আমার পেশাজীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে। এখনো তাদের জন্যই কাজ করছি। শিশু-কিশোরদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আনন্দে তাদের উচ্ছ্বসিত হতে দেখেছি। হতাশায় মিইয়ে যেতে দেখেছি। কৌতূহলের বয়স কৈশোরকাল। এ সময় ছেলেমেয়েদের মনে নিজ শরীর নিয়ে, নারী-পুরুষের সম্পর্ক, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি বিষয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। মনের ভেতর অদ্ভুত সব প্রশ্ন নিয়ে তারা ছটফট করে।
কিছু জানতে ইচ্ছে করলে বড্ড মুশকিলে পড়ে যায়। তারা তখন এসব বিষয় নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে আলোচনা করতে স্বস্তি বোধ করে না। আবার হুট করে বড়দেরও এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে পারে না। তখন তারা সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তারা যেহেতু সমবয়সী তাদের অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকমের। তাই সব সময় সঠিক উত্তর পাওয়া সম্ভব হয় না। আবার অনেকে তাদের ধারণা থেকে উত্তর দিয়ে থাকে। যা সঠিক না-ও হতে পারে।
তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য বই লিখব। শুরুতে কিশোরীদের জন্য, তারপর কিশোরদের। কিশোরীদের বিপদাপন্নতা অনেক বেশি। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অনাহুত চাপের কারণে তাদের সঠিক বিকাশ সম্ভব হয় না।
প্রকাশনা সংস্থা ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ এগিয়ে এল। তারা কিশোরী সুরক্ষা বিষয়ে সিরিজ বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় লিখলাম দুটি বই। ‘কিশোরী মনের যত্ন’ এবং ‘কিশোরী তোমায় জানতে হবে’।
কিশোরীরা প্রবলভাবে আবেগ অনুভব করতে থাকে। বলা যেতে পারে আবেগ-অনুভূতির তীব্র উপলব্ধি কৈশোরকালে শুরু হয়। তখন তারা শৈশব থেকে কৈশোরের মধ্য দিয়ে তারুণ্যে পৌঁছাতে চায়। শৈশবের উচ্ছলতা আর তারুণ্যের দায়িত্বশীলতার মাঝখানে কৈশোরকালে কিশোরীদের ভেতর সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা দেখা দেয়।
আর তাতে তাদের এক ধরনের টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। যেখানে শৈশবের চঞ্চলতাকে সরিয়ে পরিবার ও সমাজের নানান রীতিনীতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সে কী করবে আর কী করবে না।
কিশোরীরা তাই অনেক সময় বেশ অসহায় ও একা বোধ করে। তারা ভাবে, তাদের কেউ বুঝতে পারছে না। কিংবা বুঝতে চাইছে না। তখন তারা নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বা নিঃসঙ্গ অবস্থায় সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আবার অনেকে এ সময়ের অধিক স্বাধীনতাকে সংগঠিত কোনো কাজে না লাগিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। তার পর একসময় তারাও হতাশ হয়ে পড়ে।
একই সময়ে আবার কিশোরীরা নতুন, উত্তেজনাকর ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা পেতে ব্যগ্র হয়ে ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের আচরণের মধ্যে কী কী ঝুঁকি থাকে তাও হয়তো তারা জানে, কিন্তু বিশ্বাস করে যে, আমার ক্ষেত্রে এ রকম কিছু কখনোই ঘটবে না। তাতে তারা ঝুঁকি নিয়ে বড় কোনো সংকটে আটকে যায়।
কিশোরীরা যেন বই পড়ে তাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে পারে, তাই কিশোরী মনের যত্ন বইতে রাখা হয়েছে- আবেগ ও অনুভূতি, মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, উদ্বেগ, প্যানিক অ্যাটাক, ব্যায়াম, ধূমপান ও মাদকাসক্তি, পারিবারিক সম্পর্ক, কিশোরীর প্রতি সহমর্মিতা এবং যেমন করে হওয়া যায়, ভালো বাবা-মা সম্পর্কিত বিষয়সমূহ।
আর ‘কিশোরী তোমায় জানতে হবে’ বইতে বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিশোরীকে আত্মবিশ্বাসী ও সক্ষম করে তোলার সহায়ক বিষয় সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এ বইতে আছে- কৈশোরকাল ও কিশোরী ভাবনা, কিশোরীর বেড়ে ওঠা, কিশোরীর ডায়েট, জেন্ডার সমতা ও সাম্য, কৈশোরে বিয়ে নয় এবং নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহার। বই দুটি লেখার সময় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা আমাকে সহযোগিতা করেছেন তথ্য দিয়ে। তা ছাড়া কিশোরীদের নিয়ে কাজ করে এমন অনেক সংস্থা থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও ম্যানুয়াল থেকে হালনাগাদ তথ্য নিয়েছি।
এ বই কিশোরীদের জন্য। আর তাদের জন্য যারা কিশোরীর সাহচার্যে থাকেন। যাদের কাছ থেকে কিশোরীরা সহযোগিতা প্রত্যাশা করে। কিশোরীদের জীবনমুখী সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে অভিভাবক, পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রকে এই বই সাহায্য করবে।
কলি