বন, বনাঞ্চল যে নামেই বলি না কেন এ শব্দের সঙ্গে আমরা যেমন পরিচিত তেমনি এর উপকারভোগী আমরা সবাই। বন না থাকলে যেমন প্রাণিকুল বাঁচবে না, তেমনি বন না থাকলে মানুষকুলও বাঁচার সুযোগ নেই। ঠিক অনুরূপ মানুষ, প্রাণিকুলকে বাঁচাতে হলে বনকে টিকিয়ে রাখতেই হবে। আর সে বন বাঁচাতে সম্মিলিত পদক্ষেপ ছাড়া কোনো উপায় নেই।
মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের পাশাপাশি প্রয়োজন সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশ। পরিবেশ সুরক্ষায় বনের গুরুত্ব অপরিসীম। বনের বৃক্ষ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে, ছায়া, ফল ও ফুল দেয়। শুধু তাই নয় উপকূলের রক্ষাকবজ হিসেবে ভূমিকা রাখছে বন। বন্যপ্রাণীদের খাবার ও আশ্রয় দেয়। বৃক্ষ ভূমিক্ষয় রোধ করে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বজ্রপাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে। কিন্তু বনের কী অবস্থা? কেউ কি দেখছে? কখনো কখনো মনে হয় বন দেখার মতো কেউ নেই; মনে হয় বন নিজেই কাঁদছে, যে বন মানুষ ও প্রাণিকুলের অস্তিত্ব ধরে রাখে আজ সেই বন নিজেরই অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।
বর্তমান বিশ্বে শিল্পায়নের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। ফলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইলা, সিডর ও মহাসেনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছে মানুষ। উপকূলের বনাঞ্চল ধ্বংসলিলায় মেতে উঠেছে, উপকূলের রক্ষাকবজ বন নিজের অস্তিত্ব খুঁজছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে বনভূমি সুরক্ষা, নতুন বন সৃজন, বসতবাড়ির আশপাশে, রাস্তার ধারে, বাঁধের দুই ধারে, কল-কারখানা, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতের অব্যবহৃত জায়গা, শহরাঞ্চলের বাড়ির ছাদ, বারান্দা ও বেলকোনিতে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প নেই বনায়নের জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির।
কোনো দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশটির মোট ভূমির ২৫ শতাংশে বনভূমি থাকা আবশ্যক। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে শতকরা ১৭ ভাগ জমিতে বনভূমি রয়েছে। আর বেসরকারি হিসাবে বনভূমির পরিমাণ আরও কম। বাংলাদেশের প্রধান বনভূমি সুন্দরবন দেশের মোট বনভূমির ৪৪ শতাংশ। বনবিভাগের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতি, স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী বনদস্যুর লোভ-লালসার কারণে এসব সরকারি বনভূমি আজ হুমকির সম্মুখীন। জাতীয় সংসদে সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের পরিবেশিত এক তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ২৬ লাখ হেক্টর এবং এর মধ্যে ২ লাখ ৬৮ হাজার একর সরকারি বনভূমি বেদখলে রয়েছে।
সরকারের তথ্যানুযায়ী উপকূলীয় বনায়নে অর্জিত সাফল্য হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বপ্রথম সফল উপকূলীয় বনায়নকারী দেশ। উপকূলীয় জনগণের আরও অধিক সুরক্ষা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ বন বিভাগ উপকূলীয় অঞ্চলে জেগে ওঠা নতুন চরে ১৯৬৬ সাল থেকে ম্যানগ্রোভ বনায়ন শুরু করে। বন বিভাগ কর্তৃক উপকূলীয় বনায়নের সফলতা প্রত্যক্ষ করে সরকার উপকূলীয় ১২ লাখ ৩৬ হাজার একর (প্রায় ৫ লাখ হেক্টর) এলাকা বনায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এর নিকট হস্তান্তর ও বন আইনের ৪ ধারায় সংরক্ষিত ঘোষণা করে। বন বিভাগ ষাটের দশক থেকে উপকূলীয় অঞ্চলে জেগে ওঠা চরে বনায়ন শুরু করে। উপকূলীয় চরে বনায়ন প্রক্রিয়ায় বনজ সম্পদ সৃষ্টির পাশাপাশি উপকূলবাসীকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুরক্ষা করছে এবং সাগর থেকে ভূমি জেগে ওঠাসহ দৃঢ়করণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন এবং এর নেতিবাচক প্রভাব হ্রাসে ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধে সবুজ বেষ্টনী হিসেবে কাজ করে; সেই সঙ্গে দেশে কার্বন মজুদ বৃদ্ধি পেয়েছে। উপকূলীয় বনায়ন বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম ও মৎস্যগুলোর প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করেছে। ওই তথ্যে আরও বলা হচ্ছে, বনায়নের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর থেকে ১ হাজার ৬৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূমি দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। উপকূলীয় চরাঞ্চলে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৫২১ বর্গ কিমি চর বনায়ন করা হয়েছে, যা উপকূলবাসীকে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে রক্ষা করে আসছে।
কোনো দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশটির মোট ভূমির ২৫ শতাংশে বনভূমি থাকা আবশ্যক। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে শতকরা ১৭ ভাগ জমিতে বনভূমি রয়েছে। আর বেসরকারি হিসাবে বনভূমির পরিমাণ আরও কম। বাংলাদেশের প্রধান বনভূমি সুন্দরবন দেশের মোট বনভূমির ৪৪ শতাংশ।
অন্যদিকে সামাজিক বনায়নে অর্জিত সাফল্য হিসেবে বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন গ্রামীণ জনপদে বন বিভাগ ১৯৬০ দশকের শুরুর দিকে বন সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সর্বপ্রথম বনায়ন কর্মসূচি বনাঞ্চলের বাইরে জনগণের কাছে নিয়ে যায়। সরকার ২০০০ সালে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমকে ১৯২৭ সালের বন আইনে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে আইনি কাঠামোতে নিয়ে আসে। সামাজিক বনায়নকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সরকার ২০০৪ সালে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা প্রবর্তন করে। যা আরও কার্যকর ও সুযোপযোগী করার লক্ষ্যে ২০১১ সাল পর্যন্ত সংশোধনী আনা হয়। সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমের আওতায় ১৯৮১-১৯৮২ থেকে হতে ২০২২-২০২৩ সাল পর্যন্ত অগ্রগতি হয়। সবশেষ বনকে টিকিয়ে রাখার জন্য বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ প্রণীত হয়। ওই আইনের ধারা ২(৩১) অনুসারে “সহ-ব্যবস্থাপনা” রয়েছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় বন ধ্বংসের লিলাখেলার খবর। অথচ বন রক্ষার জন্য কতই না আইন রয়েছে। কিন্তু হায় এত কিছুর পরও গুটি কয়েক প্রভাবশালীর কারণে বন দিন দিন বিলুপ্তির পথে। তাহলে কি সরকার, আইন, বন বিভাগ, প্রশাসনের চেয়েও শক্তিশালী তারা? অবশ্যই নয়। তাছাড়া বন রক্ষার্থে স্থানীয় সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি কী করছে?
এ মুহূর্তে একটি কথা না বললেই নয়, দেশে বনাঞ্চল রক্ষার জন্য বন আইন রয়েছে, বনবিভাগ রয়েছে, কিন্তু তা বনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। অন্যদিকে নৌ রক্ষার জন্য নৌবাহিনী এবং নৌ পুলিশ রয়েছে। যে বাহিনীর মধ্যে বিপুলসংখ্যক সদস্য রয়েছে। কিন্তু যে বনভূমি বা বনাঞ্চল আমাদের পরিবেশ রক্ষা করে, আমাদের উপকূল তথা দেশ রক্ষা করে, যে বন আমাদের জীবনকে রক্ষা করে সেই বন রক্ষার জন্য বনবিভাগকে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে না। বন বা পরিবেশ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও এগুলো নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। তাই বনাঞ্চল, বনভূমি রক্ষার জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো তথা, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌর পরিষদ সক্রিয় করতে হবে এবং বন, বণ্যপ্রাণী রক্ষার জন্য বন পুলিশ, সবুজ পুলিশ, বন বাহিনী যে নামেই হোক করা দরকার। সে বাহিনী হতে হবে বিশেষ বাহিনী যে বাহিনীতে র্যাব, নৌ, বিজিবি, সেনাসহ সব বাহিনীর সদস্য থাকবে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে আরেকটি চৌকস টিম।
পরিবেশ রক্ষায় সজাগ, সচেতনতা, সামাজিক আন্দোলন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। পরিবেশ ধ্বংসের জন্য যেমন আমরা দায়ী তেমনি পরিবেশ বাঁচানোর প্রথম পদক্ষেপ আমাদেরই নিতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবেশ নষ্টের জন্য দায়ী আমরা। আজ সময় এসেছে প্রকৃতির বন্ধু খুঁজে বের করার অর্থাৎ মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানোর। এ ছাড়া গ্রাম থেকে শহরে অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে সবাইকে প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষেত্রে সৃষ্ট পরিবর্তন ও করণীয় সম্পর্কে একই প্ল্যাটফর্মে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সারা বছর ও দেশব্যাপী একটি অভিযান পরিচালিত হতে পারে। প্রকৃতির ক্ষতি করে সুন্দর জীবন ধারণ কখনোই সম্ভব নয়। তাই সার্বিক বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে, পরিবেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন আইন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করার ক্ষেত্রে ও বিশ্বব্যাপী গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি সবাইকে জানাতে মিডিয়াকে আরও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম এবং তরুণ সংবাদকর্মীদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সংগঠনগুলোকে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নতি পরিবেশবান্ধব ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে হবে। দারিদ্র্যবিমোচন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি থেকে দেশকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে সবাই একই কথা বলে। তাই আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরিবশে রক্ষা করি, উপকূলকে রক্ষা করি, নিজেরা বাঁচি।
লেখক: সাংবাদিক কলামিস্ট ও গবেষক
[email protected]