির সামনে গিয়ে অপেক্ষা করে।
তখন রূপা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রূপার পছন্দ নীল শাড়ি। শুধু রূপা নয়, হিমুর প্রেমে পড়েছে সব পাঠকই। তা হিমু ভক্তদের পাগলামিতে বারবার ফুটে উঠেছে। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতেই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে হিমু ও রূপার বেশে বইমেলায় হাজির হয়ে যেত। বইয়ের হিমু ছেলে হলেও বাস্তবে মেয়েদেরও হিমুর সাজে দেখা গেছে। এখনো বইমেলায় হিমু সেজে অনেকে ঘুরে বেড়ায়।
হিমুকে ভালোবেসে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন গ্রুপ। ফেসবুকেও দেখা মেলে একাধিক গ্রুপ ও পেজের। সম্ভবত, সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রুপটি হলো হিমু পরিবহন। তাদের অনেক সদস্য আছে। তারা প্রতি বছর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন বা মৃত্যুদিনে নুহাশ পল্লীতে হিমুর সাজে হাজির হয়। হিমুকে ভালোবেসে ময়মনসিংহে গড়ে উঠেছে একটি রেস্টুরেন্ট।
নাম হিমু আড্ডা। ময়মনসিংহের হুমায়ূন ভক্তদের খুবই প্রিয় একটি জায়গা এই রেস্টুরেন্ট। এভাবে হিমুকে বা রূপাকে ভালোবেসে অসংখ্য গ্রুপ গড়ে উঠেছে। যারা মনেপ্রাণে হিমু বা রূপাকে ধারণ করেন। হিমু কিংবা রূপা হয়ে এভাবেই হুমায়ূন আহমেদ তরুণ প্রজন্মের কাছে বেঁচে থাকবেন হাজার হাজার বছর। আর প্রতি বছর বইমেলায় হলুদ পাঞ্জাবি পরে কিংবা কেউ নীল শাড়ি পরে হেঁটে বেড়াবেন ভক্তরা। তখন সবাই বলবে, এই হিমু এই... এই রূপা এই।
কলি