প্রতিদিন সড়কে ঝরছে প্রাণ। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম কিছুতেই টানা যাচ্ছে না। গত সোমবার (২১ এপ্রিল) বেলা ৩টার দিকে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে বাস ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে চুয়েটের দুই শিক্ষার্থী শান্ত সাহা ও তৌফিক হোসেন নিহত হন। আহত হন আরও এক শিক্ষার্থী। এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) বাসচাপায় দুই সহপাঠী নিহতের ঘটনায় টানা তিন দিন আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আন্দোলন স্থগিত করা হয়েছে। কিছুদিন পর আবার খুলে দেওয়া হবে চুয়েট। ততদিনে শিক্ষার্থীরা হয়তো তাদের প্রিয় সহপাঠীর কথা ভুলে যাবেন। এভাবেই কি চলতে থাকবে? যিনি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে পরিবার ও দেশকে সমৃদ্ধ করার কথা, তিনি আজ অকালেই ঝরে গেলেন। এভাবেই ঝরে যায় অসংখ্য প্রাণ। শান্ত সাহা ও তৌফিকের বাবা-মা হয়তো সন্তানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পাস করে বের হয়ে তারা চাকরি করবেন। পরিবারের অবলম্বন হবে। কিন্তু তাদের সব স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তাদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ল অনিশ্চিত।
চুয়েটের শিক্ষার্থী ফুয়াদ ইকবাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের দুই ভাই নিহত হয়েছেন। আমরা বিচারের দাবিতে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করেছি। অথচ আমাদের ভিসি চাইছেন আমরা আন্দোলন না করে পরীক্ষা দিতে যাই। আমরা ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছি। দুই সহপাঠী নিহতের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক, দুই শিক্ষার্থী হত্যার বিচার, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা এক শিক্ষকের বহিষ্কারসহ ১০ দফা দাবি পেশ করেছি। আমাদের দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন দীর্ঘ হবে। আমরা চাই এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
চুয়েটের ভিসি ড. মো. রফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা চাই দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় যথাযথ বিচার হোক। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ক্লাসে না গিয়ে বিক্ষোভ করবে তা হতে পারে না। দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনার শান্তিপূর্ণ বিচার হোক, আমি সেটি কামনা করি।’
প্রতিটি মৃত্যুই বেদনাদায়ক। সেই মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয়, তবে তা মেনে নেওয়া কঠিন। দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির নিরসন করতেই হবে। এভাবে চলতে পারে না। অকালে এভাবে মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে না। দুর্ঘটনার কারণগুলো যেহেতু স্পষ্ট, সেহেতু সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দুরূহ নয়।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো কমবেশি সবারই জানা। চালকের অসতর্কতা, অসচেতনতা, বেপরোয়া বা অনিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ি চালনা, চালকের গাড়ি ওভারটেক করার প্রবণতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও রাস্তা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাবলিক যান চলাচলে অনেকটা বিধিনিষেধ থাকলেও মানছে না চালকরা।
এ দেশে আইন প্রণয়ন হয়, কিন্তু সেই আইনের বাস্তবায়ন হয় না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সড়ক পরিবহন আইন নিয়ন্ত্রণ করেন মূলত পরিবহন নেতারা। সেই নেতারা সরকারদলীয় বড় পদে বহাল থাকেন। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইন থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে নগরের ভেতরে গণপরিবহন ব্যবস্থা পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে। দুর্ঘটনা নিরসনে পরিবহন কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশ ও সিটি করপোরেশনকেও দায়িত্বশীল হতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় আইন পরিবর্তন ও আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি চালকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও চালিয়ে যেতে হবে। তবে সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চালকদের পাশাপাশি যাত্রী ও পথচারীদেরও সচেতন হওয়া উচিত।
সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে ট্রাফিক আইনের আধুনিকীকরণ করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে একনিষ্ঠ হতে হবে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালালে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। আইন অমান্যকারীকে জরিমানাসহ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ছাত্র নিহতের ঘটনায় দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসুক, এটাই প্রতাশা।