সৌজন্যে ভোট। ঈদ ও পয়লা বৈশাখের আগে শাড়ি, জুতো থেকে জামার বাজার জমজমাট। বেশ কিছুদিন হলো শেষ হয়েছে রঙের উৎসব। তবে ভোটের রঙে বাজার এখনো রঙিন। দোকানে দোকানে দেখা যাচ্ছে লাল, সবুজ থেকে গেরুয়া রঙের ছোঁয়া। সামনের লোকসভা নির্বাচন। তাকে ঘিরে প্রচার শুরু করে দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। আর ভোট মানেই প্রচারে অভিনবত্ব এনে একে ওপরকে মাত দেওয়ার পালা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর হাতিয়ার পতাকা, টুপি থেকে ছাতা। ভোটের ময়দানে মুখ দেখাদেখি না-পছন্দ হলেও একসঙ্গে বিকোচ্ছে মোদি, মমতা থেকে রাহুলের মুখোশ। একসঙ্গে উড়ছে বিভিন্ন দলীয় পতাকা।
লাল, তেরঙা, গেরুয়া পতাকা, ঘাস ফুল, পদ্মফুলের শাড়িতে সেজে উঠেছে বড়বাজার। ভোটবাক্সে সমীকরণ যাই হোক না কেন পতাকা, ছাতাসহ প্রচারের সরঞ্জাম বরাতের দিকে প্রথম স্থানে রয়েছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সিপিএম, এরপর কংগ্রেস। সবশেষে বিজেপি। এর পেছনে কারণ দর্শালেন বিক্রেতারা। এবারে রাজ্যে প্রথম দফা থেকে শেষ দফা পর্যন্ত লোকসভা ভোট রয়েছে। প্রায় দীর্ঘ দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলবে ভোট প্রক্রিয়া। তাই যত দফা নির্বাচন এগিয়ে আসবে ততই বিভিন্ন জায়গায় থেকে বরাত বেশি আসবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে এবছর নজর কাড়ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ছবি দেওয়া টি-শার্ট থেকে নরেন্দ্র মোদির মুখোশ। ঘাস ফুল প্রতীকের শাড়ি যেমন আছে, তেমন পদ্ম ফুল প্রতীকের শাড়িও মিলছে বাজারে। দলীয় প্রতীক চিহ্নসহ এক একটি শাড়ি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকায়। টি-শার্টের দাম যাচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ টাকা, বিভিন্ন মাপের পতাকা বিকোচ্ছে সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৭ টাকায়। ছবি আঁকা সান গার্ড ৮০ পিসের পকেট মিলছে ৫০ টাকা-৬০ টাকায়। বিভিন্ন দলের টুপির দাম যাচ্ছে ৪ টাকা-১০ টাকা।
অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাহুল গান্ধী, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোশ বিকোচ্ছে ৪০০ টাকা ১০০ পিস। বিভিন্ন দলের ব্যাজ আলাদা আলাদা মাপের রয়েছে। এগুলোর ৪ থেকে ১০ টাকা করে দাম। আছে উত্তরীয়। সেগুলোর দাম যাচ্ছে ৯ টাকা-৩৫ টাকা পর্যন্ত। এসবের পাশাপাশি ভালো চাহিদা রয়েছে বাইক ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডের, যার দাম ৮ টাকা প্রতি পিস। এ ছাড়া রোদ থেকে বাঁচতে ছাতা কিনছে লোকজন। ছাতা প্রতি পিসের দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
বড়বাজারের ব্যবসায়ী দেবাশীষ পালোধি জানাচ্ছেন, তার কাছে ইতোমধ্যেই যাদবপুর, মথুরাপুর, জয়নগর কেন্দ্রের তৃণমূলের তরফে পতাকার বরাত দেওয়া হয়েছে। আরও এক ব্যবসায়ী সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, কলকাতায় যেহেতু পরে ভোট তাই এই মুহূর্তে কলকাতার কোনো দলই জিনিসের বরাত দেয়নি। তবে নদিয়া, কৃষ্ণনগর, হাওড়া, হুগলি থেকে পতাকা, টুপি ও ছাতার বরাত এসেছে। তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস সব দলের তরফেই বরাত দেওয়া হয়েছে। বিক্রেতাদের কথায়, ভোটের ক্ষেত্রে পতাকা হোক বা শাড়ি, টুপি বা সান গার্ড বেশি বরাত আসে তৃণমূলের। তারপর সিপিএমের বরাত আসে। তবে তারা পতাকা, টুপি, ছাতা এগুলোর বরাত দেয় বেশি। কংগ্রেসের তরফে বেশ খানিকটা বরাত এসেছে।
পশ্চিম বাংলায় ভোটের আবহে ফের জাগছে গণসংগীত
এক সময় বলা হতো, বক্তৃতা করে মানুষের মধ্যে যত-না দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হয়েছিল, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক অনেক বেশি দ্রুততার সঙ্গে মানুষের কাছে ব্রিটিশ অত্যাচারের কাহিনি পৌঁছে দিয়েছিল। এই বাংলায় গণসংগীতের প্রাণপুরুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাস, অজিত পান্ডেদের হাত ধরে বামপন্থিরা মানুষের কাছে সর্বহারা ও অত্যাচারিতদের নিদারুণ কাহিনি গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। বামপন্থি আন্দোলনের সঙ্গে গণসংগীতের এই ধারা মিশে আছে কয়েক দশক আগে থেকেই।
সভা-সমিতির আগে এই গণসংগীত গেয়ে মানুষের কাছে অসহায়, নিপীড়িত, অত্যাচারিত মানুষের কথা তুলে ধরত বামপন্থিরা। সেকালেও প্রতুল মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরীসহ আরও বহু সংগীত স্রষ্টাদের নাম উঠে আসে। গণসংগীত কী? বলতে গিয়ে সলিল চৌধুরী বলেছিলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা সংগ্রামের সাংগীতিক ইতিহাসই হলো গণসংগীত।’ আবার গণসংগীতের রূপকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছিলেন, ‘স্বদেশ চেতনা যেখানে গীতচেতনায় মিলিত হয়ে শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতার ভাবাদর্শের সাগরে মেশে, সেই মোহনাতেই গণসংগীতের জন্ম।’
শোষণহীন, নিপীড়নহীন, অত্যাচার-মুক্ত সমাজ গঠনে বামপন্থিদের বার্তাকে গানে গানে মানুষের মাঝে তুলে ধরার কাজ এই গণসংগীত শিল্পীরা আজও নিপুণভাবে পালন করে চলেছেন শ্রমিকনগরী দুর্গাপুরে। একদা লালদুর্গ, অবিভক্ত বর্ধমান জেলার শস্যগোলা গ্রামীণ বর্ধমান বা ইস্পাতনগরী দুর্গাপুর কিংবা খনি অঞ্চল রানিগঞ্জ কিংবা আসানসোলে বামেদের শাসনব্যবস্থা কায়েম থাকার সময় বহু গণসংগীতের দল, বামফ্রন্টের সভা-সমাবেশের আগে গণসংগীতের দ্বারা মানুষের কাছে প্রতিবাদের কথা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করত।
কিন্তু, তাদের মধ্যে অধিকাংশ গণসংগীত গোষ্ঠীর মৃত্যুঘণ্টা বেজে যায় বামদের ৩৪ বছরের রাজ্যপাটের বিদায়ের সঙ্গে। তবে শিল্পশহর দুর্গাপুরে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি গণসংগীতের দল। ‘লহরী’ দুর্গাপুরের গণসংগীতের আয়োজনকে বাঁচিয়ে রেখেছে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে। আরও একটি নির্বাচন এসে গেছে। বর্ধমান-দুর্গাপুর ও আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রে যেখানেই বামেদের সভা হবে, সেখানে এই গণসংগীতের মাধ্যমে প্রতিবাদ ও বার্তা তুলে ধরবে লহরীর শিল্পীরা। তবে, এই দুই লোকসভা ও আশপাশের অঞ্চলেই তাদের এই গণসংগীত সীমাবদ্ধ থাকছে।
দুর্গাপুর লহরীর অন্যতম প্রাণপুরুষ সীমান্ত তরফদার জানিয়েছেন, ‘পুরাতন গণসংগীতের সেই ধারাকে বজায় রেখে, অতীতকে অস্বীকার না-করে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, অজিত পান্ডেদের দেখানো পথেই আমরা আজও হাঁটছি। শিকড়কে না ছিঁড়ে গান বাঁধছি। করপোরেট দুনিয়ার হাতে সব চলে যাওয়ার প্রতিবাদ, বেকারের পেটে ভাত দেওয়ার দাবি, শ্রমিকের হাতে আসুক কাজ, গণতান্ত্রিক বামপন্থি সংগঠনগুলো যে আবেদন রাখছে, আমরা সেই আবেদনকেই তুলে ধরছি গানে গানে।’
আজও রীতিমতো গণসংগীতের রেওয়াজ হয়। নাই-বা থাকল বামেরা এ রাজ্যে ক্ষমতায়। তবুও গণসংগীতশিল্পীদের মানসিক আনন্দে ভাটা পড়েনি। আজও তাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শান্তির পক্ষে গণসংগীতশিল্পীরা সমবেতভাবে গেয়ে ওঠেন, ‘কীসের শোক করিস রে ভাই/আবার তোরা মানুষ হ।’ শুধু এই বাংলায় নয়, প্রতিবেশী রাজ্য অসমেও গণসংগীতের ধারা অব্যাহত ছিল বহুকাল। ত্রিপুরাতেও গণসংগীতের নিয়মিত আয়োজন ছিল বামপন্থিদের সভা-সমাবেশের আগে। তবে, আজ অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে গণসংগীতের সেই সুর। পাশ্চাত্যের অনুকরণে বহু গণসংগীতের সৃষ্টি। আজও তাই কান-পাতলে শোনা যায় ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে গাওয়া, ‘বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও, নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি, গঙ্গা তুমি বইছ কেন?’
লেখক: কলকাতা প্রতিনিধি, খবরের কাগজ