প্রিয় টিনএজার পাঠক, তোমাদের মতো পৃথিবীতে বিষণ্নতায় ভোগা টিনএজারের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কৈশোরকাল জীবনের সবচেয়ে রঙিন পর্যায়। তবু কখন, কীভাবে টিনএজ জীবন বিষণ্নতার বেড়াজালে আটকে পড়ে বুঝে ওঠা কঠিন। শারীরিক, মানসিক পরিবর্তন কিংবা পারিপার্শ্বিক কারণে টিনএজাররা সহজেই আক্রান্ত হয় বিষণ্নতায়। অনেক সময় অভিভাবক, বড়রাও কিশোর-কিশোরীদের বিষণ্নতার রোগকে মিলিয়ে ফেলেন টিনএজ বয়সের মুড সুইং অনুভূতির সঙ্গে। বয়ঃসন্ধির বিষণ্নতা কাটানোর উপায় জেনে নাও এই লেখায়।
যখন বুঝবে বিষণ্নতায় আক্রান্ত
মন খারাপ হওয়া যেকোনো বয়সের মানুষের জন্যই একটি সহজাত অনুভূতি। কিশোর বয়সে হরমোনের নানা পরিবর্তনের কারণে খুব সহজেই আনন্দ এবং দুঃখ অনুভব হয়। ঘন ঘন মুড সুইং স্বভাবের কারণে বড়রা কিংবা কিশোর-কিশোরীরা নিজেরাও প্রায়ই তাদের বিষণ্নতাকে আলাদাভাবে নির্ণয় করতে পারেন না। তবে মন খারাপ হওয়া এবং বিষণ্নতা কিন্তু এক বিষয় নয়। সাধারণত কোনো বিষয়ে দুঃখ পেলে, আবার কখনো কারণ ছাড়াও আমাদের মন খারাপ হয়। তবে এই অনুভূতি দু-এক দিনের ভেতর কেটে গিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া যায়। আমাদের দৈনন্দিন কাজ জীবনযাপনের ওপরও এর কোনো প্রভাব পড়ে না। তবে মন খারাপের এই অনুভূতি এক থেকে দুই সপ্তাহ স্থায়ী হলে তাকে বিষণ্নতার পর্যায় বলে মনে করেন মানসিক বিশেষজ্ঞরা। এমন সময় নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হলে, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কমতে থাকলে, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ কিংবা শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে বুঝতে হবে তুমি বিষণ্নতায় আক্রান্ত।
কৈশোরে বিষণ্নতার কারণ
শৈশব থেকে কৈশোরের পথে পা দিতেই শারীরিক গঠনে আমূল পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে অনেক সময় নানা ধরনের সমস্যা ঘটে। বিশেষত কিশোরীরা এ ধরনের ঘটনায় বেশি বিষণ্নতা কিংবা ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারের শিকার হয়।
এ সময় হরমোনাল পরিবর্তনও বিষণ্নতার জন্য দায়ী। বয়ঃসন্ধির সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎই ছেলেমেয়েদের যৌন হরমোনগুলো বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। কৈশোরে হরমোন নিঃসরণের মাত্রাও বেশি থাকায় মুড ডিজঅর্ডারের ঘটনা বেশি দেখা যায়। মনের নতুন এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কিশোর-কিশোরীদের জন্য স্বভাবতই কঠিন। অনেক সময় মুড ডিজঅর্ডারের মাত্রা বাড়লে তা বিষণ্নতায় রূপ নেয়।
কিশোর-কিশোরীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা কম। এ বয়সে মস্তিষ্কের যুক্তিনির্ভর চিন্তা করার অংশও পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে না। ফলে ছেলেমেয়েরা থাকে আবেগপ্রবণ। পারিপার্শ্বিক ঘটনায় মন খারাপ হলে, দুঃখ পেলে সেটি বিষণ্নতায় রূপ নেয়।
আবার গবেষণায় দেখা গেছে, টিনএজারদের যারা স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় কাটায় সমবয়সী অন্যদের তুলনায় তাদের মধ্যে বিষণ্নতার হার সবচেয়ে বেশি। ভার্চুয়াল জগতে বেশি সময় কাটানোর ফলে মস্তিষ্কের স্থিতিশীলতা কমে যাওয়া, সামাজিক ও বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, অবাস্তব চিন্তাভাবনা বিষণ্নতা রোগ তৈরি করে।
এ ছাড়া অপরিমিত ঘুম, পুষ্টিকর খাবারের অভাব, পারিবারিক কলহ, অনিরাপদ পরিবেশে বেড়ে উঠলে কিশোর-কিশোরীরা সহজেই বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়।
বিষণ্নতার প্রভাব
বিষণ্নতা একটি দীর্ঘমেয়াদি অনুভূতি। কিশোর-কিশোরীরা অনেক দিন এই নেতিবাচক অনুভূতির ভেতর দিয়ে গেলে ব্যক্তিগত শারীরিক, মানসিক ও দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব পড়তে পারে। বেশির ভাগ সময় বিষণ্ন অনুভব করার কারণে ছেলেমেয়েরা সামাজিক জীবনযাপন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং একাকিত্ব অনুভব করে। বিষণ্নতায় আক্রান্ত টিনএজাররা প্রায়ই সময়মতো কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হয়। এতে করে ধীরে ধীরে কাজের প্রতি আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় বিষণ্নতা কিশোর-কিশোরীদের হীনম্মন্যতায় ভোগায়। দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা চলতে থাকলে কারও কারও ভেতর নিজেকে শারীরিক আঘাত করার প্রবণতা দেখা দেয়। অনেক সময় হতাশা কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়িয়ে দেয়।
বিষণ্নতা থেকে দূরে থাকার উপায়
ইতিবাচক কাজে ব্যস্ত থাকা
কৈশোরের মন ও মানসিক সুস্থতা জীবনের অন্যান্য পর্যায়ের চেয়ে সংবেদনশীল। এ সময় শখের কাজ, সৃজনশীল কাজ, খেলাধুলা, শরীরচর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে শরীর ও মন প্রাণবন্ত থাকে। এতে বিষণ্নতা থেকে দূরে থাকা যায়।
নেতিবাচক অনুভূতি দূরে রাখা
জীবনে ভালো লাগার অনুভূতি যেমন থাকবে, তেমনি খারাপ অনুভূতি, অভিজ্ঞতাও থাকবে। তবে এগিয়ে যেতে চাইলে নেতিবাচক অনুভূতিগুলোকে মনে আশ্রয় দেওয়া যাবে না। বরং এগুলো নিয়ে বেশি চিন্তা না করে ইতিবাচক অনুভূতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই চলার পথে সহায়ক।
ইয়োগা ও মেডিটেশন
কিশোর বয়সে আবেগ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কম থাকে। ফলে বিভিন্ন ঘটনায় সহজেই বিষণ্নতা গ্রাস করে। ইয়োগা ও মেডিটেশন হলো মানসিক সুস্থতা ও মন নিয়ন্ত্রণের ব্যায়াম। কৈশোরেই মেডিটেশন বা ইয়োগা চর্চা করলে নিজের মানসিক অবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়।
পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্ব
কৈশোরে হতাশাগ্রস্ত হলে পরিবারের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি, দূরত্ব, নেতিবাচক আচরণ অনেক সময় আরও বেড়ে যায়। তবে পরিবারই সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল, আপন বন্ধু। বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিজের অনুভূতি, সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আচরণ করলে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়।