![বঙ্গবন্ধুর ভাষণ: জাতীয় ভাবাদর্শ ও দিকনির্দেশনা](uploads/2024/03/20/1710929797.Dr-Md-Shafuqul-Islam.jpg)
বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দ। ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ও বাংলার মানুষের অনন্য প্রামাণ্য দলিল। বাংলাদেশ সৃষ্টির এক ও অদ্বিতীয় সংবিধান। ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ যে মুক্তি বা স্বাধীনতার দিকে যাচ্ছে, তা মূলত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। ৭ মার্চ পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশ নামক দেশটির শুভক্ষণের দিন। যার নেতৃত্বে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল বাংলার মানুষের জন্য ঐশ্বরিক উপহার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিরল কণ্ঠস্বর। মার্চ মাসের দ্বিতীয় দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রথম বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। পরবর্তীকালে ৭ মার্চ বাংলাদেশ যে পূর্ণ স্বাধীনতার পথে যাবে সেটা চূড়ান্তভাবে প্রতীয়মান হয় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে। সার্বিক অর্থে জাতির পিতা ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ধারক-বাহক ও মূল নায়ক ছিলেন। ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ওই দিনে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের বীজ বপন হয়েছিল। ৭ মার্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ মিনিটের যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগাম ইঙ্গিত ছিল। ১৮ মিনিটের ভাষণে দেশ ও মানুষের জন্য সব ধরনের নির্দেশনা ছিল। যেমন স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার, শৃঙ্খলা, শান্তি ও অসম্প্রাদায়িকতা।
ভাষণটি একমাত্র অলিখিত ভাষণ যেটা বিশ্বের ৭৮টি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল, নথি ও বক্তৃতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৭ সালে জাতিসংঘের অন্যতম সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো বিশ্ব ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে এ ভাষণকে স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তীকালে ইউনেস্কো কৃর্তক ৭ মার্চের ভাষণকে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারেও (এমওডব্লিও) সংরক্ষণ করে। ৭ মার্চের ভাষণসহ এখন পর্যন্ত ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত রয়েছে। ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়ে এখন দাবি করতে পারে তাদের নিকট একটি ব্যতিক্রম, অদ্বিতীয় এবং স্বাধীন দেশ উপহার দেওয়ার ভাষণ সংরক্ষিত রয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ভাষণ কেউ দিতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল।
ভাষণটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক ঐতিহাসিক ভাষণ। তিনি বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে ভাষণ শুরু করে বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন। ২, ৪, ৫, ৩ ও ৩ সংখ্যাগুলো যোগ করলে ১৭-এর সমান হয়। এ অলৌকিক সমীকরণ তার জন্মদিন ১৭ মার্চকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বাঙালি জীবনে এক অবিসংবাদিত নেতা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যার কল্যাণে একটি স্বাধীন দেশ, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি জাতীয়তার পরিচয় এবং একটি ভূখণ্ড আমরা পাই। অন্যথায় আমাদের হয়তো আজীবন শোষিত ও পরাধীন থাকতে হতো। পাকিস্তানি এক গোয়েন্দা রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুকে ‘চতুর’ এবং ‘বুদ্ধিমান’ উল্লেখ করা হয়। কারণ জাতির জনক কৌশলে স্বাধীনতা দিয়ে গেলেন, কিন্তু তারা কিছুই করতে পারল না।
৭ মার্চের ভাষণ একাডেমিক ও আন্তজার্তিক স্বীকৃতি পেলেও বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত জাতীয় দিবস ঘোষণা করেনি। ওই দিনটিকে জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণা করার জন্য মহামান্য হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। যাতে মানুষ ৭ মার্চকে উদযাপন করতে পারে। ইতোমধ্যে ৭ মার্চকে হাইকোর্ট জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণা করে এক মাসের মধ্যে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে যে মঞ্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে তার ভাস্কর্য নির্মাণ করার বিষয়েও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমি মনে করি, ৭ মার্চের ভাষণ প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যবইয়ে উল্লেখ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি গ্রামে গ্রামে প্রতি বছর ৭ মার্চ ভাষণটি প্রচারে সরকার কর্তৃক নির্দেশনা থাকা উচিত বলে মনে করি। এই নির্দেশনাটি মুজিববর্ষে কার্যকর করা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও যৌক্তিক। বর্তমানে এই ভাষণটি ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ওই ভাষণটি তখন পাকিস্তান সরকার রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচারের অনুমতি দেয়নি। তবে অডিও রেকর্ডটিও এম আবুল খায়েয়ের মালিকাধীন রেকর্ডে ধারণ করা হয়। আজকে এই লেখার মধ্য দিয়ে আবুল খায়েরের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
জাতির পিতা কতটুকু নির্লোভ ছিলেন, সেটা ৭ মার্চের ভাষণ থেকে উপলব্ধি করা যায়। কারণ ওই ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না’। ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের শিখিয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা, গরিব-দুখী এবং শোষিত-নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলা, সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করা ইত্যাদি। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছিলেন, ‘ভালো ভাষণ কিন্তু বক্তারা লিখে বক্তব্য দেন, আমাদের বঙ্গবন্ধু ১৮ মিনিটের সেই ভাষণে তার নিকট কোনো কাগজ ছিল না। এটি শুধু ভাষণ নয়, এটি কাব্য, এটি মহাকাব্য।’
ফিদেল কাস্ত্রো বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ ফিদেল কাস্ত্রো পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত নেতা ছিলেন। তাকে অনেকবার হত্যার চেষ্টা করেও কিন্তু হত্যা করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমরা জাতির পিতাকে বাঁচাতে পারিনি। কী এক দুর্ভাগ্য ও বেইমান জাতি আমরা। এ ভুলের মাশুল সারা জীবন বহন করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন ধারণ ও বাস্তবায়ন করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। তাইলেই প্রমাণিত হবে বঙ্গবন্ধুকে আমরা ভালোবাসি এবং বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও আদর্শ ধারণ করি। ১৮ মিনিটের ভাষণের জন্য বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং এনে দিয়েছে ১০:৬ মাপের একটি জাতীয় পতাকা। এ ভাষণের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল একটি বজ্রকণ্ঠ, একটি ইতিহাস। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্য আছে। কারণ এখানে ৭ মার্চের ভাষণসহ আরও চারটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ রয়েছে। তাই এই এলাকাটি বিশেষায়িত এলাকা হিসেবে সংরক্ষণের মযার্দা দেওয়া উচিত।
যে লোকটি ৭ মার্চের ভাষণ শোনেননি বা উপলব্ধি করেননি, তিনি বাংলাদেশের নাগিরক হতে পারেন না। নাগরিক হওয়া উচিত নয়। ৭ মার্চের ভাষণ শুধু শুনলে হবে না, ধারণ ও অনুভব করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হলে ৭ মার্চের ভাষণকে জানতে হবে। সেই অনুসারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নেতৃত্ব দিতে হবে। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাংলাদেশের প্রতিটি সংকটে এ স্লোগান হোক আমাদের পাথেয়। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।