‘কত যে শ্মশান-মশান কত যে-কত যে কামনা পিপাস-আশা
অস্তচাঁদের আকাশে বেঁধেছে আরব-উপন্যাসের বাসা!’
গতকাল (২৩ এপ্রিল) সন্ধ্যার পর আকাশের চাঁদ ঠিক যেন জীবনানন্দ দাশের চাঁদিনীতে কবিতার এই দুটি লাইনের মতো। বিশাল এ চাঁদের বুকে বাসা বাঁধতে পারবে যেকোনো উপন্যাস। দৃষ্টিনন্দন এ চাঁদের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিশীল লেখক লিখতে পারবেন যেকোনো গান, কবিতা বা উপন্যাস।
শুধু কবি বা সাহিত্যিক নয়, গতকালের আকাশের গোলাপি এ চাঁদ যেকোনো সাধারণ মানুষের মনে তৈরি করেছিল ভিন্ন এক আবেশ।
গোলাপি চাঁদ বা পিংক মুন সাধারণত প্রতিবছর এপ্রিল মাসের চৈত্র পূর্ণিমাকে বলা হয়ে থাকে। পিংক মুন বা গোলাপি চাঁদ বিশ্বব্যাপী ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। এগ মুন, ফিশ মুন, পাসওভার মুন, স্প্রাউটিং গ্রাস মুন, পাক পোয়া ইত্যাদি। অনেকে এটিকে ‘লাল ঘাসের চাঁদ’ নামেও ডেকে থাকে।
গোলাপি চাঁদ নামকরণ করা হয়েছে আমেরিকার বসন্ত ঋতুর শুরুতে ফোটা একটি বুনো ফুলের নাম থেকে। আঞ্চলিকভাবে গোলাপি রঙের এই ফুল ‘মস পিংক’ নামে পরিচিত। এপ্রিলে ফোটা এই মস পিংক ফুলের নাম থেকেই এপ্রিল মাসের চাঁদের নামকরণ করা হয়েছে পিংক মুন বা গোলাপি চাঁদ।
তবে বাস্তবিক অর্থে এই চাঁদের রং কিন্তু গোলাপি নয়। বরং সাধারণ দিনের মতো সোনালি রঙের। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে থাকা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ধূলিকণা এবং বিভিন্ন ধরনের গ্যাসের কারণে অনেক সময় চাঁদের রং পরিবর্তন হয়। এ ছাড়া অন্যান্য ধোঁয়া-দূষণও পৃথিবীতে চাঁদের আলো পৌঁছাতে বাধা দেয়। পৃথিবীতে আসা আলো তাদের নিজ নিজ তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য অনুযায়ী অনেক প্রকারে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, যার মধ্যে নীল রংকে সবচেয়ে দ্রুত বিক্ষিপ্ত হতে দেখা যায়। লাল রংও বহু দূরে যায়।
ফলে যখন চাঁদকে পৃথিবী থেকে দেখা হয়, তখন বাদামি, নীল, হালকা নীল, রুপালি, সোনালি, কমলা বা হালকা হলুদ রঙের দেখায়। আর দৃষ্টিবিভ্রমের কারণে একে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বড়ও দেখায়।
গোলাপি এ চাঁদটিও সোনালি রঙেই দেখা গেছে। কোথাও কোথাও আবার কমলা বা হালকা হলুদ রঙে দেখা গেছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গোলাপি চাঁদটি উজ্জ্বল সাদা রং ধারণ করেছে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, চাঁদ যখন পৃথিবীর খুব কাছাকাছি আসে, তখন চাঁদের আকার স্বাভাবিকের তুলনায় বড় এবং উজ্জ্বল দেখায়।
অর্থাৎ পৃথিবী যখন সূর্য ও চাঁদের মাঝ বরাবর অবস্থান করে, তখনই পূর্ণ চাঁদ দেখা যায়।
গোলাপি চাঁদ যে শুধু দেখতেই নান্দনিক তা কিন্তু নয়, নানা কারণে বিশ্বব্যাপী গোলাপি চাঁদের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। বিশ্বের বেশ কিছু সংস্কৃতিতে এই চাঁদকে দেখা হয় বৃদ্ধি, পুনর্জন্ম ও প্রকৃতির নবজাগরণ লাভের সময় হিসেবে। বলা হয়ে থাকে, এটি জীবনের প্রকৃতিগত আবর্তনকে জানান দেয়। একই সঙ্গে জানান দেয় ঋতু পরিবর্তনের।
অনেক দেশে আবার এ চাঁদের সঙ্গে মিল রেখে পালন করা হয় গুরুত্বপূর্ণ নানা ধর্মীয় উৎসব।
যেমন খ্রিষ্টানদের ইস্টার সানডে পালিত হয়ে থাকে এপ্রিল মাসের পূর্ণিমার পরের রবিবার। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সনাতন ধর্মের মানুষ এই সময় উদযাপন করেন হনুমানজয়ন্তী। একই সঙ্গে এপ্রিলের পূর্ণিমার দিন শুরু হয় ইহুদিদের পাসওভার।
২০২৪ সালের এপ্রিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। কেননা এই মাসে বিশ্ব ৫৪ বছরের মধ্যে দীর্ঘতম সূর্যগ্রহণ দেখেছে। আবার একই মাসে গোলাপি পূর্ণিমার চাঁদও দেখল বিশ্ববাসী।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা জানিয়েছে, এ বছর গোলাপি চাঁদ পরিপূর্ণরূপে ধরা পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা ৪৯ মিনিটে দেখা গেছে গোলাপি এ চাঁদ। আর বুধবার এই গোলাপি চাঁদ পূর্ণরূপে দেখার সুযোগ পান ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দারা।
বাংলাদেশ থেকেও এই চাঁদ দেখার ব্যবস্থা করেছে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের প্রশাসনিক ভবনের ছাদে স্থাপন করা শক্তিশালী টেলিস্কোপের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও জনসাধারণকে দেখানো হয় গোলাপি চাঁদ বা পিংক মুন।