‘আমাদের দেহ বহন করে অঙ্গপ্রতঙ্গের ভার, আর তাকে চালনা করে অঙ্গপ্রতঙ্গের গতিবেগ। এই দুই বিপরীত পদার্থ যখন পরস্পরের মিলনে লীলায়িত হয় তখন জাগে নাচ। দেহের ভারটাকে দেহের গতি নানা ভঙ্গিতে বিচিত্র করে। জীবিকার প্রয়োজনে নয়, সৃষ্টির অভিপ্রায়ে দেহটাকে দেয় চলমান শিল্পরূপ। তাকে বলি নৃত্য।’(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
দেহ ছন্দের তালে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে শারীরিক বিন্যাস। যে ছন্দ নিতান্তই আপন, তাতে থাকে না কোনো বাধা। সে আপন লয়ে, আপন ভঙ্গিতে বাঁধে শারীরিক ভাষা। সেই ভাষায় যখন যুক্ত হয় প্রকৃতির নিয়ম তখন তা রূপ নেয় ভাববোধের।
মানুষের জন্মের সঙ্গে সৃষ্টি নৃত্যের। এই নৃত্য কোনো নাম ধরে বেঁধে দেওয়া নৃত্য নয়। এই নৃত্য হলো ছন্দময় নৃত্য। শিশু যখন প্রথম হামাগুঁড়ি দিতে শুরু করে তারপর দুই পা, দুই হাতের সাহায্যে হাঁটতে চেষ্টা করে, তখন যে আন্দোলন তৈরি হয় তা হলো প্রাথমিক ছন্দ। সেই ছন্দে পতন ঘটলে যেমন সে দাঁড়াতে পারে না, তেমনই নৃত্যশিল্পীর দেহের বিন্যাস হলো তার ছন্দ। এই দেহে কখনো আমরা নমনীয় ভাব (লাস্য), আবার কখনো রৌদ্র (তাণ্ডব ভাব) দেখি। লাস্য শব্দটি বিলাস অর্থে ব্যবহৃত হয় নাট্যশাস্ত্রে। তাণ্ডব শৃঙ্গার রস থেকে সৃষ্ট; যার প্রয়োগ সুকুমার ও লীলায়িত গতিবিশিষ্ট। অভিনয় দর্পণের মতে যে নর্তনের করণ ও অঙ্গহারগুলো উদ্ধত এবং বৃত্তি আরভটি। এই লাস্য এবং তাণ্ডব ভঙ্গি কেবলমাত্র ভাবের দ্বারা সৃষ্টি। এই ভাববোধ পুরুষ এবং নারী যেকোনো শরীরের আন্দোলনের দ্বারা সৃষ্টি হতে পারে। এর শারীরিক ভাষা হলো নৃত্য। নৃত্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রাণীজাতির জীবনচক্র। পশুপাখি, প্রতিটি প্রাণীর দেহের বিভিন্ন গতির মধ্যে লুকিয়ে আছে নৃত্যের ভাষা। হস্তভেদ, বাহুভেদ, পদভেদ, গ্রীবাভেদ, শিরভেদ, কটিভেদ দ্বারা শাস্ত্রমতে নৃত্যের প্রয়োগ করা হয়েছে। এই প্রয়োগ দ্বারা শাস্ত্রমতে শাস্ত্রীয় নৃত্যের সৃষ্টি। এই প্রয়োগ ঘটিয়ে একজন নৃত্যশিল্পী তার দেহের গঠন তৈরি করতে পারেন। শিল্পীর দেহের প্রয়োগ আপন ভঙ্গিতে যখন আন্দোলিত হতে থাকে, তার মধ্যে কোনো নিয়ম থাকে না। সেখানে থাকে শুধু ভাব প্রকাশের ক্রিয়া।
শিল্পচর্চা যখন কোনো সভ্য সমাজের মধ্যে ঘটে, তার মধ্যে সেই সমাজের, সেই জাতির পরিচয়, উৎস ও ভূমিকা লুকিয়ে থাকে। তারা প্রতিদিন চলতে থাকা তাদের জীবনচর্চাকে সংস্কৃতির রূপ দিয়ে থাকেন। সেই সংস্কৃতিচর্চা করা শিল্পী আধ্যাত্মিক ভাব, ভক্তি ও বিশ্বাসের সম্মিলিত ভাব দ্বারা তাদের সংস্কৃতি চর্চা করে থাকে। সেই সমাজে চলতে থাকা অনুষ্ঠান দ্বারা সেই সমাজের নৃত্যশিল্পীরা অগোচরে শাস্ত্রীয় নৃত্যের দেহ গঠনের ভেদগুলো চর্চা করতে থাকে। এগুলো তাদের নানা অনুষ্ঠানের অংশ। আবার একজন শিল্পী যিনি স্বেচ্ছায় নৃত্যশিল্পী হওয়ার জন্য নিজেকে সমৃদ্ধ করতে থাকেন, সেই শিল্পী শাস্ত্রীয় ভেদগুলোর প্রশিক্ষণ নেন, সম্পূর্ণ নৃত্যশিল্পী রূপে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য। এই দুই প্রেক্ষাপটে থাকা নৃত্যশিল্পীর শারীরিক ভঙ্গি ও মানসিক ভাবের স্থানটা একই সূত্রে বাঁধা। নৃত্যের প্রেক্ষাপট কোথাও ভেদ হিসেবে, কোথাও শাস্ত্র ও সাহিত্যে, কোথাও দেহের আন্দোলনের প্রয়োগে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় বহন করে।
নৃত্যের একটি নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যেখানে আছে স্বাধীনভাবে চলার আনন্দ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে সাধনা বলতে সাধারণত মানুষ আধ্যাত্মিক মুক্তির সাধনা, সন্ন্যাসের সাধনা বোঝে। আমি যে সংকল্প নিয়ে শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি, তা মানুষের চিত্ত উৎকর্ষের জন্য।’ তার এই উক্তি দ্বারা বোঝা যায়, তিনি নৃত্য, সংস্কৃতি ও সৃজনশীল চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনো অনৈতিহাসিক বা অবৈজ্ঞানিক মানসিকতার ছিলেন না। তিনি নৃত্য সৃষ্টির জন্য কোনো দেবতার কথা কল্পনা করেননি। তার নৃত্য সৃষ্টি ছিল মনের ভিতরের ভাবকে শরীরী ছন্দে প্রকাশ ঘটানো। নৃত্য ভাবনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন– ‘মানুষ তার প্রথম ছন্দের সৃষ্টিকে জাগিয়েছে আপনদেহে, কেননা তার দেহ ছন্দরচনার উপযোগী, আবার নৃত্যকলার প্রথম ভূমিকা দেহসঞ্চালনের অর্থহীন সুষমায়, তাতে কেবলমাত্র ছন্দের আনন্দ।’
সৃজনশীল চিন্তা, শারীরিক বিন্যাসের দ্বারা সৃষ্ট নৃত্যকার হলেন ভারতের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর। ভারতীয় সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তার নৃত্যে। শরীরি প্রতিটি অঙ্গপ্রতঙ্গের চলন দ্বারা নৃত্যের ভাষায় যে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তার পরিপূর্ণ রূপের প্রতিচ্ছবি হলো তার নৃত্য। নৃত্যশিল্পীর শারীরিক ভঙ্গি, তার সঙ্গে তার অভিনয় মিলিয়ে যে আন্দোলন তৈরি হয়, তা ছিল তার নৃত্যের ভাষা। এ ভাষা ছিল সাবলীল, যেখানে চলতে জীবনচক্রের প্রতিটা পদক্ষেপ।
বিখ্যাত আমেরিকান নৃত্যশিল্পী মার্থা গ্রাহামের কাছে নাচ ছিল কথ্য নাটকের মতো। মানুষের আধ্যাত্মিক ভাব এবং মানসিক চিন্তাশক্তি অন্বেষণ করার মাধ্যমে তিনি নৃত্য রচনা করতেন। তিনি সর্বদা মানুষের মনের ভিতর চলতে থাকা দ্বন্দ্ব এবং আবেগের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। তার নাচের প্রতিকৃতিগুলোর চরিত্র থেকে অভ্যন্তরীণ আবেগময় জীবন অন্বেষণ করতে তিনি ব্যর্থ হননি। তিনি আমেরিকান সীমান্ত জীবন থেকে কিছু নাচ তৈরি করেছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ‘অ্যাপলাচিয়ান স্প্রিং’ (১৯৪৪)। বাইবেলের থিম এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি যে কৌশল অবলম্বনে নৃত্য রচনা করতেন তা ছিল আধুনিক নৃত্যের উন্নত শারীরিক-প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, যার জন্য নিরলস নিয়মানুবর্তিতা এবং অসাধারণ দক্ষতা উভয়েরই প্রয়োজন ছিল।
সমৃদ্ধ, জ্ঞানী নৃত্যশিল্পীরা যেমন তাদের নৃত্য চর্চা দ্বারা, নৃত্যের জ্ঞান দ্বারা নৃত্যের আলোমাখা পথে নতুন আলোর সূচনা করে চলেছে, তেমনই গ্রামবাংলার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে নৃত্যের সম্পূর্ণ এক আপন রূপ। সেখানে নৃত্যের প্রতিনিয়ত প্রকাশ হচ্ছে মুক্তবিহঙ্গের মতো। কখনো সে সেই সমাজের কাহিনি বর্ণনা করছে বেহুলারূপে, কখনো কৃষ্ণ বা রাধা রূপে ধর্মীয়ভাবের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। কখনো গানে গানে করতালি দিয়ে জানাচ্ছে আনন্দবার্তা। আবার কখনো অস্ত্র হাতে নিয়ে আত্মরক্ষার মাধ্যম হিসেবে করছে তার বহিঃপ্রকাশ।
নৃত্যের কোনো ভাষা নেই, জাতি নেই, বর্ণ নেই। শুধু আছে শারীরিক চলন; যেই চলন দিয়ে একজন শিল্পী তার মনের সব ভাব প্রকাশ করতে পারে সাবলীলভাবে। তাই নৃত্য হলো উন্মুক্ত; যেখানে রয়েছে প্রাণের স্পন্দন। জীবনের ছন্দে চলতে থাকা প্রতি ছন্দ নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে চলতে থাকে তার মুক্ত সুরে। তাই তো মনুষ্য সমাজের নান্দনিক শিল্পকলার মধ্যে নৃত্যকলা হলো প্রাচীনতম কলা। নৃত্যের যে সাবলীল রূপ আছে তা ব্যক্তিবিশেষে প্রকাশ ঘটে। তাই তো নৃত্য স্বাধীন। তার যে আপন চলন আছে তার সুর গাঁথা মুক্তির সুরে। সমস্ত জগতের প্রাণের সুর হয়ে বাঁধা এই নৃত্য। নৃত্যকে জানার জন্য প্রচুর জ্ঞানের প্রয়োজন নেই, শুধু প্রয়োজন তাকে উপলব্ধি করা। তাই তো নৃত্যের মধ্যে রয়েছে মুক্তির সুর।
লেখক: শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী ও গবেষক