সড়কে মৃত্যুর মিছিলের অবসান কাম্য । খবরের কাগজ
ঢাকা ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪

সড়কে মৃত্যুর মিছিলের অবসান কাম্য

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:০৬ পিএম
সড়কে মৃত্যুর মিছিলের অবসান কাম্য
আর কে চৌধুরী

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়, তা আমাদের জানা নেই। ট্রাফিক শৃঙ্খলার অভাবে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। সব সম্ভবের এই দেশে মহাসড়ক বা হাইওয়েগুলোতেও চলে নসিমন, করিমন ও অটোরিকশার মতো যানবাহন। 

সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে যেসব কারণ দায়ী তার মধ্যে অন্যতম হলো- আইন অমান্যের প্রবণতা। যানবাহন চালক, পথচারী সবার মধ্যে এ প্রবণতা ক্রিয়াশীল। 

সড়ক দুর্ঘটনার রাশ টানতে হলে যেমন ইচ্ছা তেমন চলার প্রবণতায় বাঁধ সৃষ্টি করতে হবে। মোটরসাইকেলের ফ্রি-স্টাইল চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা দরকার। সবচেয়ে আগে কী কারণে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে তা উদঘাটন করে মূল জায়গায় হাত দিতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, সড়কে যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা গেলে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এজন্য লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা দরকার। যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ যাতে যান্ত্রিক যানবাহন চালাতে না পারে সে বিষয়েও নিশ্চিত হতে হবে। যানবাহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের সম্পর্ক নিয়ে যে রটনা রয়েছে তার ইতি ঘটানোও জরুরি। 

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক প্রাণ ঝরবে তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। হতাহতের মিছিল আর দীর্ঘায়িত করতে না চাইলে যানবাহনে চালক, যাত্রী, পথচারী এবং ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে যারা জড়িত তাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। জনসচেতনতা গড়ে তোলাও জরুরি। এক্ষেত্রে ঘাটতি আছে বলেই সড়কে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। তা যেভাবেই হোক এ দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে হবে।

নানা ব্যবস্থা নেওয়ার পরও প্রতিদিনই দেশজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রকাশিত মাসিক দুর্ঘটনার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে গত মার্চে ৫৫২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে অন্তত ১ হাজার ২২৮ জন। 

সারা বছর যতসংখ্যক মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, তার প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশের মৃত্যু হয় শুধু ঈদের সময়।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিন ঈদুল ফিতরে মোট ৯৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় ঈদুল আজহায় ৭৮৬টি দুর্ঘটনায় ৭৭০ জনের প্রাণ ঝরেছে সড়কে। গত মঙ্গলবার ফরিদপুরসহ সাত জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঈদের দিনই সারা দেশে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

গত বুধবার ঝালকাঠিতে একটি সিমেন্টবোঝাই ট্রাকের চাপায় দুমড়েমুচড়ে গেছে একটি প্রাইভেটকার ও তিনটি অটোরিকশা। এ ঘটনায় ১৪ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ১২ জন। এ ছাড়া দেশের তিন জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে আরও চারজন।

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানিকে শুধুই দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দেশের সড়ক-মহাসড়কে এমন অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, যেগুলোকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলা যায়। অনেক দুর্ঘটনাই চালকের কারণে ঘটে থাকে। অনেক চালক রাত-দিন গাড়ি চালান। অত্যধিক ক্লান্তি এবং গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে।

লাইসেন্সহীন অদক্ষ চালকের হাতে, এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের হাতে গাড়ির চাবি তুলে দেওয়া হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ চালকের বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। আমাদের দেশে চালকদের আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা। চালকদের মাদকাসক্তিও সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ। 

মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো বন্ধে চালকদের ডোপ টেস্ট করানোর ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনা কি মেনে চলা হচ্ছে? সেই সময় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ থেকে জানানো হয়েছিল চালকরা মাদকাসক্ত কি না, তা রাস্তায়ই পরীক্ষা করা হবে। পরীক্ষায় কোনো চালক ধরা পড়লে তাকে সরাসরি জেলে পাঠানো হবে। চালকদের সেই ডোপ টেস্ট কত দূর?

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব। মহাসড়কে অপরিকল্পিত স্পিড ব্রেকার বা গতিরোধকগুলোও দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। এ ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়কের পাশে হাটবাজার বসা, চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব ইত্যাদি কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনের প্রয়োগ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চালক এবং সড়কে চলাচল উপযোগী ভালো মানের যানবাহন অবশ্যই প্রয়োজন। তবে একই সঙ্গে জনগণকেও হতে হবে সচেতন।

সরকারি-বেসরকারি ও নিজস্ব সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রণীত রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দিক থেকে ভারত ও পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে চার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আধুনিক, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও প্রযুক্তিনির্ভর সড়ক পরিবহন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ অনুসমর্থনকারী হিসেবে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত মানুষের সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত ও সুপারিশের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। দেখা গেছে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা হলে, বিশেষ কোনো ব্যক্তি দুর্ঘটনায় নিহত হলে বা সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সড়কে আন্দোলন দেখা দিলে কিছুদিন প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। কিছু আলোচনা, কিছু সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা রোধে তা তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখে না।

বাংলাদেশ এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য। আর্থসামাজিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এ দুটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ ছাড়া উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা সভ্যতার পরিচয় বহন করে। সুতরাং উন্নত দেশের উপযোগী পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে পরিকল্পনা ও কাজ এখনই শুরু করতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ ফিটনেসহীন যানবাহন। সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা ইত্যাদি কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। আমরা চাই, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সব ব্যবস্থা নেওয়া হোক। চালকদের ডোপ টেস্ট করে প্রয়োজনে নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হোক।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা
[email protected]

মত প্রকাশের স্বাধীনতা: সীমাবদ্ধতা ও সংকট

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ০৬:৪১ পিএম
মত প্রকাশের স্বাধীনতা: সীমাবদ্ধতা ও সংকট
মো. আবদুন নূর দুলাল।

শুরু করি বাসন্তিকে দিয়েই। ১৯৭৪ সালের সেই জালপরা বাসন্তি। বাসন্তির ছবি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় দু'বার। ৩১ জুলাই, ১৯৭৪ প্রথম প্রকাশ। ইত্তেফাকের ভেতরের ক্রোড়পত্রে দ্বিতীয় প্রকাশ ১৯৭৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ছবিটি যিনি তুলেছিলেন তার নাম ফটোগ্রাফার আফতাব আহমেদ। যখন পত্রিকায় ছাপা হয় তখন ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলেন ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন।

এই ছবিটি যে ভুয়া ছবি, সেই তথ্য উদঘাটিত হতেও সময় লেগেছে অনেক বছর। ছবিতে দু'জন নারী। একজন বাসন্তী, আর একজন বাসন্তীর চাচাতো বোন দুর্গাতি। জালপরা মেয়েটি বাসন্তী। সেই ছবি তোলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী রাজো বালা। রাজো বালা জানান, ৭৪ সালে যখন বাসন্তী- দুর্গাতিদের ছবি তোলা হয় তখন বর্ষাকাল। চারিদিকে জল আর জল। তিনজন লোক আসে বাসন্তীদের বাড়িতে। একজন সেই সময়ের স্থানীয় রিলিফ চেয়ারম্যান আনছার। অপর দু'জনকে রাজো বালা চিনেন নাই। বাসন্তী- দুর্গাতিদের একটি কলাগাছের ভেলায় করে বাড়ি থেকে বের করা হয়। আর অন্য একটি ভেলায় করে তাদের ছবি তোলা হয়। বাঁধের উপর মাঝিদের জাল ছিল যা রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। সেই জাল এনে বাসন্তীর ছেঁড়া শাড়ির উপর পড়ানো হয়। বাসন্তির কাকা বুদুরাম আপত্তি জানান। বলেন ছেঁড়া হলেও একটা শাড়ীতো পরা আছে। তার উপর জাল পরানো দরকার কী? বাসন্তী ছিলেন এক বাকপ্রতিবন্ধী এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। সেই নারীকেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডার কাজে ব্যবহার করা হয়।

এই ছবি এবং ইত্তেফাকে তা প্রকাশ ছিল সাংবাদিকতার ইতিহাসের এক ভয়াল জুচ্চুরি এবং এক কালো থাবা। এক জঘন্য প্রতারণা।

সেদিন কারও মাথায় আসেনি একটি জালের দাম একটি শাড়ির দাম থেকে কম নয়। সদ্য স্বাধীন একটি দেশে বাংলাদেশ নামক একটি যুদ্ধের ময়দানকে বিনির্মাণে যখন দিশেহারা বঙ্গবন্ধু, তখন এই সব বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ষড়যন্ত্র ও প্রোপাগান্ডা চলতে থাকে। চলতে থাকে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র। সব ষড়যন্ত্র এক হয়ে তৈরি করে ১৫ আগস্টের ভয়াল ট্রাজেডি। বাঙালি জাতিসত্তাকে ধংস করার এক ভয়ানক অপপ্রয়াস।

মত প্রকাশের স্বাধীনতার এই নেগেটিভ উদাহরণ থেকেই এই লেখাটা শুরু করলেও আমি এবং আমরা কেউই মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী নই।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা কী?

সোজাসাফটা সরল অঙ্ক। আমার বাক স্বাধীনতা মানে আমি যা খুশ তাই বলবো। কাউকে তেল মারতে ইচ্ছা হলে উৎকটভাবে তেল মারবো। কাউকে গালি দিতে ইচ্ছে হলে নিজের ভাণ্ডারে যত কঠিন শব্দ আছে তা দিয়ে গালি দিব। নিজের ভাণ্ডারে ফুরিয়ে গেলে অন্যের কাছ থেকে ধার-দেনা করে কঠিন শব্দ জোগাড় করে গালি দিব। খাঁটি বঙ্গ ভাষায় গালি দিব। খাঁটি বঙ্গ ভাষা না কুলালে আঞ্চলিক ভাষায় গালি দিব। তাতেও না কুলালে ইংরেজী, উর্দু, আরবি, ফারসি, হিন্দি যে ভাষায় উৎকট শব্দ আছে সে ভাষা থেকে শব্দ চয়ন করে গালি দিব। এমন ভাষা প্রয়োগ করবো যাতে যাকে উদ্দেশ্য করে ভাষাটি প্রয়োগ হচ্ছে তার শ্রবণ শক্তি যেন ঝালাপালা হয়ে যায়। অন্তর যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। যে শব্দটি তার কাছে সবচেয়ে কষ্টদায়ক সেই শব্দ দিয়েই তাকে জব্দ করবো। যে হাঁটতে পারে না- তাকে লেংলা বলে কষ্ট দিব। যে কথা বলতে পারে না- তাকে বোবা শয়তান বলে গালি দিব। যে নারী ডিভোর্সি- তাকে সেই প্রেক্ষাপট তুলে তুলোধুনা করবো। ভাল নারীকে কারণে বা অকারণে বেশ্যা বলে কলঙ্ক দিব। কেন দিব? কারণ এটা আমার বাক স্বাধীনতা। বাক স্বাধীনতা মানে আমার যা খুশি আমি তাই বলবো।

বাক স্বাধীনতা মানে কি এমন?

জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত ইউনিভার্সাল ডিকলারেশন অব হিউম্যান রাইটস এর ১৯নং আর্টিকেলে মানুষের বাক স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করার বিধান করা হয়েছে। সভ্যতার দাবিদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের কনভেনশন ফর দ্যা প্রকেটশন অব হিউম্যান রাইটস এন্ড ফান্ডামেন্টাল ফ্রিডম এর ১০নং আর্টিকেলে বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তার বিধান করেছে।

এবার স্বদেশ প্রসঙ্গ

স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জনের দশ মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার দ্রুততম সময়ে সংবিধান প্রণয়ন করে। রক্তের অক্ষরে লেখা সেই সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদ মত প্রকাশের তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংক্রান্ত। এই অনুচ্ছেদে নিখুঁত ভাষায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা, ভাব ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি সংবাদপত্র এবং মিডিয়ার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। তবু আমাদের দিকে আঙ্গুল তোলে আমেরিকা। আঙ্গুল তোলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই বলে বিভিন্ন ফোরামে হইচই ফেলে দেয়। হইচই ফেলে দেয় বিভিন্ন মিডিয়ায়। মাঝে মধ্যে আমরাও তাদেরকে ডেকে এনে অযাচিত মন্তব্য করাই। কেন?

আঙ্গুল তোলার কারণ কি এই যে বাংলাদেশে আসলেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনুপস্থিত? নাকি কেবলই মোড়লিপনা?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে সাদামাটা ভাষায় কিছু বিশ্লেষণ করি। মত প্রকাশের স্বাধীনাত কি অবাধ? সোজাসাপটা উত্তর- নিশ্চয়ই নয়। জাতিসংঘের ঘোষণা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কনভেনশনের সংশ্লিষ্ট অংশেই সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত আছে এই অধিকারের সীমাবদ্ধতাসমূহ।

একটা উদাহরণ দেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কনভেনশনের আর্টিক্যাল ৮ হলো ব্যক্তিগত জীবনের অধিকার। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩২নং অনুচ্ছেদ তার অনুরূপ। দু’টাই অধিকার। কোন অধিকার হতে কোন অধিকার ছোট নয়।

করিম একজন সাংবাদিক কিংবা ব্লগার। তার অধিকার আছে মত প্রকাশের। তিনি রহিম সম্পর্কে যা পেয়েছেন তা প্রকাশ করবেন অনায়াসে। অপরদিকে রহিমেরও অধিকার আছে ব্যক্তিগত বিষয় গোপন রাখার। অধিকারের সঙ্গে অধিকারের দ্বন্দ্ব।

এ বিষয়ে ইউরোপীয়ান আদালত সমূহে অনেক মামলা আছে। অনেক যুগান্তকারী রায় আছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার এখানে সীমারেখা টেনে দেওয়া আছে। কারও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমি কতটুকু বলতে পারবো তার সীমারেখা নিয়ে বিরোধ থাকলেও একটা সীমারেখা যে আছে তা নিয়ে কোন বিরোধ নেই।

এবার আদালত প্রসঙ্গ

আদালত হচ্ছে একটি শুভ্র চাদর। এতে দাগ লাগলে তা দেখা যায়। অন্য যে কোন প্রতিষ্ঠানে দাগ লাগলে যে রকম দেখা যায়, আদালতের গায়ে দাগ লাগলে দেখা যায় তার থেকে অনেক বেশি। সে জন্য আদালত নিয়ে আচার আচরণের এবং কথাবার্তার সীমারেখা তামাম দুনিয়াজোড়া স্বীকৃত। আমরা ছবি তুলি। ফটোসেশন করি। ফ্রি স্টাইলে করি। কিন্তু আমরা আদালতের ভেতরে ছবি তুলি না। কিংবা আদালতে বসা অবস্থায় মাননীয় বিচারপতির বা বিচারকের ছবি তুলি না। এটি হচ্ছে সীমারেখা।

আদালতে বিচারাধীন বিষয় সম্পর্কে আমরা কথা বলি মেপে মেপে। কারণ তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে যে কোন কথা মাননীয় বিচারপতির দৃষ্টিগোচর হতে পারে। এবং তিনি তার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন। কিন্তু নিস্পত্তিকৃত মামলা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করা বা মন্তব্য করা আমাদের অধিকার এবং তা আদালতে উৎকর্ষতা এবং মান বৃদ্ধির জন্য একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সেখানেও সমালোচনা বা মন্তব্যের ভাষা হতে হবে শালিন এবং যুক্তিসংগত। আদালত হচ্ছে আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর একটি সীমারেখা।

এবার মানহানি প্রসঙ্গে দুটো কথা বলি। সকল মানুষের একটা মান আছে। ধনীর যেমন আছে, দরিদ্রেরও আছে। স্কুল শিক্ষকের যেমন মান আছে, ছাত্রেরও আছে। উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির যেমন মান আছে, নিম্ন পদের পিয়ন চাপরাশিরও মান আছে। মুসলিমের যেমন মান আছে, হিন্দুরও আছে। পুরুষের যেমন মান আছে, নারীরও মান আছে। মূল ভূখণ্ডের মানুষের যেমন মান আছে, উপজাতিয়দেরও মান আছে। সকলের মান তার কাছে গুরত্বপূর্ণ।

মান একটি সার্বজনীন অধিকার। যেমন বাক স্বাধীনতা একটি অধিকার। এখানেও অধিকারের সঙ্গে অধিকারের দ্বন্দ্ব এবং বাক স্বাধীনতার আরেকটি সীমাবদ্ধতা। এগুলো হচ্ছে বাক স্বাধীনতার আইনী এবং যৌক্তিক সীমাবদ্ধতা। কিন্তু বাস্তবতার কষাঘাত বড়ই নির্মম। সাংবাদিক লড়াই করে মানুষকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সরবরাহের জন্য। আঘাত আসে সামরিক জান্তার বুলেট আর বেয়নেট থেকে। স্বৈরাশাসকের বন্দুক থেকে। বড় এবং ছোট কিছিমের মাস্তান থেকে। আঘাত আসে সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিদের আস্তানা থেকে।

হুমায়ুন আজাদ, অভিজিতসহ কত কত জন জঙ্গি হামলার শিকার। তাদের অপরাধ তারা মুক্ত চিন্তার মানুষ। আবার অঢেল টাকার এক মালিকের বিরুদ্ধে একবারতো সকল প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া সীমাহীন নীরবতা পালন করে। আবার একজনের উদ্যত বাক দমিয়ে দেয় আরেকজনের বিনম্র বাক। মানুষকে সঠিক তথ্য জানাতে যেয়ে পৃথিবীর বাঁকে বাঁকে ঝরে গেছে কতো কতো অকুতোভয় প্রাণ। আবার মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন কত সাধুকে চোর বানায়, কতো সম্ভ্রান্ত মানুষকে অকারণে লাঞ্চিত করে। একই মুদ্রা, এপিঠ ওপিঠ।

সংবাদ বিরুদ্ধে গেলে নিপীড়িত হয় সাংবাদিক। আবার অসাধু কলমের খোঁচায় বা ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার আঘাতে দিগন্তজোড়া অবয়ব নিয়ে দাঁড়ানো ভালো মানুষ নিমিষেই ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। এখনতো কেবল সাংবাদিকরাই নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রল করে, ভাইরাল করে মিথ্যাকে। ভাইরাল করে গুজবকে। জীবিত ব্যক্তিকে অনায়াসে মেরে ফেলে।

অবাধ তথ্য প্রবাহ

কোন কোন সুশীলকে দেখি সকাল থেকে গভীর রাত অবধি মিটিং মিছিল টকশোতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে শেষমেষ বলে কথা বলতে পারছি না, বাক স্বাধীনতা নেই। তবু শেষ অনুভূতি ব্যক্ত করি।

চাই অবাধ তথ্য প্রবাহ

কোন অবস্থাতেই অন্যের সর্বনাশ করে নয়। নিজ ভূখণ্ডের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের মাধ্যমে নয়। দুনিয়াজোড়া বিবেদ হানাহানি সৃষ্টি রক্তপাত করার জন্য নয়। যুদ্ধের উসকানি দেওয়ার জন্য নয়। জাতির জনককে হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য নয়। অবাধ তথ্য প্রবাহ চাই। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। সভ্যতার জন্য। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। একটি মানবিক পৃথিবী সৃষ্টির জন্য। তবেই হবে মুক্তচিন্তা শব্দটির প্রকৃত স্বার্থকতা।

লেখক: মো. আবদুন নূর দুলাল, সদ্য সাবেক সম্পাদক- বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি

যুক্তরাষ্ট্র এখন কী জবাব দেবে?

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ০৩:৪৪ পিএম
যুক্তরাষ্ট্র এখন কী জবাব দেবে?
মো. সাখাওয়াত হোসেন

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহতের ঘটনার জবাব চেয়েছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতি হয়নি উল্লেখ করে দেশটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তারও সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রে চলা ইসরায়েলবিরোধী মিছিলে পুলিশের হামলার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর মানবাধিকার রিপোর্ট লেখে কিন্তু আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে না। এ ছাড়া জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে কাজ করে যাচ্ছে কিংবা প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দিচ্ছে তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করছে।’

যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্রবিক্ষোভে পুলিশের হামলার ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই দেশে মানবাধিকার কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। কথা বলার স্বাধীনতা কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের বাঙালি মারা গেছে। সেই দিনও দুজন মারা গেল। আমি প্রতিবাদ জানাই। তারা জীবন-জীবিকার জন্য গেছে। কিন্তু তাদের এভাবে হত্যা করবে কেন? তারা তো কোনো অপরাধ করেনি।’ বাচ্চা ছেলেও তাদের হাত (যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ) থেকে রেহাই পায় না উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘যারা এখন মানবাধিকারের গীত গায় এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার খুঁজে বেড়ায়, তারা কী জবাব দেবে। আমি সেই জবাব চাই। মানবাধিকার সংস্থা, বিচার বিভাগ, যারা আমাদের নিষেধাজ্ঞা দেয়, আমাদের ওপর খবরদারি করে তাদের কাছে জবাব চাই।’

যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি কেন মারা যাবে, এ প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘ওইরকম মায়ের কোল থেকে নিয়ে হত্যা করা, শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন করা এটা তো সম্পূর্ণ মানবাধিকার লঙ্ঘন করা।’ গত মার্চে নিউ ইয়র্কের কুইন্সে পুলিশ উইন রোজারিও নামে এক বাংলাদেশি তরুণকে গুলি করে হত্যা করে। সে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। পুলিশের অভিযানের সময় মা তাকে কোলে আগলে রেখেছিল। এ ঘটনার পর উইনের পরিবার পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এ ছাড়া নিউ ইয়র্কের বাফেলো শহরে দুই বাংলাদেশিকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই মানবাধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার। বিশ্বের কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে যুক্তরাষ্ট্র সে বিষয়ে কথা বলবার চেষ্টা করে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করে থাকে। এটি খুবই ইতিবাচক ও প্রশংসার দাবি রাখে। তবে ইদানিং দেখা যাচ্ছে যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন; লক্ষ্য করা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে ওইসব দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা মারাত্নক আকার ধারণ করে থাকে। আবার যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয় সেসব দেশে সহিংস ঘটনার অবতারণা হলেও যুক্তরাষ্ট্র সেসব আমলে নিচ্ছে না। মায়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক জাতি নিধনের ঘটনার পরেও যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে। আবার ফিলিস্তিনে ইসরায়েল কর্তৃক শিশু ও নারী হত্যার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনের পাশাপাশি ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞকে প্রকারান্তরে সমর্থন প্রদান বাকি বিশ্বের শান্তিকামী জনতা কেউই মেনে নিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, আত্নরক্ষার স্বার্থে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এ ধরনের অজুহাত ও অদ্ভুত যুক্তি আমাদের হচকচিত করেছে, স্তম্ভিত করেছে। এমন বিবেকহীন বিবৃতি ইসরায়েলকে আরও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছে, ক্ষণে ক্ষণে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতনের খড়গ অব্যাহত রেখেছে। অথচ বাকি পৃথিবী ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে এর ওপর মামলাও হয়েছে।

এসব কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা ও সমাদর নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও ঘৃণা দেখা দিয়েছে। মায়ানমারের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে একেবারে নিধন করে দিয়েছে মায়ানমারের সামরিক জান্তা এবং সেখানে মৌন সমর্থন ও সম্মতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট যেখানে একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে সেই জায়গায় তারা কোনোভাবেই সমাধানে উদ্যোগী না হয়ে উল্টো মানবাধিকার লঙ্ঘনকেই মৌন সমর্থন প্রদান করে। আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারে ও সাম্রাজ্যবাদ নীতি প্রতিষ্ঠায় শুরু থেকেই তৎপর ছিল এবং এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন ইস্যু ও স্পর্শকাতর বিষয়ে দ্বি-পাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের সূত্র ধরে মোড়লগিরি ধরে রাখার চেষ্টা করেছে অব্যাহতভাবে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে প্রকারান্তরে সাম্রাজ্যবাদের নীতিকে প্রতিষ্ঠা করার একটি অঘোষিত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তারা তাদের পরিকল্পনা মতো এগিয়েছে। যদিও বর্তমান সময়ে তাদের গৃহীত ও ঘোষিত বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ববাসী তাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে সহজেই অবগত হয়েছে। আবার অনেকেই এমনও বলে থাকে পৃথিবীর অনেক দেশে বিশেষ করে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদকে জিইয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের সংযুক্ততাকে দায়ী করে থাকেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বিশ্বব্যাপী অনেকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। গবেষকরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এ সংস্থার তথ্য উপাত্ত মূল্যায়ন করে গবেষণা কার্য সম্পাদনের চেষ্টা করে থাকেন। কিছুদিন আগে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের যুদ্ধের ওপর এ সংস্থাটির দাখিল করা প্রতিবেদনে ব্যাপক পক্ষপাতিত্বের স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। বিশেষ করে গবেষণা সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও ইসরায়েলের সরকারের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে ফিলিস্তিনের ভুক্তভোগীদের কোনোরূপ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়নি। এ সংক্রান্ত রিপোর্ট বের হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সমালোচনার ঝড় উঠে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিশ্বব্যাপী সব দেশের মানবাধিকার সংক্রান্ত জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার নিয়ে তেমন বিস্তারিত প্রতিবেদনে উঠে আসে না কিংবা ইচ্ছে করেই প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। এটি এক অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র ও অবস্থানকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক লক্ষণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার নিয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরলেও নিজের দেশের মানবাধিকার নিয়ে একেবারেই উদাসীন। যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত বিরতিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে, পুলিশের হেফাজতে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে। মানুষের মধ্যে অস্বস্তি ও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে, তথাপি সরকার কিংবা রাষ্ট্র এসবের বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট বর্তমান প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করে বলেছেন, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে নিজ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করুন। তিনি বলবার চেষ্টা করেছেন, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য সমর্থনের কারণেই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার তেমন আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে দেখা যায়, এ যুদ্ধের কারণে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে তদুপরি যুক্তরাষ্ট্রের বোধোদয় হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে নিজ দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, জানমালের সুরক্ষা, দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতি বজায় রাখা, অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া। সর্বোপরি বর্ণ, গোত্র বৈষম্যের ব্যবধান গুছিয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিতে কাজ করে যাওয়া।

কিছু দিন পর পর সংবাদমাধ্যমের বরাতে শোনা যায়, বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু পরবর্তী সংবাদে প্রতিকারমূলক কোনোরূপ ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে তেমন উল্লেখযোগ্য অর্জনের সংবাদ আমাদের গোচরীভূত হয় না। এর মানে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি রয়েছে, তা না হলে যে সংবাদমাধ্যমের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডের সংবাদ সম্বন্ধে আমরা জেনে থাকি সেই সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব হচ্ছে পরের সংবাদটুকুও প্রচার করা। যেহেতু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সময়ে কোনো সংবাদ গোচরীভূত হয়নি সেহেতু ধরে নেওয়া যায় এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হচ্ছে না। তাহলে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াই যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নীরবে নিভৃতে বিচারের বাণী ক্রন্দনে পর্যবসিত হয়ে থাকে। আমরা মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাদের দেশে অভিবাসী হয়ে যারা গমন করছে কিংবা তাদের দেশের স্থায়ী নাগরিক তাদের প্রত্যেকের মানবাধিকার নিশ্চিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া। কেননা রাষ্ট্রের মূল এবং মৌলিক কাজ হচ্ছে নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া এবং অধিকার নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেওয়া।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

মানবিক চিকিৎসক ডা. সাহিদা আখতার : শিশুদের বন্ধু, সমাজসেবক এবং গবেষক

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ০৩:০৪ পিএম
মানবিক চিকিৎসক ডা. সাহিদা আখতার : শিশুদের বন্ধু, সমাজসেবক এবং গবেষক
ড. মতিউর রহমান

আজ থেকে তিন বছর আগে ২০২১ সালের ১ মে সন্ধ্যায় আমাদের সবার প্রিয় ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার চিরতরে বিদায় নিয়েছিলেন। কয়েক মাস ধরে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার ফুলার রোডের বাসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে দেশের চিকিৎসাঙ্গনে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি হয়।

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন দক্ষ শিক্ষক, গবেষক এবং মানবিক চিকিৎসক। তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান ও চিকিৎসাসেবার উন্নতিতে উৎসর্গ করেছিলেন। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং তার ছাত্রছাত্রীরাও তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত।

ডা. সাহিদা আখতার বিশেষ করে শিশুদের চিকিৎসায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। নবজাতক শিশুদের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এবং তাদের জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার মানবিক মনোভাব ও সহানুভূতির জন্য তিনি শিশুদের মাঝে ‘শিশুদের বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তিত্ব। রোগীদের প্রতি তার আন্তরিকতা ও সহানুভূতি তাকে সবার কাছে সমাদৃত করে তুলেছিল। দরিদ্র ও অসহায় মানুষের চিকিৎসায় তিনি সর্বদা সাহায্য করতেন এবং তাদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাও দিতেন।

ডা. সাহিদা আখতার ১৯৬১ সালে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারীতে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি পর্যায়েই তিনি তার অসাধারণ মেধা ও কৃতিত্বের মাধ্যমে সবাইকে মুগ্ধ করেছিলেন। ১৯৮৪ সালে তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন এ কলেজের পঞ্চম ব্যাচের একজন ছাত্রী।

এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর ডা. সাহিদা আখতার বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস ও সার্জনস থেকে এফসিপিএস ডিগ্রি লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি পেশাগত উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন খ্যাতিমান শিশুবিশেষজ্ঞ, যিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় শিশুদের সুস্থতা ও কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক্স বিভাগের অধ্যাপক এবং বারডেম জেনারেল হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটের প্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ শিশুবিশেষজ্ঞ হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন।

ডা. সাহিদা আখতার
ডা. সাহিদা আখতার

শুধু ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও বারডেম হাসপাতালেই নয়, ডা. সাহিদা আখতার দেশের বিভিন্ন খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল (অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন, ইন সার্ভিস ট্রেইনি); ঢাকা শিশু হাসপাতাল; আইপিজিএমআর (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়); ডা. কাশেমস ক্লিনিক ও হাসপাতাল, কুষ্টিয়া; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (লেডি ডাক্তার), ইত্যাদি।

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন দেশের একজন প্রখ্যাত শিশুবিশেষজ্ঞ, যিনি তার জীবনের প্রায় তিন দশক নবজাতক শিশুদের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন দেশের নবজাতক স্ক্রিনিং টেস্ট প্রোগ্রামের একজন পথিকৃৎ, যা শিশুদের জন্মের পরপরই নির্দিষ্ট কিছু বংশগত রোগের জন্য পরীক্ষা করে।

নিউবর্ন স্ক্রিনিং টেস্ট হল জেনোমিক মেডিসিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যা শিশুদের জন্মের পরপরই কিছু গুরুতর বংশগত রোগ শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এই রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ফেনাইলকেটোনিউরিয়া (PKU), হাইপোথাইরয়েডিজম এবং অ্যাড্রেনাল কনার্টিকাল হাইপারপ্লাসিয়া (CAH)। যদি এই রোগগুলো শিশুদের জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা হয় এবং চিকিৎসা করা হয়, তবে তাদের সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনযাপন করা সম্ভব।

ডা. সাহিদা আখতার বাংলাদেশে নবজাতক স্ক্রিনিং টেস্ট প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি এই প্রোগ্রামের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এবং এর ব্যাপক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে কাজ করেছিলেন। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে, বাংলাদেশে নবজাতক স্ক্রিনিং টেস্ট একটি জাতীয় পর্যায়ের প্রোগ্রামে পরিণত হয়েছে যা প্রতি বছর লাখ লাখ শিশুর জীবন রক্ষা করছে।

ডা. সাহিদা আখতার শিশুদের শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ, হাঁপানি, বুকের দুধ খাওয়ানোর অনুশীলন, নবজাতকের প্রয়োজনীয় যত্ন, জন্মের সময় নবজীবন সঞ্চার, উন্নত কার্ডিয়াক লাইফ সাপোর্ট, এইচবিবি (শিশুদের শ্বাস নিতে সহায়তা করা), ইসিডি (প্রাথমিক শৈশব বিকাশ), পিএনডিএ (পেরিনিটাল ডেথ অডিট) ইত্যাদি বিষয়ে নিবিড় প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এই জ্ঞান ও দক্ষতা তার চিকিৎসা অনুশীলনে প্রভাব ফেলেছিল এবং তাকে শিশুদের জন্য একজন নির্ভরযোগ্য ও দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

শিশুদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের উন্নতিতে অবদান রাখার জন্য ডা. সাহিদা আখতার শুধু চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ থাকেননি। ওপরে উল্লিখিত বিষয়গুলোতে তার গবেষণা কাজও উল্লেখযোগ্য ছিল। তার গবেষণা ফলাফল শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণা ব্যতীতও তিনি ছিলেন একজন সচেতন সমাজ গবেষক। দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন এবং মৌলিক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন। তার রচিত মৌলিক গবেষণা ও সেমিনারে/ওয়ার্কশপে উপস্থাপিত ও প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৫০-এর বেশি।

ডা. সাহিদা আখতার নিরলস পরিশ্রম করেছেন নবজাতক শিশুদের রোগাক্লান্ত মুখে হাসি ফোটাতে। তিনি কেবল চিকিৎসায়ই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং নিয়মিত চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডেও সদাসক্রিয় ছিলেন। শিশুদের ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মাতৃদুগ্ধপানে মায়েদের উদ্বুদ্ধকরণ সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে তার বিশেষ অবদান ছিল।

শিশুস্বাস্থ্যের নানা বিষয় ছাড়াও একিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন, এন্ডোক্রাইনোলজি এবং জিনোমিক্সও ছিল ডা. সাহিদা আখতারের আগ্রহের জায়গা। নিওনেটোলজি, প্রারম্ভিক শৈশব বিকাশ, জেনেটিকস, জিনোমিক মেডিসিন, মা ও শিশু মৃত্যু এবং অসুস্থতা, শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যের সামাজিক মাত্রা, পানীয় জলে আর্সেনিক প্রশমন-সনোফিল্টার ইত্যাদি বিষয়েও তিনি কাজ করেছেন।

ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক। তিনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের মাধ্যমে এ দেশের গরিব-দুঃখী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। তিনি বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন (দায়িত্ব গ্রহণের আগেই মৃত্যুবরণ করেন)। এ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সহসভাপতি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া, তিনি ছিলেন বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরামের নির্বাচিত সহসভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ পেরিনেটাল সোসাইটির নির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য, বাংলাদেশ অ্যাজমা অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের জীবন সদস্য, ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের জীবন সদস্য, ইয়ং ডায়াবেটিক ওয়েলফেয়ার সোসাইটির জীবন সদস্য। এসব সংগঠনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এ দেশের শিশু চিকিৎসা শাস্ত্রকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

ডা. সাহিদা আখতারের ব্যক্তিগত জীবন ছিল সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ। তিনি বিখ্যাত গবেষক ও অর্থনীতি শাস্ত্রের অধ্যাপক আবুল বারকাতের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। তিনি শুধু একজন স্ত্রীই ছিলেন না, বরং একজন সঙ্গী, বন্ধু এবং সহকর্মীও ছিলেন। তাদের তিন কন্যা সন্তান রয়েছে।

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন মানবিক এবং বিনয়ী ব্যক্তিত্ব। রোগী, শিক্ষার্থী, সহকর্মী- সবার কাছেই তিনি ছিলেন সম্মানিত ও প্রিয়। তিনি ছিলেন একজন অনুপ্রেরণাদায়ক শিক্ষক যিনি তার ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করেছেন এবং তাদের ভালো চিকিৎসক হতে সাহায্য করেছেন।

তার মৃত্যুর পর অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতারের স্বামী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের সম্পাদনায় ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার আত্মজীবনী ‘অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার একজন শিশুচিকিৎসকের যাপিত জীবন’। যে কেউ এ জীবনীগ্রন্থ পড়ে তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন ও অনুপ্রাণিত হবেন।

অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার চলে গেলেও তার অবদান ও স্মৃতি আমাদের অন্তরে চির অমলিন হয়ে থাকবে। একজন দক্ষ শিশুবিশেষজ্ঞ, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক এবং মানবিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি আমাদের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।

তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তার আত্মার শান্তির জন্য আমাদের সবার প্রার্থনা।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]

নৃত্যে মুক্তির সুর

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩৬ পিএম
নৃত্যে মুক্তির সুর

‘আমাদের দেহ বহন করে অঙ্গপ্রতঙ্গের ভার, আর তাকে চালনা করে অঙ্গপ্রতঙ্গের গতিবেগ। এই দুই বিপরীত পদার্থ যখন পরস্পরের মিলনে লীলায়িত হয় তখন জাগে নাচ। দেহের ভারটাকে দেহের গতি নানা ভঙ্গিতে বিচিত্র করে। জীবিকার প্রয়োজনে নয়, সৃষ্টির অভিপ্রায়ে দেহটাকে দেয় চলমান শিল্পরূপ। তাকে বলি নৃত্য।’(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

দেহ ছন্দের তালে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে শারীরিক বিন্যাস। যে ছন্দ নিতান্তই আপন, তাতে থাকে না কোনো বাধা। সে আপন লয়ে, আপন ভঙ্গিতে বাঁধে শারীরিক ভাষা। সেই ভাষায় যখন যুক্ত হয় প্রকৃতির নিয়ম তখন তা রূপ নেয় ভাববোধের।

মানুষের জন্মের সঙ্গে সৃষ্টি নৃত্যের। এই নৃত্য কোনো নাম ধরে বেঁধে দেওয়া নৃত্য নয়। এই নৃত্য হলো ছন্দময় নৃত্য। শিশু যখন প্রথম হামাগুঁড়ি দিতে শুরু করে তারপর দুই পা, দুই হাতের সাহায্যে হাঁটতে চেষ্টা করে, তখন যে আন্দোলন তৈরি হয় তা হলো প্রাথমিক ছন্দ। সেই ছন্দে পতন ঘটলে যেমন সে দাঁড়াতে পারে না, তেমনই নৃত্যশিল্পীর দেহের বিন্যাস হলো তার ছন্দ। এই দেহে কখনো আমরা নমনীয় ভাব (লাস্য), আবার কখনো রৌদ্র (তাণ্ডব ভাব) দেখি। লাস্য শব্দটি বিলাস অর্থে ব্যবহৃত হয় নাট্যশাস্ত্রে। তাণ্ডব শৃঙ্গার রস থেকে সৃষ্ট; যার প্রয়োগ সুকুমার ও লীলায়িত গতিবিশিষ্ট। অভিনয় দর্পণের মতে যে নর্তনের করণ ও অঙ্গহারগুলো উদ্ধত এবং বৃত্তি আরভটি। এই লাস্য এবং তাণ্ডব ভঙ্গি কেবলমাত্র ভাবের দ্বারা সৃষ্টি। এই ভাববোধ পুরুষ এবং নারী যেকোনো শরীরের আন্দোলনের দ্বারা সৃষ্টি হতে পারে। এর শারীরিক ভাষা হলো নৃত্য। নৃত্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রাণীজাতির জীবনচক্র। পশুপাখি, প্রতিটি প্রাণীর দেহের বিভিন্ন গতির মধ্যে লুকিয়ে আছে নৃত্যের ভাষা। হস্তভেদ, বাহুভেদ, পদভেদ, গ্রীবাভেদ, শিরভেদ, কটিভেদ দ্বারা শাস্ত্রমতে নৃত্যের প্রয়োগ করা হয়েছে। এই প্রয়োগ দ্বারা শাস্ত্রমতে শাস্ত্রীয় নৃত্যের সৃষ্টি। এই প্রয়োগ ঘটিয়ে একজন নৃত্যশিল্পী তার দেহের গঠন তৈরি করতে পারেন। শিল্পীর দেহের প্রয়োগ আপন ভঙ্গিতে যখন আন্দোলিত হতে থাকে, তার মধ্যে কোনো নিয়ম থাকে না। সেখানে থাকে শুধু ভাব প্রকাশের ক্রিয়া।

শিল্পচর্চা যখন কোনো সভ্য সমাজের মধ্যে ঘটে, তার মধ্যে সেই সমাজের, সেই জাতির পরিচয়, উৎস ও ভূমিকা লুকিয়ে থাকে। তারা প্রতিদিন চলতে থাকা তাদের জীবনচর্চাকে সংস্কৃতির রূপ দিয়ে থাকেন। সেই সংস্কৃতিচর্চা করা শিল্পী আধ্যাত্মিক ভাব, ভক্তি ও বিশ্বাসের সম্মিলিত ভাব দ্বারা তাদের সংস্কৃতি চর্চা করে থাকে। সেই সমাজে চলতে থাকা অনুষ্ঠান দ্বারা সেই সমাজের নৃত্যশিল্পীরা অগোচরে শাস্ত্রীয় নৃত্যের দেহ গঠনের ভেদগুলো চর্চা করতে থাকে। এগুলো তাদের নানা অনুষ্ঠানের অংশ। আবার একজন শিল্পী যিনি স্বেচ্ছায় নৃত্যশিল্পী হওয়ার জন্য নিজেকে সমৃদ্ধ করতে থাকেন, সেই শিল্পী শাস্ত্রীয় ভেদগুলোর প্রশিক্ষণ নেন, সম্পূর্ণ নৃত্যশিল্পী রূপে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য। এই দুই প্রেক্ষাপটে থাকা নৃত্যশিল্পীর শারীরিক ভঙ্গি ও মানসিক ভাবের স্থানটা একই সূত্রে বাঁধা। নৃত্যের প্রেক্ষাপট কোথাও ভেদ হিসেবে, কোথাও শাস্ত্র ও সাহিত্যে, কোথাও দেহের আন্দোলনের প্রয়োগে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় বহন করে।

নৃত্যের একটি নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যেখানে আছে স্বাধীনভাবে চলার আনন্দ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে সাধনা বলতে সাধারণত মানুষ আধ্যাত্মিক মুক্তির সাধনা, সন্ন্যাসের সাধনা বোঝে। আমি যে সংকল্প নিয়ে শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি, তা মানুষের চিত্ত উৎকর্ষের জন্য।’ তার এই উক্তি দ্বারা বোঝা যায়, তিনি নৃত্য, সংস্কৃতি ও সৃজনশীল চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনো অনৈতিহাসিক বা অবৈজ্ঞানিক মানসিকতার ছিলেন না। তিনি নৃত্য সৃষ্টির জন্য কোনো দেবতার কথা কল্পনা করেননি। তার নৃত্য সৃষ্টি ছিল মনের ভিতরের ভাবকে শরীরী ছন্দে প্রকাশ ঘটানো। নৃত্য ভাবনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন– ‘মানুষ তার প্রথম ছন্দের সৃষ্টিকে জাগিয়েছে আপনদেহে, কেননা তার দেহ ছন্দরচনার উপযোগী, আবার নৃত্যকলার প্রথম ভূমিকা দেহসঞ্চালনের অর্থহীন সুষমায়, তাতে কেবলমাত্র ছন্দের আনন্দ।’

সৃজনশীল চিন্তা, শারীরিক বিন্যাসের দ্বারা সৃষ্ট নৃত্যকার হলেন ভারতের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর। ভারতীয় সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তার নৃত্যে। শরীরি প্রতিটি অঙ্গপ্রতঙ্গের চলন দ্বারা নৃত্যের ভাষায় যে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তার পরিপূর্ণ রূপের প্রতিচ্ছবি হলো তার নৃত্য। নৃত্যশিল্পীর শারীরিক ভঙ্গি, তার সঙ্গে তার অভিনয় মিলিয়ে যে আন্দোলন তৈরি হয়, তা ছিল তার নৃত্যের ভাষা। এ ভাষা ছিল সাবলীল, যেখানে চলতে জীবনচক্রের প্রতিটা পদক্ষেপ।

বিখ্যাত আমেরিকান নৃত্যশিল্পী মার্থা গ্রাহামের কাছে নাচ ছিল কথ্য নাটকের মতো। মানুষের আধ্যাত্মিক ভাব এবং মানসিক চিন্তাশক্তি অন্বেষণ করার মাধ্যমে তিনি নৃত্য রচনা করতেন। তিনি সর্বদা মানুষের মনের ভিতর চলতে থাকা দ্বন্দ্ব এবং আবেগের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। তার নাচের প্রতিকৃতিগুলোর চরিত্র থেকে অভ্যন্তরীণ আবেগময় জীবন অন্বেষণ করতে তিনি ব্যর্থ হননি। তিনি আমেরিকান সীমান্ত জীবন থেকে কিছু নাচ তৈরি করেছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ‘অ্যাপলাচিয়ান স্প্রিং’ (১৯৪৪)। বাইবেলের থিম এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি যে কৌশল অবলম্বনে নৃত্য রচনা করতেন তা ছিল আধুনিক নৃত্যের উন্নত শারীরিক-প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, যার জন্য নিরলস নিয়মানুবর্তিতা এবং অসাধারণ দক্ষতা উভয়েরই প্রয়োজন ছিল।

সমৃদ্ধ, জ্ঞানী নৃত্যশিল্পীরা যেমন তাদের নৃত্য চর্চা দ্বারা, নৃত্যের জ্ঞান দ্বারা নৃত্যের আলোমাখা পথে নতুন আলোর সূচনা করে চলেছে, তেমনই গ্রামবাংলার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে নৃত্যের সম্পূর্ণ এক আপন রূপ। সেখানে নৃত্যের প্রতিনিয়ত প্রকাশ হচ্ছে মুক্তবিহঙ্গের মতো। কখনো সে সেই সমাজের কাহিনি বর্ণনা করছে বেহুলারূপে, কখনো কৃষ্ণ বা রাধা রূপে ধর্মীয়ভাবের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। কখনো গানে গানে করতালি দিয়ে জানাচ্ছে আনন্দবার্তা। আবার কখনো অস্ত্র হাতে নিয়ে আত্মরক্ষার মাধ্যম হিসেবে করছে তার বহিঃপ্রকাশ।

নৃত্যের কোনো ভাষা নেই, জাতি নেই, বর্ণ নেই। শুধু আছে শারীরিক চলন; যেই চলন দিয়ে একজন শিল্পী তার মনের সব ভাব প্রকাশ করতে পারে সাবলীলভাবে। তাই নৃত্য হলো উন্মুক্ত; যেখানে রয়েছে প্রাণের স্পন্দন। জীবনের ছন্দে চলতে থাকা প্রতি ছন্দ নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে চলতে থাকে তার মুক্ত সুরে। তাই তো মনুষ্য সমাজের নান্দনিক শিল্পকলার মধ্যে নৃত্যকলা হলো প্রাচীনতম কলা। নৃত্যের যে সাবলীল রূপ আছে তা ব্যক্তিবিশেষে প্রকাশ ঘটে। তাই তো নৃত্য স্বাধীন। তার যে আপন চলন আছে তার সুর গাঁথা মুক্তির সুরে। সমস্ত জগতের প্রাণের সুর হয়ে বাঁধা এই নৃত্য। নৃত্যকে জানার জন্য প্রচুর জ্ঞানের প্রয়োজন নেই, শুধু প্রয়োজন তাকে উপলব্ধি করা। তাই তো নৃত্যের মধ্যে রয়েছে মুক্তির সুর।

লেখক: শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী ও গবেষক

গণপরিবহন ও আমাদের বিবেক

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৪৯ পিএম
গণপরিবহন ও আমাদের বিবেক
পপি রানী বাড়ৈ

গণপরিবহনে সংরক্ষিত মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধী আসনগুলো শুধুই তাদের জন্য। তবে সংরক্ষিত ছাড়া বাকি আসনগুলোতে আপনি, আমি, শিশু, প্রতিবন্ধী সবারই বসার সুযোগ রয়েছে। এ নিয়ে আইনও ও জরিমানার কথা বলা আছে। নারী, শিশু কিংবা প্রতিবন্ধীরা দাঁড়িয়ে না থাকলে যদি সংরক্ষিত আসনগুলো খালি থাকে তখন পুরুষ যাত্রীরা নিশ্চই সেখানে বসতে পারেন। তবে বিপত্তিটা তখনই ঘটে, যখন বাসভর্তি পুরুষ যাত্রীদের মধ্যে নারীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও তাদের জন্য নির্ধারিত আসনে পুরুষরা বসে থাকেন।…

অফিস শেষে বাংলামোটর মোড় থেকে দ্রুত বাসে উঠে পড়লাম। গন্তব্য বাড়ি। বাসের দরজার সামনে দাঁড়ালাম। ভালোভাবে চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম বাসের একটি আসনও খালি নেই। বাসের পেছন থেকে দরজা পর্যন্ত গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছেন পুরুষযাত্রীরা। এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় খুব ভালোভাবেই লক্ষ্য করলাম নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত ছয়টি আসনের (বাস ভেদে ৯ থেকে ১৫টি আসন সংরক্ষিত খাকে) চারটিতেই বসে আছেন পুরুষ যাত্রী। তাদেরকে কিছু বলতে গিয়েও আর বললাম না।

এর মধ্যেই আরও কিছু পুরুষ যাত্রী হুড়মুড়িয়ে বাসে ওঠার চেষ্টা করলেন। তবে বাস ভর্তি থাকায় এবং আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় তারাও কোনোমতে দরজা ধরে দাঁড়ালেন। সেখান থেকে এক ভাই হঠাৎ আমাকে বলে উঠলেন, ‘আপা, মহিলাদের সিটে বেডারা বইয়া আছে। উঠে আপনারে জায়গা দিতে কন।’ আমিও সভয়ে নারীদের আসনে বসে থাকা একজনকে বললাম, ভাই এগুলোতো সংরক্ষিত আসন। এখানে বসেছেন কেন?

সেখান থেকে এক ভাই আমার দিকে একনজর তাকিয়ে মাথা ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর মগ্ন হলেন জানালা দিয়ে রাস্তার যানজটের দৃশ্য উপভোগ করতে। তার পাশের যাত্রীও মনে হলো জানালা দিয়ে তাকিয়ে আকাশের বিশালতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন! তাদের আচরণে মনে ব্যথা অনুভব করলাম। আস্তে আস্তে বললাম ‘এতগুলো ছেলের মধ্যে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছি তাও উনাদের একটু বিবেকবোধ কাজ করছে না।’

কথাগুলো সে দুই যাত্রীর কান পর্যন্ত না পৌঁছালেও চালকের ঠিক পেছনের আসনে বসা আরেকজনের অহংবোধকে বেশ জোরেশোরে নাড়া দিল! তাই আমাকে বসতে না দিয়ে (আমার ওপর কিছুটা ক্ষোভ থেকে ও ছোট করার উদ্দেশ্যে) আমার পেছনে থাকা এক যাত্রীকে ডেকে বললেন, ‘ভাই আমি কারওয়ার বাজার নেমে যাব, আসেন আসেন আপনি আমার সিটে এসে বসেন।’ আমার পেছনের যাত্রীটি বললেন, ‘না আমি বসবো না। আপাকে বসতে দেন।’ পরে তিনি (চালকের পেছনে বসা সেই যাত্রী) আমাকে বললেন, ‘ঠিক আছে তাহলে আপনিই বসেন।’ আমি বললাম, ‘এতক্ষণ আমার পেছনের ভাইকে ডেকে এখন আমাকে বসতে বলছেন কেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আপনারা যখন পুরুষদের সিটে বসেন তখন তো আপনাদের উঠিয়ে দিই না আমরা।’ একথা বলেই তিনি বিজয়ের হাসি দিলেন। আমাকে এ কথা শোনাতে পেরে যেন গর্ববোধ করলেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাসে কি আদৌ পুরুষ আসন আছে? আমি তাকে বললাম, আপনার হয়তো জানা নেই আপনি যেগুলোকে ‘পুরুষ সিট’ বলছেন সেগুলো আসলে ‘জেনারেল সিট’ অর্থাৎ নারী-পুরুষসহ সবার। এ তো গেল সাধারণ একটি ঘটনা। প্রতিটি পাবলিক বাসে লুকিয়ে আছে হাজারো নারীর ভিন্ন ভিন্ন অসহায়ত্বের গল্প।

ঢাকা শহরের হাজারো সমস্যার মধ্যে পাবলিক বাস নারীদের জন্য একটি আতঙ্কের নাম। কারণ এসব বাসগুলোতে বুলিং থেকে শুরু করে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে।

এদের মধ্যে সংরক্ষিত আসন নিয়ে ঝামেলা তো নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতিদিনই কিছু যাত্রীর কমন ডায়ালগ থাকে। যেমন- ‘বাসে টাকা দিয়ে উঠেছি সিট ছড়বো কেন? জায়গা নাই তো বাসে উঠছেন কেন? সব জায়গায় নারী-পুরুষ সমান অধিকার তাহলে বাসে উঠলে কেন বাড়তি সুবিধা চান?’ আমিও বলতে চাই, বাসে কেন বাড়তি সুবিধা চাইব আমরা? উত্তরটা সহজ। কিছু সংখ্যক পুরুষের তৈরি বাড়তি কিছু অসুবিধার কারণেই আমরা সুবিধা চাইব।

বাসের সংরক্ষিত মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধী আসনগুলো শুধুই তাদের জন্য। আপনি পুরুষ চাইলেই সেখানে বসার দাবি করতে পারবেন না। তবে সংরক্ষিত ছাড়া বাকি আসনগুলোতে আপনি, আমি, শিশু, প্রতিবন্ধী সবাই বসতে পারি। এ নিয়ে আইন পাশ হয়েছে, জরিমানার কথা বলা আছে। থাক... সে প্রসঙ্গে গেলাম না। নারী, শিশু কিংবা প্রতিবন্ধীরা দাড়িয়ে না থাকলে যদি সংরক্ষিত আসনগুলো খালি থাকে তখন পুরুষ যাত্রীরা নিশ্চই সেখানে বসতে পারেন, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। তবে বিপত্তিটা তখনই ঘটে, যখন বাসভর্তি পুরুষ যাত্রীদের মধ্যে নারীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও তাদের জন্য নির্ধারিত আসনে পুরুষেরা বসে থাকেন।

বিষয়টা একটু উল্টো করে দেখুন তো। যদি আপনার মা-মেয়ে, স্ত্রী কিংবা বোন পুরুষ যাত্রীদের মাঝে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতো। কিছু পুরুষ যদি নানা বাহানায় তাদের স্পর্শকাতর স্থানগুলো ছুয়ে দিত। তখনও কি আপনি সংরক্ষিত আসনে পুরুষদের বসে থাকতে বলতেন? কাউকে জানালা দিয়ে আকাশের বিশালতায় হারিয়ে যেতে দেখে কিংবা ঢাকা শহরের যানজটকেও দুনিয়ার সবচেয়ে উপভোগ্য দৃশ্য মনে করা যাত্রীর আচরণে তৃপ্তির হাসি দিতেন। আপনি কি বলতেন টাকা দিয়ে উঠেছেন ভাই সিট ছাড়বেন না? মা, মহিলা সিট বলে হৈ চৈ করতেন? উত্তারটা আমি জানি। নিসন্দেহে ‘না’। কারণ আপনি আপনার মা, বোন, সন্তানকে শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন। তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে সহানুভূতির এত অভাব কেন?

তবে এর ব্যতিক্রম চিত্রও আছে। বাসে নারীদের বেহাল দশা দেখে কিছু যাত্রীভাইকে জেনারেল আসন ছেড়ে দিতে দেখেছি। দেখেছি সিটের মাঝে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসতে। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা।

এ তো গেল পুরুষের কথা। আমরা নারীরাও কিন্তু মাঝে মাঝে পুরুষের চেয়ে কম তা নয়। প্রতিটি পাবলিক বাসে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বাস ভেদে ৯ থেকে ১৩টি পর্যন্ত সংরক্ষিত আসন রয়েছে। অর্থাৎ তিন ধরনের মানুষের জন্য আসনগুলো সংরক্ষিত। তবে নির্দিষ্ট করে যেহেতু স্টিকার দেওয়া বা লেখা থাকে না কোন আসনগুলো প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য, তাই সবাই বিশেষ করে নারীরা ভেবেই নেন এগুলো শুধু তাদের জন্য সংরক্ষিত। এতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন যাত্রীরা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও তাদের জন্য আসন ছেড়ে দেন না। চালক বা তার সহকারীও প্রতিবন্ধী যাত্রীদের আসনগুলো ছাড়তে বললে নারীরা তা ছাড়েন না। এই ধরণের নারীরা যেন কারো কথা গায়েই মাখেন না। গায়ে মাখাবেনই বা কেন? দেখতে শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও তারা হয়তো মনে মনে নিজেদের প্রতিবন্ধীই ভাবেন!

আসলে আমরা দিনে দিনে সামান্য সহানুভূতির জায়গাটুকুও বিসর্জন দিয়ে ফেলছি। সভা-সেমিনারে বড় বড় কথা বলছি, মানবিকতার মহান বুলি আওড়াচ্ছি। তবে কাজের বেলায় তার কোনো প্রতিফলন নেই। বিবেকবোধটা আসলে কোথায়? যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক থেকে আধুনিকতর হওয়ার প্রতিযোগিতা করছি। কিন্তু মানুষ কোথায় হচ্ছি?

জীবন সে তো দূর্বা ঘাসের উপর জমে থাকা দুফোটা শিশির বিন্দু। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই যা বাষ্পীভূত হয়ে যায়। তাই চলুন না ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে আমারা এক অন্যের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হই। নারী-পুরুষ দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে, একে অন্যের সহযোগী হই। সম্মান করি প্রতিটি মা-বাবা-ভাই-বোনকে। সহজ করে দেই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষগুলোর চলার পথকে। শুরুটা হোক পাবলিক বাস থেকেই।

লেখক: সংবাদকর্মী ও শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]