১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশের গ্রামে-গঞ্জে, অলিতে-গলিতে ঢুকে নিষ্ঠুর নির্যাতন, লুটপাট, খুন, ধর্ষণ চালায়। তাদের নিষ্ঠুর সেই নির্যাতনের সাক্ষী এখনো রয়েছে দেশের আনাচে কানাচে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলোকে সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে রাখা খুবই প্রয়োজন। এর পাশাপাশি যেসব জায়গা সংরক্ষিত করা হয়েছে, কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, সেসব জায়গা ভ্রমণ করে পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের জ্বলন্ত প্রমাণ, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, বাঙালির গৌরবগাথা জানা জরুরি। এতে দেশ প্রেমের পাশাপাশি জাতীয়তাবোধ সমৃদ্ধ হয়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে জানার জন্য দেশের কিছু স্থান এর মধ্যেই মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। যেমন জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, স্বাধীনতা জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘর, সামরিক জাদুঘর, মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স ইত্যাদি।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবহনকারী এসব প্রতিষ্ঠান দেশের একেক জায়গায়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী সব বীর শহিদদের স্মৃতিকে স্মরণে রাখতে নির্মিত হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধের সাত জোড়া স্তম্ভ বা দেয়াল ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, শাসনতন্ত্র আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, গণ অভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধকে নির্দেশ করে। ঢাকা থেকে সামান্য দূরত্বে স্মৃতিসৌধের অবস্থান। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র এই স্মৃতিসৌধ।
১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের রাতে ধরে নিয়ে ঢাকার রায়েরবাজার ইটখোলার কাছে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। পরবর্তীতে ওই বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়।
স্বাধীনতা জাদুঘর বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ভূগর্ভস্থ জাদুঘর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের সাক্ষী ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিত এ জাদুঘরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ নথি, অ্যাম্ফিথিয়েটার, স্বাধীনতা স্তম্ভ, জলাধার, শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ম্যুরাল এবং অডিটোরিয়াম রয়েছে।
মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে অবস্থিত। স্মৃতি কমপ্লেক্সের আঙিনায় একটি বড় মানচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া আছে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলির স্মারক ম্যূরাল, স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স, ঐতিহাসিক আম্রকানন এবং ঐতিহাসিক ছয় দফার রূপক উপস্থাপনকারী গোলাপ বাগানসহ মুক্তিযুদ্ধের আরও অনেক স্মৃতি।
আর কিছু স্থান সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা খুব কম। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে, ঢাকার মিরপুরে জল্লাদখানা বধ্যভূমি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমিগুলোর অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকার মিরপুরে নিরীহ মানুষদের হত্যা করে গণকবর দেয়। মিরপুরের দুটি জায়গা খনন করে আবিষ্কার করা বধ্যভূমি থেকে ৭০টি মাথার খুলি, ৫৩৯২টি হাড়, শাড়ি, ফ্রক, ওড়না, অলংকার, জুতা, তসবি ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়। নেত্রকোণা জেলার কমলাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ফুলবাড়ি গ্রামে চিরশায়িত রয়েছেন সাতজন মুক্তিযোদ্ধা। এই জায়গা সাত শহিদের মাজার নামে পরিচিত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কয়েকটি টর্চার সেল নির্মাণ করেছিল। তার মধ্যে একটি রয়েছে চাঁদপুরে। সারা দেশ থেকে ট্রেন, লঞ্চ, স্টিমারযোগে যারা চাঁদপুর আসতো তাদেরকে এখানে নির্যাতন করা হতো। নির্যাতন শেষে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। চাঁদপুরের বড় স্টেশন সংলগ্ন পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়ার মিলনস্থল মোলহেডে বধ্যভূমিতে তৈরি করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ‘রক্তধারা’ স্মৃতিস্তম্ভ।
এমনিভাবে দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য স্মৃতিময় স্থানে ভ্রমণের মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে জানতে এবং উপলব্ধি করতে পারি।
জাহ্নবী