![প্রকৃতির কোলে পল্লি পর্যটন](uploads/2023/11/24/1700805172.f.jpg)
বাংলার প্রকৃতিতে এখন চলছে হেমন্তকাল। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে এ সময় অনেক শিশু-কিশোর গ্রামের বাড়িতে কয়েকদিন কাটিয়ে আসে। যদিও ধীরে ধীরে এ প্রচলন কমে যাচ্ছে। তবে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো অর্থবহ পর্যটনেরই একটি অধ্যায়। জানাচ্ছেন মৃত্যুঞ্জয় রায়।
দক্ষিণ কোরিয়ার জুনজুর তিনটি গ্রামে বেড়াতে গিয়ে একটি আইডিয়া মাথায় এসেছিল। ওরা যদি গ্রাম দেখানোর জন্য এতে ব্যবস্থা করে হাজার হাজার পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে, তাহলে আমাদের দেশে শ্যামল সুন্দর পল্লি জননীর আদুরে কোলে দুর্বা বিছানো বিছানায় শুয়ে প্রকৃতি দেখার সুযোগ কেন আমরা পর্যটকদের দিতে পারছি না। বাঁশের মাচায় শুয়ে বাঁশের পাতার ঝিরিঝিরি ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে কাজলা দিদিকে মনে করা, সহস্র শাপলা ফোটা অবারিত বিলের জলাভূমিতে ছোট্ট ডিঙি নিয়ে ভেসে বেড়ানো, বিলকোলে ঝুলানো হিজল শাখায় বেণীর মতো ফোটা লাল ফুল দেখে হিজল-তমালে কাব্য লেখা, শরতের দিগন্ত বিস্তৃত আমন ধানের খেতে বাতাসের ঢেউ তোলা অথবা কার্তিকের শেষে হেমন্তের সোনালি ধানে ডুবে যাওয়া, শীতের কুয়াশা ভেঙে সাত সকালে খেজুর রসের রস আস্বাদন করা, ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে খোলা মাঠে ধেই ধেই করে নেচে বেড়ানো আর কদমের ডালে ডালে ফুলের মাখামাখি দেখে মুগ্ধ হওয়া- এসবই রয়েছে আমাদের পল্লি প্রকৃতির ঐশ্বর্য ভাণ্ডারে। শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে দেখা, মন খুলে তা অনুভব করা আর পর্যটকদের চোখগুলো খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
পৃথিবীর অনেক দেশেই কোরিয়ার মতো পল্লি পর্যটনের ব্যবস্থা রয়েছে। কোরিয়ায় জিওনজুর হ্যানক গ্রামে গিয়ে দেখলাম, সেখানে কোরিয়ার আদি পল্লি কেমন ছিল অবিকল সেভাবে তারা সে গ্রামটিকে রেখেছে। গ্রামবাসীরাও সেখানে রয়েছে। তাদের বাড়িতে কেউ থাকতে চাইলে, রাত কাটাতে চাইলে সে আতিথেয়তার ব্যবস্থাও রয়েছে সেখানে। রয়েছে আদি ঐতিহ্যের কোরিয়ান গ্রাম্য বা লোক ঐতিহ্যের লোক উপকরণের পসরা সাজানো দোকান পাট। আদিম সেচ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ঘরের ভেতর শোয়ার ব্যবস্থা পর্যন্ত সবই রয়েছে সেই সনাতন ধারার।
আর একটি কোরিয়ান গ্রাম সোলত। সেখানে গিয়ে দেখলাম সে গ্রামের লোক সংখ্যা মাত্র ৯৮ জন, যাদের অধিকাংশই বৃদ্ধ। অথচ গ্রামটা বেশ বড়। এত বড় গ্রামে এত অল্প মানুষ কেন? প্রশ্ন করতেই গাইড জানিয়েছিলন, উন্নত হওয়ার পর কোরিয়ার তরুণ-যুবক শ্রেণির মানুষ প্রায় সবাই গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেছে চাকরি করতে। তাই জমিগুলো চাষের লোকও এখন আর গ্রামে নেই। যন্ত্র দিয়ে জমি থেকে ফসল কাটা হয়। অনেক জমি চাষের জন্য তাই দু-একজন থাকলেই চলে। সে গ্রামে দেখলাম, একটা চমৎকার দোকান। স্থানীয় গ্রাম্য খাবার বিশেষ করে কোরিয়ান পিঠার জন্য সে দোকানটার সুনাম আছে। কয়েকজন বয়স্ক লোক দোকানটা চালাচ্ছেন। তাদের জমিতে উৎপাদিত ধান থেকে চাল, চাল থেকে চালের গুঁড়া- গম থেকে ময়দা গ্রামেই তৈরি করে তা থেকে তারা পিঠা তৈরি করছেন। সেসব পিঠার স্বাদ পর্যটকরা নিতে পারছেন অর্থের বিনিময়ে। আবার আধুনিক বিপণন ব্যবস্থায় তারা অনলাইনে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে কোরিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে সেসব পিঠা সরবরাহ করছেন। খুব ব্যস্ত সেখানকার নারী-পুরুষ। খেতের টাটকা শাকসবজি আর ফলমূলও বিক্রি করছেন পর্যটকদের কাছে। সারা দিন গ্রামবাসী যৌথভাবে সেসব কাজ করছেন পালাক্রমে। লাভের টাকাও তারা ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। এক জোট হয়ে গ্রামের সবাই মিলে এক পরিবারের মতো থাকার কী চমৎকার আয়োজনই না তারা করেছেন! অবশ্য তাদের গ্রামটা যেখানে, সেখানে প্রকৃতি দেবীও তার উদার হাতে সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়েছেন। জলাশয়, বন, পাহাড়- সব মিলিয়ে গ্রামটা অনেক সুন্দর। প্রকৃতির সেসব রূপ দেখে ও খাবারের রস আস্বাদন করে পর্যটকরা দিন শেষে ফিরে আসছেন এক বুক আনন্দ নিয়ে।
কোরিয়ার আর একটি গ্রামে মিরাস গিয়ে দেখলাম, সেখানে একটি পরিবারে অনেকখানি জমিতে একটি বিশাল আপেল বাগান রয়েছে। কাঠের তৈরি দোতলা বাড়িটাও চমৎকার, পরিপাটি করে গোছানো। ছোট একটি সাধারণ খামারি পরিবার হলেও তাদের দেখে তা মনে হচ্ছে না। ওদেরও গাড়ি আছে! সন্তানরা সুন্দর পোশাক পরে স্কুলে যাচ্ছে। কৃষক আর কৃষানি মিলে আপেল বাগানে কাজ করছেন। আমরা গেলে সেই আপেল বাগানটাই প্রথমে ঘুরে দেখলাম। বললেন, আপনারা যে আপেলটা খেতে ইচ্ছে করে গাছ থেকে ছিঁড়ে সেটা খেতে পারেন। ওয়াও! ইয়া বড় সাইজের একটা আপেল খেয়ে মুখ-মন ভরে গেল। এত মিষ্টি আর সুস্বাদু আপেল জীবনে কখনো খাইনি। আপেলের স্বাদ এত ভালো হয়? আপেল বাগান ঘুরে ফিরে এসে বসলে তিনি আমাদের আপেল জুস দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। সেটাও তার আপেল খেতের আপেল থেকে নিজেরাই তৈরি করেছেন। জুস তৈরির ব্যবস্থাও তার ওখানে রয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের সে গ্রামে আপেল ভ্রমণটা চমৎকার হয়েছিল। অবশ্য এজন্য সেই খামারিকে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়েছিল। এটাই পল্লি পর্যটনের এক ব্যবসায়িক দিক।
এখন কাজের সুযোগ কম থাকায় গ্রামের লোকেরা শহরের দিকে ছুটছেন। চাষাবাদে যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় পল্লি শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। এমন অনেক শ্রমিক আছেন যাদের যোগ্যতা বা দক্ষতা দিয়ে আর কোনো কাজ জোগাড় করতে পারছেন না। তাই বিপদে আছেন সেসব গ্রামের লোকেরা। এক্ষেত্রে যেসব গ্রামে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রাকৃতিকভাবেই রয়েছে, এমন সব গ্রামে যদি কোরিয়ার মতো আমাদের গ্রামগুলোয় পল্লি পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় তাহলে সেসব গ্রামের মানুষের আয় বাড়বে, পল্লি প্রকৃতির নির্মল আনন্দ উপভোগের সুযোগ পাবেন আমাদের শহরবাসী এমনকি বিদেশিরাও। ইতোমধ্যে কেউ কেউ তা করে বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছেন। জলজঙ্গলের কাব্য অনেকের কাছেই বেড়ানোর জম্পেস স্পট। তবে তার সঙ্গে গ্রামবাসীদের সম্পৃক্ততা নেই। গ্রামবাসীদের সম্পৃক্ত করে তৈরি করা হয়েছে জিন্দা পার্ক। সেটি ভিলেজ কমিউনিটি ট্যুরিস্ট সাইট হলেও তাতে কৃত্রিমতাও আছে। দরকার শতভাগ প্রাকৃতিক পল্লি পর্যটনের ব্যবস্থা। বান্দরবানে বগা লেকের পাশে স্থানীয় গ্রামবাসীরা সেটি কিছুটা করতে পেরেছে। এর জন্য আগ্রহী গ্রামবাসীদেরই এগিয়ে আসতে হবে, দরকার দুয়েকজন ভালো সংগঠক ও পরিকল্পকের। উদ্যোগ নিলে তা আমাদের পর্যটনে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে আশা করি। যথাযথ প্রচার পেলে তা একদিন বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হবে।
জাহ্নবী