সতেরো বছরের নভোদীপ কাউর নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের একটি বিউটি পারলার ওর মায়ের অবর্তমানে সামলাচ্ছিল। এখনো সে ভোটার হয়নি। তবে নিশ্চিত জানে, মা-বাবা একদম ৫ তারিখেই ভোট দিতে যাবেন এবং কমলা হ্যারিসই সেই ভোট পাবেন।
নভোদীপের মায়ের এই সাঁলোতে মাস দুই আগে আমি একবার এসেছিলাম। তখন যে হিজাব পরা পাকিস্তানি নারীকে কাজ করতে দেখেছি, তাকে এবার দেখলাম না। তবে ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসর থেকে আসা নভোদীপের মামাতো দিদিও এই দোকানে কাজ করছে। সে গ্রিনকার্ড পেয়েছে।
‘কমলা এলে ওর সিটিজেনশিপ হয়ে যাবে। ডেমোক্র্যাটরা এলে অভিবাসীরা ভালো থাকে,’ বেশ হাসি হাসি মুখে জানায় নভোদীপ।
এই পারলারে শ্বেতাঙ্গ কাস্টমার দুই দিনের এক দিনও দেখিনি। তবে গতকাল একটি কালো (আফ্রো-আমেরিকান) মেয়েকে দেখলাম ঢুকেছে। নাম জিজ্ঞাসা করায় সে বলল তার নাম ‘ডেইজি’। ডেইজি ভোট দিতে যাবে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে চুপ করে থাকায় নভোদীপই আমার দিকে তাকিয়ে এবার ইংরেজির বদলে হিন্দিতে বলে, ‘আভি কাস্টমারকো সাথ ইলেকশন কি বাত মাত কিজিয়ে!’ (এখন কাস্টমারের সঙ্গে ভোট নিয়ে কথা বলবেন না)
মনে মনে বললাম, দূর... ‘ইলেকশন কি বাত’ করার জন্যই তো রাস্তা পার হয়ে এই সাঁলোতে এলাম। এখানেও আলাপ করা যাবে না? এক দিন পরেই যে ভোট।
প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাটদের সংকট
এলাম পাশের স্টারবাকস কফিশপে। কিন্তু কেউ প্রেম করছে, কেউ একমনে ল্যাপটপে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কাজ করছে দেখে থমকে গেলাম। তার চেয়ে ঠিক অ্যাপার্টমেন্টের সামনের রাস্তায় নেমে জনে জনে পথচারীকে ধরে জিজ্ঞাসা করাই ভালো ছিল বোধ হয়। সারা সন্ধ্যার ‘অর্জন’ হলো কিনা নভোদীপদের সাঁলোতে একের পর এক পাঞ্জাবি ‘ভাংরা’ গান শোনা!
এবারের মার্কিনি নির্বাচনটি একটু ভিন্নধর্মী এ কারণে যে, চিরদিনের ‘প্রগতিশীল’ ডেমোক্র্যাটরাই এবার গাজা-ইসরায়েল এবং রুশ-ইউক্রেন নামক দু-দুটো যুদ্ধের এবং বিশেষত গাজায় এক বছরে ৪২ হাজার মানুষের মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রেই মুসলিম অভিবাসী থেকে উদারনীতিকরা চিন্তিত। অন্যদিকে ‘ফার রাইট’-এর প্রতীক ট্রাম্প হয়ে উঠেছেন ‘যুদ্ধবিরোধী’ আহ্বানেরও প্রবক্তা। আবার কদিন আগে যে ফিলিস্তিনি-মার্কিনি তরুণী সাবিহার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তিনি ডেমোক্র্যাট সমর্থক হলেও একজন মার্কিনি হিসেবে মনে করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অন্য দেশের কোনো কাজে টাকা-পয়সা খরচ করার বদলে মার্কিন নাগরিকদের স্বাস্থ্য, শিক্ষাতেই সব টাকা খরচ করা উচিত।
‘আমরা মার্কিনিরা কেন অন্যদের দেশে অন্যদের সাহায্য করতে যাব? এদিক থেকে ডেমোক্র্যাটদের বদলে রিপাবলিকানদের নীতিই সঠিক- যদিও আমি ডেমোক্র্যাট সমর্থক,’ সাবিহা বলছিল। সাবিহা অবশ্য মায়ের দিক থেকে পুয়ের্তো রিকান আর আরব বাবার অমতে সম্প্রতি বিয়ে করেছেন ডমিনিকান রিপাবলিকের এক ছেলেকে। গর্ভপাত এবং সংখ্যালঘু নাগরিকের অধিকার প্রশ্নে সাবিহা ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক হলেও গত চার বছরে মার্কিন অর্থনীতির হাল প্রচণ্ড খারাপ হয়ে পড়েছে বলেও তিনি মনে করেন। মোদ্দা কথা হলো এবারের নির্বাচনে ‘প্রগতিশীল-রক্ষণশীল’ বিষয়গুলো কেমন এ ওর সঙ্গে দলা পাকিয়ে গেছে!
শেষের কবিতা
এখানকার গণমাধ্যমগুলো নির্বাচনি খবরে মুখর। অনেকে নির্বাচনি প্রচারণা নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। কিন্তু উপায় কী! এই এক জায়গায় এখানকার গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। তবে বিচিত্র জনগোষ্ঠী-অধ্যুষিত যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় জরিপ ছাড়া নির্বাচনে কে জিতবে বলা অসম্ভব। কেননা এখানে এক এক জায়গার ভোটারদের নিজস্ব হিসাব আছে। সেটা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-অঞ্চল-লিঙ্গভেদে আলাদা। আপনি লাতিনো-অধ্যুষিত এলাকায় গেলে এক রকম হাওয়া দেখবেন, আরবদের মধ্যে অন্য রকম। নারীদের ভাবনা- তাও বিচিত্র পেশার বিচিত্র বয়সের নারীদের হিসাব আলাদা। তরুণ-তরুণী ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ভাবনাতেও কোনো মিল পাওয়া যায় না। পুরো সমাজটা হোমোজেনিক নয় বলেই ভোট নিয়ে বিচিত্র ভাবনা আর বিচিত্র বর্ণচ্ছটা। তবে দিন শেষে তাদের জীবন কতটা সহজ ও সুন্দর হতে পারে; কীভাবে বাঁচবে সেই ভাবনাই তাদের তাড়িত করে। এই জায়গাতেও সব দেশের সব ভোটারের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তবে একটা বিষয়ে বাংলাদেশের ভোটের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে না। সেটা হলো, ভোট দিতে পারবেন কি পারবেন না, তা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই। না দেওয়ার কথাটা তারা ভাবতেই পারেন না। এ নিয়ে আমি তাই কাউকে প্রশ্নও করিনি।
গতকাল শেষ হয়েছে এই বহু বর্ণিল ভোট নিয়ে নানান জরিপ, পূর্বাভাসের বিচিত্র প্রবাহ। এখন অপেক্ষা শুধু ফলাফলের।
কমলা হ্যারিস আপনাকে অভিনন্দন। ডোনাল্ড ট্রাম্প আপনাকেও অভিনন্দন। যিনিই জিতুন, এই নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে সুসংহত করবে। অভিবাদন মার্কিন জনগণকে।