প্রিয় লেখক বা কবির বাড়ি, জন্মস্থান বা স্মৃতিময় স্থানে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে থাকে অনেকেরই। বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখকদের স্মৃতিময় স্থানেও ঘুরে বেড়াতে যান অনেকেই। যেখানে রয়েছে সেই লেখকের জীবন ও সাহিত্যকর্মের নানা নিদর্শন। বাংলাসাহিত্যের পাঁচ বিখ্যাত কবি ও লেখকের স্মৃতিময় স্থান সম্পর্কে জানাচ্ছেন আহমেদ রিয়াজ।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি
রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত স্থান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ গ্রামে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি। কুষ্টিয়া শহর থেকে দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। যৌবনের উল্লেখযোগ্য সময় এই কুঠিবাড়িতে কাটিয়েছিলেন কবিগুরু। রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে পদ্মানদীর কোলঘেঁষা এ অঞ্চলের জমিদারি পেয়েছিলেন।
এরপর ১৮৮৯ সালে জমিদার হয়ে এখানে পা রাখেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯০১ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে জমিদারি করেন। এ সময় তিনি এখানে লেখেন সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, গীতাঞ্জলীসহ বেশ কিছু রচনা। এখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরীসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব।
কুঠিবাড়িজুড়েই রয়েছে কবিগুরুর ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র। প্রায় ৩০ বিঘা আয়তনের রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির মূল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে আড়াই বিঘা জমিতে। তবে আয়তনের সম্পূর্ণ জায়গাজুড়েই রয়েছে বিভিন্ন মনোমুগ্ধকর শিল্পকর্ম। ভবনটিতে রয়েছে বিভিন্ন আকারের ১৬টি কক্ষ। ভবনের তৃতীয় তলায় ছিল কবির লেখালেখির ঘর। কুঠিবাড়ির ছাদ থেকে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত এবং জ্যোৎস্না উপভোগ করতেন রবীন্দ্রনাথ।
আরাম কেদারা, চঞ্চলা ও চপলা নামের দুটো স্পিডবোট, ৮ বেহারার পালকি, পল্টুন, টি টেবিল, কাঠের চেয়ার, সোফাসেট, পালংক এবং কবির আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্মসহ নানান জিনিসপত্র রয়েছে এখানে। আরও আছে কবিগুরুর লেখা চিঠিসহ বিভিন্ন বয়সের তোলা ছবি।
এ কুঠিবাড়িতে প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ জাতীয় পর্যায়ে কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। এ সময় দর্শনার্থী, দেশ-বিদেশের রবীন্দ্র গবেষক ও গুণীজনসহ রবীন্দ্র ভক্তদের মিলনমেলায় পরিণত হয় কুঠিবাড়ি।
নজরুল জাদুঘর
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে সরকারিভাবে কবি নজরুলকে বাংলাদেশে আনা হয়। কবিকে বসবাসের জন্য ধানমন্ডির ২৮ নম্বর লেকপাড়ে একটি বাড়ি দেওয়া হয়। কবি এখানেই তার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন। সেই বাড়িটাই নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর নজরুল জাদুঘর করা হয়।
ঠিকানা: নজরুল ইনস্টিটিউট, কবি ভবন, ভাষাসৈনিক বিচারপতি আব্দুর রহমান চৌধুরী সড়ক, বাড়ি ৩৩০ বি, রোড ১৫ (পুরোনো ২৮) ধানমন্ডি, আবাসিক এলাকা, ঢাকা ১২০৯।
এই ভবনের পঞ্চম তলায় রয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউট গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারটি গড়ে তোলা হয়েছে নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্মের ওপর গবেষণা করার উপযোগী করে। নজরুল ইনস্টিটিউট গ্রন্থাগারের বইয়ের অধিকাংশ বই-ই রয়েছে কবি নজরুল বিষয়ক।
সবমিলিয়ে এই গ্রন্থাগারে রয়েছে ১০ হাজার বইয়ের বিশাল সংগ্রহ। কবি নজরুল বিষয়ে এখানে রয়েছে সব দুর্লভ বই। রয়েছে কবির স্বহস্তে লেখা গান এবং কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি। এছাড়া রয়েছে কবির গানের একটি বিশেষ সংগ্রহ। জাদুঘর স্থাপিত হয় ১৯৯৯ সালের ১৪ এপ্রিল। উদ্বোধন করেন কবির দুই পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী ও উমা কাজী। জাদুঘরের নিচেরতলায় রয়েছে ৪টি কক্ষ। ওগুলোতে রয়েছে কয়েকটি আলমিরা ও নজরুলের বিভিন্ন সময়ের প্রায় ১০৯টি আলোকচিত্র। সরকারী ছুটি বাদে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে।
পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের বাড়ি
ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলায় গোবিন্দপুর গ্রামে পল্লি কবি জসীম উদ্দীনের বাড়ি। কুমার নদের পাশে কবির বাড়িতে রয়েছে পুরোনো ৪টি টিনের ঘর। বসতবাড়ির বিভিন্ন রুমে রয়েছে তার ব্যবহৃত নানান জিনিসপত্র। কবির বিভিন্ন লেখা বাড়ির চত্বরে প্রদর্শন করা আছে। নদীর সামনে বিশাল জায়গায় রয়েছে আগত দর্শনার্থীদের জন্য বসার স্থা্ন। বাড়ির উত্তরে রাস্তার পাশে কবির কবরস্থান।
পল্লিকবি জসীম উদ্দীন ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ থেকে ডালিম গাছের তলে চিরশায়িত রয়েছেন। জসীম উদ্দীনের বাল্যকাল, কৈশোর ও যৌবনের অনেকটাই কেটেছে এ পল্লিতে, সেখানকার মাঠেঘাটে, নদী তীরে, চরে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এ ছাড়া জসীম উদ্দীনের বাড়ির আঙিনায় নির্মাণ করা হয়েছে জসীম উদ্দীন সংগ্রহশালা।
মধু পল্লী
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়িটি বা মধু পল্লী যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে অবস্থিত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ সালে এই বাড়িতেই জন্ম নেন। তার শৈশবও এখানেই কাটে। এখানে রয়েছে তার ব্যবহার করা কয়েকটি ভবন, পুকুরঘাট এবং কবির নানা স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র, যা নিয়ে জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে । যশোর শহর থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ির দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটার।
বর্তমানে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাহায্যে কবির স্মৃতি নিদর্শন এবং আলোকচিত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি জাদুঘর।
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংস্কার করা এই দোতলা বাড়িটিতে রয়েছে মোট ছয়টি কক্ষ। এর মধ্যে ওপরে রয়েছে তিনটি এবং নিচে রয়েছে তিনটি কক্ষ। এর নিচতলায় রয়েছে কবি পরিবারের একটি মন্দির আর মধুসূদন জাদুঘর। মধুসূদন জাদুঘরে আছে কবির ব্যবহার করা খাট, চেয়ার ও আলমারি। এর পাশে রয়েছে একটি ছোট পাঠাগার। এই ভবনের একদম উত্তরদিকে আছে ছাদহীন দেয়ালঘেরা একটি অসাধারণ নির্মাণশৈলীর একটি কক্ষ। বাড়ির প্রবেশপথের সামনে রয়েছে ১৯৮৪ সালের শিল্পী বিমানেশ চন্দ্র বিশ্বাসের নির্মিত কবি মধুসূদন দত্তের একটি ভাস্কর্য।
জীবনানন্দ দাশ সংগ্রহশালা
জীবনানন্দ দাশের জন্ম বরিশালের ধানসিঁড়ি নদীর তীরে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে যে বাড়িটিতে কবি থাকতেন, সেটির নাম এখন ‘ধানসিঁড়ি’। তার স্মৃতিবিজড়িত ধানসিঁড়ি নদীর পাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে জীবনানন্দ দাশ সংগ্রহশালা ও পাঠাগার।
কলি