
অনুচ্ছেদ লিখন
অতিথি পাখি/পরিযায়ী পাখি
বরফাচ্ছন্ন শীতপ্রধান অঞ্চলের ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচতে এবং তুলনামূলক উষ্ণ আবহাওয়ার সুখ অনুভব করতে সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে অতিথি পাখিরা আসে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার দেশ বাংলাদেশে। শীতকালে অতিথি পাখিদের আগমন ঘটে এবং শীত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাখিরা তাদের আগের আবাসের উদ্দেশে উড়াল দেয়। অল্প সময় অবস্থানের জন্য এ দেশে আসে বলে এই পাখিরা আমাদের অতিথি, আর তাই এদের নাম অতিথি পাখি। অনেকে এদের ‘পরিযায়ী পাখি’ বলেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন, সুনামগঞ্জের হাওর, ঢাকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা চিড়িয়াখানার জলাশয়গুলোয় এরা সাময়িক আবাস গড়ে তোলে। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ, খুলনা ও যশোরের বিলগুলোতেও অনেক পাখি আশ্রয় নেয়। শীতজুড়েই জলে বা জলাধারে থাকে অতিথি পাখির বিচরণ। মূলত হিমালয়ের পাদদেশ থেকে এবং সুদূর সাইবেরিয়া বা উত্তর ইউরোপ থেকে পাড়ি দিয়ে এরা শীতের অতিথি হয়ে আসে। অতিথি পাখিদের মধ্যে কাইন, রাঙ্গে, টেকুর, ডাক, বালি হাঁস, কোড়া, কুদলা, হাঁস জাতীয় পাখি, চখাচখি, বড় দিঘির গুলিন্দা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। জলাধারে আশ্রয় নেওয়া এই পাখিগুলোর বিচরণ যেমন একদিকে হৃদয়গ্রাহী, অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কিছু মানুষের নিষ্ঠুর আচরণ শীতের এই অতিথিদের অবাধ বিচরণকে সংকটময় করে তোলে। প্রতি বছরই শীতের সময় কিছু মানুষ অতিথি পাখি নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে, যা অনৈতিক। বাস্তবে অতিথি পাখিদের অতিথির মতোই সাদরে গ্রহণ করা উচিত। তাদের জন্য তৈরি করা উচিত অভয়ারণ্য। এই পাখিরা শুধু আমাদের দেশে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেই আসে না; তারা নিয়ে আসে সাম্য-মৈত্রীর বার্তাও। অতিথি পাখিরা আমাদের সামনে কাঁটাতারমুক্ত অবাধ বিচরণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে যায়। বিশ্বায়নের যুগে এই বার্তাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই অতিথি পাখি সংরক্ষণে আমাদের বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে পাখি শিকারিদের। তবেই বাংলাদেশ হবে অতিথি পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
শ্রমের গুরুত্ব
বিশ্বসংসার শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে। লক্ষ-কোটি মানুষের যুগ-যুগান্তরের শ্রমের ওপরেই রচিত হয়েছে সভ্যতার বিশাল সৌধ। সুতরাং শ্রমের মর্যাদা শ্রমশীলতারই যোগ্য পুরস্কার। পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। পরিশ্রম ছাড়া মানবসভ্যতা এক পা-ও এগিয়ে আসেনি। অথচ এ শ্রমের যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে অনেকেই কুণ্ঠিত বোধ করেন। অনেকেই দৈহিক শ্রমের কাজকে সম্মানহানিকর বলে মনে করে। সৎ পথে থেকে যেকোনো শ্রমসাধ্য কাজ করাই সম্মানজনক। আসলে ছোট কিংবা বড় কাজ বলে কিছু নেই। ভিক্ষাবৃত্তি এবং নীতিহীন কাজ ছাড়া সব কাজই মর্যাদার দাবিদার। সুতরাং কোনো ধরনের শ্রমকেই সম্মানের দিক থেকে খাটো করে দেখা যায় না। বিশ্বের সব মহামানবই শ্রমকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছেন। তারা নিজেরাও তাদের ব্যক্তিগত জীবনে শ্রমসাধ্য কাজ করেছেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের দিকে লক্ষ করলেও আমরা দেখব যে, তিনি নিজে কঠোর পরিশ্রম করেছেন এবং কোনো কাজকেই অমর্যাদাকর বলে মনে করেননি। ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার প্রাপ্য পরিশোধ করো’- তার এ বাণী তো শ্রমের মর্যাদারই অকুণ্ঠ স্বীকৃতি। ব্যক্তিজীবন কিংবা জাতীয় জীবনের সব উন্নতির মূলেই রয়েছে শ্রমশক্তি। পৃথিবীতে যে জাতি যত পরিশ্রমী, সে জাতি তত উন্নত। সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের দিক থেকে পাশ্চাত্য দেশগুলো এতটা উন্নতি সাধন করেছে, তার পেছনেও রয়েছে শ্রমের অতুলনীয় অবদান। অথচ আমাদের সমাজে এ শ্রমের মর্যাদার বদলে কারও কারও কাছে অবজ্ঞা মনে হয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই চাকরি প্রত্যাশা করেন এবং কৃষি, খামারশিল্প ইত্যাদি শ্রমসাধ্য কাজকে হীন মনে করেন। কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই বেকার যুবকসহ অনেকেই এসব কাজে অংশগ্রহণ করে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারেন। একটা সুষ্ঠু ও গতিশীল সমাজ সৃষ্টি করতে চাইলে শ্রমকে মূল্য দিতে হবে, পুরোনো মূল্যবোধের অবসান ঘটাতে হবে। তাই আজকে বোঝার সময় এসেছে, শ্রমে কোনো হীনতা নেই এবং শ্রমশীল মানুষের হাতেই রয়েছে আগামী দিনের নেতৃত্ব।
আরো পড়ুন : ২টি অনুচ্ছেদ লিখন, ২য় পর্ব
শিশুশ্রম
‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’ অর্থাৎ শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজ যারা শিশু আগামী দিনে তাদের ওপরই ন্যস্ত হবে দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব। কিন্তু নানা কারণে শিশুরা আজ উপযুক্ত পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত। জীবিকার প্রয়োজনে তারা বাধ্য হচ্ছে শ্রমদানে। বর্তমানে শিশুদের সুন্দর শৈশব এবং বিকশিত জীবনের সবচেয়ে বড় বাধা শিশুশ্রম। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের আনুমানিক শ্রমশক্তির শতকরা ১৫ ভাগই শিশু। শিশুদের এ বিরাট অংশ শ্রমদান করতে বাধ্য হয় আর্থসামাজিক পরিস্থিতির কারণে। এ দেশের শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এসব মানুষ বাধ্য হয়ে বাড়তি উপার্জনের জন্য তাদের সন্তানদের ঝুঁকিপূর্ণ নানা কাজে নিয়োজিত করে। রাজনৈতিক বিপর্যয়, সাম্প্রদায়িকতা, উদ্বাস্তু জীবনের ছিন্নমূলতা, পিতা-মাতার নৃশংস আচরণ, পিতা-মাতার পঙ্গুত্ব ইত্যাদি কারণে শিশুদের কাজ করার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশুশ্রমের কারণে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও অর্ধেকের বেশি শিশু অকালে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে। অর্থাৎ শিশুশিক্ষার সঙ্গে শিশুশ্রমের একটি বিপরীতমুখী সম্পর্ক রয়েছে। আবার শিশুরা কর্মক্ষেত্রে যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে, তা তাদের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে তারা যেমন তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাই শিশুশ্রম বন্ধের জন্য আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের পাশাপাশি শিশুবান্ধব সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই শিক্ষিত ও সচেতন নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠবে, যারা দেশ গঠনে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখতে পারবে।
বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ
এ বিশ্বকে সুশীতল ও বাসোপযোগী করে রাখার ক্ষেত্রে বৃক্ষের অবদান সবচেয়ে বেশি। বিশ্বকে সবুজ শ্যামলে ভরে দিয়েছে বৃক্ষরাজি। মানুষের সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য যেসব মৌলিক চাহিদা রয়েছে তার অধিকাংশই পূরণ করে বৃক্ষ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের জন্য দিনের পর দিন বৃক্ষ নিধনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে যে, একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকল্পে মোট ভূমির শতকরা ২৫-২৬ ভাগ বনভূমি থাকা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের মোট ভূমির মাত্র ১২ থেকে ১৪ ভাগ বনভূমি রয়েছে। বাংলাদেশের বনাঞ্চলের মধ্যে টাঙ্গাইল জেলার মধুপরের গড়, গাজীপুরের ভাওয়ালের গড়, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, সিলেট জেলার বনাঞ্চল ও খুলনার সুন্দরবন উল্লেখযোগ্য। এসব বনাঞ্চলসহ সারা দেশে যেসব ছোটখাটো বনাঞ্চল রয়েছে তা কোনোভাবেই দেশের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। ফলে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। অসময়ে বৃষ্টিপাত, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বৃক্ষরোপণ বা বনায়ন সৃষ্টি করা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। বাংলাদেশ সরকারের বন ও কৃষি বিভাগ থেকে প্রতি বছর জুন-জুলাইয়ে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন করা হয়। এ সময় সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশের বনাঞ্চলে, জেলা সদর, ও অন্যান্য স্থানে নানা ধরনের গাছের চারা রোপণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেসব স্থানে বৃক্ষের চারা রোপণ করা হয়, সেগুলো হলো- দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সড়কের ধার ও অফিসের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। বিনামূল্যে বিভিন্ন কেন্দ্রে চারাগাছ বিতরণ করা হয়। আমাদের এ কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এককভাবে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংগঠন কিংবা সরকারের পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। এ দায়িত্ব আমাদের সবার, সমগ্র জাতির।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (বাংলা)
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল, ঢাকা
কবীর