সরকাররিভাবে সারা দেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও দেশের এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সরকারের আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শন করে দেদার পলিথিন উৎপাদন ও বিক্রি করে কালো টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। বেড়েই চলছে পলিথিনের ব্যবহার। বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। হুমকিতে জীববৈচিত্র্য। বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। পরিবেশ রক্ষায় দেশে দুই দশক আগে আইন করেও বন্ধ করা যায়নি পলিথিনের ব্যবহার। বরঞ্চ এর তৈরি ব্যাগের ব্যবহার, উৎপাদন এবং বিপণন ও পরিবহন হচ্ছে প্রকাশ্যেই। পরিবেশবিদরা পুরোপুরি পলিথিন বন্ধের দাবি জানিয়ে এলেও তা আমলে নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর। আইনের বাস্তব ভিত্তিক প্রয়োগ না থাকায় সর্বত্র প্রতিটি কাজেই বাড়ছে পলিথিনের ব্যবহার। এই অসাধু ব্যক্তিদের নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন ও বিপণনের কারণে দেশের মানুষ ও পরিবেশ আজ হুমকির মুখে পড়েছে।
দেশে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। দুই বছর আগে পলিথিন এবং একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থা নিতে এক বছর সময় বেঁধে দেন উচ্চ আদালত। এ ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে পলিথিনের ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক মহল থেকে তাগিদ আছে। এত কিছুর পরও এবারের বাজেটে এসেছে উল্টো প্রস্তাব। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ (ওভেন প্লাস্টিক ব্যাগসহ) ও মোড়কসামগ্রীর ওপর বিদ্যমান ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আদায় করা হয়। এটি বাড়ানোর পরিবর্তে কমিয়ে ১ দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কাঁচাবাজার, মুদিদোকান, শপিং মল, চেইনশপ সর্বত্রই নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এ পণ্য নিয়ন্ত্রণে মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হলেও এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার এতটুকুও কমেনি। নির্ভরযোগ্য বিকল্পের অভাবে বাজার সয়লাব হয়ে আছে নিষিদ্ধ পলিথিনে।
রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট, শান্তিনগর বাজার, ফকিরাপুল ও মালিবাগ রেলগেট বাজারসহ সারা দেশের গ্রাম-গঞ্জের সর্বত্র নিষিদ্ধ পলিথিনে ভরপুর। পাটজাত মোড়কের বদলে প্লাস্টিক বা পলিথিনের বস্তায় আটা, ময়দা, চিনি, ডাল, আদা, রসুন বাজারজাত করা হচ্ছে। এমনকি ভারত থেকে যে চাল আমদানি করা হয়েছে সেটাও পলিথিনের বস্তায়। তবে কিছু চালের দোকানে বেশির ভাগই পাটের বস্তা রয়েছে।
আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার হচ্ছে ক্ষতিকর পলিথিন। এতে ভেঙে পড়েছে শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা। দূষিত হচ্ছে পানির তলদেশ, উর্বরতা হারাচ্ছে ফসলি জমির মাটি। ভরাট হচ্ছে নদীনালা, খালবিল। অতিমাত্রায় পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারের কারণে মানবশরীরে বাসা বাঁধছে ক্যানসারসহ নানা রোগ। পরিবেশবাদীরা বলছেন, অনেক দেশ আইন করে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে স্থলের পর এবার সাগর-মহাসাগরকে বিষিয়ে তুলছে বিষাক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক। তারপরও সচেতনতা বাড়ছে না আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে। মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশকে রক্ষা করতে পলিথিন ও ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পলিথিন নিষিদ্ধ হওয়ার পরও সারা দেশে চলছে এর রমরমা ব্যবহার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনেই রাজধানীসহ সারা দেশেই পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার চলছে। ছোট্ট পণ্য থেকে শুরু করে বড় পণ্য- সবকিছুই বিক্রেতারা পলিথিনের ব্যাগে ভরে ক্রেতাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পলিথিনে তৈরি সব ধরনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ-বিতরণ নিষিদ্ধ। এর ব্যত্যয় হলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ এ আইন লঙ্ঘন করেই প্রশাসনের নাকের ডগায় বাজারগুলোতে অবলীলায় বিক্রি হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সারা দেশে অবৈধ পলিথিন তৈরির কারখানা রয়েছে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০। এর মধ্যে পুরান ঢাকা এবং বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে রয়েছে কমপক্ষে ৭ শতাধিক কারখানা। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিন কোটি কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া হয়। ফেলে দেওয়া পলিথিন ব্যাগের একটা বিরাট অংশ কোনো না কোনোভাবে নদীতে গিয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর জমেছে। এতে নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
পুরনো পলিথিন পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে নতুন পলিথিন। এতে মারাত্মকভাবে বায়ুদূষণ হচ্ছে। পলিথিন পোড়ালে কার্বন মনো-অক্সাইড তৈরি হয়ে বাতাস দূষিত করে। এদিকে পলিথিনের জন্য সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যেও পড়েছে ঝুঁকির মুখে। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর ৮৭ হাজার টন ওয়ানটাইম পলিথিন ও প্লাস্টিক বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিক স্ট্র, কটনবাড়, ফুড প্যাকেজিং, ফুড কনটেইনার, বোতল, প্লেট, প্লাস্টিক চামচ, কাপ, প্লাস্টিক ব্যাগ, পেস্ট, শ্যাম্পুর প্যাকেট ইত্যাদি।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিদের মতে, নিষিদ্ধ এই পলিথিন একই সঙ্গে কৃষিজমি ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। এটি একটি অপচনশীল প্লাস্টিকজাতীয় পদার্থ, যা দীর্ঘদিন পর্যন্ত অপরিবর্তিত, অবিকৃত থেকে মাটি ও পানি দূষিত করে। এতে মাটির উর্বরতা শক্তি ও গুণ নষ্ট হয়ে ফলন কমে যায়। এর বাইরে যত্রতত্র পলিথিন পড়ে থাকা, আগুনে পোড়ালে বাতাস দূষিত করা এবং পয়োনিষ্কাশনে বাধা তৈরিসহ নানাভাবে পরিবেশকে দূষিত করে।
পলিথিনের সংস্পর্শে এলে গাছ বা চারার শিকড় গজাতে পারে না। ফলে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে সময়মতো ফলন হয় না বা হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী হয় না। পলিথিনের ক্ষতিকর রাসায়নিক গাছপালা, উদ্ভিদ ও মানবদেহের জন্যও ক্ষতিকর। পলিথিন বিক্রি বন্ধ করার ওপর প্রশাসনের কোনো নজরদারি দেখা যায়নি।
এদিকে প্রশাসন থেকে পলিথিন বিক্রি ও উৎপাদন বন্ধের কথা বলা হলেও মাঠে-ময়দানে তেমন কোনো লক্ষ্যণ দেখা যায়নি। কিন্তু প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, আমরা নিয়মিত তৈরির কারখানাগুলোতে অভিযান চালিয়ে পলিথিন জব্দ করছি, জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দিচ্ছি। আইনে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও সারা দেশে ব্যাপকহারে ব্যবহার হচ্ছে। দেখার কেউ নেই। পলিথিনের কারণে পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে বড় প্রমাণ বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে জমা ৬-১০ ফুট পলিথিনের স্তর। সাগরে মাছের তুলনায় পলিথিনের সংখ্যা বেশি। ঢাকাসহ সারা দেশের শহরের ড্রেনগুলো পলিথিন ও প্লাস্টিকদ্রব্যে ভরে গেছে। একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বড় বাজেটের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও এর সুরাহা করা সম্ভব হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পচনশীল দ্রব্যে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যবহারের সাময়িক অনুমোদন নিয়ে এর ব্যবহার অব্যাহত রাখা হয়। পলিথিন বন্ধে অভিযান এক সময় চললেও এখন অজ্ঞাত কারণে বন্ধ আছে। এখন যেভাবে পলিথিন ব্যবহৃত হচ্ছে তা বেআইনি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
email- [email protected]