রাজধানীতে সবুজায়ন কমেছে আধুনিকায়নের নামে। কংক্রিটের রাজধানীতে নিঃশেষ হওয়ার পথে পার্ক ও খেলার মাঠ। যে কয়টি অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও নির্মাণকাজে ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। তা ছাড়া পার্ক-মাঠ থাকার ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক বৈষম্যও রয়েছে। তাপপ্রবাহের কবলে পড়ে মানুষ ছুটে যেতে চায় সবুজ শীতল গাছগাছালির ছায়ায়। বাসার কাছে কোথায় আছে সবুজঘেরা পার্ক কিংবা উদ্যান, যেখানে একটু ছায়া পাওয়া যায়। এলাকায় পার্ক বা মাঠ থাকলেও অনুন্নত এলাকায় ঘনবসতির কারণে এগুলো নেই বললেই চলে। ফলে রাজধানীর শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। হুমকির মুখে পড়েছে রাজধানীর জীববৈচিত্র্য। রাজধানীতে সবুজায়ন বাড়ানোর কিছু পরিকল্পনা থাকলেও এর গতি খুবই ধীর বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা শহরে যে আয়তন সেই তুলনায় ৬১০টি মাঠ থাকা দরকার। কিন্তু আছে মাত্র ২৩৫টি। এগুলো ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে ওয়ার্ড সংখ্যা ১২৯। এর মধ্যে ৪১টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ বা পার্ক নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ঢাকা শহরে গত ২২ বছরে পার্ক ও মাঠের সংখ্যা কমেছে ১২৬টি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক জরিপে দেখা যায়, ঢাকার ২৩৫টি খেলার মাঠের মধ্যে ১৪১টি প্রাতিষ্ঠানিক। অর্থাৎ জনসাধারণের জন্য উপযুক্ত নয়। মাত্র ৪২টি খেলার মাঠ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এর মধ্যে দখল হয়ে আছে ১৬টি। এ ছাড়া ১৭টি সরকারি মাঠ, ২৪টি আবাসিক কলোনি মাঠ এবং ১২টি ঈদগাহ রয়েছে।
দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫টি ওয়ার্ডে পার্ক বা মাঠ রয়েছে মাত্র ২৭টি। এর মধ্যে ছয়টি পার্ক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ইজারা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৫০টি ওয়ার্ডে পার্ক রয়েছে মাত্র ২৩টি। বিদ্যমান এসব পার্ক ও খেলার মাঠের অধিকাংশেই নেই সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার। ফলে নাগরিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন নির্মল বায়ুসেবন, ব্যায়াম ও হাঁটাচলার অধিকার থেকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যেকোনো শহরের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য প্রায় ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা দরকার। এই খোলা জায়গা হওয়া উচিত পার্ক ও খেলার মাঠ। কিন্তু ঢাকা শহরে এর পরিমাণ এক বর্গমিটারেরও কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানী যে দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, এর জন্য অনেকাংশে দায়ী পার্ক-খেলার মাঠ না থাকা। পরিবেশ ধ্বংস না করে উন্নয়ন কীভাবে করা যায়, সেই উপায় বের করতে হবে। রাজধানীতে খেলার মাঠ বেদখল হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ আরও উদাসীন। স্বল্প আয়ের মানুষসহ নগরের সব এলাকা ও শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে খেলার মাঠ, পার্ক সুবিধাদি নিশ্চিত করতে হবে। উত্তরা, বনানীর মতো পরিকল্পিত এলাকায় বিনোদন সুবিধাদি না বাড়িয়েই জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে দেওয়া হচ্ছে। ফলে এসব এলাকায় বাসযোগ্যতা কমছে।
বিআইপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান খবরের কাগজকে বলেন, খেলার মাঠকে আধুনিক নগর পরিকল্পনার বিনোদন সুবিধার পাশাপাশি স্বাস্থ্য অবকাঠামো হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে মাঠগুলো অবশিষ্ট আছে, সেগুলোতে সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
পার্ক ও খেলার মাঠে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের পাশাপাশি বিদ্যমান পার্ক ও খেলার মাঠ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। বেদখল হওয়া মাঠ ও পার্কগুলোকে দখলমুক্ত করতে কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে হবে।