ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

পরিকল্পিত আর্থিক সমস্যা ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন প্রয়োজন

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৫:১৭ পিএম
আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:৩৮ এএম
পরিকল্পিত আর্থিক সমস্যা ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন প্রয়োজন
শেখ শামীম ইকবাল

ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রাজস্ব কম আদায় হওয়ায় সরকারের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ বৃদ্ধি এবং হুন্ডিতে টাকা আসায় মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি। সঙ্গে সঙ্গে সিন্ডিকেট নামের অদৃশ্যমান সত্তার কর্মকাণ্ডের ফল ভোগ করছি দেশের আপামর জনসাধারণ, যারা নিয়মিত পরিচিত হচ্ছি মূল্যস্ফীতি নামক অর্থনীতির তত্ত্বের সঙ্গে।

বিগত কয়েক বছরে সামাজিক, অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছে, তা অস্বীকার করবার কোনো উপায়। প্রায় দেড় দশকের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি আলোচিত সময়ে বেশ ম্রিয়মাণ হয়ে উঠেছে। 

সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের সর্বমোট জিডিপির পরিমাণ ৪৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিগত কয়েক বছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধানতম প্রমাণক। তবে এই সময়কালে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বৈদেশিক ঋণের অর্থে বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করেছে দৃশ্যমান কাঠামোগত উন্নয়ন, যা মেগা প্রোজেক্ট নামে জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয়। যে কোনো কল্যাণমূলক প্রকল্পই মানুষের কাছে সাড়া পেতে বাধ্য এবং বেশকিছু মেগা প্রকল্প মানুষের মাঝে সাড়া ফেলেছে। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির অনুপাতের মাত্র ২২ শতাংশ, যা পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের দেশের তুলনায় এখনো আশাপ্রদ। পাশাপাশি বেড়েছে অভ্যন্তরীণ খাত থেকেও সরকারের ঋণ গ্রহণ। 

তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে মার্কিন ডলারে। যেখানে নানারকম অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক কারণে বিগত দুই বছরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ এবং এই সময়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর ফলে আমদানি হয়েছে নিয়ন্ত্রিত এবং রপ্তানির পরিমাণ বাড়লেও তা আশাতীত নয়। 

সবচেয়ে দ্রুত বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের জন্য প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স প্রেরণ। গত কয়েক বছরে রেকর্ড পরিমাণে বাংলাদেশি দেশের বাইরে জীবিকার প্রয়োজনে গেলেও বাড়েনি রেমিট্যান্স প্রেরণের হার। পাশাপাশি জনপ্রিয় হয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন হুন্ডি ব্যবসা। কারণ বাজারে নিয়ন্ত্রিত মার্কিন ডলারের মূল্য থেকে হুন্ডিওয়ালার কাছ থেকে অনেক বেশি দর পাওয়া যাচ্ছে। 

তদুপরি হুন্ডিওয়ালাদের রক্ষাকবচ হচ্ছে তারা যারা এ দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার করছে। গত কয়েক বছরে খেলাপি ঋণের চিত্র আর বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে টাকা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো হয়েছে। সুদহারের সীমারেখার কারণে ব্যাংক ঋণের উল্লম্ফন আর বিভিন্নভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হওয়া। এমনকি এই ঋণের টাকা দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ করা হলে পরোক্ষভাবে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা পালন করত কিন্তু ব্যাংক ঋণের এই অর্থ পরিণত হয়েছে বিদেশে ভোগবিলাসের উপকরণ হিসেবে। তাহলে সহজ সমীকরণে দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাশালী নির্দিষ্ট শ্রেণি একাধারে ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী আর কর প্রদানে তাদের আগ্রহের কথা নাই বা বললাম। 

ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রাজস্ব কম আদায় হওয়ায় সরকারের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ বৃদ্ধি এবং হুন্ডিতে টাকা আসায় মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি। সঙ্গে সঙ্গে সিন্ডিকেট নামের অদৃশ্যমান সত্তার কর্মকাণ্ডের ফল ভোগ করছি দেশের আপামর জনসাধারণ, যারা নিয়মিত পরিচিত হচ্ছি মূল্যস্ফীতি নামক অর্থনীতির তত্ত্বের সঙ্গে। 

এসব তো গেল সমস্যার কথা, যার সমাধানও আমাদের দেশের প্রজ্ঞাবান দায়িত্বশীলরা সবাই মোটামুটি জানেন। তাছাড়া বিশ্বের নানা দেশের সমস্যায় পতন আর তার থেকে উত্তরণ কেইস স্টাডি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা চর্চা করছে। আর আমাদের দেশের দায়িত্বশীলরা আজ অমুকের পরামর্শ নিচ্ছেন কাল অমুকের আলোচনা হবে ঘোষণা করছেন। আজ সুদহার প্রায় বাজারের হাতে ছেড়ে দিলাম স্মার্টভাবে, আজ ব্যাংক সংগঠনের ওপর ডলারের মূল্য ছেড়ে দিলাম তারা অভূতপূর্ব পদ্ধতিতে ডলারের হার নির্ধারণ করল স্বপ্নে পাওয়া তাবিজের মতো করে। অর্থ মন্ত্রণালয় রাজস্বনীতিতে বাজারে মুদ্রার ফোয়ারা ফোটাল আর বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিকনীতিতে বাজারে মুদ্রায় টান সৃষ্টিতে প্রশান্ত মহাসাগরে মাছ ধরার জন্য বাঁশের কঞ্চির ছিপ ফেলল। যাই হোক, কিছু একটা তো হবে, আজ না হয় তো কাল, হয়তো নতুন বছরে, হয়তো সামনের নির্বাচনের পর, আর নয়তো সামনের কোনো এক ঈদের পর!! 

পরিশেষে, সমস্যা এখন পুরোটাই দৃশ্যমান, সমাধানও অনুমানযোগ্য। তবে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কে বাঁধে সেটা দেখার অপেক্ষা।   

লেখক: শেখ শামীম ইকবাল, ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক 
[email protected]     

জাতীয় শিক্ষাক্রম ফ্রেমওয়ার্ক-২০২১ প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের মতামত কতটা গুরুত্ব পেল?

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৪:২৭ পিএম
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৫:০৫ পিএম
জাতীয় শিক্ষাক্রম ফ্রেমওয়ার্ক-২০২১ প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের মতামত কতটা গুরুত্ব পেল?
মো. হাবিবুর রহমান

গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য একটি কার্যকরী শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) প্রণয়ন অপরিহার্য। কারিকুলাম প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন জাতীয় কারিকুলাম প্রণয়নে শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের অংশগ্রহণ কতটা নিশ্চিত করা হয়েছে? বা কীভাবে করা হয়েছে? প্রণীত জাতীয় কারিকুলাম এখন বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে, এ বিষয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া কী বার্তা দেয়? 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুবাদে স্নাতক পর্যায়ে দুটি ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একটি কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। টারসিয়ারি পর্যায়ে বর্তমানে ওবিই (OBE, Outcome Based Education) পদ্ধতিতে কারিকুলাম প্রণয়নের জন্য ইউজিসি কর্তৃক নির্দেশনা রয়েছে। এই পদ্ধতিতে কারিকুলাম প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্টেকহোল্ডারদের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। মোটাদাগে এই স্টেইকহোল্ডাররা হলেন: বিষয় বিশেষজ্ঞ (Subject Experts); প্রাক্তন শিক্ষার্থী (Alumni); শিক্ষার্থীদের বা যাদের জন্য কারিকুলাম প্রণয়ন করা হচ্ছে তাদের প্রয়োজন  (Target Population's Needs); অভিভাবক  (Guardians); চাকরিদাতা (Employers); এডভাইজরি প্যানেল (বিভিন্ন পেশাজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত) এবং সমাজের সদস্য (Community Members)। আমি ও আমার সহকর্মীরা কারিকুলাম প্রণয়নের সময় উল্লিখিত এই স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাদা করে বসেছি, আলোচনায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছি এবং তাদের মতামতগুলো লিপিবদ্ধ করেছি। প্রণীত কারিকুলামেও এর যথাযথ প্রতিফলন ঘটেছে। 

জাতীয় শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) প্রনয়নের  ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন কমিটি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন। জাতীয় শিক্ষাক্রমের প্রভাব/ফলাফল জাতির জীবনে সুদূরপ্রসারী। সুতরাং শিক্ষাক্রম প্রণয়নের প্রক্রিয়াও যথাযথ ও সময়োপযোগী হওয়া বাঞ্চনীয়। কারিকুলাম প্রণয়নের ধাপসমুহ সঠিকভাবে অনুসরণ করলেই যে, প্রণীত কারিকুলাম ত্রুটিমুক্ত হবে একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারিকুলামের কার্যকারিতা ভালো বোঝা যাবে এর বাস্তবায়ন পর্যায়ে। তবে, কারিকুলামের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। কেন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না? বা দুর্বলতাগুলো কোথায়? তা চিহ্নিত করা জরুরি। কেননা এর মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অভিভাবকদের সাথে কথা বলেছি ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেছি। এই আলোকে অভিভাবকদের কাছ থেকে আমি অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ভালো নয়। অভিভাবকদের মাধ্যমে এই নেতিবাচক মনোভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে এবং তাদের মানসপটেও নতুন কারিকুলামের প্রতি তথা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি হতে পারে। যা আদতে নতুন প্রজন্মের জন্য এক অশনিসংকেত। সুতরাং শুরুতেই এই অনাস্থা দূর করা জরুরী। মোটাদাগে যে বিষয়গুলো অভিভাবকগণ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের সাথে আমার আলোচনায় উঠে এসেছে, সেগুলো হল: ক। নতুন কারিকুলাম প্রণীত সিলেবাস, বই-পুস্তক, শ্রেণী-শিখন পদ্ধতি ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় আস্থাহীনতা; খ। মূল্যায়ন প্রক্রিয়া স্পষ্ট ও চূড়ান্ত না হওয়া (অতিমাত্রায় পরীক্ষামূলক বা এক্সপেরিমেন্টাল); গ। নতুন কারিকুলাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের (দেশে ও বিদেশে) উচ্চ শিক্ষা পদ্ধতির বা কারিকুলামের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? এবং এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণার অভাব; ঘ। সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। 

নতুন কারিকুলামের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত, প্রতিক্রিয়া ও যৌক্তিক সমালোচনাকে গুরুত্ব দেওয়া অতীব জরুরি। কারিকুলাম প্রণয়নের প্রাইমারি স্টেইকহোল্ডারদের একদম বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সুবিবেচনাপ্রসূত হবে না এবং কোনো ভালো ফলাফলও বয়ে নিয়ে আসবে না। কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং একে ফলপ্রসূ করতে হলে স্টেইকহোল্ডারদের যৌক্তিক মতামত গ্রহণ ও তাদের সহযোগিতা অনস্বীকার্য।  

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা
[email protected]

প্রশ্নফাঁস: মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কোথায়?

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৪, ০৪:৪১ পিএম
আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৪, ০৪:৪১ পিএম
প্রশ্নফাঁস: মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কোথায়?
তৌহিদ-উল বারী

পড়াশোনা মানে যেন লাভ-ক্ষতির ব্যবসা। এমনটাই পরিলক্ষিত হয়, যখন ক’টা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন মিলে যায়। তাহলে তো আর কথা নেই। ব্যাস! এখন শুধু খাতায় গিয়ে লিখে দেওয়াটা বাকি। কি বা দরকার এত লেখাপড়া করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। যেখানে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পাওয়া যায় আর পরে মিলে যায় লোভনীয় সার্টিফিকেট। এভাবেই যেন গেঁথে দেওয়া হয়েছে বর্তমান শিক্ষার্থী আর অভিভাবকের মাথায়। একটি স্বল্প শিক্ষিত মানুষ নামের কুচক্রী মহল তাদের এই প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ের মধ্য দিয়েই পড়াশোনাকে বানিয়ে ফেলেছে একটি লাভ-ক্ষতির ব্যবসা।

প্রশ্নফাঁস একটি সভ্য জাতির জন্য কলঙ্ক বয়ে আনে নিঃসন্দেহে। যা আমরা শুনে এসেছি নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ‘If you want to destroy a nation, first destroy it’s education’ যদি তুমি একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চাও তাহলে প্রথমেই ওই জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস কর।

এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, এ যেন শত্রুপক্ষ বাঙালি জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার এক মহোৎসবে মেতে ওঠেছে। একটি স্বল্পশিক্ষিত মহল যেন শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করছে।

এসব স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মাথায় বিন্দুমাত্র কাজ করে না, প্রশ্ন ফাঁসের কারণে জাতির কত বড় সর্বনাশ হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হচ্ছে না বরং এরা তার থেকে বিমুখ হচ্ছে। যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা কোনোরকমে টেনেটুনে পাসের চিন্তা রাখে তাদের দলেই ধাবিত হচ্ছে মেধাবী শিক্ষার্থীরা। কারণ একটাই, এসব শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে পাশ করার চেষ্টা। যার প্রেক্ষিতে মেধাবীরা আজ পড়াশোনার প্রতি, মেধাচর্চার প্রতি বিমুখ হচ্ছে। 

কেমন জানি, প্রশ্নফাঁস করে অবৈধ টাকা কামানোর নেশায় নেমেছে সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র। ফলে গত ছয় বছরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এসব চক্রের প্রায় তিন শতাধিক সদস্য। এর মধ্যে রয়েছে ডাক্তার, শিক্ষক, ছাত্র, বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের পরিচালকসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। কেউ কেউ একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে ফের একই অপরাধ করছে। বিচার কার্যক্রমের ধীরগতির সুবিধাও নিচ্ছে এসব চক্রের সদস্যরা।

তবে এত এত গ্রেপ্তারের পরও কেমন জানি এই প্রশ্নফাঁস ঠেকানোই যায় না। কোনো না কোনো ভাবে এসব প্রশ্ন ফাঁস হয়েই যায়। কেন বারবার এমনটা হচ্ছে? এর পিছনে কারা দায়ী? কিসের ঘাটতি রয়েছে এই কুচক্রী মহলকে ঠেকানোর পেছনে? নাকি এভাবেই চলতে থাকবে ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো। প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে, পরীক্ষা দেবে, অপরাধীও শনাক্ত হবে। কিন্তু বিচারের কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকবে না। তাহলে এরকম হলে কেমন হবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবন? এটা নিয়ে কি আমরা মোটেও ভাবার বিষয় মনে করছি না! 

তবে আমরা এটা নিশ্চিত ভাবে জানি প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর ৪ নম্বর ধারায় এই শাস্তির বিধান আছে। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া অধিকাংশ আসামিদের অপরাধের শাস্তির রায় হয়নি। তাহলে কি এটাই হতে পারে একই ঘটনা পুনরাবৃত্তির কারণ? নাকি আরও কোনো অদৃশ্য কারণ রয়েছে এ প্রশ্নফাঁসের পেছনে। খতিয়ে দেখা হোক, চিরতরে বন্ধ হোক প্রশ্নফাঁসের এই দুর্নীতি-অনিয়ম। দিনশেষে মেধাবীরাই তাদের মেধার মেধার স্বাক্ষর রাখুক।

লেখক: শিক্ষার্থী ও কলামিস্ট 
[email protected]

মহুয়া পালায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র: সেকাল ও একাল

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৪:৫৫ পিএম
আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৪:৫৭ পিএম
মহুয়া পালায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র: সেকাল ও একাল
মো. রেজাউল করিম

‘মহুয়া’ পালা মৈমনসিংহ গীতিকার অন্যতম আলোচিত গীতিকাব্য। সাহিত্য সর্বদাই সমাজের ব্যক্তি-মানুষ ও সমাজের উপরিস্থিত ও অন্তস্থ আন্তসম্পর্কের বর্ণনাচিত্র। মৈমনসিংহ গীতিকায় কবিরা সরল লোকজ ভাষায় মানবজীবনের গান গেয়েছেন। চরিত্র-চিত্রণের নৈপুণ্যে নর-নারীর প্রেম অনুভূতির স্তর অতিক্রম করে স্পষ্ট বাস্তবতায় কাহিনিসমূহ অমরত্ব লাভ করেছে। মহুয়া পালা এমনই এক আখ্যানচিত্র যে পালা বা গাথায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র বিধৃত হলেও তা গোটা বাংলার, বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র হিসেবেই গণ্য করা যায়। মহুয়া পালায় বর্ণীত আখ্যানের সমাজচিত্র পৌনে চার শ বছর পরও চলমান বঙ্গীয় সমাজে অনেকাংশেই বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়।

মৈমনসিংহ গীতিকার প্রায় সব কাব্যই মানব-মানবীর প্রেমাখ্যানের মনোস্তত্ত্বকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। মহুয়া পালাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই পালার প্রধান দুই চরিত্র- নদের ছাঁদ ও মহুয়া সামাজিক অবস্থানের দুই মেরুতে অবস্থানকারী দুই যুবক-যুবতী। শুধু যে সামাজিক অবস্থান পৃথক তা-ই নয়, তাদের ধর্মও পৃথক। অথচ তারা একে অপরের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়। প্রেম, পরিবার ও সমাজসৃষ্ট ঘাত-প্রতিঘাত, মানোস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, প্রেমের প্রতি অকুণ্ঠ প্রতিশ্রুতি ও ত্যাগ- ফলে পরিবার ও সমাজসৃষ্ট আরোপিত নিগ্রহ এবং আরোপতি নিগ্রহের বিরুদ্ধে মনোস্তাত্ত্বিক দ্বৈরথের আখ্যান এই পালার উপজীব্য। পরিশেষে যার সমাপ্তি ঘটে ট্র্যাজিক পরিণতির মধ্য দিয়ে। 

নদের চাঁদ ও মহুয়া পালার চিত্রায়ন শুরু হয় গারো পাহাড়ের ওপারে হিমানী পর্বতে, যা কিনা ছয় মাসের দূরত্ব।  হিমানী পর্বতের ওপারে ঘন জঙ্গল যেখানে চন্দ্র কিংবা সূর্যের আলো পৌঁছে না- এমন ঘন জঙ্গলে বাস করে ডাকাত সর্দার হুমরা, তার বাহ্যিক পেশা সাপুড়ে তথা বেদে- ডাকাত সর্দার হুমরা ‘হুমরা বাইদ্যা’ নামেই পরিচিত। ষোলো বছর আগের ঘটনা- হুমরা বাইদ্যা কাঞ্চনপুর গ্রামের এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে ডাকাতি শেষে অপরূপ রূপ-মাধুর্যের অধিকারী ছয় মাসের এক কন্যাকে দেখে চুরি করে নিয়ে আসে। এই ঘটনা শুধু যে তৎকালীন সমাজচিত্র তা-ই নয়, পৌনে চার শ বছর পরও বর্তমান বেদে জনগোষ্ঠী কর্তৃক শিশু, বিশেষত শিশুকন্যা চুরির কথা শোনা যায়। 

চুরি করে আনা শিশুকন্য মহুয়া অন্তজ বেদে সমাজে বেড়ে উঠতে থাকে আরও দশটি মেয়ের মতো। সাপের খেলা, নাটকীয় সংলাপ, নদী থেকে জল আনা, এমনকি ঘোড়ায় চড়া- সব কাজেই সে পারদর্শী হয়ে ওঠে। ভাগ্য অন্বেষণে নদী, জলাশয়, পাহাড় অথবা গ্রামীণ লোকালয়ে মৌসুমভেদে ঘুরে বেড়ায় তারই পালক-পিতা বেদেসমাজের দলপতির সঙ্গে। যাযাবর শ্রেণির বেদেসমাজ দলপতির ‘বৈদেশেতে’ যেত- সেই পর্বের বর্ণনা পাওয়া যায় পালায় এভাবে: ‘ঘোড়া লইল গাধা লইল, কত কইবো আর- সঙ্গেতে করিয়া লইল রাও চণ্ডালের হাড়- শিকারি কুকুর লইল শিয়াল হেজে ধরে- মনের সুখেতে চলে বৈদেশ নগরে।’ উপরিউক্ত স্তবক থেকে জীবিকার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেদে সমাজের পরিভ্রমণের চিত্র জানা যায়, যা এখনো বিরাজমান। তবে বর্ণনায় আতিশয়োক্তি রয়েছে বলে মনে হয়। একই নৌকায় কুকুর আর শেয়াল বহনের ঘটনা বর্ণনার আতিশয়োক্তি বলেই প্রতীয়মান হয়।

এই স্তবকে সনাতন বাঙালি সমাজের আতিথেয়তার প্রমাণও পুরিস্ফুট। জমিদারের নায়েব প্রথম দর্শনেই মহুয়ার প্রেমে পড়ে। মহুয়াও তার প্রতি সমভাবে আকৃষ্ট হয়। সে নিজেদের আলয়ে নদেরকে নিমন্ত্রণ জানায়, যা পালায় এভাবে বর্ণীত হয়েছে: ‘আমার বাড়িত যাইওরে বন্ধু বইতে দিয়াম পিরা- জল পান করিতে দিয়াম সালি ধানের চিরা- সালি ধানের চিরা দিয়াম আরও সবরি কলা- ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা।’ পালার এই স্তবক এ দেশের সনাতন সমাজের লোকজ খাদ্য দিয়ে হাজার বছরের আতিথেয়তা প্রকাশ করে, যা আজও গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান।

তৎকালীন বেদে সমাজের নারীরা তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিষ অথবা ধারালো অস্ত্র সঙ্গে রাখত। পালার বিভিন্ন পর্বে তার বিবরণ পাওয়ায়। এ ছাড়া বিষের বিশেষ ব্যবহার লক্ষ্যণীয়, যা বেদে সমাজে সে-সময়ে ছিল, এখনো আছে এমন তথ্য প্রমাণিত। এই পালায় তক্ষকের বিষ অস্ত্র হিসেবে বিবৃত হয়েছে যখন মহুয়া তাকে অপহরণকারী সওদাগরের মাঝি-মাল্লাদের বানিয়ে দেওয়া পানের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেয়। এখানে দুটি দৃশ্যকল্প অবলোকন করা যায়। প্রথমত, বেদেকন্যা নিজের কাছে গোপনে বিষ রাখত। দ্বিতীয়ত, তারা সেই যুগে, এমনকি বর্তমানেও কথার জাদুতে মানুষকে মোহাবিষ্ট করতে পারে। তাই তো দেখা যায়- যারা তাকে অপহরণ করেছে, তার নাটকীয় কথার মাধুর্যে মোহাবিষ্ট হয়ে তারই সাজিয়ে দেওয়া পান খেয়ে সবাই অচেতন হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, বেদে সমাজে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া মাত্রই বিশেষত নারীরা পান খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যা এখনো বিদ্যমান। 

গোটা পালা নিবিড় অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, এই পালার পরতে পরতে ফুটে উঠেছে তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজচিত্র, যা পৌনে চার শ বছর পর আজও শুধু বেদে সমাজ নয়, বাংলার গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান। রক্ষণশীল সমাজের বেদেকন্যা মহুয়া সুন্দরী ও জমিদারের দেওয়ান সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদের ভালোবাসায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিন্ন ধর্ম এবং বিবাহ তথা সম্প্রদানের ব্যাপারে অভিভাবকের সিদ্ধান্তের প্রাধান্য। সে-যুগেও অভিভাবকের সিদ্ধান্তের বাইরে যুবক-যুবতী প্রণয়াসক্ত হতো, যা এই পালায় বিবৃত হয়েছে। তবে কোনো বাধাই দুজনের মধ্যে আত্মিক দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত দুজনে আত্মাহুতির মাধ্যমে প্রমাণ করেছে ভালোবাসা শাশ্বত। এমন চিত্র বাংলার গ্রামীণ সমাজই শুধু নয়, শহুরে সমাজেও এখন কদাচিৎ হলেও জানা যায়।  

হুমরা বাইদ্যা নদের চাঁদের প্রতি তার আদরের পালিত কন্যা মহুয়ার আসক্তি টের পেয়ে যায়। এই পর্যায়ে দেখা যায়, হুমরা বাইদ্যা ভাবে- কিছুদিনের মধ্যেই দেশের বাড়ির জমিতে ফসল উঠবে; ফসল তোলার টান, বাড়ির পুকুরের মাছ ধরার মৌসুম, অন্যদিকে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে মহুয়ার গোপন প্রণয়ের আশঙ্কা- তাকে কিছু একটা করতেই হবে। বেদে দলে মহুয়ার সখা পালঙ্ক হুমরা বাইদ্যার নিষ্ঠুরতার আশঙ্কায় মহুয়াকে পরামর্শ দেয় এক সপ্তাহ বাইরে বের না হওয়ার জন্য। ঠাকুরবাড়িতে সে পৌঁছে দেবে মহুয়ার মৃত্যুর খবর। মহুয়া রাজি হয় না, উল্টো ঠাকুরবাড়ির পানে চেয়ে চন্দ্র-সূর্য আর পালঙ্ক সখাকে সাক্ষী মেনে নদের চাঁদকে স্বামী বলে ঘোষণা করে। পালঙ্ককে বলে সে নদের চাঁদকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, অন্যথায় বিষপানে আত্মহত্যা করবে। হুমরা বেদে মহুয়ার অজান্তে দলবল নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ করে দলের অন্যদের সঙ্গে। হুমরা বাইদ্যা নদের চাঁদকে তক্ষকের বিষ প্রয়োগে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সে মহুয়ার হাতে বিষলক্ষার ছুরি দিয়ে নদের চাঁদকে হত্যা করতে বললে মহুয়া নদের চাঁদকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে পালিয়ে যায়। পালায় যা বলা হয়েছে: ‘আরে করে ঝিলিমিলি নদীর কূলে দিয়া, দুজনে চলিল ভালা ঘোড়া সুয়ার হইয়া’। 

ধর্মীয় বিশ্বাস, বাদ-মতবাদ গীতিকা-রচয়িতাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আচ্ছন্ন করেনি। জীবনবিরোধী সবকিছুই অস্বীকৃত হয়েছে এ কাব্যমালায়। মৈমনসিংহ গীতিকায় মূলত মুক্ত প্রেমের জয়গান বিবৃত হয়েছে। এ গীতিকার নারীরা ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করেছে কখনো বা অভিভাবকের অভিমতের বিরুদ্ধেও জীবনসাথী বেছে নেওয়ার লক্ষ্যে ঝুঁকি নিয়েছে, গৃহত্যাগ করেছে। এটা কোনোকালেই অলৌকিক, অসম্ভব বা অবাস্তব ছিল না। যে কারণে বলা যায়, মৈমনসিংহ গীতিকায় নারীর শক্তি, উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক মূল্যবোধের জয়গান বিবৃত হয়েছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক
[email protected]

পুলিশে সৃষ্ট অস্থিরতা

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৩:১৫ পিএম
আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৩:১৫ পিএম
পুলিশে সৃষ্ট অস্থিরতা
মো. সাখাওয়াত হোসেন

সম্প্রতি ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে এক পুলিশ সদস্য কর্তৃক অন্য এক পুলিশ সদস্য হত্যার ঘটনায় বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশে সৃষ্ট অস্থিরতা ও সংকট নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। গণমাধ্যম না যতটুকু তার থেকে কয়েক কাঠি এগিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিশেষ করে কনস্টেবল কর্তৃক কনস্টেবল হত্যায় অনেকেই সন্তুষ্টির ঢেঁকুড় তুলেছে। এই যে পুলিশকে নিজের করে না ভাবা, পুলিশের দুঃসময়ে পাশে না থাকা, পুলিশকে মানসিকভাবে সমর্থন না করা ইত্যাদি বিষয়ে এক ধরনের হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।

পুলিশের মধ্যকার যেকোনো ধরনের নেতিবাচক সংবাদে আমাদের উৎফুল্ল হওয়ার একটি ব্যতিক্রমী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ বিষয়গুলো পুলিশ সদস্যদেরও অজানা নয়। অথচ যখনই কোনো সংকটের মুখোমুখি হই কিংবা কোনোভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত বা আমাদের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে কেউ ক্রোক করে এবং অপরাধীদের দ্বারা কোনোরকম ভয়ভীতি প্রাপ্ত হলে আমরা তৎক্ষণাৎ পুলিশের দ্বারস্থ হই। তদুপরি পুলিশকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচার ও সৃষ্টকরণের ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। 

খবরে জানা যায়; রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে সহকর্মীকে গুলি করে হত্যা মামলার আসামি পুলিশ কনস্টেবল কাওসার আহমেদের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায়। কাওসারের স্ত্রী নিলুফারের ভাষ্যে; কাওসারের দুই সন্তান আছে। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন। সংসারে কোনো ঝামেলা বা কলহ ছিল না। তবে তিনি জানান, ‘কাওসারের মানসিক সমস্যা ছিল। রাঙামাটির বরকলে চাকরি করার সময় তিনি মানসিক সমস্যায় ভোগেন। এরপর বিভিন্ন সময় সরকারিভাবেই তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে অন্তত তিনবার চিকিৎসা করানো হয়েছিল। নিয়মিত ওষুধও সেবন করতেন। কাওসারের কাছে প্রেসক্রিপশনও আছে। সংসারে কোনো অভাব-অনটন ছিল না। তবে চাকরি নিয়ে খুবই টেনশন করেন তিনি। ছয় ঘণ্টার ডিউটি আট ঘণ্টা হতো।’

ইংল্যান্ডে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে শতকরা ৩০ জন মানসিক সমস্যায় ভোগেন- গবেষণা জরিপে এমন তথ্যের আভাস পাওয়া গেছে। কর্তৃপক্ষ যেহেতু তাদের সদস্যদের মানসিক সমস্যা নিয়ে কাজ শুরু করেছে কিংবা উদ্যোগ নিয়েছে তাহলে সমস্যা-পরবর্তী সমাধানের আভাসও পাওয়া গেছে। ইংল্যান্ডের মতো দেশে; যে দেশে পুলিশ পাবলিকের একটি চমৎকার সম্পর্ক বিদ্যমান, সেই দেশে পুলিশ সদস্যদের একটি বড় অংশের মানসিক সমস্যার উদাহরণ একটি বড় প্রশ্নের সামনে নিয়ে আসে আমাদের। বাংলাদেশ পুলিশ কি আদৌ তাদের সদস্যদের মানসিক অবস্থানকে তুলে ধরার কিংবা যাচাই করার কোনোরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে? অন্যান্য দেশে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ে প্রত্যেক ইউনিটে আলাদা করে সেন্টার স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার বিষয়ে সেন্ট্রালি পুলিশ হাসপাতাল রয়েছে, যেটি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল এবং ইউনিট কিংবা রেঞ্জভিত্তিক চিকিৎসা সেন্টার কিংবা ডাক্তারদের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার তেমন ব্যবস্থা নেই। 

বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যদের চাকরিতে নানা রকমের চাপকে মোকাবিলা করেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলমান চাপকে মোকাবিলা করেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। তথাপি এ ধরনের পেশাগত চাপকে ব্যবহারিকভাবে প্রশমনের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সঙ্গত কারণেই পেশাগত প্রতিকূলতার আকার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি অঘোষিত নেতিবাচকতাকে সব সময় পুলিশ সদস্যদের মোকাবিলা করতে হয়। বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের পেশাগত চাপকে মোকাবিলা করতে বিশেষ ধরনের সাপোর্ট সেন্টার নেই। সাধারণত পুলিশ সদস্যরা যে ধরনের চাপকে মোকাবিলা করে থাকেন তার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  

প্রথমত, পুলিশের চাকরিতে সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। সবসময়ই পুলিশকে সজাগ থাকতে হয়, কখন কোন নির্দেশনা চলে আসে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে; এ ধরনের একটা তাড়না সবসময়ই পুলিশ সদস্যদের মধ্যে থাকে। আমরা সবাই জানি, জরুরি যেকোনো পরিস্থিতিতে পুলিশের সব ধরনের ছুটিও বাতিল হয়ে যায়। পুলিশের মূল কাজই হচ্ছে জনসাধারণের নিরাপত্তা দেওয়া এবং জনগণের সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া। জায়গা থেকে পুলিশে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সারা দেশে ঈদের ছুটিকে সামনে রেখে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এবং হলফ করে বলা যায়, এ ইউনিটের সদস্যদের অধিকাংশ ঈদের ছুটি থেকে দায়িত্বের কারণে বঞ্চিত হন। 

দ্বিতীয়ত, সিনিয়র, জুনিয়র ও ব্যাচমেটদের সঙ্গে নানা বিষয়ে সম্পর্কের ঘাটতি একজন পুলিশ সদস্যের মানসিক বৈকল্যের কারণ হয়ে থাকে। বিসিএস অফিসারদের মধ্যে এমন দেখা যায়, কোনো এক ব্যাচের কর্মকর্তা ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন আবার ওই একই ব্যাচের কর্মকর্তা এখনো এসপি হতে পারেননি। এমন নজির ও উদাহরণ বাংলাদেশ পুলিশে রয়েছে। এ ব্যাপারগুলো একজন অফিসারকে মানসিকভাবে ট্রমার মধ্যে ফেলে রাখে, ফলে পুলিশিংসহ অন্যান্য কাজে তার একটি নমুনা পাওয়া যায়। পুলিশের অভ্যন্তরীণ পদোন্নতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাওয়ার বিষয়গুলোকে সামনে রেখে একই ব্যাচের সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ ও মতদ্বৈততার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া অনেক সময় দেখা যায়, জুনিয়র বিভিন্ন উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে বিশেষ করে ছুটি ও কর্মঘণ্টা ইত্যাদি বিষয়ে। উপরন্তু আলোচনার জায়গা থেকে ব্যাচভিত্তিক ও রেঞ্জভিত্তিক সুযোগ-সুবিধার রকমফেরের কারণে মানসিক ট্রমার মধ্যে থাকেন অনেকেই। সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পুলিশের পারফরম্যান্স ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবান্বিত করে থাকে। 

তৃতীয়ত, একঘেয়েমি কাজ। নিয়মিত একই কাজে অনেক পুলিশ সদস্যের মধ্যে বিরক্তিবোধ চলে আসে। সে কারণেই কাজের মধ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে আসার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এমনও দেখা যায়, কেউ সরাসরি পেট্রোল নিয়ে ব্যস্ত আবার অনেক পুলিশ সদস্য অফিস ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে থাকেন। আবার কেউ কেউ আছেন একই রেঞ্জ কিংবা একই ইউনিটে দীর্ঘদিন কাজ করায় তার কাজের মান ও কাজের ধরনে উন্নতি না হয়ে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে আসছে। এ বিষয়গুলোকে সমন্বয়ে করে পোস্টি ও পদায়ন করা জরুরি, তা না হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের কাজের মানে তেমন তারতম্য দেখা যাবে না। 

চতুর্থত, পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণা। দীর্ঘদিন ধরে নেতিবাচক ধারণার ব্যাপারটি পুলিশের মনে ও মগজে গেঁথে আছে এবং এ ব্যাপারগুলো পুলিশ কর্তৃক ইতিবাচক ও প্রো-অ্যাকটিভ কাজের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশের হাজার ভালো কাজ থাকলেও নেতিবাচক কাজটিকে সবার সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যাপারগুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পুলিশ একটি মানসিক অশান্তি নিয়ে দিনাতিপাত করে। বিপদে-আপদে পুলিশের সাহায্যের দ্বারস্থ হই এবং পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাই কিন্তু মূল্যায়নের সময় পুলিশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার লক্ষ্য নিয়েই যেন আমরা মতামত দিয়ে থাকি। এ ব্যাপারগুলো পুলিশ সদস্যদের গোচরীভূত এবং দায়িত্ব পালনের সময় উল্লিখিত বিষয়গুলো তাদের ট্রমার মধ্যে রাখে, যা পারফরমেন্সে প্রভাব ফেলে।  

পঞ্চমত, পদোন্নতি, বদলি ও পদকপ্রাপ্তিতে বৈষম্য ইত্যাদি কারণে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করে। পদোন্নতি নিয়ে সংস্থাটির বাইরে সরাসরি কোনো সদস্য কথা না বললেও তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও অভিমান বিরাজ করে। কমিউনিটিতে পরিচয় ও প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করে দেয় পদোন্নতি সংক্রান্ত ইস্যুগুলো, সে কারণেই পুলিশ সদস্যরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং অনেকেই নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে থাকে। এ ব্যাপারগুলো সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের পারিবারিক ও কর্মময় জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। 

ষষ্ঠত, রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কারণে স্বাধীনতা হরণ করা হয়, এ ধারণা রয়েছে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিনের। এ দোদুল্যমান অবস্থা থেকে পুলিশের অনেকেই বের হয়ে আসতে চান। পুলিশকে সংস্কারের ব্যাপারে প্রায় সবাই মতামত দেন। তথাপি কেন, কীসের জন্য পুলিশের সংস্কার আটকে গেছে, সেটি খুঁজে বের করে দ্রুততর সময়ে পুলিশকে স্বতন্ত্র ইউনিট হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে পুলিশের পারফরম্যান্স আশাব্যঞ্জক হবে নিশ্চিতভাবেই। আমরা মনে করি ও বিশ্বাস রাখি, পুলিশকে যদি আমরা যথাযথভাবে ধারণ করতে পারি তাহলে পুলিশের কাছ থেকে আরও ইতিবাচক ও প্রো-অ্যাকটিভ কর্মকাণ্ড প্রত্যাশা করতে পারি। যেমনটি দেখেছিলাম করোনার সময়ে। সর্বোপরি পুলিশের সংকটগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করে সামনের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশের মধ্যে সৃষ্ট অস্থিরতা অচিরেই সমাধান হয়ে আসবে।
    
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

নতুন শরণার্থী গ্রহণের চাপ রোহিঙ্গা সংকট আরও গভীর করবে

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৪, ০৪:২২ পিএম
আপডেট: ২৯ জুন ২০২৪, ০৪:২২ পিএম
নতুন শরণার্থী গ্রহণের চাপ রোহিঙ্গা সংকট আরও গভীর করবে
কামাল উদ্দিন মজুমদার

রাখাইনে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মি এর মধ্যে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ আরও রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার জন্য তীব্র চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। আনুমানিক ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী নাফ নদীর একটি এলাকায় অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। জাতিসংঘের অধিকার অফিসের মুখপাত্র এলিজাবেথ থ্রোসেল মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেন। মায়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত থমাস অ্যান্ড্রুস বাংলাদেশ সরকারের কাছে "তার বন্ধ সীমান্ত নীতি প্রত্যাহার করতে" এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের মানবিক সমর্থন আবারও প্রদর্শন করার জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার দৃঢ়ভাবে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে যে, তারা ইতোমধ্যে এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আতিথ্য করেছে এবং আর গ্রহণ করতে পারবে না।

ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজা সংকটের মতো অন্যান্য বৈশ্বিক ঘটনাগুলোর ভিড়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতিমধ্যে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে  বসবাস করা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দুর্দশার দিক থেকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে। মায়ানমার থেকে সমস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য তারা এখনও কোনও দৃঢ় পদক্ষেপে নিতে পারেনি। তারা শুধু মুখে মুখে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মায়ানমারে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত লোকদের প্রত্যাবর্তনের বার বার আশ্বাস দিলেও গত প্রায় আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও স্বদেশে ফেরাতে পারেনি। 

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং অধিকার গোষ্ঠীগুলোকে বুঝতে হবে যে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব, উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে পারে না বা নতুন কোনো অনুপ্রবেশের অনুমতি দিতে পারে না।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকার করে যে- রেশনের ঘাটতি, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সহিংসতা বৃদ্ধি এবং রোহিঙ্গা জঙ্গি গোষ্ঠীর দ্বারা জোরপূর্বক নিয়োগ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবন ও মঙ্গলকে হুমকির মুখে ফেলেছে। একইভাবে তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে নতুন শরণার্থীদের গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ করা রোহিঙ্গারাদের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলময় হবে না। 

পুরনো সমস্যা, নতুন চ্যালেঞ্জ  
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন, আর কোনো রোহিঙ্গা বা মায়ানমারের নাগরিককে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। গত কয়েক দশক ধরে এখানে স্থানান্তরিত হওয়া দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে বিশাল বোঝায় পরিণত হয়েছে। তাই মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের কোনো নতুন আগমনকে তা বাংলাদেশের জন্য হবে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'। 

শরণার্থীদের স্থায়ী আবাসস্থল খুঁজে বের করার কোনো সমাধান না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক এবং জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ১৯৮০ এর দশক থেকে বয়ে বেড়ানো বোঝা আর বইতে রাজি নয়। দাতারা ২০২০ সালে প্রয়োজনীয় তহবিলের মাত্র ৬০ শতাংশ দিয়েছিল, যা ২০২২ সালে ৪৯ শতাংশ ও ২০২৩ সালে প্রায় ৫১.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। 

আন্তর্জাতিক সাহায্য হ্রাসের ফলে বাংলাদেশ প্রতি বছর রোহিঙ্গাদের জন্য খরচ করতে হচ্ছে ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল আর্থিক বোঝা বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের জন্য ঋণ চাইতে বাধ্য করেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশচ প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাংক ও এডিবি-এর কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ঋণ চেয়েছিল - যার মধ্যে ৫৩৫ মিলিয়ন ঋণ এবং ৪৬৫ মিলিয়ন অনুদান রয়েছে। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কীভাবে আরও রোহিঙ্গাকে স্বাগত জানাবে! 

রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ শুধু আর্থিক সীমাবদ্ধতাই নয়, জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও ঝুকিতে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বিশেষ করে যুবকরা যারা সশস্ত্র সংগঠন এবং অপরাধচক্রে যোগদান করেছে, তারা অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, স্বর্ণ চোরাচালান এবং অন্যান্য অপরাধে জড়িত হওয়ায় শরণার্থী শিবিরের অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অনেকেই আবার এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ জঙ্গি গোষ্ঠীর দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে এগুলোই জড়িয়ে পড়ছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৭ থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫০০টিরও বেশি অপহরণ এবং ১৮৬টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা ও রোহিঙ্গা শিবির পরিচালনার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে একটি বিশাল আর্থিক চাপ তৈরি করছে।

এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে স্থানীয়দের সাথে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটছে। বাংলাদেশ এখন এমন একটি ফাঁদে আটকা পড়েছে যে তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মায়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করতে পারে না, যেখানে তারা আরও রক্তপাতের সম্মুখীন হতে পারে। আবার তারা স্থানীয়দের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানের জন্য উপযোগী পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারছে না। সুতরাং, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ যেটি কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামান্য সহায়তায় কয়েক হাজার শরণার্থীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আবাসন দিয়ে আসছে, বার বার এটি করেই যাবে আর অন্যরা চুপচাপ দেখে যাবে তা আশা করা কপটতা ছাড়া আর কিছু নয়।  

চলমান রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ বারবার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রকাশ করে যাচ্ছে, তবুও প্রত্যাবাসনের আন্তর্জাতিক কোনো অর্থবহ ও আপাত প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। গত প্রায় আট বছরে, উন্নত দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহায়তার পরিবর্তে শুধু ফাকা বুলি ও বিবৃতিই দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, উন্নত দেশ, যাদের বিশাল ভূমি এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব কম, তারা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের উপর চাপ কমানোর বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে পারে। তাছাড়া, তারা মায়ানমার কর্তৃপক্ষ বা আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, খাদ্য এবং স্বাস্থ্যসেবার জন্য রাখাইনে একটি মানবিক করিডোর প্রদান করতে চাপ দিতে পারে যাতে তারা বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য না হয়। 

যেহেতু রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি গুরুতর এবং আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে পুনরায় সংঘর্ষের কারণে প্রত্যাবাসনের আপাত কোনো লক্ষন নেই, তাই বাংলাদেশে অবস্থান করা ১ দশমিক ৩ মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গার জীবন টিকিয়ে রাখা দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এমন পরিস্থিতিতে নতুন অভিবাসীদের গ্রহণ করতে বাংলাদেশকে বাধ্য করার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত দ্রুত আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি সংকটের দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর সমাধান নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হওয়া। 

লেখক: গবেষক
[email protected]