ঈদের শাব্দিক অর্থ বার বার ফিরে আসা। অর্থাৎ খুশি বা আনন্দটা বার বার ফিরে আসে বলেই এর নাম ঈদ। দিনের সঙ্গে যেমন রাতের সম্পর্ক রয়েছে, আলোর সঙ্গে যেমন অন্ধকারের যোগাযোগ রয়েছে, তেমনি দুঃখকষ্টের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে আনন্দ, সুখ। যে কোনো সাধনাই কষ্টের। একমাস সিয়াম সাধনাও তেমনি এক কষ্টকর বিষয়। এবং এই কষ্টের পর আল্লাহর তরফ থেকে উপহার হিসেবে বান্দার জন্য দেওয়া হয়েছে খুশি বা ঈদ। এ থেকে বোঝা যায়, জীবনে অনেক রকম কষ্ট আসবে, দুঃখ আসবে। তাই বলে হতাশ হওয়া যাবে না। কারণ কষ্টের পর আনন্দ বা খুশি আসবেই।
পৃথিবীর প্রায় দুইশ কোটি মুসলমান ঈদ আনন্দ উপভোগ করেন। আমরা যেমন ঈদ উল ফিতরকে বলি রোজার ঈদ। আজারবাইজানের লোকেরা বলে ‘রামাজান বায়রামি’। মধ্যপ্রাচ্য এবং এর আশপাশের দেশগুলোতে ঈদ উল ফিতরকে এভাবেই উচ্চারণ করে। ইন্দোনেশিয়ায় বলে ‘লেবারান।’ সেনেগালে বলে ‘করিতি’। তবে যে যেভাবেই বলুক, ঈদ উল ফিতর বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য একই রকম আনন্দ ও খুশি নিয়ে হাজির হয়। কেবল আনন্দ উদযাপনের ধরনটা বৈচিত্রময়। পৃথিবীর নানান জাতি-গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব রীতি ও ঐতিহ্য অনুসারে ঈদ পালন করে থাকে।
বিশ্বের অন্যতম মুসলিম দেশ তুরস্ক। আজারবাইজানের মতো ওই দেশেও ঈদ উল ফিতর পরিচিত ‘রামাজান বায়রামি’ অথবা ‘সেকের বায়রামি’ নামে। রামাজান বায়রামি অর্থ রমজানের ভোজ আর সেকের বায়রামি অর্থ মিষ্টান্ন ভোজ। আমাদের দেশের মতোই ঈদের দিন তুরস্কের সবাই নতুন জামা-কাপড় পরে ঈদের নামাজ পড়ে। নামাজ শেষে কোলাকুলি করতে করতে একজন অন্যজন্যকে শুভেচ্ছা জানায় ‘বায়রামিনিজ মুবারক’ বলে। এর অর্থ তোমার ঈদ সুন্দর হোক। তুর্কিরা কোলাকুলির পর ছোটরা বড়দের বাড়িয়ে দেওয়া ডানহাতে চুমু খায়। শিশুরা প্রতিবেশিদের ঘরের দরজায় দরজায় ছুটে বেড়ায়। প্রতিবেশিরা এদিন তাদের ঘরের দরজায় দরজায় তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন বাকলাভা আর তুর্কিশ ডেলাইট, চকোলেট এবং ঈদ সেলামি রেখে দেয়। শিশুরা যার যার প্রয়োজন মতো খাবার খায় আর ঈদ সেলামি নিয়ে নেয়। ঈদ উৎসব পালনের জন্য আমাদের দেশের মতো তিনদিনের সরকারি ছুটি থাকে তুরস্কে।
পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া। ও দেশের ঈদ উদযাপন তুর্কিদের চেয়ে একটু ভিন্ন। অন্যান্য মুসলিম দেশের মতোই ইন্দোনেশিয়াতেও ঈদের ছুটি থাকে। এই ছুটিতে পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে মিলিত হয়। ইন্দোনেশিয়ানদের ঈদ পালনের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য হচ্ছে ‘মুডিক’। ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় মুডিক অর্থ নদীপথে যাত্রা করা বা পাল তোলা। সোজা বাংলায় বললে মুডিক মানে বাড়ি ফেরা। ইন্দোনেশিয়ার বড় বড় শহরে অনেক মানুষকে কাজের জন্য থাকতে হয়। কিন্তু ঈদের সময় পরিবারের সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে সবাই বাড়িমুখো হয়। এটাকেই ওরা মুডিক বলে।
বাংলাদেশের মানুষও বড় বড় শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে কিংবা জন্মভিটায় ঈদ উদযাপন করতে ছুটে আসে। বিষয়টা ঠিক একই রকম। এই ঈদ উল ফিতরের সময় ইন্দোনেশিয়ানদের আরেকটা রীতি খুব উল্লেখযোগ্য। ওটার নাম ‘হালাল বিহালাল।’ তবে এটা ঈদের পরেই পালন করে ওরা। বিষয়টা হচ্ছে ঈদের পর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী ও প্রতিবেশিদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর একজন আরেকজনের কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেয়। অনেক সময় পরিচিতদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি কিংবা বেয়াদবি বা অন্যায় হয়ে যায়। ঈদের পর দেখা করে সেই ইচ্ছা-অনিচ্ছাকৃত অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাওয়াটার রীতিই হচ্ছে হালাল বিহালাল।
শিশুদের ঈদের সালামি নেওয়ার রেওয়াজও আছে আমাদের মতো। তবে শিশুদের ঈদের সালামি দেওয়া হয় একটু অন্যরকমভাবে। শিশুরা বড়দের সঙ্গে দেখা করতে এলে রঙিন খামের মধ্যে পুরে তাকে ঈদসালামি দেওয়া হয়। ঈদ উপলক্ষ্যে পরিচিত ও আত্মীয়-পরিজনের কবর জিয়ারত করাও ওদের রীতি।
মালয়েশিয়ানরাও কিন্তু ঈদের সময় বাড়িতে ছুটে আসে। তবে মালয়েশিয়ানরা একটু সৌখিন ধরনের রীতি পালন করে। বাড়িতে এসেই তারা ‘পেলিটা’ দিয়ে ঘরদোর সাজিয়ে তোলে। পেলিটা হচ্ছে তেলের বাতি। ঈদ উপলক্ষ্যে ঐতিহ্যবাহী খাবার কেটুপাট, রেনডাং রান্না করে। ঈদে বাড়িতে অতিথি এলে কেটুপাট ও রেনডাং দিয়ে আপ্যায়ণ করে। কেটুপাট হচ্ছে ভাত আর রেনডাং হচ্ছে রান্না করা মাংস। ঈদ উল ফিতরকে মালয়েশিয়ানরা বলে ‘হারি রায়া অ্যাইডিলফিতরি।’ অর্থাৎ ঈদ উল ফিতর উদযাপন। মালয়েশিয়ানদের ঈদ পালনের আরেকটা ঐতিহ্য হচ্ছে, যে কেউ যে কারো বাড়িতে যখন তখন ঢুকতে পারে। অর্থাৎ ঈদের দিনে ওদের বাড়ির সদর দরজা সবসময় খোলা থাকে যে কোনো অতিথির অপেক্ষায়।
আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোতেও প্রায় একই রকমভাবে ঈদ উৎসব পালিত হয়। তেমনি একটি দেশ কেনিয়া। এই কেনিয়া নামক দেশটির একটি প্রদেশ হচ্ছে মম্বাসা। মম্বাসায় ঈদ উদযাপনের রীতি কিন্তু দুনিয়ার অনেক জায়গা থেকে ভিন্ন তবে বেশ মজার। ওদের ভাষায় ‘কুমি লা মউইশো’ মানে রোজা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ ঈদের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ওদের ঈদ আনন্দ শুরু হয়ে যায়। রাস্তায় রাস্তায় সবাই নেমে আসে উৎসবের আনন্দে। পছন্দের কাপড়চোপড় কেনে- নিজের জন্য, প্রিয়জনের জন্য, পরিবারের সদস্যদের জন্য। আর সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, কিছু কিছু জায়গায় ঈদ উপলক্ষ্যে রাস্তার ওপর বসে যায় গল্প বলার আসর। গল্পবলিয়েরা এদিন শিশুদের আনন্দ দেওয়ার জন্য রূপকথার গল্প শোনান। শিশুদের কাছে এটা বিশেষ আনন্দের। আর এই আনন্দ ঈদ উপলক্ষ্যেই পাওয়া যায়।
জাহ্নবী