‘দিজ ট্রেন ইজ বাউন্ড ফর মতিঝিল’। কিংবা ‘নেক্সট স্টেশন ইজ আগারগাঁও’। অথবা ‘দরজা থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ান’। মেট্রোরেলে চড়লেই আমরা এমন অনেকগুলো নির্দেশনা শুনতে পাই। কিছুক্ষণ পর পর নারী কণ্ঠের এই দিকনির্দেশনাগুলো শোনার অপেক্ষায়ও থাকি। কান পেতে থাকি কখন সেই কণ্ঠটি আমাকে জানাবে আমার গন্তব্যের খবর। শুনতেও বেশ ভালো লাগে। তবে সেই সঙ্গে মনে প্রশ্নও জাগে। এটা কি বাস্তব কোনো নারীর কণ্ঠ? নাকি মেশিন জেনারেটেড কোনো ভয়েস। না, এটি আসলে মেশিন জেনারেটেড ভয়েস নয়। এই মিষ্টি কণ্ঠটি কিমিয়া অরিনের।
কিমিয়া অরিন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। বাংলাদেশে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে একটি সফটওয়্যার ফার্মে কাজ করেছেন অনেকদিন। বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতারে ইংরেজি সংবাদ পাঠ করতেন। সব মিলিয়ে দেশে নয় বছর কাজ করেছেন কিমিয়া অরিন। মেট্রোরেলে কণ্ঠ দেওয়ার কাজটি করলেও মেট্রোরেল চালু হওয়ার আগেই তিনি লেখাপড়ার জন্য বিদেশে চলে যান। কিমিয়া অরিন বর্তমানে হিউম্যান কম্পিউটার ইন্টারাকসানের ওপর মাস্টার্স করতে কানাডায় আছেন। মেট্রোরেলের নারী কণ্ঠ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশের মানুষের নানা কৌতূহল ও মন্তব্য নিয়ে বন্ধুরা প্রায়ই তাকে ফোনের স্ক্রিনশট পাঠায়। বন্ধুরা জানায়, বেশির ভাগ মানুষই নাকি মনে করেন, এটা তাদের কম্পিউটারের আপা। সাধারণ মানুষ এমনটা ভাবতেই পারে। কেননা প্রথম দিকে তিনি যখন তার পরিবার, বন্ধু বা পরিচিতদের বলতেন, মেট্রোরেলের কণ্ঠটি তার নিজের, কেউ বিশ্বাসই করতে চাইত না। তখন বিশ্বাস করানোর জন্য তাদের নিজের ইউটিউব চ্যানেলের লিংক দিয়ে কণ্ঠ মিলিয়ে দেখতে বলতেন।
কিমিয়া অরিন একবার টরেন্টোয় মেট্রোরেলে চড়ে যাচ্ছিলেন আর নির্দেশনা শোনার অপেক্ষা করছিলেন তখন তার দেশের কথা মনে পড়ছিল। কিমিয়া তখন ভাবছিলেন, আমার দেশেও মানুষ আমার মতো ট্রেনের নির্দেশনা শোনার অপেক্ষা করে। আর সেটা আমারই কণ্ঠ। হাজার মাইল দূরে থেকেও আমি দেশের মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এটা ভাবতেই তার দারুণ লাগছিল। মেট্রোরেল শুরু হওয়ার বেশ কিছুদিন পর একবার তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। কোথায় কোথায় তার কণ্ঠ আছে তা দেখার জন্যই তিনি এসেছিলেন। তখন মেট্রোরেলে উঠেছিলেন আত্মীয় ও বন্ধুদের বিশাল এক দল নিয়ে। সবাই মিলে নির্দেশনাগুলো কোরাস করে বলেছিলেন। এটা ছিল তার কাছে খুব মজার ব্যাপার। তবে প্রথম যখন মেট্রোরেলে নিজের কণ্ঠ শুনেছিলেন তিনি তখন খুব এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলেন। সবাই তার দিকনির্দেশনা শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন। বিষয়টি ছিল তার কাছে যেমন ভালোলাগার তেমনি ভীষণ ভরসার। তবে কিমিয়া যখন কাজটা শুরু করেছিলেন তখন কিন্তু তা মজার ছিল না। বরং ছিল ভীষণ কষ্টের।
এজন্য তাকে অনেক পরীক্ষা দিতে হয়েছে। অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাকে কণ্ঠ দিয়ে যেতে হয়েছে। তার কণ্ঠটি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমে তিনি টিকিট ভেন্ডিং মেশিনের কাজটি করেছেন। এরপর প্লাটফর্মের ভয়েস। তারপর ট্রেনের ভেতরের ভয়েস। এমনও হয়েছে সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কণ্ঠ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন কিমিয়া। রাত ১১টার দিকে গলা দিয়ে আর যেন কোনো আওয়াজই বের হতে চাইছিল না। এদিকে স্টুডিও থেকে একের পর এক চায়ের পেয়ালা আসছিল। যত যাই হোক আর যতক্ষণই লাগুক কাজটা তাকে শেষ করতেই হবে। অবশেষে তিনি সফলভাবে কাজটি শেষ করেছেন। বর্তমানে উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সবচেয়ে দ্রুতগামী এই গণপরিবহনটি সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলছে। ১৬টি স্টেশন থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী বহন করার মতো এই গণপরিবহনের যাত্রীরা তার কণ্ঠে নির্দেশনা শুনে চলেছেন। কণ্ঠসেবা দিয়ে সহযোগিতা করে চলেছেন হাজার হাজার মানুষকে।
জাহ্নবী