পাকিস্তানকে টপকে সমৃদ্ধি অর্জন করে উন্নয়নের অংশীদার হতে পেরেছে বাংলাদেশ। সামাজিক ও মানব উন্নয়ন সূচকেও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। পাঁচ বছর আগেই মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকার রপ্তানি আয় ইসলামাবাদের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। রিজার্ভ চার গুণ বেশি। পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি এখন ২৭ শতাংশের বেশি, যা বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ। বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন এখন ঈর্ষণীয় হয়ে উঠছে পাকিস্তানের কাছে। বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানের সরকার বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে প্রশংসা করেছে। সর্বশেষ এ বিষয়ে মন্তব্য করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। গত ২৪ এপ্রিল করাচিতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাপক উন্নতি করেছে, বাংলাদেশের দিকে তাকালে এখন লজ্জিত হই।
এলডিসি থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের পথে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে বাংলাদেশ। এখন বিশ্বদরবারে দেশটির গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বিস্ময়কর পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বদরবারে পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়। অন্য দেশের কাছে তা অনুকরণীয়ও বটে। এসব অবকাঠামোর উন্নয়নই গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করেছে, যা সার্বিকভাবে আয় বাড়াতে সহায়তা করেছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সব সময় কমবেশি অস্থিরতা ছিল। সেখানে গণতন্ত্র প্রায় অনুপস্থিত। এর ফলে দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় একধরনের স্থিতিশীলতা ছিল, যা অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। এই পার্থক্যই বাংলাদেশকে এগিয়ে দিয়েছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৮০ টাকা, যা তৎকালীন ৯০ মার্কিন ডলারের সমান। মাথাপিছু আয় ৫০০ ডলার ছাড়াতে ৩১ বছর সময় লাগে বাংলাদেশের। নব্বইয়ের দশকের পর বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয় এবং মাথাপিছু আয় বাড়াতে থাকে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৬৫ ডলার। আর পাকিস্তানের ১ হাজার ৪৭১ ডলার। বাংলাদেশ এক দশক ধরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশ অর্জন করেছে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানে এ সময় জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয় গড়ে মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ। স্বাধীনতার সময় জিডিপির ৬ থেকে ৭ শতাংশ আসত শিল্প খাত থেকে। তখন পাকিস্তানে শিল্পের অবদান ছিল ২০ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশের শিল্প খাতে অবদান জিডিপির ২৯ শতাংশ। বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানে ৩৪৮ বিলিয়ন ডলার।
রপ্তানি আয়ে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমাণ ৫ হাজার ৫৫৬ (৫৫.৫৬ বিলিয়ন) কোটি ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান গত অর্থবছরে ৩ হাজার ২৫০ (৩২.৫০ বিলিয়ন) কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় এখন ৬০ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, মার্চে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৮ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি এখন অতিমাত্রায় বেশি। মূল্যস্ফীতির চাপে পাকিস্তানের মানুষ পিষ্ট। শুধু গত মার্চেই দেশটিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৭ শতাংশের বেশি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি হয়েছে, এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত ও রেমিট্যান্স বড় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশে আরও সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এ ছাড়া তৈরি পোশাক খাত, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের সামনে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে।