
প্রত্যেক জাতির ইতিহাস তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। যার অস্থি থেকেই জন্ম নেয় মুক্তির অগ্নিশিখা। রুশ বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব এবং ইতালির রেনেসাঁ সে আন্দোলনেরই ধারাক্রম। এসব আন্দোলন ও তার গতিপ্রবাহ সে দেশের জাতির সার্বিক জাগরণের পথকে ত্বরান্বিত করেছে। মূলকথা, সংগঠিত এ আন্দোলনের ভেতর থেকে একটি জাতি তার নিজস্ব সত্তার আলোকময় পথটি খুঁজে পেয়েছে। ফলে অপরিহার্য এ ঘটনাগুলোই সেই জাতির জাতীয় জীবনে হয়েছে চিরভাস্বর। সে সূত্রে বাঙালির জাতীয় জীবনে ঐতিহাসিক চেতনার উজ্জ্বল মাস, ফেব্রুয়ারি এবং উত্তাল মার্চ।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় পরিচয়ে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের জন্ম। এই অবৈজ্ঞানিক বিভেদ থেকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রত্যক্ষ সূচনা। একই সঙ্গে যা ধর্মনির্ভর জাতীয়তাবোধের আড়ালে অর্থনৈতিক শোষণের সুড়ঙ্গও। স্পর্শকাতর এ মুহূর্তেই অঙ্কুরিত হয় বাঙালির স্বাতন্ত্র্যবোধ। যার প্রতিফল দেখা দেয় ৪৮-৪৯ সালের সিলেটের কৃষক ও নানকার বিদ্রোহ এবং রাজশাহীর নাচলের সাঁওতাল বিদ্রোহের ঝড়। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ মিস্টার জিন্নাহ ঘোষণা করেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ রেসকোর্স ময়দানের এ ঘোষণার পর পরই সমগ্র বাঙালি পশ্চিাদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। সৃষ্টি হয় ’৫২-এর অমর একুশ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে বাঙালি জাতি মানবসত্তা গঠনের ভিত্তি খুঁজে পায়। যার স্থিতি ও বিকাশ ঘটে সময়ের পিঠে। আন্দোলনের ডানায় ভর করে সৃষ্টি হয় ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট। আসে নির্বাচন। এই নির্বাচনের যুক্তফ্রন্টের জয় প্রচণ্ড চাপে ফেলে পাকিস্তানিদের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন। অতঃপর ১৯৬৬-এর ছয় দফার প্রকম্পনের পথে ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নিশ্চিত পতন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের পতনের পর সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় আসেন সেনাবাহিনী প্রধান আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান।
হিংস্র ইয়াহিয়া ক্ষমতায় এসে বাংলার মানুষের শক্তি বুঝতে পেরে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন দেন। এই নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে মোট ৩১৩ আসনে আওয়ামী লীগ লাভ করে ১৬৭টি। এরপর ১৭ ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচন হয়। অবাক করা সত্য- আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনে লাভ করে ২৯৮টি আসন। এ বিজয় ক্ষমতা বদলের পথকে পরিষ্কার করে দেয়। কিন্তু বাংলার মানুষকে ক্ষমতার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ষড়যন্ত্রের পথ খুঁজে নেয় ইয়াহিয়া ও তার দোসর। এই বিপরীতমুখী অপ্রত্যাশিত বেদনা বাঙালিকে জাগ্রত করে। মানবসত্তা বিকাশের পথে ১৯ বছর পর একাত্তরের মার্চ মাসে উন্মেষ ঘটে বাঙালি জাতিসত্তার। ’৬৯-এর আন্দোলন এবং ’৭০-এর নির্বাচনের মধ্যে পূর্ব বাংলার মানুষ অভূতপূর্ব সংগতি গড়ে তোলে।
একাত্তরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে এ ঐক্য মজবুত হয়ে ওঠে। দুর্বার এ জাগরণের অগ্রনায়ক হন শেখ মুজিবুর রহমান।
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার প্রায় সব আসন লাভ করে। আওয়ামী লীগের এ বিজয় এবং পাকিস্তানের পরাজয় কার্যত পাকিস্তানকে দুটি পৃথক সত্তায় বিভক্ত করে। পাওয়া না পাওয়ার হিসাবে পরিবেশ উত্তপ্ত হতে থাকে। দাবির মুখে ইয়াহিয়া পরিষদ আহ্বান করেন ১ মার্চ। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে পয়লা মার্চের গণপরিষদ অধিবেশন স্থগিত করেন। ঘোষণা দেন ৩ মার্চ। এবার ৩ মার্চের অধিবেশনকে কেন্দ্র করে ১ মার্চ পূর্ব বাংলার মানুষ প্রতিবাদে রাজপথে নামে। হৃদয়ের লালিত কথা এবার সম্মিলিত কণ্ঠে উচ্চারিত হয়- ‘ওদের সঙ্গে থাকা যাবে না।’ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মানুষ রাজপথ দখলে নেয়। ২ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ছাত্রদের পক্ষে পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রব।
সবাইকে সঙ্গে নিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন শেখ মুজিব। দিন পেরিয়ে আসে ৭ মার্চ। আন্দোলনে উত্তাল হয় সারা বাংলা। দেশের নানা দিকে স্লোগান হতে থাকে- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ ৭ মার্চ বিকেল ৪টায় রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখ মানুষের সামনে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন শেখ মুজিব। ভাষণের শেষে তিনি উল্লেখ করেন- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শেখ মুজিবের ভাষণে বাঙালি ভাবাবেগে উদ্বেলিত হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে সোচ্চার হয়ে ওঠে। মুক্তিকামী মানুষ স্বাধীনতা মন্ত্রে উজ্জীবিত হয় প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তির জন্য। ৭ মার্চ পর দেশের পরিস্থিতি দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হতে থাকে। ১০ মার্চ শেখ মুজিব জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে ৭ কোটি মানুষের মৌলিক অধিকার প্রশ্নে জরুরি তারবার্তা প্রেরণ করেন।
১৪ মার্চ শেখ মুজিব ৩৫টি নির্দেশ জারি করে প্রশাসনের ভার প্রায় হাতে নিয়ে নেন। ১৫ মার্চ কড়া নিরাপত্তায় ঢাকা আসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। তার পর আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। শুরু হয় মুজিব ইয়াহিয়ার রুদ্ধদ্বার বৈঠক। আন্দোলনের মধ্যদিয়ে দিন গড়াতে থাকে। ১৯৭১-এর ২১ মার্চ আন্দোলনে সারা দেশ কেঁপে ওঠে। বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার মধ্যকার আলোচনা ভেস্তে যায়। বিদ্রোহে ফুঁসে ওঠে বাঙালি। ২২ মার্চ শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামে গর্জে ওঠে মানুষ। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এদিন সকালে ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের পূর্ব-নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত করেন। ২৩ মার্চ শুধু ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ভবন ও সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে পাকিস্তানি পতাকা দেখা যায়। মুক্তিপাগল বাঙালি অসহযোগ আন্দোলনের ২৩তম দিনে বাংলাদেশের পতাকা হাতে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে।
২৪ মার্চ পূর্ব-বাংলার নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয় পাকিস্তানিদের। সামরিক জান্তাকে পেছনে ফেলে স্বাধীনতার প্রশ্নে বাঙালি জাতি সামনে এগোতে থাকে। পরিণতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে ২৪ মার্চ সৈয়দপুরে হানাদার বাহিনী জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলি করলে প্রায় ৩০০ নিরস্ত্র বাঙালি মারা যায়। মানুষ প্রহর গুণতে থাকে বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত নির্দেশের জন্য। ঠিক এই মুহূর্তে এসেই বাঙালিকে স্বাধীনতার পথ থেকে ফেরাতে না পেরে ইয়াহিয়া জাতিকে হত্যার নীলনকশা চূড়ান্ত করেন। পরাজয়ের আভাস পেয়ে মানব থেকে দানবে পরিণত হন ইয়াহিয়া। ২৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার মধ্যকার আলোচনা প্রত্যাশিত অগ্রগতি ছাড়াই শেষ হয়। বাতাসের মতো আন্দোলনের ঘূর্ণিবেগ ঊর্ধ্বে উঠতে থাকে।
২৪ মার্চ দিন শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দেন, ‘আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্র আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলার জনগণের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে তা বরদাশত করা হবে না।’ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন অংশ নেন। দুই ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠক শেষে তাজউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের জানান, ‘আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য প্রদান শেষ। এখন প্রেসিডেন্টের উচিত তার ঘোষণা শেষ করা।’ তিনি বলেন, ‘আজ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না।’
২৫ মার্চ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে মানুষের ঢল নামে। অবস্থা বেগতিক দেখে মারমুখী হয়ে ওঠে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। শুরু করে আক্রমণ। প্রথমে ইপিআর ঘাঁটি ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ ঢাকা শহরের নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মধ্যরাতে গ্রেপ্তার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেপ্তারের আগে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের চূড়ান্ত ঘোষণা প্রেরণ করেন তিনি। ২৬ মার্চ থেকে সমগ্র বাঙালি জাতি এক হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমে পড়ে। ১৯৭১ সালের ২৬-এর প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সূচনা খুব দ্রুত সুগঠিত সংগ্রামে রূপ লাভ করে। মুজিবনগরে গঠিত হয় অস্থায়ী জাতীয় সরকার। তার পর দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় কাঙ্ক্ষিত বিজয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ২৬ মার্চ পরম গৌরব ও মর্যাদার দিন। এই দিনেই বাংলার মানুষ প্রিয় মাতৃভূমির চূড়ান্ত মুক্তির জন্য প্রতিরোধ সংগ্রামের সূত্রপাত করে। ৯ মাস যুদ্ধে বাংলা মায়ের ৩০ লাখ সন্তান শহিদ হয়। সম্ভ্রম হারান ৩ লাখ মা-বোন। ২৬ মার্চ বাঙালির স্বাধীনতার জন্য স্পষ্ট ত্যাগের প্রথম সূচনা প্রহর। জাতীয় জীবনে তাই এদিনের গুরুত্ব ও মর্যাদা তুলনাহীন। আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি ২৬ মার্চ। গৌরবময় এদিনের কথা স্মরণ রেখে বাংলার মানুষকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলা মায়ের সোনার সন্তানদের জীবন বিসর্জনকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে প্রত্যেকে দেশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে। সেই চেতনায় স্নাত হয়েই আমরা হব খাঁটি দেশপ্রেমিক। তা না হলে প্রাপ্ত এ শ্রেষ্ঠ অর্জন হাতছাড়া করার অশুভ শক্তি আমাদের দিকে ধেয়ে আসবে। তখন শামসুর রাহমানের বিখ্যাত সেই কবিতার চরণ কণ্ঠে নিয়ে আমাদের বেদনার বেহাগে গাইতে হবে- ‘তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা, আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়? আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?’
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজ, বগুড়া