নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন হওয়ায় বাধ্য হয়ে সরকার গত বছরের আগস্ট, সেপ্টেম্বরে কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু চার মাসের ব্যবধানে এসব পণ্যের কোনো দামই বেঁধে দেওয়া দামের ধারেকাছে নেই। এমনকি নতুন সরকার গঠনের পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তারপরও কোনো পণ্য সরকারনির্ধারিত দামে পাওয়া যাচ্ছে না। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, গোড়ায় গলদ থেকে যাচ্ছে। বড় ব্যবসায়ীরা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না। সিন্ডিকেট করেই তারা বিভিন্ন অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছেন। তারা না কমালে খুচরা পর্যায়ে কমবে না দাম। মিলার থেকে আড়ত, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা একে অপরকে দোষারোপ করেই ভোক্তাদের কাছে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছেন।
পেঁয়াজ বা আলুর ভরা মৌসুমেও কমছে না দাম। কয়েকটি কোম্পানি সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম গত বছরের আগস্টে হঠাৎ করে বাড়িয়ে দেয়। বাড়তে বাড়তে ডজনে তা ১৭০ টাকায় ঠেকে। এ নিয়ে হইচই পড়লে অনেক পরে পেঁয়াজ, আলুর সঙ্গে ডিমের দামও ১৪৪ টাকা ডজন বেঁধে দেয় সরকার। সেই দামই আছে গরিবের এই আমিষের। নিত্যপণ্যের মধ্যে বিভিন্ন অজুহাতে চিনিতেও ভোক্তাদের পকেট কাটা হচ্ছে।
এদিকে আওয়ামী লীগ নতুন সরকার গঠন করে নিত্যপণ্যের দাম কমানোর জন্য ঘোষণা দিলেও বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। মন্ত্রিসভা গঠনের পরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের আমদানি শুল্ক কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেয়।
তারপরও বাজারে কোনো পণ্যের দাম কমেনি। কিন্তু কোনো পণ্যের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলে তাৎক্ষণিক বেড়ে যায়। দোকান মালিক সমিতির সদস্যরা বলছেন, সরকার তো আমদানি করে না। সরকার কেন দাম বেঁধে দেয়? সরকারের তো দাম নির্ধারণ করে বাস্তবায়ন করার কথা নয়। সরকার পারলে নিজেরা মাল আনবে, বাজারে বাজারে বিক্রি করবে, দেখবে আমরা বেশি দামে বিক্রি করছি কি না।
আসন্ন রমজান সামনে রেখে বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে থাকবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, দুই মাস আগেই রমজান ঘিরে সব ধরনের পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে। এ জন্য বাজারমূল্য স্বাভাবিক রয়েছে। রমজানে অসাধু ব্যবসায়ীদের কঠোরভাবে দমন করে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা হবে।
এদিকে আলু, পেঁয়াজ, ডিম, রসুনসহ যাবতীয় কৃষিপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ক্রেতার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের প্রতারণার যেন আর শেষ নেই। বাজারে নতুন পেঁয়াজ এলেও এখনো বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৪০ টাকায়। দেখারও যেন কেউ নেই।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সভাপতি গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরবরাহ পরিস্থিতি যদি উন্নত না হয়, তাহলে ঘোষণা দিয়ে মুক্তবাজার ব্যবস্থায় পণ্যের দাম নির্ধারণ করা বাস্তবসম্মত নয়। যদি বাস্তবায়ন করতে হয়, পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। যদি পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত না করি, কেবল ঘোষণা দিয়ে জেল-জরিমানা করে বাস্তবায়ন করি, তাহলে এটা বাস্তবসম্মত মনে হয় না।
বাস্তবসম্মত করতে হলে বাজারে পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রির বিষয়টা কার্যকর হবে না।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারব্যবস্থায় যেভাবে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত কাঠামো না থাকলে সুফল পাওয়া যায় না। ইতোপূর্বে আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, যেসব পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন এলপিজি আর তেলের ক্ষেত্রে কিছুটা দেখা গেছে। কাঁচা পণ্যের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যেসব পণ্য কম সময়ে বাজারে আসে এবং চাহিদা থাকে, নিয়মিত বাজার তদারকি এবং নির্ধারণ করা মূল্যে সেটি বিক্রি হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য কাঠামো দরকার। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে মনিটরিং কাঠামোটি শক্তিশালী নয়। সে কারণে মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে যে প্রত্যাশা করা হয়, সেটি পূরণ হয় না। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে খুচরা বাজার পর্যন্ত যত মার্কেট এজেন্ট থাকবে তাদের প্রত্যেকের নিবন্ধন দরকার। শুধু ট্রেড লাইসেন্স থাকলে চলবে না। লাইসেন্সধারীরা বাজারে যে ব্যবসায়িক লেনদেন করবেন, তা ডিজিটাল পদ্ধতিতে রিপোর্ট করবেন। তাদের প্রত্যেকের আইডি থাকবে এবং আইডি দিয়ে তার কাছে কী পরিমাণ পণ্য মজুত আছে, সেটি শনাক্ত করা যাবে।
বাজারে বড় ধরনের কোনো অযাচিত প্রভাব আছে কি না, তা দেখা দরকার। তদারকি শক্তিশালী করতে হবে। এটা উপজেলা, জেলা থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত হতে হবে। প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট যেসব বিভাগ রয়েছে তাদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে দায়িত্ব পালন করতে হবে। বাজার কমিটিগুলোকেও সক্রিয় পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপে সাধারণ মানুষের জীবন এখন চিড়েচ্যাপটা। যে কারণে সরকার পণ্যের একটা বেঁধে দেওয়া দাম নির্ধারণ করেছে, তা কার্যকর করা মঙ্গলজনক হবে।