দেশজুড়ে দুঃসহ তাপপ্রবাহ বিরাজ করছে। গরমে পুড়ছে সারা দেশ। এর প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতেও। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না অনেকে। দোকানপাটে ক্রেতা কমেছে, বেচাকেনাও কম। দুপুরের অসহ্য গরমে বিক্রেতারা বাধ্য হয়েই দোকান বন্ধ রাখছেন। তাপপ্রবাহে ফসল চাষে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে বাজারে খাদ্য সরবরাহ কমতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছেন। সারা দেশে এই অসহনীয় তাপমাত্রায় শিশুদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে ইউনিসেফ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। শুধু গরম পড়ার কারণে লোকসান গুনছেন বিক্রেতারা। এর প্রভাব পড়বে সমগ্র অর্থনীতিতে। বিলাসী পণ্য, শখের কেনাকাটা নেই বললেই চলে।
গরম বাড়ার পর থেকে রিসোর্ট, হোটেল ও রেস্তোরাঁয় ভিড় কমেছে। অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কায় অনেকে বাইরে খাওয়া কমিয়েছেন। সাপ্তাহিক বা বিভিন্ন ছুটিছাটায় অনেকে স্বাভাবিক সময়ে বন্ধুবান্ধব বা পরিবার-পরিজন নিয়ে রিসোর্টে ঘুরতে গেলেও এই গরমে একেবারেই যাচ্ছেন না। গরমে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকায় সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছিল। অবশ্য আজ রবিবার থেকে আবার স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছেন। গণপরিবহনে যাত্রী কমেছে। রিকশা, সিএনজি যা পাওয়া যাচ্ছে তাতে চাওয়া হচ্ছে দ্বিগুণের বেশি ভাড়া। কৃষি, শিল্প সব খাতে গরমের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলেছে, প্রচণ্ড তাপমাত্রা ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে দৈনিক কর্মঘণ্টা ২ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে, যা ৮ কোটি পূর্ণকালীন চাকরির সমতুল্য। গবেষণা বলছে, বেশি গরম আবহাওয়ায় কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা কমে যায়, এমনকি তারা যদি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসেও কাজ করেন। এর ফলে সার্বিকভাবে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে যায়। পণ্য পরিবহনেও প্রচণ্ড তাপমাত্রা প্রভাব ফেলেছে। যেহেতু দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ কোল্ড চেইন অবকাঠামো নেই, তাই পরিবহনের সময় প্রচণ্ড তাপে অনেক খাদ্যপণ্য নষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানি করা পণ্য বন্দর থেকে ছাড়করণে দেরি হওয়ায় তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
শুধু তা-ই নয়, গরমে ফল, শাকসবজি পচে যাচ্ছে। বিপাকে আছেন ফল ব্যবসায়ীরা। অতিরিক্ত গরমে সব ধরনের ফল সংরক্ষণ করে বিক্রি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশের ৫০টির বেশি জেলার ওপর দিয়ে এখন তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট ফিজ ডট ওআরজির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তীব্র তাপমাত্রার কারণে নির্মাণ ও কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। অর্থাৎ অবকাঠামোর নির্মাণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং কৃষির ফলন কমে যেতে পারে। প্রচণ্ড গরমে ধান, সবজি, ভুট্টা, সয়াবিন ও তুলার মতো অনেক ফসলের ফলন কমে যায়। এমনকি মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, গরু-ছাগলের খামারে পড়েছে গরমের নেতিবাচক প্রভাব। শিল্প খাতে উৎপাদন মারাত্মক আকারে ব্যাহত হচ্ছে। কেউ কেউ তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবেও দেখছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, গরমের ফলে কৃষক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে বাজারে পণ্যসংকট হতে পারে। ফলে দাম বাড়তে পারে, যা শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়াবে।
এ দেশের জিডিপিতে উৎপাদন, খনিজ, পরিবহন ও নির্মাণের মতো খাতের অবদান যেহেতু ৫০ শতাংশের বেশি, সেহেতু এসব খাতকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন জরুরি। বৃক্ষরোপণে শহর এবং গ্রামের তরুণদের উদ্বুদ্ধ করা, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এ কাজে সম্পৃক্ত করা। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বছরের একটা সময়ে এ ধরনের কার্যক্রমে যাতে সম্পৃক্ত হতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার কমিয়ে আনা। সর্বোপরি তাপপ্রবাহের ক্ষতি মোকাবিলায় সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।