![সুন্দরবনে গহিন অরণ্যের হাতছানি](uploads/2024/02/08/1707372217.b5.jpg)
বাংলাদেশে বেড়াতে যাওয়ার জন্য হাজারও জায়গা আছে। কিন্তু এই বেড়ানোর পাশাপাশি যদি অ্যাডভেঞ্চারের শখ থাকে, আর তা যদি হয় জঙ্গলে, তাহলে সুন্দরবন ছাড়া আর কোনো জায়গার নাম মনে আসবে না। বাংলাদেশের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বনভূমি এই সুন্দরবন। সেই সঙ্গে পানিতে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ আর নয়নাভিরাম সবুজের হাতছানি- প্রতি মুহূর্তেই শিরদাঁড়া দিয়ে রোমাঞ্চের ঢেউ তোলে।
সুন্দরবনের বিশেষত্ব হচ্ছে, বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, অনিন্দ্যসুন্দর হরিণ, কুমির, বানরসহ নানা জাতের পাখি। একসঙ্গে এত বৈচিত্র্য দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। গহিন বনের মধ্যেই সাড়ে ৩০০ বছরের পুরনো মন্দির। রয়েছে পুরনো বসতির ধ্বংসাবশেষ। জেলেরা নাম দিয়েছে বাঘের বাড়ি। পর্যটকরা নদীপথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে বাঘের দেখা পাচ্ছেন। কখনো নদী সাঁতরে যাচ্ছে বাঘ, আবার কখনো-বা নদীর তীরে অলস সময় পার করছে। ইদানীং বনরক্ষীদের অফিসের সামনেও দেখা মিলছে বাঘের।
প্রতিবছর সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণে আসেন। শুধু কিছু সুন্দর মুহূর্ত কাটানো নয়, শহরের বাইরে নির্জন ভূখণ্ডে নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। জালের মতো বিছিয়ে থাকা নদী-খালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জঙ্গলটি পর্যটনের ষোলোআনাই পূরণ করার অকৃত্রিম জায়গা।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার অংশ নিয়ে এই সুন্দরবন। এর সঙ্গে বনের দক্ষিণ কোলঘেঁষে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। নিকটবর্তী সাগরে সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের দৃশ্যও নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের ছোঁয়া দেয়। সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার, যা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত। বাংলাদেশে সুন্দরবনের আয়তন ৬ হাজার ৫১৭ বর্গকিলোমিটার। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এই বনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো।
সুন্দরবনের যত দর্শনীয় স্পট: সুন্দরবনের একেক ঋতুতে একেক রূপ। তবে সুন্দরবন ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সময় বর্ষাকাল। বনের সবুজ সৌন্দর্য যেন এই সময়টায় ফুটে ওঠে। বর্ষার মিষ্টিপানির ছোঁয়ায় পশুপাখিরা মেতে ওঠে আনন্দে। সুন্দরবনের স্পটগুলোর মধ্যে কটকা সমুদ্রসৈকত অসাধারণ। এটি শরণখোলার ‘টাইগার পয়েন্ট’ হিসেবে পরিচিত। এখানে ৪০ ফুট উঁচু টাওয়ার থেকে বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এ ছাড়া মোংলা থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কচিখালী আরেক আকর্ষণীয় স্থান। প্রায় তিন কিলোমিটার বিস্তৃত সমুদ্রসৈকত রয়েছে এখানে। মোংলার কাছেই সুন্দরবনের করমজলকে বন্যপ্রাণীর প্রজননকেন্দ্র বলা হয়। এখানে রয়েছে কুমির, হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন প্রাণী। মোংলা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে হারবাড়িয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। কলাগাছিয়ায় ইকোট্যুরিজম সেন্টার, ‘হিরণপয়েন্ট’খ্যাত নীলকমল অভয়ারণ্য, দুবলারচর, মানিকখালী, আন্ধারমানিক ও দোবেকী এলাকায়ও পর্যটকদের আনাগোনা বেশি থাকে।
খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেকে বনের মধ্যেই কয়েক শ বছরের পুরনো একটি মন্দির রয়েছে। বনের প্রান্তে রয়েছে কোনোরকমে টিকে থাকা কিছু বাড়ির দেয়াল ও ইটের স্তূপ। পর্যটকদের আগ্রহের কারণেই ২০২১ সালে শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র চালুর উদ্যোগ নেয় বনবিভাগ। এখানে পর্যটকদের আসা-যাওয়ার সুবিধার জন্য পন্টুন, ওয়াচ টাওয়ার, আরসিসি ঢালাই রাস্তা, বিশ্রাম নেওয়ার গোলঘর করা হয়েছে।
নতুন ইকোট্যুরিজমে বাড়তি রোমাঞ্চ: ইকোট্যুরিজম হলো একান্ত নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে ভ্রমণের মাধ্যমে বন ও বন্যপ্রাণীর সৌন্দর্য অবলোকন। সুন্দরবনে যুক্ত হয়েছে নতুন চারটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। আগে খুলনা রেঞ্জের মধ্যে সুন্দরবন ভ্রমণের কোনো সুযোগ ছিল না। নতুন চারটি কেন্দ্রের দুটিই পড়েছে খুলনা রেঞ্জে। পশ্চিম বনবিভাগ খুলনা রেঞ্জের আওতায় রয়েছে শেখেরটেক ও কালাবগী। পূর্ব বন বিভাগে শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্ধা ও চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় এসব স্থানে আরসিসি ঢালাই হাঁটা পথ, ৫০ ফুট উঁচু ওয়াচ টাওয়ার করা হয়েছে। নতুন পর্যটনকেন্দ্রকে ঘিরে পর্যটকরা ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছেন। সুন্দরবনে পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণীয় স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে ইকোট্যুরিজম স্পটগুলো।’
যেভাবে যাবেন সুন্দরবনে: পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় অনেকেই ঢাকা থেকে সহজেই মোংলা পৌঁছে চলে যাচ্ছেন সুন্দরবনে। তবে সহজ ও কম খরচে সুন্দরবন ভ্রমণ করতে ট্যুর অপারেটর বেছে নিতে পারেন। নির্দিষ্ট প্যাকেজে পাওয়া যাবে থাকা, খাওয়া, বেড়ানো, নিরাপত্তারক্ষী, গাইডসহ যাবতীয় সব সুবিধা। খুলনা ও মোংলায় এমন শতাধিক ট্যুর অপারেটর আছে।
এক দিনে সুন্দরবন ভ্রমণ করতে চাইলে খুলনা, বাগেরহাটের মোংলা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে সুন্দরবন ভ্রমণ করা যায়। খুলনা থেকে কালাবগী অথবা শেখেরটেক এবং সাতক্ষীরা থেকে কলাগাছিয়া অথবা দোবেকী। ট্রলারে করে করমজল, কালাবগী ও কলাগাছিয়া পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে আসতে ট্রলারপ্রতি খরচ হবে ২৫০০ থেকে ৫৫০০ টাকা। প্রতিটি ট্রলারে ২০-৩০ জন পর্যন্ত যাওয়া যায়।
বাগেরহাটের মোংলা থেকে লঞ্চ বা ট্রলারে ৪৫ মিনিটের পথ করমজল। খুলনার বিআইডব্লিউটিএ লঞ্চ ঘাট থেকেও সুন্দরবন যাওয়া যায়। শরণখোলার কচিখালী স্পটে যেতে বাসযোগে গোপালগঞ্জ-কাটাখালী-মোংলা-কচিখালী যেতে হবে। সাতক্ষীরা হয়ে মুন্সিগঞ্জে যাওয়াটা সুন্দরবন ভ্রমণে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এখানে বনের মধ্যেই রিসোর্টে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
জাহ্নবী