বর্তমান সময়ে ফ্যাশনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ট্যাটু। অন্যের চেয়ে নিজেকে একটু আলাদাভাবে উপস্থাপন করার জন্য অনেকেই হাতে, ঘাড়ে কিংবা শরীরের দৃশ্যমান কোনো জায়গায় ট্যাটু এঁকে থাকেন। আবার এমনো দেখা যায়, যারা একটি ট্যাটু করতে গিয়েই পরিবারের সঙ্গে লড়াই শুরু করে দেন।
তবে একটা সময় মায়ানমারের পার্বত্য অঞ্চলের চিন রাজ্যে ট্যাটু করা ছিল বাধ্যতামূলক। সেখানকার কন্যাশিশুদের ছয় বছর বয়স পেরোলেই মুখে আঁকা হতো ট্যাটু। মায়ানমারের পার্বত্য অঞ্চলের চিন রাজ্যের নারীরা তাদের মুখভর্তি ট্যাটুর জন্য বিখ্যাত। পুরো বিশ্বেই এই নারীদের ট্যাটুর জন্য তাদের আলাদাভাবে দেখা হয়। এর পেছনে অবশ্য একটি মর্মান্তিক কারণ রয়েছে। এই প্রথা এখানে শুরু থেকেই ছিল না। মূলত সম্ভ্রম বাঁচাতেই এখানকার নারীরা মুখে ট্যাটু আঁকেন। বিকৃত করেন তাদের চেহারা।
২০১৪ সালের আদমশুমারি অনুসারে, প্রায় ৫ লাখ মানুষের বাস চিন রাজ্যে। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী চিনদের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি অদ্ভুত প্রথা আছে, যা কিছুটা বর্বরও মনে হতে পারে। ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে এই উপজাতির প্রত্যেক মেয়ের মুখে এঁকে দেওয়া হয় ট্যাটু অর্থাৎ তাদের চেহারা বিকৃত করে দেওয়া হয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে আসছে চিনদের এই রীতি। সেখানে গেলে প্রত্যেকটি নারীর মুখেই দেখা মিলবে এই ট্যাটুর।
মায়ানমারের পার্বত্য অঞ্চলে মূলত শত শত বছর ধরে বাস করে এই উপজাতির মানুষ। কয়েকশ বছর ধরে রাজ্যটির বাসিন্দারা আধুনিক পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্নই ছিলেন বলা যায়। তবে পর্যটকদের আনাগোনায় তারা সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। নারীদের মুখে ট্যাটু করা সেখানকার প্রাচিন প্রথা। গ্রামের প্রত্যেক মেয়ে তা করে। এর পেছনের কারণ হিসেবে প্রচলিত রয়েছে এক কাহিনি। একবার এক বার্মিজ রাজা ঘুরতে এসেছিলেন এখানে। সে সময় এক নারীর রূপে মুগ্ধ হন রাজা।
সেই নারী ছিলেন বিবাহিতা। তবু তাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয় রাজার জন্য। একপর্যায়ে পালিয়ে আসতে সমর্থ হন তিনি। কিন্তু শঙ্কা আর কাটে না। কখন যেন রাজার লোকেরা আবার ধরে নিয়ে যায় তাকে। আর তখনই ছদ্মবেশ ধারণ করতে ছুরি দিয়ে নিজের মুখমণ্ডল বিকৃত করে ফেলেন ওই নারী। সেই রাজা যখন যে মেয়েকে খুশি সঙ্গী হিসেবে নিয়ে যেতেন। এতে মেয়ের সম্মতি থাকুক বা না থাকুক। তবে মেয়েটিকে কখনোই স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হতো না। রাখা হতো উপপত্নী করে। যখন ইচ্ছে একজনকে ত্যাগ করে আবার নতুন কোনো মেয়েকে সঙ্গী করত তারা।
ওই রাজার মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার কারও সাধ্য ছিল না। শেষ পর্যন্ত সম্ভ্রম রক্ষার্থে ট্যাটু এঁকে মুখমণ্ডল বিকৃত করার চর্চা শুরু করে এই সম্প্রদায়ের নারীরা। সবাই জানত, রাজকীয় শক্তির বিরোধিতা মানেই নির্মম নির্যাতন। আর তাই শেষ পর্যন্ত এই পথ বেছে নেওয়া। রাজার হাত থেকে রাজ্যের মেয়েদের বাঁচাতে ছোটবেলাতেই তাদের মুখে ওই নকশা করে দিত মা-বাবারা। একটা সময় ট্যাটু শিল্পেও রীতিমতো সৃজনশীল হয়ে ওঠেন চিন নারীরা। এরপর মুখে ট্যাটু তাদের সংস্কৃতিরও একটি অংশ হয়ে ওঠে।
একবার ট্যাটু করতে প্রায় পুরো দিন সময় লেগে যেত। এই ট্যাটু আঁকাতে ভয়ানক যন্ত্রণাও হতো। বিশেষ করে চোখের পাতায় ট্যাটু করার সময়। শরীরে যে অংশে ট্যাটু আঁকা হয় সেই অংশে লোহার অস্ত্র দিয়ে কেটে তার ওপর গরু, ছাগল বা ভেড়ার কালো চর্বি লাগানো হয়। একবার ট্যাটু আঁকলে প্রায় ছয় থেকে সাত দিন স্থায়ী হয়। তারপর আবার, এভাবেই ট্যাটু আঁকা চলতে থাকে মৃত্যু পর্যন্ত। কখনো কখনো পুরুষদের আকৃষ্ট করতেও মুখে আঁকা হয় ট্যাটু। সেখানকার মানুষ এমনো বলেন, মাকড়সা জাল দিয়ে যেমন পোকামাকড় ধরে থাকে, মাকড়সার জালের মতো ট্যাটু দিয়েও নারীরা পুরুষদের ফাঁদে ফেলেন। তবে এলাকাভেদে এই ট্যাটুর নকশাও আলাদা। নকশা দেখেই বলে দেওয়া যায় কোন নারী কোন এলাকার। ছয়টি আলাদা জাতি আছে তাদের মধ্যে। তারা কপালে ইংরেজি পি, ডি ও ওয়াই অক্ষর আঁকেন। তারা ট্যাটু আঁকতে লোহার দণ্ড ছাড়াও পাতা, ঘাসের কাণ্ড, বেতের কাঁটা ও কাচের টুকরা ব্যবহার করেন। কালি তৈরি হয় পশুর চর্বি পুড়িয়ে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রথা পরিণত হয় এক চিত্তাকর্ষক শিল্পে। প্রথমে মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শুরু হলেও পরে তার বিপরীত প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়। মুখে অঙ্কিত ট্যাটুই হয়ে উঠল সৌন্দর্যের প্রতীক। আর এটি হয়ে দাঁড়াল চিন নারীদের গৌরবের বিষয়। তবে শুধু নারীদের সম্ভ্রম রক্ষায় নয়। এই ট্যাটু করার পেছনে রয়েছে আরেকটি ব্যাখ্যা। সেটি অবশ্য ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় থেকে অনেক চিন সংখ্যালঘুরা খ্রিষ্টান ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে বা অন্যথায় এটিকে অ্যানিমিস্ট বিশ্বাসের পাশাপাশি গ্রহণ করেছে। স্থানীয় যাজকরা বলতেন যে শুধু যাদের ট্যাটু ছিল তারাই স্বর্গে যাওয়ার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে।
১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ণ মাত্রায় প্রচলিত ছিল চিনদের ট্যাটু প্রথা। এরপর থেকেই পদক্ষেপ নেয় দেশটির সরকার। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নারীরা এখনো মানতে নারাজ সরকারের সিদ্ধান্ত। মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতে কানজুড়ে বিশাল আকৃতির দুল পরেন তারা। নতুন প্রজন্ম অবশ্য দিন দিন বিরক্ত হয়ে উঠছে প্রথাটির প্রতি। নিজেদের সুন্দর মুখমণ্ডল আর বিকৃত করতে চায় না তারা। মায়ানমারের সামরিক সরকার ট্যাটু আঁকলে তার ওপর জরিমানার বিধানও করেছিল। সেই ভয়েও অনেকে আর ট্যাটু আঁকতে চান না।
কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই হয়তো পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে প্রথাটি। তবে এখন মায়ানমার সরকারের কোনো অনুমোদন নেই এই রীতিতে। এমনকি এতে কোনো সমর্থনও নেই তাদের।
সূত্র: বিবিসি
কলি