একটি পাঠাগার গড়ার লক্ষ্যে শ্রম, মেধা কোনোকিছুরই কমতি রাখেননি তিনি। অনেক বাধার মুখে পড়েছেন। তবু তারুণ্যের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে ঠিকই তিনি গড়ে তুলেছেন পাঠাগার। আজ সেই পাঠাগার এলাকার গর্বের অংশ। নিজের সেই পাঠাগার গড়ে তোলার গল্প শোনাচ্ছেন প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গ রাখাল
বাবা গানপ্রিয় মানুষ ছিলেন। কোথাও গাজীর গান, অষ্টকগান, যাত্রাপালা কিংবা কীর্তন হলে সেখানেই ছুটে যেতেন। বাবা কোন শিল্পী না হলেও জীবন যাপন ছিল এসবকে কেন্দ্র করেই। সাদাসিধা জীবন যাপনে সদালাপী ভালো মানুষ। আমি কিংবা আমরা চার ভাইবোন সেই শিক্ষা পেয়েছি। বাবা আমাকে যেখানেই গাজির গান, কীর্তন বা বায়োস্কোপ হতো সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।
এছাড়া আমি গ্রামের মা কাকিদের কাছে শুনে শুনে শ্লোক, প্রবাদ-প্রবচন সংগ্রহ করতাম। এভাবেই আমার সাহিত্যের পথে ধীরে ধীরে পদার্পণ। তবে বাবার সঙ্গে বেড়ানো আমাকে উদারতার শিক্ষা দিয়েছে। বাবাও অনুভব করতে পেরেছিলেন, আমি লেখতে পারি।
স্কুলে থাকা অবস্থায় করেছিলাম নভেলটি ক্লাব। পরে কয়েকজন মিলে গ্রামে করেছিলাম টুরিস্ট সংঘ। সেখান থেকে মানুষের সাহায্য সহযোগিতাসহ আমরা যশোর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে পরিদর্শন করে আসি। মানুষের জন্য কিছু করলে মনের মধ্যে এক ধরণের প্রশান্তি কাজ করে। ছোটবেলা থেকেই আমার প্রচুর বইপড়ার নেশা। নিজে কিনে কিংবা অন্যের কাছ থেকে সংগ্রহ করে পড়েছি। বাবার কাছ থেকে টিউশন ফি বেশি করে নিয়ে সেই টাকা দিয়ে গল্প- কবিতা- উপন্যাসের বই কিনে পড়েছি। মানুষ আলনাতে জামা-কাপড় রাখে আমি সেখানে বই রেখেছি। সেই ছোটবেলা থেকেই অনেকে আমার কাছ এসেছে; বই ধার নিয়ে নিয়ে পড়েছে। বাবা বলতেন, আমার বাজানের এত বই- সবাই যখন তার কাছ থেকে বই নিয়ে পড়ে তখন আমার খুব ভালো লাগে।
২০০৯ সালে নভেম্বরে খুলনার আড়াইশ বেড হাসপাতালে আমাদের চোখের সামনে বাবা মারা যান। বাবাকে হারানোর পর থেকেই আমার মধ্যে একটা বিষয়ই কাজ করত, কিভাবে বাবাকে ধরে রাখা যায়। তখন মনে হলো আমি যেহেতু পড়তে ভালোবাসি, সর্বদা বই নিয়ে থাকি, তাহলে বাবার নামে পাঠাগার করতে পারি। বইও পড়া হল, বাবাকে স্মরণ রাখাও হল সমাজের মানুষেরও উপকারও হল।
আমার যে সব বই ছিল তা দিয়েই নিজের থাকার ঘরে ২০১৪ সালে শুরু করেছিলাম পাঠাগারের কার্যক্রম। আমার বইগুলো হয়ে গেল সবার বই। গ্রামের কিছু বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করলাম পাঠাগার করার জন্য। প্রথমদিকে কয়েকজন আমার সঙ্গে থাকলেও পরে আর কেউ আমার সাথে থাকেনি। আমি তবুও থেমে যাইনি। নিজে নিজেই কাজ করে চলেছি বরং আরও দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে। এবার ভাবলাম যেহেতু আমাকেই সব করতে হচ্ছে সেহেতু আমার বাবার নামেই আমি পাঠাগার করব। এতোদিন নাম না থাকা পাঠাগার হলেও এর পর থেকে ‘গোলাম রসুল স্মৃতি পাঠাগার’ নামে শুরু হলো নতুনভাকে কার্যক্রম। বাবার নামে পাঠাগারের নাম দেওয়ার কারণে যে দু-একজন সঙ্গে ছিলেন তারাও সরে গেলেন।
এই পাঠাগার নিয়ে কাজ করতে এসে অনেকে পাগল বলেছে, কত লোক বলেছে রোজগার না করে পাঠাগার করছে, কে এই আউট বই পড়বে? আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন বলতো এই ছেলে কোনদিন মানুষ হবে না। যেখানে মানুষ অর্থের চিন্তা করে সেখানে তিনি সমাজ উদ্ধার করবে দাদা হাতেমতাই হয়েছে। এতো কিছুর পরেও বাবা চলে যাওয়ার পরে মা উৎসাহ যুগিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। নিজের কানের গয়না বিক্রি করে অর্থ দিয়েছেন কাজ করে যাওয়ার জন্য। তার উৎসাহ অনুপ্রেরণায় আজ আমাদের পাঠাগারের কাঠামো হয়েছে।
একবার পাঠাগারের কিছু দরকারি কাগজপত্র স্বাক্ষরের জন্য আমার ছোটবোন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে গিয়েছিল কিন্তু সে না থাকায় অ্যাসিল্যান্ডের কাছে স্বাক্ষরের জন্য গেলে তিন তো স্বাক্ষর করেনইনি, উল্টো অপমান করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এখানে এসেছে স্বাক্ষর নিতে? এখন কেউ বই পড়ে? যতসব টাকা খাওয়া ধান্ধা।’
আমার ছোটবোন বাড়িতে এসে আমার কাছে কেঁদেছিল। এতো কিছুর পরেও আমরা দমে যাইনি। কারণ এই পাঠাগারের সাথে আমার বাবার স্মৃতি জড়িত। আজ সেই পাঠাগারের পূর্ণাঙ্গতা এসেছে, বসার জায়গা হয়েছে, যে কেউ এসে পড়তে পারবে-সাহিত্যের আড্ডা দিতে পারবে। এই পাঠাগারে এখন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার হয়েছে। এই পাঠাগারের উদ্যোগে ঝিনাইদহ জেলার সব কবি-সাহিত্যিক নিয়ে সম্মিলন হয়েছে। এখান থেকে দোতারা নামে পাঠাগারের মুখপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এখন প্রতিনিয়ত সাহিত্য আড্ডা হচ্ছে। সমাজের প্রগতিশীল মুক্তমনা কবি-সাহিত্যিকদের এই পাঠাগারকে কেন্দ্র করে সকলের সাথে পরিচিত করে দিতে পারছি।
কিন্তু প্রথমে এর পথ চলা এত সহজ ছিল না। অনেক কুকথা শুনতে হয়েছে। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও কাজ করে যাচ্ছি মানুষকে বইমুখী করার লক্ষ্যে। সমাজের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যেতে চাই, নিজের ঐতিহ্যকে লালন করেই এগিয়ে যেতে চাই সামনের দিকে।। শুধু একটা কথাই ভাবি-
একটা আলোর পরশ পেলে
লক্ষ প্রদীপ জ্বলে
একটা মানুষ মানুষ হলেই
বিশ্বজগৎ চলে।
জাহ্নবী