হলুদ হিমু নীল রূপা । খবরের কাগজ
ঢাকা ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, সোমবার, ১৩ মে ২০২৪

হলুদ হিমু নীল রূপা

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৩, ১০:৫৬ এএম
হলুদ হিমু নীল রূপা
হিমু সেজেছে রাফিত। রূপা সেজেছে মৌ। পোশাক দিয়েছে রঙ বাংলাদেশ। ছবি তুলেছেন শরিফ মাহমুদ

হিমু আর রূপাকে কে না চেনে? জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি অনবদ্য দুই চরিত্র হিমু ও রূপা। অনেক টিনএজার তো হিমু বা রূপা হতে চায়। কিন্তু কেন? কী এমন জাদু আছে হিমু আর রূপার মধ্যে? হিমু ও রূপাকে নিয়ে তরুণ-তরুণীদের স্বপ্ন আর বাস্তবতার গল্প শোনাচ্ছেন রবিউল কমল।

নানাবাড়িতে বেড়াতে গেছে তৌশিয়াত শাইক। সবাই ওকে শাইক বলেই ডাকে। মামার রুমে ঢুকে রুমটা ঘুর দেখছিল। মামা অনেক বই পড়েন। টেবিলে বই, সেলফে বই, খাটের ওপরে বই, বালিশের পাশে বই...। হঠাৎ তার চোখ পড়ল সেলফের কর্নারে। সেখানে কালো প্রচ্ছদের একটি বই। হাত বাড়িয়ে বইটা নিল। তারপর বইয়ের নামটা দেখে অবাক হলো ‘হলুদ হিমু কালো র‌্যাব’। লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। নাম প্রচ্ছদ ভালো লাগায় বই নিয়ে ছাদে উঠল। সেখানে এক কোনায় বসে পড়া শুরু করল। দেখতে দেখতে তিন ঘণ্টা কেটে গেল। বইটাও এক বসাতেই কখন শেষ হয়ে গেল বুঝতেই পারল না সে। এভাবেই শাইকের সঙ্গে হিমুর পরিচয় হয়।

তৌশিয়াত শাইক সেন্ট জোসেফ স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল হিমু সিরিজের বই পড়া হয়েছে কি না। প্রশ্ন শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে এভাবেই জবাব দিয়েছিল সে। শাইক জানায়, ওই বই দিয়েই হিমুর সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার বই পড়ার অভ্যাস ছিল না। কিন্তু হলুদ হিমু কালো র‌্যাব বইটি আমাকে বই পড়া অভ্যাস গড়তে সহায়তা করেছে। তারপর হিমুর সবগুলো বই এক এক করে পড়েছি। হিমু চরিত্রটি অসাধারণ। একদম অন্যরকম। বইটা পড়তে পড়তে অজান্তেই নিজেকে হিমু ভেবে ফেলা যায়। মনে হতো আমিই তো হিমু। কতবার যে নিজেকে হিমু ভেবেছি। মাঝে মাঝে স্কুলে গিয়ে হিমুর মতো কথা বলতাম। স্কুলের মাঠে খালি পায়ে হাঁটতাম। নিজেকে আধ্যাত্মিক চরিত্র মনে হতো। 

শুধু শাইক নয়, হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্রের প্রেমে পড়েনি এমন টিনএজার হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। যারা একবার এই সিরিজের বই পড়েছে তারা সবাই চরিত্রের সঙ্গে মজেছে। বিশেষ করে টিনএজাদারদের ভীষণ প্রিয় একটি চরিত্র হিমু। শুধু হিমু বললে ভুল হবে, রূপাও কম প্রিয় নয়। এক সময় তরুণরা টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে হিমুর বই কিনেছে। বইয়ের ভাঁজে বই লুকিয়ে সেই বই পড়েছে। রাতের বেলা খালি পায়ে হেঁটেছে। হলুদ পাঞ্জাবি পরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে। এই পাগলামি ছিল অত্যন্ত আনন্দের।

এখনো হিমুর বইগুলো টিনএজারদের কাছে সমান জনপ্রিয়। যারা টিনএজ বয়স পার করে এসেছে তারাও যেমন হিমুতে মজেছিল, এখনকার তরুণদের কাছে হিমু জনপ্রিয়। কিন্তু, তরুণদের কাছে হিমু এত প্রিয় কেন? 

এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হুমায়ূন আহমেদের লেখনির জাদু। তিনি এই চরিত্রকে এমনভাব চিত্রিত করেছেন যে কাউকে কল্পনার জগতে নিয়ে যাবে। পাঠক নিজের মধ্যে হিমুর ছায়া খুঁজে পাবেন। হুমায়ূন আহমেদ সব বয়সী মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয় ছিলেন। এই দেশের তরুণ প্রজন্মকে বইমুখী করার ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের বিরাট অবদান আছে। তরুণ প্রজন্মকে বইমুখী করার পেছনে হিমু কিংবা রূপা চরিত্রটি এগিয়ে থাকবে। বিশেষ করে হিমুর কথা বলতেই হবে।

মূলত ময়ূরাক্ষী হুমায়ুন আহমেদের লেখা হিমু সিরিজের প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাস থেকেই পাঠক হিমু ও রূপার দেখা পায়। হিমু নিয়ে অনেক কথাই বলা হলো। কিন্তু হিমুর পরিচয় জানানো হলো না। হিমু হলো বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ও কাল্পনিক একটি চরিত্র। যার স্রষ্টা হুমায়ুন আহমেদ। হিমু একজন বেকার ও বেখেয়ালি যুবক। ছন্নছাড়া ও উদাসীন জীবনযাপন করতে ভালো লাগে তার। এর বাইরে আর কিছু তাকে স্পর্শ করে না।

হিমুর আসল নাম হিমালয়। এ নামটি রেখেছিলেন তার বাবা। হুমায়ূন আহমেদের বর্ণনা অনুযায়ী, হিমুর বাবা মনে করতেন- যেভাবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হয়, ওই একইভাবে মহাপুরুষও তৈরি করা সম্ভব। তিনি হিমুকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। এজন্য একটি স্কুল খুলেছিলেন এবং সেখানের একমাত্র শিক্ষার্থী ছিল হিমু। হিমুর পোশাকও ছিল নির্দিষ্ট, পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি। কিন্তু কেন হলুদ রং বেছে নেওয়া হলো, কারণ হলুদ হলো বৈরাগের রং। তার অন্যতম কাজ হলো ঢাকা শহরের অলি-গলিতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো।

 এই সিরিজের বিভিন্ন বইয়ে নানা সময়ে হিমুর মধ্যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রকাশ পেয়েছে। সব বইয়ে দেখা গেছে হিমুর আচার-আচরণ বিভ্রান্তিকর। অন্যদের বিভ্রান্ত করাই যেন তার প্রিয় একটি কাজ। আর কোনো উপন্যাসেই কোনো মায়া হিমুকে আটকাতে পারেনি। সে সবসময় প্রেম-ভালোবাসাকে উপেক্ষা করেছে।

আর এসবই কারণেই তরুণদের কাছে হিমু এত প্রিয়। কারণ তরুণরাও হিমুর মতো স্বাধীন জীবন পছন্দ করে। স্কুল-কলেজ কিংবা বাড়ির চার দেওয়ালের জীবন তাদের ভালো লাগে না। এজন্য তারা হিমুর মধ্যে নিজের ছায়া খুঁজে পায়। আর রূপা হলো হিমুর বান্ধবী। তাকে ঘিরে হিমুকে নিয়ে লেখা প্রায় সব উপন্যাসে রহস্য দেখা যায়। সে সবসময় হিমুর জন্য অপেক্ষা করে। রূপা হিমুকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু হিমু আগ্রহ দেখায় না। তবে হিমু মাঝে মাঝে রূপার সঙ্গে দেখা করতে তাদের বাড়ির সামনে গিয়ে অপেক্ষা করে।

তখন রূপা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রূপার পছন্দ নীল শাড়ি। শুধু রূপা নয়, হিমুর প্রেমে পড়েছে সব পাঠকই। তা হিমু ভক্তদের পাগলামিতে বারবার ফুটে উঠেছে। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতেই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে হিমু ও রূপার বেশে বইমেলায় হাজির হয়ে যেত। বইয়ের হিমু ছেলে হলেও বাস্তবে মেয়েদেরও হিমুর সাজে দেখা গেছে। এখনো বইমেলায় হিমু সেজে অনেকে ঘুরে বেড়ায়।

হিমুকে ভালোবেসে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন গ্রুপ। ফেসবুকেও দেখা মেলে একাধিক গ্রুপ ও পেজের। সম্ভবত, সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রুপটি হলো হিমু পরিবহন। তাদের অনেক সদস্য আছে। তারা প্রতি বছর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন বা মৃত্যুদিনে নুহাশ পল্লীতে হিমুর সাজে হাজির হয়। হিমুকে ভালোবেসে ময়মনসিংহে গড়ে উঠেছে একটি রেস্টুরেন্ট। 

নাম হিমু আড্ডা। ময়মনসিংহের হুমায়ূন ভক্তদের খুবই প্রিয় একটি জায়গা এই রেস্টুরেন্ট। এভাবে হিমুকে বা রূপাকে ভালোবেসে অসংখ্য গ্রুপ গড়ে উঠেছে। যারা মনেপ্রাণে হিমু বা রূপাকে ধারণ করেন। হিমু কিংবা রূপা হয়ে এভাবেই হুমায়ূন আহমেদ তরুণ প্রজন্মের কাছে বেঁচে থাকবেন হাজার হাজার বছর। আর প্রতি বছর বইমেলায় হলুদ পাঞ্জাবি পরে কিংবা কেউ নীল শাড়ি পরে হেঁটে বেড়াবেন ভক্তরা। তখন সবাই বলবে, এই হিমু এই... এই রূপা এই।

কলি

 

মায়ের জন্য

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৪, ০৩:১৪ পিএম
মায়ের জন্য
ফরাসি আর্টিস্ট উইলিয়াম অ্যাডফ বাগরো এবং পিয়েরে অগ্যস্ত রনোয়ার এর আঁকা মা ও শিশু

মা যদি আমাদের ভালো না বাসতেন, আদর না করতেন, যত্ন না করতেন- তাহলে আমাদের জীবন এতটা সুন্দর ও মধুময় হয়ে উঠত না। কীভাবে? টাইমস অব ইন্ডিয়া অবলম্বনে বিস্তারিত জানাচ্ছেন আহমেদ রিয়াজ

মায়ের ভালোবাসা তুলনাহীন
এটা কেবল মানুষ নয়, প্রাণীদের বেলায়ও সত্যি। মানুষ থেকে হাতি (হাতিদের গর্ভধারণের সময় ২২ মাস), এমনকি ওরাংওটাংও (যারা সন্তান জন্মের চার মাস পর্যন্ত সন্তানকে চোখের আড়ালও করে না), মেরু ভালুক (যারা গর্ভধারণের সময় দ্বিগুণ ওজনের হয়ে যায় এবং আট মাস না খেয়ে থাকে), বাঘ, সিংহ, সিলমাছ, তিমিসহ প্রত্যেক প্রাণীর মায়েরা সন্তানদের জন্য কত কিছু যে করে। এই সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মায়েদের কত রকমের শারীরিক ধকল যে সইতে হয় জীবনভর, তার হিসাব কি কেউ করেছি কখনো। সন্তানের প্রতি মায়ের এই ভালোবাসা তুলনাহীন।

মাতৃত্বে বদলে যায় মায়ের মস্তিষ্ক
এক গবেষণায় দেখা গেছে সন্তান জন্মের চার মাস পর মায়ের মস্তিষ্কে অনেক বেশি গ্রে ম্যাটার দেখায়। এই গ্রে ম্যাটার হচ্ছে মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ডের মাঝামাঝি প্রয়োজনীয় এক ধরনের টিস্যু। এই টিস্যু মানসিক অবস্থা, শ্মরণশক্তি, আবেগ এবং চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস গর্ভাবস্থায় মস্তিষ্কে হরমোন প্রবাহের কারণে এটা ঘটে- যেমনটা টিনএজ হরমোনগুলো তাদের মস্তিষ্ক বিকাশের দিকে নিয়ে যায়।

সন্তানও মাকে আজীবনের সুরক্ষা দেয়
সন্তান জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে মা ও সন্তানের শরীরের কোষ অদলবদল হয়। এবং মায়ের শরীরে এই কোষগুলো কয়েক দশক ধরে থাকে। গবেষকরা বলেন এসব কোষ কোনো নারীকে কয়েক ধরনের ক্যান্সার থেকে সুরক্ষা দেয়। এর মধ্যে আলঝেইমার এমনকি হার্টের নানা রোগ থেকেও রক্ষা করে।

মা কাছে থাকলে মানসিক চাপ কমে যায়
গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মা কাছে থাকলে, এমনকি ফোনে মায়ের কণ্ঠ শুনলে অক্সিটসিন বেড়ে যায় এবং কর্টিসল স্তর কমে যায়- যা শিশুদের শান্ত করে দেয় এবং এমনকি টিনএজারদের আরও বেশি দায়িত্বশীল করে তোলে। তিন মাস বয়সী শিশুর সঙ্গে মায়ের হৃদস্পন্দনে সমন্বয় ঘটে, যখন মায়ের কাছ থেকে সামান্যতম আদরের ছোঁয়াও পায় শিশু- এমনকি মায়ের হাসিতেও।

জন্মের আগেই মায়ের কণ্ঠ চিনতে পারে শিশু
গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভে থাকার সময় মায়ের কণ্ঠ শুনলে শিশুর হৃদস্পন্দর বেড়ে যায়, যেটা অন্য কারও কণ্ঠ শুনলে হয় না। মায়ের হৃদস্পন্দনের শব্দ এবং মায়ের কণ্ঠ শিশুর মস্তিষ্ক গঠনে বিশেষ সহায়ক হয়, এমনকি জন্মের পরও।

সবার আগে
অন্য কেউ উপলব্ধি করার আগে মা তার সন্তানের কান্নার শব্দ টের পেয়ে যান, কারণ সন্তানের জন্মের পর মায়ের অক্সিটসিন স্তর বেড়ে যায়। এই পরিবর্তনের কারণ হচ্ছে সন্তানের শব্দ মায়ের শ্রবণ প্রক্রিয়া আরও বেশি অনুভূতিশীল হয়।

শিশুরা মায়েদের যে নামে ডাকে
ইংরেজ শিশুর কাছে ‘মম’, চাইনিজ শিশুর কাছে ‘মামা’, আইসল্যান্ডের শিশুর কাছে ‘মাম্মা’, হিব্রু শিশুর কাছে ‘এম’, ভিয়েতনামি শিশুর ‘মি’, ভারতীয় শিশুর কাছে ‘মা, বাংলাদেশের শিশুর কাছেও ‘মা’- ভাষার যত বৈচিত্র্যই থাকুক না কেন, যে কোনো শিশুর প্রথম শব্দই ‘মা’।

কঠোর মা বনাম কোমল মা
যেসব মা খুব বেশি কঠোর নন, তাদের কাছে শিশুরা অনেক বেশি মমতায় বেড়ে ওঠে। কঠিন শাসনে থাকা শিশুর চেয়ে, কঠিন শাসনে না থাকা শিশুদের সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক বেশি ভালো হয়।

অ্যান্টিবডি
শিশুর প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি মায়েরাই উৎপন্ন করেন। শিশুর শরীরে নানান রকম ব্যাকটিরিয়া অথবা ভাইরাস তৈরি হয়, মায়ের দুধে সেগুলোর ক্ষতিকর উপাদান সরিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। এমনকি মা যখন শিশুকে আদরে চুমুও দেন, সেটাও শিশুর শরীরের ক্ষতিকর উপাদানগুলো হটিয়ে দেয়।

মায়ের আদর
যে কারও জীবনে মায়ের আদর ও ভালোবাসা কেবল মানসিক নয়, শারীরিক সক্ষমতাও তৈরি করে। যে সক্ষমতার কারণে আজ যারা টিনএজার, হেসে-খেলে, দৌড়ে, ছুটে বেড়াচ্ছ, মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা না পেলে কি সেটা সম্ভব হতো? আর এ থেকেই প্রমাণিত হয়, দুনিয়ায় মায়ের চেয়ে বড় বন্ধু আর কেউ নেই। কাজেই সন্তানের কাছ থেকে ভালোবাসা মায়ের প্রাপ্য- মা দিবস কেবল এক দিন নয়- প্রতিদিন।

জাহ্নবী

ফারিয়া হক তারুণ্যের অনুপ্রেরণা

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৪, ০৩:০৯ পিএম
ফারিয়া হক তারুণ্যের অনুপ্রেরণা

পড়াশোনার গণ্ডি এখনো তার শেষ হয়নি। লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি সলিউশনস ফার্স্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কো-ফাউন্ডার এবং সিওও। আবার এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর হিসেবে যুক্ত আছেন ওয়ান ওয়ে স্কুলের সঙ্গে। করছেন উপস্থাপনাও। কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া তার জন্য প্রায় নিয়মিত ব্যাপার। পড়াশোনা সামলে এমন সব সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সবার নজর কেড়েছেন ফারিয়া হক। ফারিয়ার বাবা-মা দুজনই শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত। পরিবারে মা-বাবা ছাড়া আছে ছোট এক বোন। ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় বসবাস ফারিয়াদের।

ছোটবেলা থেকেই ফারিয়া নানা রকম সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কবিতা আবৃত্তি, কোরআন তিলাওয়াত, মেধা স্বীকৃতি, সৃজনশীল খেলায় তার স্থান থাকত প্রথম দিকে। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় কবিতা লেখার শুরু তার। পত্র-পত্রিকায় সেসব কবিতা ছাপাও হয়েছে। শিক্ষকের বিদায়ে মানপত্র লিখে তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। ফারিয়া মনে করেন, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। সে লক্ষ্যে ২০২২ সালের ২৬ জুন ফারিয়া হক ‘ওয়ান ওয়ে স্কুল’ নামক ফ্রি ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হন।

ছোটবেলায় স্কুলের নানা প্রোগ্রামের উপস্থাপনা করতেন। তাই বড় হয়ে উপস্থাপনা ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি তার। কিন্নর কণ্ঠ, সুন্দর বাচনভঙ্গি, উপস্থিত বুদ্ধিমাত্রার কারণে তিনি উপস্থাপনায় সবার প্রশংসা পান। ‘স্পিচ মাস্টার্স বাংলাদেশ’ আয়োজিত ‘পাবলিক স্পিকিং অ্যান্ড প্রেজেন্টেশন’ ওয়ার্কশপে ক্যাজুয়াল উপস্থাপনা তার অনন্য অর্জন। শত মানুষের মধ্যে নিজেকে সাবলীলভাবে তুলে ধরেন তিনি। এ ছাড়া আইটিসহ নানা বিষয়ে নিয়ে ফেসবুক লাইভে তাকে আলোচনা করতে দেখা যায়। ফারিয়া বলেন, উপস্থাপনায় অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে।

ন্যাশনাল টেক কার্নিভাল-২৩ অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে আইটি অভিজ্ঞ, সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয় ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। ৫০০ লোকের উপস্থিতিতে এই প্রোগ্রামে অর্গানাইজার টিমের সদস্য ছিলেন তিনি। তিনি এই প্রোগ্রামে ‘ওয়ান ওয়ে স্কুল’ সম্পর্কে প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে সবার কাছে তুলে ধরেন। গোটা প্রোগ্রামে তার সাংগঠনিক মুনশিয়ানার পরিচয় মেলে। ওয়ান ওয়ে স্কুল সম্পর্কে ফারিয়া বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য বিনামূল্যে অদক্ষ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা। এর আগে তিনি Youth Against Hunger-এর কেন্দ্রীয় কমিটিতে কাজ করেছেন। যার উদ্দেশ্য তরুণদের হাত ধরে দেশের মানুষের নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও রূপান্তরের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা।

২০২৩ সালের ১০ আগস্ট ওয়ান ওয়ে স্কুল আয়োজিত ‘ন্যাশনাল ফ্রিল্যান্সার্স কার্নিভাল-২০২৩’-এ আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন ফারিয়া হক। যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে আসন অলংকৃত করেছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, আরও উপস্থিত ছিলেন দেশ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ এবং সারা দেশ থেকে আগত শিক্ষার্থীরা। সফল ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব হবেন। এমন ভাবনা ফারিয়ার ছিল অনেক দিন আগে থেকেই। তিনি একজন আইটি উদ্যোক্তা। সফলভাবে পরিচালনা করছেন সলিউশনস ফার্স্ট নামক একটি প্রতিষ্ঠান।

কাজ করতে গিয়ে কোন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন জানতে চাইলে ফারিয়া বলেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা সব কাজেই সফল। কখনো অনেক ধরনের প্রশ্ন আসে, যেহেতু আমাদের উদ্দেশ্য মহৎ তাই ততটা সমস্যা হয়নি এখনো। আনন্দময় অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রত্যেকটা মিটিং বা টিম অ্যানাউন্সমেন্টের আর্টিকেল লেখা কিংবা প্রজেন্টেশনের পর ‘ওয়ান ওয়ে স্কুল’ পরিবারের সদস্যরা যখন বলেন ‘আপু আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি- এর চেয়ে প্রশান্তির আর কিছুই নেই। এমন একটি টিম পেয়েছি যারা আপনালয় নিজের পরিবারের মতো, কাজের প্রাপ্তি হিসেবে সব সদস্যের দোয়া ও ভালোবাসা অতুলনীয়। সৎ পথে সর্বদা দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করা এবং নিজের ও তরুণদের দক্ষতা অর্জনে সোচ্চার ভূমিকা পালন করবেন। এমনটাই তার আগামী দিনের সংকল্প।

জাহ্নবী

 

সোমালীয় টিনএজার অতি দুঃখে কাটে যাদের জীবন

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৪, ০৩:০৭ পিএম
অতি দুঃখে কাটে যাদের জীবন

সোমালীয় বাবা-মায়েরা সাধারণত কর্তৃত্বপরায়ণ। ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে বাবা-মা যা সিদ্ধান্ত নেবেন তাই ছেলেমেয়েদের মানতে হয়। বাবা-মায়েরা খুব বেশি সুরক্ষা তাদের সন্তানদের দিতে পারেন না। সোমালীয় টিনএজাররা অনেকেই নিদারুণ অবস্থার মুখে পড়ে। একদিকে আছে আর্থিক অস্বচ্ছলতার জাঁতাপীড়ন, এর ওপর আছে তাদের বলপূর্বক সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া। আছে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়া। যৌন হয়রানি এবং অপহরণের মতো ভীতিজনক অবস্থায় পতিত হওয়া। সোমালীয় টিনএজারদের জীবন মোটেও সুখের নয়।

মেয়েদের অতি অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রাপ্ত বয়সে না পৌঁছানো পর্যন্ত কোনো মেয়েকে বিয়ে দেওয়া যাবে না। কিন্তু কোথাও এটা উল্লেখ করে দেওয়া হয়নি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার বয়স কত? এজন্য ১৮ বছর হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। ১৫ বছরে পৌঁছানোর আগেই শতকরা ১৫ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এবং শতকরা ৩৬ ভাগের বিয়ে হয় তাদের আঠারো বছরের আগে। তবে ভালোর মধ্যে সোমালীয় সমাজব্যবস্থা একেবারে পরিবারকেন্দ্রিক। সন্তানরা বিয়ে হওয়া পর্যন্ত তাদের বাবা-মায়ের কাছেই থাকে। এ ছাড়া পরিবারের কোনো সদস্য যখন বিয়ে করে বা অসুস্থ হয় তখন পরিবারের সব সদস্য যার যা শক্তি সামর্থ্য আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যাতে পরিবারের সদস্যটি মনে করে, সে একলা নয়। তার স্বজনরা আছে। মেয়েদের অধিকারের দিক দিয়ে সর্বনিম্নর দিক থেকে চতুর্থ। লিঙ্গসমতার বালাই নেই সোমালিয়ায়। মেয়েরা সমাজে নানাবিধ বৈষম্যের শিকার। ১৫ বছরের মধ্যেই ৯৮ শতাংশ সোমালীয় মেয়েদের খতনা করানো হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রেও মেয়েরা চরম বৈষম্যের মধ্যে আছে। মাত্র ২৫ শতাংশ ভাগ মেয়ে তাদের সঠিক বয়সে প্রাইমারি স্কুলে যায়। বাকি ৬৫ শতাংশ ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মেয়েরা হয় কোনোদিন স্কুলেই যায়নি বা প্রাথমিক শিক্ষাটা পেয়েছে মাত্র। দেশটির ৪২ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরু হলেই তাদের স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হয়। প্রথমত, প্রথম চার দিন কখনো-বা সাত দিনও মেয়েদের স্কুলে যেতে দেওয়া হয় না। আর মায়েরা মনে করতে থাকে মেয়ের এখন আর স্কুলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন সে আর বালিকা নয়, সে এখন মহিলা। তাকে এখন বাড়িতে থেকে বাসার কাজে সাহায্য করা উচিত আর স্বামী খোঁজা উচিত! তার আর এখন শুধু শুধু স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে সময় নষ্ট করার কোনো দরকার নেই! আর পড়েই লাভ কী? সে কোনো চাকরি করলে স্বামীর বাড়ির লোকজন সেটার উপকারভোগী হবে, তাই বাপের বাড়ির লোকজন তাকে পড়িয়ে লাভ কী? মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে এরকমটাই মনে করে সোমালীয় পরিবারগুলো। তাই যত তাড়াতাড়ি মেয়েদের বিদেয় করা যায় ততই পয়সা বাঁচল। বিশাল এক জনগোষ্ঠী যা হতে পারত দেশের সম্পদ, তারা কিন্তু অন্যের ঘাড়ে বোঝা হয়েই থেকে যাচ্ছে। ইদানীং ইউনিসেফের প্রকল্পের মাধ্যমে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে পরিবারগুলোকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে ধর্মীয় নেতাদেরও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আরেকটি সমস্যা ইন্টারনেটের ব্যবহার নিয়ে। টিনএজারদের মধ্যে মোবাইলে সময় ব্যয় করার হার অত্যধিক। প্রতি ১০ জনের মধ্যে সাতজনেরই মোবাইল ফোন আছে। এবং আফ্রিকার মধ্যে সোমালিয়ায় সবচেয়ে সস্তায় ইন্টারনেট পাওয়া যায়। এর মধ্যে মেয়েদের ইন্টারনেট ব্যবহার করার বিপদ বেশি। যেসব মেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেলিংয়ের শিকার হয়। ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে পর্নোগ্রাফির প্রতি টিনএজারদের মধ্যে আকর্ষণ বেড়েছে। ফলে অব লাইনে বা সাধারণভাবে আশঙ্কাজনকভাবে মেয়েদের প্রতি সহিংসতা বেড়ে গেছে। তবে অনলাইন অপরাধকে সোমালিয়ায় তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয় না। ফলে এসব অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা যায় না। তাই প্রতিনিয়ত অল্পবয়সী মেয়েরা সাইবার অপরাধের শিকার হয়।

সোমালিয়ায় শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় অক্টোবর থেকে, শেষ হয় জুনে। প্রাইমারি স্কুল সময়বৃত্ত চলে ছয় বছর। এরপর নিম্ন মাধ্যমিক দুই বছর। এর পর উচ্চমাধ্যমিক ছয় বছর। দক্ষিণ এবং কেন্দ্রীয় অঞ্চলে সরকারি শিক্ষা বলতে কিছু নেই। সবই বেসরকারি। সেখানে বেতন খুবই বেশি। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। আর যারা শরণার্থী বা রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী তারা বইপত্র কিনতে অক্ষম। তাদের জাতিসংঘের সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য। কমবেশি ৩০ লাখ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় না। যারা যায় তারাও স্কুল শিক্ষার তেমন উপকার পায় না। নেই বইপত্র, নেই প্রয়োজন মতো টয়লেট, না আছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক।

অপর্যাপ্ত চাকরি, তার ওপর পর্যাপ্ত শিক্ষার ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে তারা চাকরিও পায় না। দেশের মধ্যে আছে নানান গোষ্ঠীর ঝগড়া-বিবাদ। ফলে সহজ পথ হিসেবে এসব টিনএজার সশস্ত্র দলগুলোতে ভিড়ে যায়। তারা অপরাধীগোষ্ঠীতে ঢুকে নানা প্রকার অপরাধ করতে শুরু করে। অনেক সময় স্থানীয় শাসকরাও নিজেদের স্বার্থে এসব বিপথগামী বালক টিনএজারদের ব্যবহার করে। তারা কখনো কখনো জলদস্যুতাকেও তাদের জীবনের লক্ষ্যে পরিণত করে!

জাহ্নবী

 

কৃষিজীবীদের সেবায় হাফসা তাসনিম

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১২:৫০ পিএম
কৃষিজীবীদের সেবায় হাফসা তাসনিম
চলছে তরমুজ চাষিদের প্রশিক্ষণ

সুন্দরবনের বানিশান্তা উইনিয়নের ঢাংমারী গ্রামের বাসিন্দাদের নানান রকম পেশা। মাছধরা, মধু সংগ্রহ, গোলপাতা সংগ্রহ ইত্যাদি। তবে এগুলো মৌসুমি পেশা। তাদের মূল পেশা কৃষি। এই কৃষিজীবী মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন হাফসা তাসনিম। বিস্তারিত জানাচ্ছেন সুলতানা লাবু

দীর্ঘদিন ধরে হাফসা তাসনিমের বড় বোন জেলে এবং মৌয়ালদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। সেখানকার পর্যটন এলাকার উন্নয়নেও তিনি এবং তার পরিবারের অনেক সদস্য বড় বোনকে সহযোগিতা করে আসছেন। যেমন শিশুদের পাঠশালা, নারীদের জন্য দরজির স্কুল ইত্যাদি। উদ্দেশ্য গ্রামের মানুষগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা। কাজ করতে গিয়ে এই তরুণী দেখলেন মধু সংগ্রহ বা মাছ ধরা তাদের মৌসুমি পেশা। মূল পেশা কৃষি। দুই বছর ধরে কৃষকরা এই অঞ্চলে তরমুজ চাষ শুরু করেছেন। কিন্তু চাষপদ্ধতির অভিজ্ঞতার অভাবে কৃষকরা লাভবান হচ্ছিলেন না। বরং পর পর দুই বছর তাদের ক্ষতি গুনতে হয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় সরকারি সেবাগুলোও তারা পাচ্ছিলেন না। এমনকি সেই সেবা সম্পর্কে তারা কিছু জানেনও না। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তো জানেন। শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ এলাকার কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করলে খুব সহজেই তারা লাভবান হতে পারেন। যে কাজটি করার জন্য সরকারের অনেক বেশি লোকোবল প্রয়োজন, সময় প্রয়োজন।

শিক্ষার্থীরা কিছুটা সময় আর মনোযোগ দিলে কাজটি সহজেই হয়ে যায়। শুধু প্রয়োজন একটু ইচ্ছাশক্তি। প্রন্তিক কৃষকদের দুর্দশা দেখে এমনই চিন্তা এল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফসা তাসনিমের। তখনই এই তরুণীর মনে হলো কৃষির ছাত্রী হিসেবে কৃষকদের সাহায্য করা তার দায়িত্ব।

ঢংমারীর তরমুজ ক্ষেত

 

উৎসাহী চার-পাঁচজন বন্ধু নিয়ে হাফসা তাসনিম একটি টিম গঠন করলেন। তারপর কৃষির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগুলোকে কাজে লাগিয়ে পৌঁছে গেলেন কৃষকদের কাছে। কৃষিবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ফারমার ফিল্ড স্কুল। কয়েক দফায় ফারমার ফিল্ড স্কুলের কাজটি করে বের করলেন কৃষকরা কী কী সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কী কারণে তারা মুনাফা অর্জন করতে পারছেন না। কিংবা তাদের কাঙ্ক্ষিত ফসলটি ঘরে তুলতে পারছেন না। কৃষকদের প্রত্যাশাগুলোসহ তাদের সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধানের তালিকা করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তরুণদের এই উদ্যোগে শিক্ষকরাও খুব আগ্রহ প্রকাশ করলেন। শিক্ষকদের পরামর্শে সেখানকার মাটি পরীক্ষা করা হলো। কতটুকু সার দরকার এবং কীভাবে পরিচর্যা করতে হবে তাও নির্ধারণ করা হলো। সেই পরামর্শগুলো শিক্ষার্থীরা কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিলেন। এতে কৃষকরা লাভবান হতে থাকল।

তরমুজ চাষে কৃষকরা নতুন এবং অনভিজ্ঞ ছিল বলে অধিক পরিমাণে কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করেছিল। এবং দুই বছর ধরে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। তাছাড়া বাজারজাতকরণের সিন্ডিকেট সমস্যা তো ছিলই। সিন্ডিকেট নিয়ে শিক্ষার্থীদের কিছুই করার ছিল না। তাই উৎপাদন খরচ কমানোর কাজেই কৃষকদের সহযোগিতা করতে লাগলেন। একে তো প্রত্যন্ত অঞ্চল তার ওপর বারবার যাওয়া-আসার খরচ সামলানো শিক্ষার্থীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই যোগাযোগ করলেন সেখানকার অ্যাগ্রিকালচার অফিসারদের সঙ্গে। পাশাপাশি শিক্ষকদের সহযোগিতায় এমন একটি এনজিওর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন যারা কৃষকদের নিয়ে কাজ করে। এনজিওর কাছ থেকে তরমুজ চাষিরা প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় সহযোগিতা পেল। এবং তরমুজ চাষের জ্ঞানার্জন করে লাভের মুখ দেখতে শুরু করল। সুন্দরবন এলাকার তরমুজ চাষিদের সফলতা তরুণী হাফসা তাসনিমকে আরও উৎসাহী করে তুলেছে। সারা বাংলার কৃষকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রবল হয়েছে। সারা দেশে তিনি এমন একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চান যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় কৃষকদের সমস্যাগুলো সরেজমিন আইডেনটিফাই করবে। এবং তাদের সহায়তা করবে। শিক্ষার্থীরা অন্তত যোগাযোগগুলোকে যুক্ত করে দিলেও কৃষকরা অনেক বেশি লাভবান হবেন।

মানুষের সেবায় নিজেকে সব সময় নিয়োজিত রাখতে চান তিনি। কারণ ছোটবেলা থেকেই বড় বোন আঁখি সিদ্দিকা তাকে শিখিয়েছেন জীবনের প্রতিটি সময়কে সততার সঙ্গে সঠিকভাবে এবং প্রডাক্টটিভলি ব্যবহার করা উচিত; যা অন্য মানুষের কল্যাণে আসবে। তাহলেই চিরকাল পৃথিবীতে বেঁচে থাকা সম্ভব। কারও উপকার করলে অবশ্যই তার মনে এবং মস্তিষ্কে স্থান পাওয়া যায়। এই অনুপ্রেরণা হাফসা তাসনিমকে সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে সহায়তা করেছে। ২০১৯ সাল থেকে এই তরুণী কখনো ত্রাণ কার্যক্রম, কখনো পরিবেশ সচেতনতা ক্যাম্পেইন, কখনো বৃক্ষরোপণ, কখনো কৃষকদের সহযোগিতা করা, কখনো গ্রামীণ নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের কাজে নিজেকে সংযুক্ত রেখেছেন।

ঘরে আবদ্ধ না থেকে করোনাকালীন মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। সুন্দরবন, খুলনা শহর, কয়রা উপজেলা এবং খুলনার বিভিন্ন এলাকায় মানুষকে মাস্ক পরার সচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করেছেন।

এ ছাড়া আত্মরক্ষা বা সেল্ফ ডিফেন্সের একটি প্রোগ্রামে বাংলাদেশের ১৬টি জেলায় পরিচালনার কাজ করেছিলেন। সেখানে বয়সন্ধিকালীন মেয়েরা বা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা সাত দিনব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ নিতে পারে। প্রশিক্ষণটির মাধ্যমে মেয়েদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলা হয়। যাতে যেকোনো ধরনের বিপদ থেকে মনোবল দিয়ে মেয়েরা নিজেকে রক্ষা করতে পারে। তিনি এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। হাফসা তাসনিম কৃষি অনুষদ থেকে এ বছর গ্রাজুয়েশন শেষ করেছেন। এবং ক্রপ বোটানি ডিপার্টমেন্টে এমএসসি করছেন। তিনি চান প্রতিটি দিন বা প্রতিটি বছর মানুষের কল্যাণে যেন কিছু না কিছু করা যায়।

জাহ্নবী

 

প্রত্যন্ত গ্রামে শিক্ষার আলো

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১২:৪৫ পিএম
প্রত্যন্ত গ্রামে শিক্ষার আলো
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে তন্ময় আলমগীর

আশপাশের গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জের নামাপাড়া গ্রামে ছিল না কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানকার ছেলেমেয়ারা শিক্ষা ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে। আধুনিক বিশ্বের মানানসই নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই। এই তাগিদ অনুভব করে গ্রামের এক স্বপ্নবাজ তন্ময় আলমগীর সুধীজনের পরামর্শ ও সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেন জিনিয়াস আইডিয়াল স্কুল।

তরুণ লেখক তন্ময় আলমগীর কর্ম জীবনে বাংলায় শিক্ষকতা করেছেন, চাকরি করেছেন দেশের বিভিন্ন পত্রিকায়। সবশেষ করোনার প্রকোপ কমতে শুরু করলে একটি দৈনিক পত্রিকার চাকরি ছেড়ে কিশোরগঞ্জ ফিরে স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন তিনি। সবার সাহস এবং উৎসাহে স্থাপিত হয় স্বপ্নের বিদ্যালয়।

‘আধুনিক ও নৈতিক শিক্ষার সমন্বয়ে আলোকিত মানুষ গড়ার প্রত্যয়ে’ নামাপাড়া গ্রামের মলাই ফকির বাজারে স্থাপিত জিনিয়াস আইডিয়াল স্কুলের শুরুটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দিয়েই। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি বই উৎসবের মাধ্যমে যাত্রা শুরু। প্রারম্ভিক যাত্রায় প্লে গ্রুপ থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ১০৫ শিক্ষার্থী নিয়ে এই স্বপ্নের আলোকিত অধ্যায়ের শুরু। পর্যায়ক্রমিক শ্রেণি বৃদ্ধির মাধ্যমে গত বছর সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ১৩৫ শিক্ষার্থী ছিল এই বিদ্যালয়ে। সংশ্লিষ্টরা স্বপ্ন দেখে জিনিয়াস আইডিয়াল স্কুল এক দিন কলেজে রূপান্তরিত হয়ে দ্যুতি ছড়াবে এই গ্রামে।

একদল দক্ষ ও শিক্ষিত মানুষের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে স্কুলের পরিচালনা পর্ষদ। যোগ্য ও মানসম্পন্ন শিক্ষক দ্বারা পাঠদান করা হয়। শিক্ষক স্থানীয় হওয়ায় শিক্ষার্থীদের প্রতি পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন। শিক্ষার মান যাচাইয়ে নিয়মিত পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে এবং অভিভাবকদের অবগতির বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয় স্কুল থেকে।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তন্ময় আলমগীর
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তন্ময় আলমগীর

 

জিনিয়াস আইডিয়াল স্কুলে প্রভাতি ও দিবা দুই শিফটে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বিনা কারণে শতভাগ উপস্থিতি না থাকলে পরবর্তী পরীক্ষায় বসতে পারে না শিক্ষার্থীরা। শুধু তত্ত্বীয় মূল্যায়ন নয়, ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হলেও প্রতি পরীক্ষার পাশাপাশি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক মূল্যায়ন ও আচরণসংক্রান্ত মূল্যায়নেরও ব্যবস্থা রয়েছে। সপ্তাহের শেষদিন বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকে উৎসবের আমেজ। এদিন নাচ, সংগীত চর্চা, অভিনয়, আবৃত্তি, সুন্দর হাতের লেখা, খেলাধুলা ইত্যাদি সৃজনশীলতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া হয়। স্কুলে নিয়মিতভাবে প্রত্যেক জাতীয় উৎসবসহ বিভিন্ন বিশেষ দিবস শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পালন করা হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছোট পরিসরে পাঠাগারও রয়েছে।

এই বিদ্যালয়টি যেভাবে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে এতে দিন দিন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। বিদ্যালয়ে আরও নতুন শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন সময়ের দাবি। শিক্ষার্থীদের জন্য স্থাপিত পাঠাগার আরও সমৃদ্ধ হবে শিশু-কিশোর বইয়ের সমারোহে। এসব সমস্যা সমাধানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা রয়েছে বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের। তারা স্বপ্ন দেখছেন মানসম্মত শিক্ষা দিয়ে আলোকিত প্রজন্ম গড়ে তুলতে। দোরগোড়ায় এমন পড়াশোনার সুযোগে পেয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকের পাশাপাশি এলাকার সচেতন মানুষও সন্তুষ্ট। এভাবে আলো ছড়িয়ে স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটে তন্ময় আলমগীরের মতো স্বপ্নবাজ যুবকরা।

জাহ্নবী