ছোটবেলায় দেখেছেন বাবা বাড়ির আনাচে-কানাচে নানা প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন। গড়ে তুলেছিলেন মস্ত বড় আম বাগান। গাছের প্রতি বাবার এমন ভালোবাসা দেখে নিজেও এক দিন বাগান করার স্বপ্ন দেখতেন জেসমিন আরা। সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। নিজের পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন দেশের সবচেয়ে বড় নার্সারি।
এজন্য তিনি সরকারিভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বৃক্ষরোপণে বিশেষ অবদান রাখায় জেসমিন আরা সম্মাননা পেয়েছেন। একজন সফল উদ্যোক্তার পরিচয় গড়ে তুলে এই নারী এখন বহু উদ্যোক্তার আইডল।
ময়মনসিংহের পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ঘেঁষা গৌরীপুর উপজেলার কাশিয়ারচর এলাকায় ২০১৯ সালে গড়ে তোলা তার নার্সারির নাম ‘আধুনিক নার্সারি অ্যান্ড হর্টিকালচার ফার্ম’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সফলতা পাওয়ায় বর্তমানে ১২ একর জায়গাজুড়ে তিনি নার্সারি গড়ে তুলেছেন।
বিশালাকৃতির নার্সারিতে বনজ চারা ছাড়াও দেশি-বিদেশি জাতের আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, বেদানা, কমলা, আমড়া, লেবু, জাম্বুরা, সফেদা, মাল্টা, বড়ই, কামরাঙা, মিষ্টি তেঁতুল, চালতা, লিচু, বেল, লটকনসহ বিভিন্ন জাতের অসংখ্য চারা রয়েছে। বর্তমানে ৩০০ প্রজাতির উন্নতমানের ৪ লাখ চারা রয়েছে। নিয়মিত ২১ জনসহ মোট ৩৫ জন শ্রমিক তার নার্সারিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, শ্রমিকদের কেউ কেউ চারা উত্তোলন করে বিক্রি করছেন। আবার কেউ গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এ সময় কথা হয় নাজমা খাতুন নামের এক শ্রমিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ভ্যানগাড়ি চালিয়ে যা রোজগার করেন তা দিয়ে তিন ছেলেমেয়ের ভরণপোষণসহ পড়াশোনা করানো যায় না। আমি এক সময় গৃহিণী ছিলাম। নার্সারি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানে কাজের সুযোগ পেয়েছি। এখন আমার এবং স্বামীর রোজগার করা টাকা দিয়ে দিনগুলো ভালোভাবেই চলে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েদেরও স্কুলে পড়াশোনা করাচ্ছি।’
মনির মিয়া নামে আরেক শ্রমিক বলেন, ‘আগে দূর-দূরান্তে শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন কষ্টের কাজ করতাম। থাকা-খাওয়ার খরচ বাদ দিয়ে মাস শেষে যা বেতন পেতাম তা দিয়ে পোষাত না। বাড়ির পাশে নার্সারি গড়ে ওঠায় এখানে চাকরি নিয়েছি। এই বেতন দিয়ে পরিবার নিয়ে তিনবেলা খেয়েপরে বেঁচে আছি।’
আধুনিক নার্সারি ও হর্টিকালচার ফার্মের পরিচালক জেসমিন আরা বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার গাছ লাগানো থেকে আমারও গাছের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। সব সময় চেয়েছি গাছের মাধ্যমেই সফল উদ্যোক্তা হওয়ার। স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে নার্সারি গড়ে তুলেছি। সারা দিন স্বপ্নের নার্সারিতে সময় দিয়ে ধীরে ধীরে সফলতা পেয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে অনেকে নার্সারি করার জন্য পরামর্শ নিতে আসেন। আমি তাদের পরামর্শ দিচ্ছি। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন নার্সারি গড়ে তুলেছেন। এখন তারাও বেশ লাভবান।’
জেসমিন আরার স্বামী ড. শামছুল আলম মিঠু ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী নার্সারির শুরু থেকেই যথেষ্ট পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে কখনো হেঁটে, কখনো ভ্যানে, আবার কখনো রিকশায় চড়ে খুব সকালে চলে আসেন নার্সারিতে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে সময় দেন। তার কঠোর মনোবল ও পরিশ্রমের কারণে সফলতা এসেছে। আমিও যতদূর পারি তাকে নানা দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকি। এখানের সবগুলো চারা উন্নতমানের হওয়ায় সারা দেশ থেকে লোকজন এসে কিনছেন।’
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের পরিচালক দিলরুবা আহমেদ বলেন, ‘জেসমিন আরার নার্সারির চারা নানা প্রান্তে নিয়ে লোকজন রোপণ করছেন। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা দুজনেই লাভবান হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে গাছগুলো অবদান রাখছে। সারা দেশে প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগাতে সবাইকে উৎসাহ দিতে হবে, গড়ে তুলতে হবে নার্সারি। জেসমিন আরার মতো আরও অনেকে নিজের পরিশ্রমের মাধ্যমে সফল উদ্যোক্তা হবে এমনটাই প্রত্যাশা করি।’