
‘বাবা, ভূত আঁকো!’
রাজু এমন আহ্লাদে ভূত আঁকার কথা বলল যেন ভূত আঁকা ডালভাতের মতো ব্যাপার! আবার ব্যাপারটা এমন যেন, বাবা পাবলো পিকাসোর মতো বড় মাপের কোনো শিল্পী, যখন যা খুশি তাই আঁকতে বললে নিমিষেই এঁকে দিবে!
রাজুর কথা শুনে বাবা প্রথমে অবশ্য একটু চমকে উঠল, ‘কী আঁকব!’
‘ভূত আঁকো বাবা, ভূত!’
রাজু আঁকার খাতা আর পেন্সিল ধরিয়ে দিলো বাবার হাতে।
‘ভূত কীভাবে আঁকব? আমি কী কখনো ভূত দেখেছি নাকি!’
রাজু অবাক হলো, ‘কী বলো তুমি বাবা! এত বড় হয়েছো এখনো তুমি ভূতই দেখোনি?’
বাবা বিরক্ত হলো, ‘ভূত কি পাখ-পাখালির মতো চোখের সামনে ওড়াওড়ি করে যে যখন তখন দেখা যায়!’
‘পাখ-পাখালির মতো ওড়াওড়ি না করুক, সিনেমায়-বইতে-পত্রিকায় কত কত ভূতের ছবি দেখা যায়! ঘুমের ভেতরে স্বপ্নেও তো কতদিন ভূতেরা এসে আনাগোনা করে। তুমি কখনো দেখোনি?’
‘তা না হয় দেখেছি। কিন্তু তুমি নিজেই তো এঁকে ফেলতে পারো। তুমি না কত কিছু আঁকতে পারো, একটা ভূত আঁকতে পারবে না?’
রাজুর মুখ দেখে মনে হলো সে আঁতকে উঠল, ‘না, না, না। আমি আঁকব না!’
বাবা মুচকি মুচকি হেসে বলে, ‘কেন? ভয় লাগে?’
‘না, না, না। ভয় লাগে না।’ রাজুর দ্রুত জবাব, ‘আমি আঁকলে কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং হয়ে যাবে। এজন্য তুমি আঁকো।’
‘আচ্ছা, তুমি তাহলে বলে দাও কেমন ভূত আঁকব।’
‘হুম।’ একটু চিন্তা করল রাজু, ‘ইয়া বড় একটা মাথা আঁকো।’
বাবা আঁকল।
‘মাথায় দুইটা শিং দাও।’
বাবা দিলো।
‘চোখ আঁকো, গোল গোল চোখ। নাক হবে ভোঁতা। কান খাড়া খাড়া। ইয়া বড় বড় দাঁতওয়ালা মুখ, উপরের পাটির দাঁতগুলো মুখের বাইরে বের হয়ে থাকবে। আর এলোমেলো লম্বা লম্বা জটপাকা চুল।’
রাজু একমনে বলে যাচ্ছিল। একটু থেমে উঁকি দিয়ে দেখে নিল বাবা ঠিকঠাক আঁকছে কিনা।
‘তারপর?’ বাবা তাড়া দিলো।
‘ভূতের শরীরটা আঁকো ডিমের মতো। লম্বা লিকলিকে হাত, হাতের চেয়ে মোটা মোটা আঙুল হবে। হাত দুপাশে ছড়িয়ে রাখো।’
‘আর?’
‘উমমম...’ রাজু ভাবল একটু, ‘আর কিছু লাগবে না। শেষ।’
‘কী বলো? ভূতের পা কী হবে? ভূত কি হাঁটবে না?’
‘না, হাঁটা লাগবে না। এ ভূত হাত দিয়ে ডানার মতো ঝাপটিয়ে উড়ে বেড়াবে।’ রাজু তাগাদা দিলো, ‘তুমি সুন্দর করে ঘষামাজা করে আরেকটু বিদঘুটে আর ভয়ঙ্কর ভাব দিয়ে শেষ করে ফেলো।’
বাবা কথা বাড়াল না। আঁকা শেষ করে জানতে চাইল, ‘দেখো, কেমন হয়েছে?’
রাজু ভ্রু কুঁচকে খাতাটা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে দেখে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘যেমনই হোক, আপাতত চলবে।’
বাবা ফিক করে হেসে দিলো। আরও জানতে চাইল, ‘ছবিটা নিয়ে এখন তুমি কী করবে?’
‘কাল স্কুলে নিয়ে গিয়ে রিতু-সেতুকে ভয় দেখাব। ওরা ভূত খুব ভয় করে কিনা!’ বলেই ছবিটা নিয়ে রাজু নিজের ঘরে চলে গেল।
রাতে ঘুমের মধ্যে মনে হলো কেউ যেন রাজুর পিঠে টোকা দিয়ে ডাকছে। রাজু চোখ খুলে পাশ ফিরে চমকে উঠল, বাবার আঁকা ভূতটা দাঁতগুলো বের করে বিদঘুটে হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে! রাজু ভয় পেলেও বুঝতে দিতে চাইল না, তবুও একটু তোতলাতে লাগল, ‘তু-তুমি কে?’
‘হে, হে, হে, আমি ওই ভূতটা, তোমার ব্যাগের ভেতরে খাতায় যেটা আঁকা আছে।’ কর্কশ স্বরে খিক খিক করে হাসতে হাসতে বলল ভূতটা।
রাজু অবাক হলো, ভয়ও পেল। তারপরও নিজেকে শান্ত রাখল, ‘ধুর! বাজে কথা। স্বপ্ন
দেখছি বোধহয়।’ বলেই আবার পাশ ফিরে
শুয়ে পড়ল। ভূতটা আবার টোকা দিলো,
‘ঘুমিয়ে পড়ছো কেন? আমি তো তোমাকে ভয় দেখাতে এসেছি।’
রাজু পাশ ফিরে বলল, ‘আমি এসব ভয় পাই না। দূর হও।’ তারপর আবার পাশ ফিরে চোখ বুজে নিল। ভূতটার আত্মসম্মানে লাগল, ‘বললেই হলো ভয় পাও না! আগে এদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো।’
রাজু তাকাতেই ভূতটা তার বের হয়ে থাকা উপরের পাটির দাঁতগুলো আরও বের করে, হাত দুটো কান পর্যন্ত তুলে ভেঙচানোর মতো ভঙ্গি করে নাড়িয়ে খিক খিক করে বলতে লাগল, ‘হাউ মাউ খাও, এখন কি ভয় পাও?’
রাজু ভয় পায়, কিন্তু ধমকিয়ে বলে, ‘কীসের ভয়! দূর হও!’ রাজু আবার পাশ ফিরে চোখ বুজে ফেলে। ভূতটা রাজুর পিঠে আবার টোকা দেয়। রাজু তাকায় না। ভূতটা টোকা দিতে থাকে। রাজু তাকায় না। ভূতটা টোকা দিতেই থাকে। রাজু এবার রেগে যায়, ‘এখনই দূর হও বলছি। আমি বেশি রেগে গেলে কিন্তু তোমার দাঁতগুলো সব ফেলে দিব!’
‘কী! ভূতের দাঁত ফেলে দিবে!’ ভূতটাও উত্তেজিত হয়ে গেল, ‘কত্তবড় সাহস তোমার! একটা ভূতের দাঁত তুমি ফেলে দিবে! এসো, উঠে এসো, দেখি কেমন করে তুমি ভূতের দাঁত ফেলো!’ ভূতটা অস্থিরতায় এলোমেলোভাবে তার লিকলিকে হাত দুটো নাড়াতে লাগল।
রাজু শান্তভাবে বলল, ‘সত্যিই দেখতে চাও?’
‘চাই মানে! অবশ্যই চাই। এই আমি কোমড় বেঁধে দাঁড়ালাম। দেখি তুমি কী করতে পারো।’
‘পরে কিন্তু পস্তাবে। কাউকে কিন্তু মুখ দেখাতে পারবে না!’
‘সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না! তুমি আগে আমার দাঁত ফেলে দেখাও।’
‘ঠিক আছে, সত্যিই যদি তুমি দেখতে চাও তাহলে কাল আবার এসো। যদি আসতে পারো তবেই দেখাব।’
‘কাল মানে! আজই দেখাও, এখনই...।’ ভূতটা অস্থির হয়ে গেল।
‘তোমার যদি সাহস থাকে তবে কাল আবার এসে দেখাও। সাহস করে যদি কাল আবার আসতে পারো তবেই আমি তোমার দাঁত ফেলে দেখাব। আর যদি সে সাহস না থাকে তাহলে থাকো কোমড় বেঁধে দাঁড়িয়ে, আমাকে বিরক্ত করো না। আমি ঘুমাব।’
‘সাহস নিয়ে প্রশ্ন! ভূতের সাহস নিয়ে প্রশ্ন!’ মনে হলো রাগের চোটে ভূতটার চোখ দিয়ে আগুন বের হয়ে আসবে! কিন্তু সে সামলে নিল, ‘ঠিক আছে, কালকেই আসব। দেখব তুমি কীভাবে আমার দাঁত ফেলো!’
ভূতটা চলে গেল। রাজু চোখ খুলে পাশ ফিরে একবার দেখে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল যে ভূতটা আসলেই চলে গেছে কিনা। সেটা নিশ্চিত হয়ে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তার মাথায় এরইমধ্যে ভূতের দাঁত ফেলে দেয়ার একটা বুদ্ধি এসে গেছে। তাই সে নিশ্চিন্তে ও নির্ভয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই রাজু তার ব্যাগ থেকে খাতাটা বের করল। বাবার আঁকা ভূতটা যেভাবে আঁকা হয়েছিল সেভাবেই আছে। সে ঠিক করল, এটা আজ আর স্কুলে নিয়ে যাবে না, রিতু-সেতুকে ভয় দেখাবে না। গতরাতের ঘটনা সত্য হোক বা স্বপ্ন, এর একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে আগে।
সে একটা ইরেজার দিয়ে ভূতটার দাঁতগুলো সব মুছে দিলো! তারপর ছবির নিচে লিখে দিলো, ‘ফোকলা ভূত’।
রাতে অনেকক্ষণ রাজু জেগে থাকল, ভূতটা আর এল না। সারারাতে ভূতটা আর এলই না। আর কোনোদিন আসবেও না! ফোকলা মুখ নিয়ে কীভাবে আসবে!
রাজুর কাছে অবাক লাগল, মানুষের মতো ভূতেরাও আজকাল ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম’ বোঝে না!
জাহ্নবী