টিনএজার বা কিশোর-কিশোরীরা তো চিরকালই ছিল। ছিল না শুধু তাদের টিন টাইটেলটা। কবে থেকে তারা টিন টাইটেল পেল তা নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে! জানাচ্ছেন সুলতানা লাবু
টিনএজ বা কিশোর শব্দের উৎপত্তি
কিশোর-কিশোরী বা টিনএজার শব্দটির আবিষ্কার ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। তবে কিশোর শব্দটি পরিচিতি পেতে সময় লেগেছে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। কিন্তু কিশোর বা টিনএজাররা পরিপূর্ণ পরিচিতি পেয়েছে তারও বেশ কয়েক বছর পর। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের শিক্ষা, অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির সংমিশ্রণেই আবির্ভাব ঘটেছিল টিনএজারদের। যদিও কেউ কেউ মনে করেন কিশোর শব্দটি সতেরো শতক থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে।
কী করে তারা টিনএজার উপাধি পেল? আর কেনই বা তাদের আলাদা করা হলো?
এর পেছনে একটি গল্প আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোয় বড় ধরনের এক পরিবর্তন ঘটেছিল। তখন ছোট ছোট শহরগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক পরিবার চলে আসে বড় বড় শহরে। পেছনে ফেলে আসে তাদের পারিবারিক খামারবাড়িগুলো। যেখানে শিশু, কিশোর, প্রাপ্তবয়স্ক সবাই একসঙ্গে খামারে কৃষিকাজ করত। কিন্তু বড় বড় শহরে এসে তারা যখন বসবাস শুরু করল তখন তারা উপলবব্ধি করতে পারল যে তারা শৈশব-কৈশোরের বিলাসিতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ১৬, ১৫, ১৪ এমনকি ১৩ বছর বয়সেও তাদের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বা মহিলাদের সঙ্গে কৃষিকাজ করতে হয়েছিল। কিন্তু শহরে তা করতে হচ্ছে না। কারণ ততদিনে আমেরিকায় শিল্পায়নের অগ্রগতি হয়েছে। তাই কিশোর-কিশোরীদের আর কৃষিকাজ করতে হয় না। কিংবা কারুশিল্প শিখে মেকানিক্যাল কোনো কাজ করে তাদের উপার্জন পরিবারকে দিতে হয় না। কিশোর-কিশোরীরা তাহলে করবেটা কী? যেহেতু সেটা যুদ্ধ-পরবর্তী সময় ছিল, সেহেতু তারা তখন যুক্ত হতে থাকল যুদ্ধফেরত কিশোর ও বিপথগামী যুবকদের সঙ্গে। তাদের আচরণ উগ্র থেকে উগ্র হতে শুরু করল। ১৯৪৩ সালে তো আমেরিকান টিনএজারদের সবাই ভয়ই পেত। সবার কাছে তারা বিদ্রোহী হিসেবেই পরিচিত ছিল। এ সময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল সাধারণ মানুষের মধ্যেও। শুধু আমেরিকাতেই নয়, কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে পুরো ইউরোপেই ভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছিল ১৯৩৩ সাল থেকেই। তাদের আচার-আচরণের নানা দিক নিয়ে তখন থেকেই আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছিল। মনোবিজ্ঞানী, স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে নানাজন নানা গবেষণায় নেমে পড়ল তাদের নিয়ে। যারা যুদ্ধে গিয়েছিল কিশোর বয়সে আর ফিরে এসেছিল প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে তারাও যোগ দিয়েছিল কিশোরদের সংরক্ষণের কাজে। সবার প্রথমে লেখাপড়া তাদের জন্য বাধ্যতামূলক হলো। সেই সঙ্গে নির্ধারণ হলো কিশোর-কিশোরীদের বয়সসীমা। ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের এই দলে ফেলা হলো। ইংরেজি ১৩ (থারটিন) থেকে ১৯ (নাইনটিন) এই সংখ্যাগুলোর শেষে টিন আছে বলে এই বয়সীদের নাম দেওয়া হয় টিনএজার।
স্বীকৃতি পাওয়া প্রথম টিনএজার
১৯৪৫ সালে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ‘এ টিনএজ বিল অব রাইটস’ নামে একটি স্মারক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে টিনএজারদের অধিকার, স্বাধীনতা, আচরণ নিয়ে মোট ১০টি পয়েন্টে ভাগ করা হয়। এর পর পরই টিনএজারদের অধিকার ও যত্নের বিষয়টি আরও বেশি নজরে আসে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের। টিনএজারদের জন্য নানারকম পোশাক, জুতা, প্রসাধন ইত্যাদির বিজ্ঞাপন শুরু করে ব্যবসায়ীরা। পণ্যব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ব্যবসা ভালো চলতে লাগল বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোরও। ১৯৫০ সালে এসে আমেরিকার ছোট মেয়েরা বিখ্যাত পুলড স্কার্ট এবং বেবি সক্স পরতে শুরু করে। ছোট ছেলেরা পরতে শুরু করে চিনোস পোশাক এবং ব্রিল ক্রিম। এরাই ছিল সত্যিকার অর্থে টিনএজার স্বীকৃতি পাওয়া প্রথম কিশোর-কিশোরী বা টিনএজার।
অধিকার আদায়ে টিনএজারদের সহযোগিতা করা ও পাশে থাকা
এই সেতু পেরোনোর সময়টা শুধু টিনএজারদের জন্যই কঠিন নয়, কঠিন তাদের বাবা-মায়ের জন্যও। তবে বুদ্ধিমান বাবা-মায়ের জন্য বিষয়টা কঠিন নয়। যেমন, একজন আমেরিকান টিনএজার তার মায়ের কাছে অনুমতি চাইল, সে তার বন্ধুদের বাসায় আমন্ত্রণ জানাবে। সারা দিন বন্ধুদের নিয়ে অনেক মজা করবে। মা জানেন, বন্ধুরা মজা করতে গিয়ে তার ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড করবে। তাহলে মা তখন কী করবেন? অনুমতি দেবেন! নাকি বাধা দেবেন। যেহেতু মজা করার অধিকার তার আছে তাহলে বাধা তো দেওয়াই যাবে না। অনুমতি দিতেই হবে। তবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সে অনুমতি দিতে হবে। মা বলবেন, ‘অবশ্যই বন্ধুরা আসবে। অনেক মজা করবে। তবে ঘরবাড়ি এলামেলো করা চলবে না। আর নিজেদের মজা করার জন্য যাতে অন্য কারও অসুবিধা না হয় সে দিকে খেয়াল রাখা তোমার এবং তোমার বন্ধুদের কর্তব্য। তোমার বন্ধুদের জন্য আমি বিশেষ কোনো খাবারের ব্যবস্থা করব কি?’ এরকম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই টিনএজারদের পাশে থাকতে হবে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবাইকে।
শুধু তাদের আনন্দ করার অধিকারে পাশে থাকলেই চলবে না। তাদের সব ধরনের অধিকারেই পাশে থাকতে হবে। যেমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার। ভুল করার অধিকার। অনেকে মনে করেন ভুল করা আবার অধিকার হয় কী করে? মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, টিনএজারদের অবশ্যই ভুল করার অধিকার রয়েছে। তাদের ভুল করতে দিতে হবে। কারণ ভুলের মাধ্যমেই সে নিজেকে আবিষ্কার করতে শিখবে। আর ভুল করতে না দিলে বড় হয়ে বড় বড় ভুল করবে। এবং ভুল সিদ্ধান্তে নিয়ে জীবনে অনেক কষ্ট ভোগ করবে। টিনএজারদের তারা যত্নের সঙ্গে লালন পালন করে। কারণ এরাই ভবিষ্যতের সম্পদ। তারাই একদিন নেতৃত্ব দেবে। আরও সফলভাবে এই ভবিষ্যৎ সম্পদকে রক্ষার জন্য বর্তমানে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের তারা প্রি-টিন উপাধি দিয়েছে। কারণ এ সময় থেকেই অনেকের বয়ঃসন্ধির লক্ষণগুলো শুরু হয়ে যায়। পুরো বিশ্ব এখন টিনএজারদের যত্ন নিচ্ছে। আমরাও আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পদ রক্ষার জন্য আমাদের টিনএজারদের যত্ন নেব।
টাইটেল পাওয়ার আগে টিনএজাররা কোন দলে ছিল?
শব্দের ব্যবহার যেদিন থেকেই হোক না কেন বিশ শতকের আগে তারা টিন উপাধিটি পায়নি। তখনই টিনএজারদের আলাদা করা হয়েছিল। আর এই আলাদা করার ফলে তারা শিশু এবং বড়দের মধ্যে একটা সেতু তৈরি করেছে। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই সেতুর তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়। তার আগে টিনএজারদের কেউ কেউ ছিল শিশুদের দলে। কেউবা আবার বড়দের দলে। কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক গঠন বা সক্ষমতা একটু বেশি হলেই তারা পড়ে যেত বড়দের দলে। বড়দের সঙ্গে বড়দের মতো নানা কাজ করতে হতো।
টিনএজ বয়স কেন গুরুত্বপূর্ণ
আলাদা করার পর থেকেই টিনএজারদের নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। শুরু হয় টিনএজারদের জন্য মুভি, নানারকম ফ্যাশনের জিনিস, খেলাধুলা ইত্যাদি।
মনোবিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করলেন, কেমন হওয়া উচিত কিশোর-কিশোরীদের আচরণ? তাদের সঙ্গেই বা অন্যরা কেমন আচরণ করবে? টিনএজ বয়সে তাদের মনের কী কী পরিবর্তন হতে পারে? স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরাও থেমে থাকেননি। তারাও নানা গবেষণার মাধ্যমে খুঁজে বের করলেন টিন বয়সীদের শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানসিক পরিবর্তনের সামঞ্জস্য। তারা এর নাম দিয়েছিলেন বয়ঃসন্ধিকালীন বয়স। এই সময়টি তাদের জন্য একটি বিশেষ সময়। টিন-এ প্রবেশ করে তারা শৈশবের ইতি টানছে। আর টিন পেরোলেই যোগ দেবে বড়দের দলে। এই সময় যেহেতু তাদের শরীরিক পরিবর্তন ঘটে, সেহেতু মনেরও অনেক রকম পরিবর্তন ঘটে। তাই তাদের শরীর এবং মনের ওপর দিয়ে বিশাল এক ঝড় ও চাপ বয়ে যায়। তাদের জন্য এটি একটি সেতু।
জাহ্নবী