একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী দিন। বাঙালি জাতীয় জীবনের সব চেতনার উৎস হচ্ছে এই দিন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার ঐতিহাসিক দিন এটি। এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, পৃথিবীতে রক্ত দিয়ে কথা বলার অধিকার আদায়কারী জাতি হওয়ার দুর্লভ ইতিহাস রচিত হয়েছে এই একুশে ফেব্রুয়ারিতেই! এই দিনকে ঘিরে ঘটে যাওয়া অনেক তথ্য অজানা রয়ে গেছে আমাদের কাছে। তেমনি কিছু তথ্য জানাচ্ছেন শাহরিয়ার আহমেদ।
একুশের প্রথম কবিতা
একুশের রক্তাক্ত স্মৃতির প্রথম প্রতিবাদী প্রকাশ চট্টগ্রামের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মাহবুব-আলম-চৌধুরীর অগ্নিগর্ভ দীর্ঘ কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি’ নিয়ে এসেছি। আমাদের ইতিহাসে অগ্নিসাক্ষী এই কবিতা। তীব্র জ্বালাময় অভিব্যক্তি নিয়ে এই কবিতায় প্রথম একুশের পতাকা কাঁধে তুলে নিয়েছিল।
১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি লেখা এই কবিতার সুর চড়া এবং প্রতিবাদী গদ্যকথার ঢঙে এর প্রকাশ। এখানেও সেই কৃষ্ণচূড়া, আগুন, রক্ত, আলপনা সবই আছে যা প্রতিবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। কিন্তু এর মূল সুর ক্রোধের, ঘৃণার এবং শত্রুর বিরুদ্ধে সেই সঙ্গে প্রতিশোধেরও। প্রত্যক্ষভাবে সরকারবিরোধী বক্তব্যসংবলিত কবিতা সহ্য করা পাকিস্তানের স্বভাব ধর্ম ছিল না। তাই এই কবিতাটি ছাপানোর সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ করা হয়।
একুশের প্রথম সংকলন
একুশের আবেগ, এর উত্তাপ এতটাই তীব্র ও গভীর হয়ে লেখক বুদ্ধিজীবীর চেতনায় দাগ কেটেছিল যে এর প্রভাব দেখা যায় হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ১৯৫৩ সালে মার্চ মাসে প্রকাশিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে। কবিতাই এখানে প্রধান এবং প্রতিটি কবিতায় আবেগ এবং উত্তাপই প্রধান। এই বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা নিষিদ্ধ করা হয়। শুধু তা-ই নয়, এই বইয়ে যাদের লেখা ছাপানো হয়েছিল তাদের সবার নাম কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, যাতে চাকরি কিংবা অন্য কোনো রকম সুবিধা তাদের দেওয়া না হয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য তাদের অনেক ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়েছে।
একুশের প্রথম গান
একুশের প্রথম গান আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। তখনকার তরুণ ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা এই গানটি শুরুতে ছিল কবিতা, পরে সুরারোপিত হয়ে গানের মর্যাদা পেয়ে যায়। এই গানটির প্রথম সুর করেছিলেন আব্দুল লতিফ। পরবর্তী সময়ে চার্চ সংগীতের অনুকরণে এতে পুনঃসুরারোপ করেন সুরকার আলতাফ মাহমুদ। কবিতাটি বায়ান্ন সালেই লেখা হয়েছিল। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত এই গান আবছা ভোরের আকাশ মথিত করে এই বেদনা নিয়ে: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ করুণ সুরে প্রতিটি ধ্বনির গা-বেয়ে একুশের মর্মবেদনা শিশিরের মতো ঝরে পড়তে থাকে। আর মিছিলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
একুশের প্রথম নাটক
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের শিল্প-সাহিত্যে আসন করে নিয়েছে ’৫২ সাল থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী জেলখানায় বসে একুশে ফেব্রুয়ারিকে পটভূমি করে লিখেছেন ঐতিহাসিক নাটক ‘কবর’, সেখানেই সেটা মঞ্চস্থ হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা নাটকটি পড়লে বোঝা যায় পাকিস্তানি শাসকদের ভণ্ডামিকে তিনি কেমন বিদ্রূপ করেছেন। নাটকটিতে লেখক দেখিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের শহিদরা কবরে যেতে চান না।
পাগলা মুর্দা ফকির, পুলিশ আর নেতাকে জানিয়ে দেয় যে, বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ যত নিচেই কবর দাও, এ লাশ কবরে যাবে না। মুর্দা ফকিরের কথা সত্য হয়েছিল ’৭১ সালে। ভাষা আন্দোলনের সেই শহিদরা ’৭১-এ লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে এসেছিল। মুনীর চৌধুরী ছিলেন সে ধরনের শিল্পী, যিনি মানুষকে ভবিষ্যৎ দেখাতে পারতেন।
একুশের প্রথম উপন্যাস
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম কর্মী জহির রায়হান রচনা করেছিলেন অসাধারণ একটি উপন্যাস ‘আরেক ফাগুন’। যা একুশের পটভূমিতে রচিত প্রথম উপন্যাস। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে তার একটি দুর্দান্ত গল্প আছে। তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’তেও একুশের কথা আছে। আমাদের দেশের শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সবাই একুশ উপলক্ষে কিছু না কিছু সৃষ্টি করেছেন- যুগে যুগে সংগ্রামের প্রেরণা হিসেবে অম্লান করে রেখেছেন।
লেখক : একাদশ শ্রেণি,সরকারি বিজ্ঞান কলেজ।
কলি