![পরিকল্পিত আর্থিক সমস্যা ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন প্রয়োজন](uploads/2023/11/29/1701256636.Sheikh-shamim-iqbal.jpg)
ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রাজস্ব কম আদায় হওয়ায় সরকারের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ বৃদ্ধি এবং হুন্ডিতে টাকা আসায় মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি। সঙ্গে সঙ্গে সিন্ডিকেট নামের অদৃশ্যমান সত্তার কর্মকাণ্ডের ফল ভোগ করছি দেশের আপামর জনসাধারণ, যারা নিয়মিত পরিচিত হচ্ছি মূল্যস্ফীতি নামক অর্থনীতির তত্ত্বের সঙ্গে।
বিগত কয়েক বছরে সামাজিক, অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছে, তা অস্বীকার করবার কোনো উপায়। প্রায় দেড় দশকের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি আলোচিত সময়ে বেশ ম্রিয়মাণ হয়ে উঠেছে।
সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের সর্বমোট জিডিপির পরিমাণ ৪৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিগত কয়েক বছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধানতম প্রমাণক। তবে এই সময়কালে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বৈদেশিক ঋণের অর্থে বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করেছে দৃশ্যমান কাঠামোগত উন্নয়ন, যা মেগা প্রোজেক্ট নামে জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয়। যে কোনো কল্যাণমূলক প্রকল্পই মানুষের কাছে সাড়া পেতে বাধ্য এবং বেশকিছু মেগা প্রকল্প মানুষের মাঝে সাড়া ফেলেছে। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির অনুপাতের মাত্র ২২ শতাংশ, যা পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের দেশের তুলনায় এখনো আশাপ্রদ। পাশাপাশি বেড়েছে অভ্যন্তরীণ খাত থেকেও সরকারের ঋণ গ্রহণ।
তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে মার্কিন ডলারে। যেখানে নানারকম অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক কারণে বিগত দুই বছরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ এবং এই সময়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর ফলে আমদানি হয়েছে নিয়ন্ত্রিত এবং রপ্তানির পরিমাণ বাড়লেও তা আশাতীত নয়।
সবচেয়ে দ্রুত বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের জন্য প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স প্রেরণ। গত কয়েক বছরে রেকর্ড পরিমাণে বাংলাদেশি দেশের বাইরে জীবিকার প্রয়োজনে গেলেও বাড়েনি রেমিট্যান্স প্রেরণের হার। পাশাপাশি জনপ্রিয় হয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন হুন্ডি ব্যবসা। কারণ বাজারে নিয়ন্ত্রিত মার্কিন ডলারের মূল্য থেকে হুন্ডিওয়ালার কাছ থেকে অনেক বেশি দর পাওয়া যাচ্ছে।
তদুপরি হুন্ডিওয়ালাদের রক্ষাকবচ হচ্ছে তারা যারা এ দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার করছে। গত কয়েক বছরে খেলাপি ঋণের চিত্র আর বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে টাকা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো হয়েছে। সুদহারের সীমারেখার কারণে ব্যাংক ঋণের উল্লম্ফন আর বিভিন্নভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হওয়া। এমনকি এই ঋণের টাকা দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ করা হলে পরোক্ষভাবে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা পালন করত কিন্তু ব্যাংক ঋণের এই অর্থ পরিণত হয়েছে বিদেশে ভোগবিলাসের উপকরণ হিসেবে। তাহলে সহজ সমীকরণে দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাশালী নির্দিষ্ট শ্রেণি একাধারে ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী আর কর প্রদানে তাদের আগ্রহের কথা নাই বা বললাম।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রাজস্ব কম আদায় হওয়ায় সরকারের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ বৃদ্ধি এবং হুন্ডিতে টাকা আসায় মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি। সঙ্গে সঙ্গে সিন্ডিকেট নামের অদৃশ্যমান সত্তার কর্মকাণ্ডের ফল ভোগ করছি দেশের আপামর জনসাধারণ, যারা নিয়মিত পরিচিত হচ্ছি মূল্যস্ফীতি নামক অর্থনীতির তত্ত্বের সঙ্গে।
এসব তো গেল সমস্যার কথা, যার সমাধানও আমাদের দেশের প্রজ্ঞাবান দায়িত্বশীলরা সবাই মোটামুটি জানেন। তাছাড়া বিশ্বের নানা দেশের সমস্যায় পতন আর তার থেকে উত্তরণ কেইস স্টাডি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা চর্চা করছে। আর আমাদের দেশের দায়িত্বশীলরা আজ অমুকের পরামর্শ নিচ্ছেন কাল অমুকের আলোচনা হবে ঘোষণা করছেন। আজ সুদহার প্রায় বাজারের হাতে ছেড়ে দিলাম স্মার্টভাবে, আজ ব্যাংক সংগঠনের ওপর ডলারের মূল্য ছেড়ে দিলাম তারা অভূতপূর্ব পদ্ধতিতে ডলারের হার নির্ধারণ করল স্বপ্নে পাওয়া তাবিজের মতো করে। অর্থ মন্ত্রণালয় রাজস্বনীতিতে বাজারে মুদ্রার ফোয়ারা ফোটাল আর বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিকনীতিতে বাজারে মুদ্রায় টান সৃষ্টিতে প্রশান্ত মহাসাগরে মাছ ধরার জন্য বাঁশের কঞ্চির ছিপ ফেলল। যাই হোক, কিছু একটা তো হবে, আজ না হয় তো কাল, হয়তো নতুন বছরে, হয়তো সামনের নির্বাচনের পর, আর নয়তো সামনের কোনো এক ঈদের পর!!
পরিশেষে, সমস্যা এখন পুরোটাই দৃশ্যমান, সমাধানও অনুমানযোগ্য। তবে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কে বাঁধে সেটা দেখার অপেক্ষা।
লেখক: শেখ শামীম ইকবাল, ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক
[email protected]