
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ এক মাস পূর্ণ হলো আজ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে ৮ আগস্ট। তার পর থেকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারে জোর দেওয়া শুরু হয়। একই সঙ্গে শুরু হয়েছে অর্থনীতি মেরামতের কাজও।
কাঠামো সংস্কারের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কর্মকর্তা পর্যায়ে আনা হয়েছে ব্যাপক রদবদল। ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গুম-হত্যা চিরতরে বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। আয়নাঘর নামের নির্যাতনের সেই ঠিকানা বাতিল করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করা হচ্ছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাকে সরকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক কাঠামোর কোন খাতে কতটা সংস্কার প্রয়োজন এবং তা কীভাবে সম্ভব তা নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্য উপদেষ্টারা। আলোচনায় অংশ নিয়েছেন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও। সকলের মতামতের প্রতিফলন আনতে রাজনৈতিক দলের কাছে সংস্কার প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী, সংবিধান সংস্কার, তত্ত্ববধায়ক সরকারের রূপরেখা, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে বিশিষ্টজনের মতামত চাওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও ছাত্রদের অন্যতম সমন্বয়ক মাহফুজ আলম বলেন, ‘দেশে স্বচ্ছ, জবাবদিহি ও জনসম্পৃক্ত রাজনীতি ও নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে সংবিধান সংস্কার করতে হবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘সংবিধান, আইনকানুন, বিধিবিধানে পরিবর্তন, বিচারক নিয়োগ-সবই সংস্কারের অংশ। গত সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন দলীয়করণের ফলে মানুষ নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের কবলে পড়ে অযোগ্য, অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়। এসব প্রতিষ্ঠান জনবান্ধব, দুর্নীতিমুক্ত ও কার্যকর হিসেবে গড়ে তুলতে সংস্কার শুরু হয়েছে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সব সংস্কার হয়তো অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করতে পারবে না। কিন্তু এই পরিবর্তন আনতে হলে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হওয়া দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে রাজনৈতিক সমঝোতা করতে হবে। তাদের মধ্যে লিখিত চুক্তি করা যেতে পারে যে, তারা ক্ষমতায় গেলে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। তবে সেই ঐকমত্য এখনই হওয়া চাই। একটা জাতীয় সনদ প্রণীত হতে পারে। বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হওয়া দরকার, সেগুলো লিখিত থাকবে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেগুলো বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকারবদ্ধ হবে।’
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন হিসাব কষছেন। গত এক মাসে তিনি ৩০টির বেশি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নামি-দামি অনেক রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান তাকে অভিনন্দন জানিয়ে সম্পর্ক জোরদার করার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বিগত সরকারের যে ধরনের সম্পর্ক ছিল তাতে ভাটা পড়েছে। বাঁধ খুলে দেওয়া ও সীমান্ত হত্যাকাণ্ড ইস্যুতে ভারত সরকারকে কঠিন বার্তা দিয়েছে বর্তমান সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সার্ককে গতিশীল করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজাতে ৯০ দিনের সীমারেখা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা খাতে ব্যাপক সংস্কার শুরু করা হয়েছে।
গণভবনকে জাদুঘর করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘জাদুঘরে রূপান্তরের পর গণভবনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নানা ঘটনার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বছরে যেসব নিপীড়নের ঘটনা ঘটিয়েছে, যারা গুম হয়েছেন, তাদের তালিকা থাকবে। নিপীড়নের চিত্রও থাকবে।’
মানবাধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা হচ্ছে এমন মত জানিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত গুমের কারণে নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা সাত শতাধিক।’ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছেন। এখন এ বিষেয় আইনি সংস্কার করা হবে।
বর্তমান সরকারের এই এক মাসে পুলিশ বিভাগের সংস্কারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশ বিভাগকে এখনো পুরোদমে সক্রিয় করা সম্ভব হয়নি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকার পুলিশ বিভাগকে সক্রিয় করে সৎ, আন্তরিক ও পেশাদার হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তবে পুলিশ বাহিনী এক মাসের মধ্যে পরিবর্তন হবে, তা আশা করা ঠিক না। সরকারকে পুলিশ সংস্কারে আরও জোর দিতে হবে।’
সংস্কারের অংশ হিসেবে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ, দুর্নীতি ও গণহত্যার দায়ে বিগত সরকারের অনেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃখলা বাহিনীর সদস্য, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, গণমাধ্যমকর্মীর নামে করা মামলায় অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘গণহত্যার দায়ে যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের কোন পদ্ধতিতে দ্রুততম সময়ে বিচার করা হবে, আইন মন্ত্রণালয় থেকে তার রূপরেখা নির্ধারণ করা হচ্ছে।’
অর্থনীতিতে সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাপক সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পুঁজিবাজারসহ অর্থ খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজে গতি বাড়াতে আগের সরকারের আমলে দায়িত্ব পালনরতদের বাদ দিয়ে নতুনদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শিল্প খাতে স্থিতিশীলতা রাখতে, কারখানায় সুষ্ঠু পরিবেশ ও শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি নিয়ে রিভিউ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মো. হাতেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিশ্ববাপী পরিচিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইমেজ কাজে লাগিয়ে এ দেশের অর্থনীতি নতুনভাবে এগিয়ে যাবে।’
অর্থনৈতিক সংস্কারের আংশ হিসেবে এরই মধ্যে কালোটাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। ব্যাংক খাতে স্থিরতা আনতে কমিশন গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের মালিক দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তাকে বিচারের আওতায় আনলেও তার প্রতিষ্ঠান সচল রাখতে সরকার প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যবসায়ীদের কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বন্দর সচল করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পণ্যের দাম কমাতে এরই মধ্যে অনেক নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে।
আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করাই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের আর্থিক খাত সংস্কার করা খুব জরুরি। বর্তমান সরকার দায়িত্বে এসে এখানেই হাত দিয়েছে। এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জের কাজ। অর্থনীতি ঠিকভাবে মেরামত করতে পারলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। আমদানি কমবে, রপ্তানি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। ছাত্র-জনতাও এটাই চেয়েছে।’