মহাকাশে ঘটে গেল এক নাটকীয় ঘটনা। একটি ভিনগ্রহী গ্রহ তার নক্ষত্রের আকর্ষণে বিলীন হয়ে গেছে। শক্তিশালী জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ সেই ভিনগ্রহের করুণ পরিণতির চিত্র তুলে ধরেছে, যা গ্রহটির ধ্বংসের কারণ সম্পর্কে আগের ধারণার চেয়ে ভিন্ন।
২০২০ সালের মে মাসে জ্যোতির্বিদরা প্রথমবারের মতো প্রত্যক্ষ করেন, একটি নক্ষত্র তার একটি গ্রহকে গ্রাস করতে যাচ্ছে। তখনকার তথ্যের ভিত্তিতে তারা মনে করেছিলেন, নক্ষত্রটি তার জীবনকালের শেষ পর্যায়ে প্রসারিত হয়ে একটি ‘লাল দানব বা রেড জায়ান্ট’ অবস্থায় পৌঁছে গ্রহটিকে গিলে ফেলেছে। তবে ওয়েব টেলিস্কোপের নতুন পর্যবেক্ষণ বলছে, সেই ঘটনাটি ঘটেছিল ভিন্নভাবে। গবেষকদের মতে, নক্ষত্রটি গ্রহের দিকে এগিয়ে যায়নি। বরং গ্রহটির কক্ষপথ দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে নক্ষত্রের দিকে ধাবিত হয়েছে। এক সময় তা নক্ষত্রে পতিত হয়েছে, যার পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ।
ঘটনার পরের দৃশ্য বেশ নাটকীয়, যা ওয়েব টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে। ঘটনাটি ঘটার পরপর ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা ছবিতে দেখা গেছে, গ্রহটি বিলীন হওয়ার পর নক্ষত্রের চারপাশে সম্ভবত উত্তপ্ত গ্যাসের একটি বলয় তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে ঠাণ্ডা ধুলার মেঘ। টেলিস্কোপটি ২০২১ সালে উৎক্ষেপিত হয় ও ২০২২ সাল থেকে এটি মহাকাশ পর্যবেক্ষণে ভূমিকা রাখছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং এই গবেষণার প্রধান লেখক রায়ান লাউ বলেন, ‘গ্রহটি যখন তার অন্তিম যাত্রায় নক্ষত্রে পতিত হয়েছিল, তখন নক্ষত্র থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পদার্থ ছিটকে বেরিয়ে আসে। সেই ধুলা এখন সেখানে ছড়িয়ে আছে।’ সম্প্রতি অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ১২ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অ্যাকুইলা নক্ষত্রমণ্ডলের দিকে। নক্ষত্রটি আমাদের সূর্যের চেয়ে কিছুটা লালচে, কম উজ্জ্বল এবং ভরের পরিমাণও সূর্যের প্রায় ৭০ শতাংশ।
ধারণা করা হচ্ছে, গ্রহটি ছিল একটি ‘উষ্ণ বৃহস্পতি বা হট জুপিটার’ শ্রেণির। অর্থাৎ এটি বৃহস্পতির মতো একটি গ্যাসীয় দৈত্য গ্রহ, যা নক্ষত্রের খুব কাছে প্রদক্ষিণ করার কারণে অত্যন্ত উত্তপ্ত অবস্থায় ছিল। হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের পোস্টডক্টরাল ফেলো মরগান ম্যাকলিওড বলেন, ‘সম্ভবত গ্রহটি বৃহস্পতির চেয়েও কয়েকগুণ ভারী ছিল। কারণ, নক্ষত্রে এত বড় পরিবর্তন ঘটাতে হলে তেমন বিশাল গ্রহ দরকার।’
গবেষকরা মনে করছেন, নক্ষত্রের সঙ্গে মহাকর্ষীয় মিথস্ক্রিয়ার ফলে গ্রহটির কক্ষপথ ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এরপর এটি নক্ষত্রের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। ম্যাকলিওডের মতে, ‘নক্ষত্রের বায়ুমণ্ডলের প্রবল বাধার মুখে গ্রহটি আরও দ্রুত নক্ষত্রের গভীরে পতিত হতে থাকে। এ সময় গ্রহটির বাইরের গ্যাসীয় স্তর খসে পড়তে থাকে এবং সংঘর্ষের ফলে উৎপন্ন তাপে নক্ষত্রের গ্যাসীয় পদার্থ ছিটকে বেরিয়ে আসে। এতে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে গ্যাস, ধুলা ও নানা উপাদান।’
তবে গ্রহটির চূড়ান্ত পরিণতি ঠিক কী হয়েছে, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি নিশ্চিত নন। ম্যাকলিওড বলেন, ‘আমরা দেখেছি গ্রহটির পতনের ফলে নক্ষত্রের ওপর কী প্রভাব পড়েছে। তবে গ্রহটির ঠিক কী হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে জানি না। মহাকাশের অনেক ঘটনা এত বিশাল ও দূরবর্তী যে, সেগুলোর পরীক্ষা ল্যাবরেটরিতে করা অসম্ভব। তবে আমরা কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে কেবল অনুমান করতে পারি।’
এই ঘটনা আমাদের সৌরজগতের জন্য আপাতত কোনো হুমকি নয়। গ্রহ-নক্ষত্রের সম্পর্ক যেমন পরিবর্তনশীল, তেমন অনিশ্চিত। আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলোর কক্ষপথ স্থিতিশীল। কারণ আমাদের গ্রহগুলো সূর্যের এতটা কাছে নেই যে, তাদের কক্ষপথ এভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। তবে এর মানে এই নয় যে, সূর্য ভবিষ্যতে কোনো গ্রহকে গ্রাস করবে না। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রায় ৫০০ কোটি বছর পর সূর্য যখন তার লাল দানব অবস্থায় পৌঁছাবে, তখন এটি প্রসারিত হয়ে বুধ, শুক্র এমনকি পৃথিবীও হয়তো তার মধ্যে তলিয়ে যেতে পারে। তখন সূর্যের বাইরের স্তরগুলো মহাকাশে ছড়িয়ে যাবে এবং এটি একটি শ্বেত বামন নক্ষত্রে পরিণত হবে।
জেমস ওয়েবের নতুন পর্যবেক্ষণ গ্রহদের অন্তিম পরিণতি সম্পর্কে নতুন ধারণা দিচ্ছে। রায়ান লাউ বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণ ইঙ্গিত দেয়, নক্ষত্র প্রসারিত হয়ে গ্রহকে গ্রাস করার চেয়ে বরং গ্রহগুলো ধীরে ধীরে তাদের নক্ষত্রের দিকে এগিয়ে গিয়ে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে আমাদের সৌরজগৎ তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। তাই আমাদের আপাতত কেবল সূর্যের লাল দানব হয়ে ওঠার ও আমাদের গ্রহকে গ্রাস করার বিষয়ে চিন্তা করতে হবে।’ সূত্র: রয়টার্স