ঢাকা ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, শুক্রবার, ৩১ মে ২০২৪

সচেতনতার অভাবেই কী অগ্নিকাণ্ড!

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৪, ০২:৪৫ পিএম
সচেতনতার অভাবেই কী অগ্নিকাণ্ড!
ইসরাত জাহান চৈতি

এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে গাজীপুর ও রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬২ জন। যে পরিবারটি প্রিয়জন হারাল, পিতার কাঁধে পুত্র/কন্যার লাশ উঠল, যে সন্তান অল্পবয়সে পিতৃহীন হলো, যে মায়ের বুক খালি হলো; তার জন্য জীবনের সবচেয়ে অসহায় ও ভয়ংকর অধ্যায় এটি।…

রবিবার (২৪ মার্চ) পর্যন্ত গাজীপুরের কালিয়াকৈরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৬ জনে। ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৩ মার্চ কালিয়াকৈরের তেলিরচালা এলাকার একটি বসতবাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এতে মোট ৩৬ জন দগ্ধ হন।

এর আগে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি লিপ ইয়ার উদযাপন করতে গিয়ে রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি ভবনে ৪৬ জন মারা যান। অত্যন্ত হতাশার বিষয় হলো- তাদের অধিকাংশই মারা গেছেন আগুনে দ্বগ্ধ হয়ে নয়, বরং শ্বাসনালি পুড়ে, ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে। অর্থাৎ, আগুন লাগার পর ভবন থেকে নামার অব্যবস্থাপনা এর অন্যতম প্রধান কারণ। এ ঘটনার পর জানা গেছে ভবনটিতে ছিল না তেমন কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। ওঠানামার সিঁড়ি এতই সরু ছিল যে দুইজন একসঙ্গে নামা প্রায় অসম্ভব ছিল। এ ছাড়াও বেশ কয়েকবার ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। সে সবের তোয়াক্কা না করে ভবনটিতে চলছিল রমরমা ব্যবসা। অর্থাৎ, পর্যাপ্ত সচেতনতা ও তদারকির অভাবে সচল ছিল ভবনটি। 
 
গাজীপুর ও বেইলি রোডের ঘটনায় এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে প্রাণ হারিয়েছে ৬২ জন মানুষ। সংখ্যাটি আমার আপনার কাছে নেহাতই একটা মাত্র অংক হলেও এর গভীরতা কিন্তু কম নয়। যে পরিবারটি প্রিয়জন হারাল, পিতার কাঁধে পুত্র/কন্যার লাশ উঠল, যে সন্তান অল্পবয়সে পিতৃহীন হলো, যে মায়ের বুক খালি হলো তার জন্য মোটেও এটা একটা সংখ্যা নয়। তার জন্য জীবনের সবচেয়ে অসহায় ও ভয়ংকর অধ্যায় এটি।

শুধু বেইলি রোড বা গাজীপুরের অগ্নিকাণ্ড নয়, গত ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত আরও বেশ কয়েকটি জায়গায় অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। সেসব স্থানে প্রাণহানি হয়নি বলে সেগুলো মানুষের ভেতর তেমন সাড়া জাগাতে না পারলেও যে ব্যবসায়ীর স্বপ্ন আগুনে পুড়ে ছাই হলো, তার জন্য এর চেয়ে ভয়াবহ হয়তো আর কিছু হতে পারে না।

বাংলাদেশে আগুন পুড়ে মৃত্যু, হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা নতুন কিছু নয়। আমরা এখনো ভুলিনি নিমতলী ট্র্যাজেডি, বঙ্গবাজার ট্র্যাজেডি বা ঢাকার তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন শ্রমিক নিহতের ঘটনা, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও আগুনে ৪৯ জনের মৃত্যু, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সুগন্ধা নদীতে লঞ্চের ইঞ্জিনরুমে আগুনের ঘটনায় ৩৮ জনের প্রাণহানি বা একই বছর  নারায়ণগঞ্জের জুস তৈরি কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন নিহতের ঘটনা। উল্লেখযোগ্য এসব ঘটনা ছাড়াও প্রতিনিয়ত ঘটছে কোনো না কোনো স্থানে অগ্নিকাণ্ড। 

এ তো গেল দুই-এক বছর আগের ঘটনা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যমতে, শুধু ২০২৩ সালেই সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১০২ জন। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৭৭টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে।

নিহতের হিসাবের বাইরে এসব ঘটনায় আহত বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিন্তু নেহাতই সামান্য নয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স মিডিয়া সেলের দেওয়া তথ্যমতে, সারা দেশে বিগত এক বছরের অগ্নিকাণ্ডে ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৪ টাকা মূল্যের সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।  

অগ্নিকাণ্ডের সূত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে- সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, বৈদ্যুতিক গোলযোগ, বিড়ি-সিগারেট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। অর্থাৎ, এসব ঘটনার অধিকাংশই ঘটেছে অসচেতনতাজনিত কারণে। হয়তো সামান্য সচেতনতাই পারত অনেকাংশে এসব ঘটনা রোধ করতে।

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক ও অগ্নিনিরাপত্তা সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান বিএম ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর একেএম শাকিল নওয়াজ বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলেন, আগুন লাগলে সেটি ছড়িয়ে পড়া অনেকাংশেই ঠেকানো সম্ভব যদি আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কোনো ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ভবনে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। সেগুলো হলো- অ্যাকটিভ সিস্টেম বা সক্রিয় ব্যবস্থা ও প্যাসিভ সিস্টেম বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। অগ্নিনিরাপত্তায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে জরুরি। এটা বাড়ি নির্মাণের সময় মূল নকশার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি ৬টি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন :

ডাক্ট লাইন ও কেবল হোল সিল করা
আধুনিক বহুতল ভবনগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, হিটিং, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগের জন্য যে পাইপগুলো টানা হয় ডাক্ট লাইন এবং কেবল হোলের ভেতর দিয়ে। এই ডাক্ট লাইন ও গর্ত দিয়ে ধোঁয়া এবং আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।  এ জন্যে ডাক্ট লাইন ও কেবল হোলগুলো আগুন প্রতিরোধক উপাদান দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

আগুন প্রতিরোধী উপাদান ব্যবহার
ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবহৃত উপাদানগুলো আগুন প্রতিরোধী হওয়া জরুরি। সিনথেটিক বা হাইড্রোকার্বন উপাদান থাকে এমন কোনো পদার্থ দিয়ে ভবনের ভেতরের সাজসজ্জা না করার পরামর্শ কর্মকর্তাদের।

অ্যালার্ম সিস্টেম বসানো
প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়ার পরও যদি কোনো ভবনে আগুন লাগে, তা হলে সেক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার একটা উপায় হচ্ছে ফায়ার এবং স্মোক অ্যালার্ম সিস্টেম বসানো এবং সেটি ঠিকমতো কাজ করে কি না তা নিয়মিত পরীক্ষা করা। বিশেষজ্ঞদের মতে,  অ্যালার্ম সিস্টেম কাজ করলে কোনো এক জায়গায় আগুন লাগলে পুরো ভবনের বাসিন্দারাই আগুন সম্পর্কে জানতে পারে এবং দ্রুত তারা ভবন খালি করে নিচে নেমে আসতে পারে। ফলে প্রাণহানি ব্যাপকভাবে কমানো সম্ভব। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থাই নেই।

জরুরি বহির্গমন পথ নিশ্চিত করা ও ব্যবহার
যেকোনো ভবনেই আগুন লাগলে সেটি থেকে দ্রুত বের হয়ে আসার জন্য বাইরে একটা জরুরি বহিগর্মন পথ থাকতে হবে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তৈরি ভবনগুলোতে এ ধরনের কোনো বহির্গমন পথ নেই বললেই চলে।

ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা ও ব্যবহার করা
প্রতিটি ভবনেই অগ্নিনির্বাপণ সিলিন্ডার বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে এগুলো ব্যবহার করতে জানতে হবে ভবনের বাসিন্দাদের। আগুন লাগার পর প্রথম দুই মিনিটকে বলা হয় প্লাটিনাম আওয়ার বা সবচেয়ে মূল্যবান সময়। এই সময়ে ঘাবড়ে না গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমানো যায় বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক মি. নওয়াজ। তবে আমাদের দেশের মানুষ ঠিক এই সময়টাতেই মাথা ঠান্ডা না রেখে বড় বিপদের দিকে ঠেলে দেন নিজেদের।  ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও হয় বেশি।

স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম
আগুন নেভানোর জন্য একটা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা হচ্ছে স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম। এটি কোনো একটি ভবনের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকে। এ ব্যবস্থায় কোনো একটি স্থানে তাপমাত্রা ৫৭ ডিগ্রির বেশি হলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরিত হয়ে পানি ছিটিয়ে পড়তে থাকে। ফলে আগুন নিভে যায়। বড় বড় বাণিজ্যিক বা কারখানা ভবনে সাধারণত এগুলো ব্যবহার করা হলেও, বর্তমানে আবাসিক ভবনগুলোতেও এগুলোর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না।

নিয়মিত মহড়া
ভবনে আগুন লাগলে সেখান থেকে কীভাবে বের হয়ে আসতে হবে, তার জন্য নিয়মিত মহড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ভবনের সব বাসিন্দাকে অংশগ্রহণে মাসে অন্তত একবার এ ধরনের মহড়া করতে হবে।

তবে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হলো, আমাদের দেশে এর কোনোটাই সঠিকভাবে মানা হয় না। মেনে চলা হয় না কোনো নিয়ম। উপরন্তু, আমাদের দেশে মানুষের মাঝে রয়েছে সচেতনতার ভয়াবহ অপ্রতুলতা। দেখা যায়, কোনো স্থানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কিছুদিন পর্যন্ত সেটা নিয়ে তৎপর থাকে প্রশাসন। নানা ধরনের অভিযান পরিচালনা করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন ভবন সিলগালা করে দেওয়া হয়। যেমনটা ঘটল বেইলি রোড ট্র্যাজেডির পর । এসব ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও আগের রূপে ফিরে যায় সবকিছু। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে চলতে থাকে অগ্নিনির্বাপণবিহীন অট্টালিকাসম ভবনগুলো।

এসব দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন স্থায়ী কিছু সমাধান, পর্যাপ্ত সচেনতা ও কার্যকর কিছু নিয়মকানুনের। একই সঙ্গে প্রয়োজন ফায়ার সার্ভিসের যান্ত্রিক উন্নয়ন। পাশাপাশি প্রয়োজন বেসরকারিভাবে পরিচালিত কোনো ফায়ার সার্ভিস সংস্থার। এটা হতে পারে পিপিপির কোনো প্রকল্প। ঠিক যেমন সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। অনেক সময় দেখা যায় পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রাংশের অভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসতে অনেক সময় লেগে যায়। এতে অল্প সময়েই ক্ষতির পরিমাণ অধিক হয়। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা ও উদ্যোগ। যদি সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে এ ধরনের কোনো সংস্থা পরিচালিত হয় এবং ভবন নির্মাণের অনুমোদনের সময় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, ওঠানামার পর্যাপ্ত জায়গাসম্পন্ন সিঁড়ির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায় এবং অগ্নিকাণ্ডের সময় ব্যক্তির করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। একই সঙ্গে উল্লেখিত বিষয়গুলো যথাযথভাবে মেনে চলা হয়, তবে পুরোপুরিভাবে অগ্নিকাণ্ড নিরোধ করা সম্ভব না হলেও অনেকাংশেই কমে আসবে নিহত-আহত ও ক্ষতির পরিমাণ। তাই চলুন, আমার আপনার থেকেই শুরু হোক অগ্নিকাণ্ড রোধের প্রথম পদক্ষেপ। অকালে ঝরে না যাক আর কোনো প্রাণ।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও সাবেক শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মহাবিশ্বের চির বিস্ময়

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৪, ১২:৫১ পিএম
মহাবিশ্বের চির বিস্ময়
কাজী নজরুল ইসলাম

শুকনো খটখটে, এবড়োথেবড়ো, উঁচুনিচু, ঢেউ খেলানো ভূমি। শুকনো রুক্ষ মাটি রোদে পুড়ে খাঁখাঁ করছে। কৃষিজমির সামান্য মাটিটুকুও পাথর, কাঁকর আর বালির মিশেলে কালচে হয়ে গেছে। বিস্তীর্ণ ধু ধু মাঠে ঝাঁকড়া মাথায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু তালগাছ। একটা মাত্র নদী, নাম ‘অজয় নদ’ মৃতপ্রায় অবস্থায় বেঁচে আছে। গ্রীষ্মের সময় পানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। শুকনো মৌসুমে নদীর ওপর দিয়ে চলে ঘোড়ার গাড়ি। বর্ষার প্রারম্ভে এই নদীই দুকূল ছাপিয়ে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। এদিকে-ওদিকে ছোট বড় পাহাড় জঙ্গল থাকলেও কয়লাখনির দূষিত বাতাসে চারদিক বিষণ্ন হয়ে থাকে সবসময়। এই স্থানের নামই চুরুলিয়া, যা বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমায় অবস্থিত।

প্রকৃতির এই বিরুদ্ধ পরিবেশের ছোঁয়ায় মানুষের চালচলন, মেজাজ-মর্জিও প্রকৃতির মতোই রুক্ষ-কর্কশ হয়ে যায়। এই বিরুদ্ধ পরিবেশেই ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, বাংলা সন ১৩০৬, ১১ জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার কাজী আমিনউল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় পত্নী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। নবজাতকের নাম রাখা হয় কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী আলী হোসেন নামে নজরুলের এক ভাই এবং উম্মে কুলসুম নামে এক বোন ছিল। এ ছাড়া কাজী ফকির আহমেদের ঔরসে প্রথম স্ত্রীর গর্ভে সাজেদুন্নেসা নামে একজন কন্যাসন্তান ছিল।

মুঘল সম্রাট শাহ্ আলমের শাসনকালে বিহারের রাজধানী পাটনার হাজিপুর থেকে নজরুল-পরিবার চুরুলিয়ায় আবাস গড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সম্রাটের আদেশে স্থানীয়ভাবে আদালত স্থাপন করা হয়। সম্রাটের প্রতিনিধি সমস্যার সমাধান করতে পারছিলেন না। নতুন আসা পরিবারের একজন সদস্য সমস্যার সুন্দর সমাধান করে দেন। দুপক্ষই তার রায় মেনে নিলে সম্রাটের পক্ষ থেকে তাকে কাজী উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সম্রাটের দরবার থেকে দান হিসেবে দেওয়া হয় বেশকিছু জায়গাজমি। তখন থেকে পরিবারটির উপাধি হয়ে যায় কাজী পরিবার। এই পরিবারেরই সদস্য ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুলের বাড়ির পাশে ছিল নরোত্তম রাজার গড়। গড়ের উল্টো দিকে হাজি পালোয়ানের পুকুর। হাজি পালোয়ান নামে এক আধ্যাত্মিক ফকির রুক্ষ মাটির বুকে এই পুকুর খনন করেছিলেন। পুকুরপাড়ে ছিল হাজি পালোয়ানের মাজার। মাজারের পাশে ছিল একটি মসজিদ। এই মসজিদের খাদেম ছিলেন নজরুল। বাল্যকালে নজরুল এই মসজিদে আজান দেওয়া, নামাজ পড়ানো ছাড়াও ছোটদের হাদিস পড়াতেন। এখান থেকেই তিনি কোরআন-হাদিস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। 

চাচা বজলে করিমের কাছ থেকে ফারসি ভাষা এবং কবিতার পাঠ নিয়ে আরবি-ফারসির সমন্বয়ে একদিন নজরুল লিখে ফেলেন একটি পদ্য। এটাই নজরুলের হাতে লেখা প্রথম কবিতা। 

মেরা দিল বেতার কিয়া তেরী আব্রুয়ে কামান;
জ্বলা যাতা হ্যায় ইশ্বক্ মে জান পেরেশান।
হেরে তোমার ধ্বনি
চন্দ্ৰ কলঙ্কিনী
মরি কী যে বদনের শোভা, মাতোয়ারা প্রাণ।
বুলবুল করতে এসেছে তাই মধু পান॥

এরপর চাষার সং, শকুনি বধ, মেঘনাদ বধ, দাতা কর্ণসহ আরও অসংখ্য পালা গান ও নাটক রচনা করেন। লেটো গানের দলে তাকে নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। বিখ্যাত কবিয়াল 'গোদা কবি' শেখ চকোর লেটো গানের দলে নজরুল প্রতিভা নিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলেন, এই ব্যাঙাচি বড়ো হয়ে সাপ হবে। নিজেকে নজরুলের অধীন বলে স্বীকার করে লেটো গানের দলে সুর ধরতেন এই বলে,

আমরা এই অধীন হয়েছি ওস্তাদহীন
ভাবি তাই নিশিদিন,
বিষাদ মনে।
নামেতে নজরুল ইসলাম,
কি দিব গুণের প্রমাণ।

কিন্তু নজরুল বাল্যকাল থেকেই ছিলেন বাঁধনহারা। কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম তাকে আটকে রাখতে পারেনি। লেটো গানের দলে তার কাব্যিক যাত্রা শুরু করলেও একদিন দলের ধরাবাঁধা নিয়মকানুন ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, দল ছেড়ে যাত্রা করেন অজানার পথে। হাজির হন আসানসোলে। গ্রাম্য লেটো দলের ‘ব্যাঙাচি কবি’ নজরুল হয়ে উঠেছিলেন আসানসোলের বেকারি বয়। রুটির দোকানের পাঁচ টাকা মাইনের ভৃত্য হয়ে কাটালেন কিছুদিন। সেখান থেকে ময়মনসিংহ দরিরামপুর গ্রাম। ময়মনসিংহ থেকে পালিয়ে ছুটে গেলেন করাচিতে। নজরুলের জীবনই যেন একজন বাউন্ডুলে যাযাবরের আত্মকাহিনি। তার জীবনের বাঁধনহারা উল্লাসের রূপক হয়ে বারবার আবির্ভূত হয়েছেন আরবের বেদুইন, ভবঘুরে আর বাউন্ডুলেরা। আর তাই তো চেঙ্গিস, কালা পাহাড়, গজনি মামুদরা বারবার উঠে এসেছে তার কাব্যে ও কবিতায় বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে।

লেটোর দল ছেড়ে কাশিমবাজারের কাছে মাথরুন গ্রামে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউট, যা মাথরুন স্কুল নামে পরিচিত ছিল-সেখানে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই স্কুলেই বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে। নজরুল, শৈলেন আর শৈলজা মুসলমান, খ্রিষ্টান আর ব্রাহ্মণ এই তিনজনের মধ্যে ছিল প্রগাঢ় সম্পর্ক। জ্ঞান অর্জনের পথে ভাষা কখনো তার কাছে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি।

নজরুলের জীবন দুঃখে-কষ্টে ভরা ছিল বিধায় তিনি কারও দুঃখ সহ্য করতে পারতেন না। রুটির দোকানে কাজ করার সময় ঘুঙ্ঘুর বাঁধা লাঠি হাতে এক ফকির ঘুরে বেড়াত। সে কারও কাছে ভিক্ষা চাইত না। তার নাম ছিল মৌনি ফকির। নজরুল ফকিরকে দেখামাত্রই ছুটে যেতেন। ভিক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গান শোনাতেন। একদিন মর্মান্তিকভাবে ঘোড়াগাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মৌনি ফকির মারা যান। ব্যথাতুর কবি সেদিনই অর্থাৎ ১৯১৬ সালের এপ্রিল মাসের এক রাতে মৌনি ফকিরকে নিয়ে একটি কবিতা লেখেন। কবিতার নাম ক্ষমা। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকায় ১৩২৬ সালের শ্রাবণ সংখ্যায় (১৯১৯ সালের জুলাই-আগস্ট) ‘ক্ষমা’ কবিতাটিই ‘মুক্তি’ নামে প্রকাশিত হয়। মুক্তি নজরুলের প্রকাশিত প্রথম কবিতা। এ কবিতার ফল্গুধারা থেকেই তার কাব্যজীবনের সূচনা হয়। 

১৯১৭ সাল, নজরুল তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শেষ করেছেন। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। রানীগঞ্জের দেয়ালে পোস্টার পড়ল : কে বলে বাঙালি যোদ্ধা নয়? কে বলে বাঙালি ভীতু? জাতির কলঙ্ক মোচন করা একান্ত কর্তব্য, আর তা পারে একমাত্র বাংলার যুবশক্তি। ঝাঁপিয়ে পড় সিংহবিক্রমে। বাঙালি পল্টনে যোগ দাও।

মেট্রিক পরীক্ষার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে চুরুলিয়াকে বিদায় জানিয়ে যোগ দেন বেঙ্গল রেজিমেন্টে। লাহোর থেকে পেশোয়ার, পেশোয়ার থেকে করাচি নৈশেরা শুরু হয় সৈনিক জীবন। সেনানিবাসে থাকাকালে তিনি দ্রুতই প্রমোশন পেয়ে হাবিলদার পদে উপনীত হন। সেখানে এক পাঞ্জাবি মৌলবির সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। 

রুবাইয়াৎ-ই হাফিজ মুখবন্ধে কবি বলেন, আমি তখন স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেছি। ১৯১৭ সালের কথা। সেখানে আমার হাফিজের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমাদের বাঙালি পল্টনে একজন মৌলবি থাকতেন। একদিন তিনি দ্বীওয়ান ই-হাফিজ থেকে কতগুলো কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। শুনে আমি এমন মুগ্ধ হয়ে যাই যে, সেদিন থেকে তার কাছে ফারসি শিখতে আরম্ভ করি। তারই কাছে ক্রমে ফারসি কবিদের প্রায় সমস্ত কাব্যই পড়ে ফেলি।

১৯২০ সালে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে নজরুল কলকাতায় ফিরে ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে আসেন। নজরুল তার জীবনে সৈনিককালীন স্মৃতি বহন করতেন। গায়ে থাকত গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি, গেরুয়া রঙের চাদর, হাতে একখানা হাতপাখা, মাথায় একরাশ এলোচুল কাঁধ পর্যন্ত ঝোলানো। তার বিচিত্র পোশাকের সঙ্গে পায়ে থাকত মিলিটারি বুট। অদ্ভুত পোশাকে এক অনন্য ব্যতিক্রম হয়ে চলতেন তিনি। তাকে দেখে চমকে উঠত আকাশের মেঘ আর মাটির কানন। উচ্ছল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর নজরুল তার জীবনের রূপকথায় সত্যের পরশ পাথরের স্পর্শ পেয়ে দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেন বিদ্রোহের শব্দাবলি। 

বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সহকারী সম্পাদক মুজফফর আহমেদের সঙ্গে ছিল নজরুলের প্রগাঢ় সম্পর্ক। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই দুজনে এক সঙ্গে মিলে ‘নবযুগ’ নামের সান্ধ্য পত্রিকা বের করেন। নজরুল বারবার প্রেমে পড়েছেন। কিন্তু কুমিল্লার পল্লিবালা নার্গিসের প্রেমের বারিধারায় সিক্ত হয়েছিল তার মনপ্রাণ। কিন্তু ঘরজামাই থাকার হীনশর্তের কারণে বাসর রাতে নার্গিসকে ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। নজরুলের বক্ষে পারিজাত মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েছিলেন নার্গিস। নার্গিসের সঙ্গে বিচ্ছেদের ফলে বেদনার আগুনে দগ্ধ হয়ে সৃষ্টি হয়েছে অগ্নিবীণা আর ধূমকেতুর জ্বালা। কুমিল্লা থেকে ফিরে নজরুল কলকাতায় এসে মুজফফর আহমেদের ৩/৪-সি তালতলা লেনের বাসায় ওঠেন। এই বাড়িতেই ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের এক শীতের রাতে কবি রচনা করেন তার কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’।

১৯২২ সালে তার প্রকাশিত ধূমকেতু পত্রিকায় আনন্দময়ীর আগমনে কবিতা প্রকাশের কারণে রাজদ্রোহিতার অপরাধ এনে নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যন্ত্রণার নীলবিষে দগ্ধ হয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি হিসেবে কবিতা লেখার জন্য কারাদণ্ড স্বীকার করে নেন। কারারুদ্ধ অবস্থায় বন্দিদের প্রতি অবিচারের প্রতিবাদে তিনি অনশন করেন। তাকে নাকে নল ঢুকিয়ে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করা হলো। তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কবি বদ্ধ ঘরে উচ্চারণ করেন ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট’ অর্ফিয়াসের মতো তার হিরণ্ময় সুরে চারপাশ সাড়া পড়ে যায়। চিরবিদ্রোহী নজরুল ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অর্ফিয়াস। তার উদয়ে থেমে গিয়েছিল বাংলা কবিতার চিরন্তন ভাষা। ছন্দের অক্ষরে সূচিত হয়েছিল বিদ্রোহের প্রবল জোয়ার।

কারামুক্তির পর আশালতা সেনগুপ্তকে (প্রমীলা) বিয়ে করেন। ১৯২৪ সালের ১৬ আগস্ট নজরুলের প্রথম পুত্রের জন্ম হয়। ডিসেম্বরের এক রাতে চার মাস বয়সী আজাদ কামাল মারা যায়। একই সময়ে পরপর দুটি গ্রন্থ নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত হয়। একদিকে দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব; অন্যদিকে পুত্রশোকে পর্যুদস্ত হয়েও তিনি বিদ্রোহের দামামা বাজিয়ে চলছিলেন নিত্যনিয়ত। 

নজরুল ছিলেন চিরদিনই সেরা। তার ভেতরে ছিল জাত নেতৃত্ব। তিনি যখন দুষ্টুমি করতেন, তখন ছিলেন দুষ্টু দলের সর্দার। মসজিদে কাজ করার সময় হয়েছিলেন সেখানকার ইমাম। লেটো দলে তাকে দেওয়া হয় ওস্তাদের আসন। সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন হাবিলদার। আর কবিতা লিখতে গিয়ে তিনি হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি। সমাজের বৈষম্য, অনাচার ও ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম একক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সমাজের সর্বস্তরে ন্যায় ও সাম্য বিধান করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য। যখনই সমাজে অসাম্য এবং অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণের করাঘাতে ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল’ দেখা দেবে, তখনই ধূমকেতুর দীপ্ত শিখা হয়ে নজরুল যুগে যগে ফিরে আসবে মানুষের অভয় বাণী হয়ে।

সিদ্ধার্থ গৌতম ও যশোধারার দিনগুলো

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৪, ০৪:৪০ পিএম
সিদ্ধার্থ গৌতম ও যশোধারার দিনগুলো
সংঘানন্দ মহাথের

বহু দূরে উত্তর ভারতের প্রায় শেষান্তে ছিল কপিলাবস্তু- প্রাচীন রাজধানী নগরী। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, সেখানে নগর ও প্রাসাদ আনন্দে-উৎসবে মেতে উঠেছিল যখন রাজকুমার সিদ্ধার্থ জন্মগ্রহণ করেন। যারা রাজার নিকট সুসংবাদ নিয়ে এল, রাজা সেই খবরবাহকদের বহু দামি উপহার দিলেন, আরও যারা কাজ করেছিল তা যৎসামান্যই হোক, প্রত্যেকে বহু উপহার পেল। কারণ যে সন্তান জন্ম নিয়েছে তা রাজা এবং পুরো রাজ পরিবারের বহু প্রার্থনা ও সাধনার ফল ছিল। এ কারণেই যে, রাজা শুদ্ধোধন এবং রানি মহামায়া দুজনই দীর্ঘকাল নিঃসন্তান ছিলেন। এরপর রাজা বসলেন অন্দরের একটি কক্ষে, যেখানে একদল প্রাজ্ঞ ব্যক্তি কাগজ, বই এবং অপরিচিত যন্ত্রপাতির ওপর ঝুঁকে কিছু কাজ করছেন।

আপনি কি জানতে চান তারা কী করছিলেন? খুব অদ্ভুত ব্যাপার। শিশু রাজকুমার সিদ্ধার্থের সময়ের তারা-নক্ষত্রের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং তার থেকে কুমারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছিলেন। অদ্ভুত শোনালেও এই ভারতবর্ষের অতি প্রাচীন রীতি যা আজও লোকে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছে। নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ দ্বারা এই ভবিষ্যদ্বাণী হলো একজন মানুষের ঠিকুজি কোষ্ঠী। আমি এমনও মানুষের কথা জানি, যার কাছে বেশ কয়েক পূর্বপুরুষের নাম ও কোষ্ঠী আছে। আমাদের দেশেও এর ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। কপিলাবস্তুর জ্ঞানী ব্যক্তিদের বহু সময় লেগেছিল রাজকুমারের কোষ্ঠী তৈরি করতে। কারণ তাতে যে ভবিষ্যৎ তারা দেখেছিলেন, তা এতই অসাধারণ ছিল যে, তারা ঘোষণা করার আগে সবার সহমত নিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছিলেন যে কাজটি নির্ভুল হয়েছে কি না। তবুও পাঁচজন পণ্ডিত মহাশয় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন এবং দুটো মতামত জানিয়েছিলেন মহারাজকে। অবশেষে তারা এসে রাজার সামনে দাঁড়ালেন। ‘বেশ এবার বলুন’ রাজা উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শিশুপুত্র আমার বাঁচবে তো?’ সবচেয়ে প্রবীণ জ্যোতিষী জবাব দিলেন, ‘বাঁচবে, মহারাজ।’

‘আহ’ বললেন মহারাজ, ‘বেশ বেশ।’ এ সংবাদ জানার পর এবার ধৈর্যসহকারে বাকিগুলো শোনা যেতে পারে। ‘সে বাঁচবে’ পুনরুক্তি করলেন বৃদ্ধ জ্যোতিষী এবং তারপর নিজের বক্তব্য জানালেন, ‘কিন্তু যদি এ কোষ্ঠী ঠিক হয়ে থাকে, তা হলে আজ থেকে সপ্তম দিনে, শিশুর মা, মহিষী মহামায়া মৃত্যুবরণ করবেন। এবং সেটাই ইঙ্গিত দেবে মহারাজ যে, আপনার পুত্র পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রাজা হবেন, না সাধারণ মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে বস্তু জগৎ পরিত্যাগ করে মহান ধার্মিক গুরু হবেন।’ এই বলে তিনি পিতাকে কাগজগুলো অর্পণ করে সঙ্গীদের নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।

মহামায়া মারা যাবেন- মহান রাজা অথবা ধার্মিক গুরু, কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে লাগল মহারাজের কানে। তিনি একা বসে ভবিষ্যদ্বাণীর কথা ভাবতে লাগলেন। যে ভয়ানক ঘটনা ঘটতে চলেছে তা তার কাছে সেরকম সাংঘাতিক মনেই হলো না শেষ কথাগুলোর তুলনায়। ‘ধার্মিক গুরু’- ভিখারি- এই কথাগুলোর অর্থ একই? রাজা শিউরে ওঠেন। চিন্তার জগতে নিমগ্ন হতে থাকেন। কিন্তু দাঁড়াও! কথাগুলো ছিল ‘সাধারণ মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে, বস্তুজগৎ পরিত্যাগ’- ‘আমার পুত্র কোনোদিন সাধারণের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখবে না।’ পিতা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করলেন, ভাবলেন এভাবেই পুত্রকে তিনি তার পছন্দের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারবেন- এক পরাক্রমী মহারাজা।

সিদ্ধার্থ কুমারের জন্মের সাত দিনের মধ্যে মহারানি মহামায়া মৃত্যুবরণ করেন ঠিক যেমনটি সেই পণ্ডিতেররা বলেছিলেন। বিগত সাত দিনে তাকে প্রাণভরে সব রকমের যত্ন ও সেবা করা হলো। যত্নের কোনো ত্রটি ছিল না, বাঁচানোর সবরকম চেষ্টাই করলেন রাজা শুদ্ধোধন। কিন্তু লাভ হলো না। নির্ধারিত দিনে তিনি শিশুর মতো নিদ্রা গেলেন, আর উঠলেন না। রাজা শুদ্ধোধন এত শোকের মধ্যেও কিছুটা আশঙ্কিত, কারণ এখন তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে জ্যোতিষীরা সত্য কথা বলেছে। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, তার সন্তানকে তিনি ভিখারি হওয়ার ভবিতব্য থেকে বাঁচাবেনই। পরিবর্তে তাকে করে তুলবেন এই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও প্রতিপত্তিশালী রাজা; একে বৌদ্ধ সাহিত্য চক্রবর্তী রাজা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

শিশু যখন ধীরে ধীরে বালক হলো এবং বড় হতে লাগল, তার আশপাশের লোকেরা মনে করতেন তার সামনে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে। তিনি এত বুদ্ধিমান, প্রাণচঞ্চল, লেখাপড়া ও খেলায় এত চমৎকার ছিলেন এবং সব থেকে বড়ো কথা- এত প্রেমে পরিপূর্ণ যে তার একটি কথায় বা একবার দৃষ্টিপাতে যে কেউ তার অনুরাগী হয়ে পড়ে। তার কোনো শত্রু নেই। সবাই তার সম্বন্ধে সর্বদা বলে, তিনি ‘করুণায়’ পরিপূর্ণ’। তিনি ডানাভাঙা পাখিকে অশেষ যত্নে সেবা করতেন; কোনোদিন পশুপাখিদের তীরধনুক দিয়ে শিকার করেননি। যেমন কপিলাবস্তুর অনেক বন্ধু অভিজাত তরুণরা করত। তিনি বলতেন, নিরীহ ও অবলা জীবদের হত্যা করা পুরুষোচিত কাজ বলে তিনি মনে করেন না। তাহলে তিনি তীরের আঘাতের বেদনার কথা জানতেন। কিন্তু অন্য কোনোরকম দুঃখ-যন্ত্রণার কথা তিনি কখনো শোনেননি। তার গৃহ এক রাজপ্রাসাদ। তার চারদিকে মনোরম বাগান, বাগানের পর উত্তরে মাইলের পর মাইল উন্মুক্ত ক্ষেত্র রাজধানীর চারধারে বিস্তৃত। এগুলোর বাইরে তিনি কখনো বালক বয়সে যাননি। এখানে তিনি ঘোড়ায় চড়তে পারতেন, তীর চালনা করতে পারতেন এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে, দেখে, ভেবে, স্বপ্ন দেখতে পারতেন। এখানে কোনো দুঃখ ছিল না, দুঃখের কথা কেউ বলতও না। কারণ রাজা কর্তৃক দুঃখের কথা বলা নিষেধাজ্ঞা ছিল। এই পরিবেষ্টিত জায়গাটি নিজেই এক রাজ্য ছিল। তিনি এর বাইরে যাওয়ার কথা কখনো ভাবেনওনি। এবং তার বাবা সবাইকে বারণ করে দিয়েছিলেন তার সামনে যেন কোনো প্রকারের দুঃখ-যন্ত্রণার কথা না বলে। কারণ শুদ্ধোধনের সবসময় মনে হতো ‘সাধারণ মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে’ সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করবেন। এই যন্ত্রণার জ্ঞান থেকে তিনি পুত্রকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।

একজন ভারতীয় যুবকের অধ্যয়নকাল হওয়া উচিত তার ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত। তারপর সে স্বাধীন। যখন তরুণ গৌতম সে বয়সের কাছাকাছি পৌঁছলেন তখন তিনি নিজেই দেশ ছেড়ে অন্য দেশের উদ্দেশে পাড়ি দিতে পারতেন। কেউ বারণ করতে পারত না তাকে, নিজের পিতাও না- কারণ তিনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাধীন। তাই এই সময়ে তারা তাকে বাঁধতে চাইলেন, ফুলডোরে। তাকে প্রস্তাব দিলেন বিয়ে করে সংসারী হতে। তাদের মনে হলো, এ এখন শুধু সময়ের প্রশ্ন। তার কাছাকাছি যদি এক সুন্দরী সহধর্মিণী এবং ফুটফুটে আদরের সন্তান থাকে তা হলে তিনি আনন্দ ও ভালোবাসার বন্ধনে এমন বাঁধা পড়ে যাবেন যে বাড়ি ত্যাগ করতে পারবেন না। তিনি তাদের জন্য আরও ধন-সম্পদ সংগ্রহ করতে প্রয়াসী হবেন এবং বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ও ক্ষমতাশালী সম্রাট হয়ে উঠবেন। ঠিক যেমনটি তার জন্মের সময় জ্ঞানী পণ্ডিতরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু গৌতম একটা ব্যাপারে মনস্থির করেছিলেন। তিনি নিজে পাত্রী দেখবেন ও পছন্দ করবেন। তাই সমস্ত তরুণ সভাপদ যাদের বিবাহযোগ্য ভগিনী ছিল একসঙ্গে সাত দিনের জন্য সভায় নিমন্ত্রিত হলেন। প্রতিদিন সকালে নানারকম খেলাধুলা চলতে লাগল, হয় গদা খেলা, বা তলোয়াল খেলা বা অশ্বলায়ন। বিকেলে নানা ধরনের খেলার প্রদর্শনী যেমন লোফালুফির খেলা, সাপ খেলা ইত্যাদি এবং নাটকের আয়োজন হতো। এগুলো রাজপ্রাসাদের প্রদর্শনালাতেই হতো এবং সবাই একসঙ্গে বিনোদনের আনন্দ নিতেন।

রাজা নিজে, মন্ত্রীরা এমনকি সভাসদরাও সবাই একজন বিশেষ নারীর কথা ভাবছিলেন, যাকে গৌতম পছন্দ করবেন। তার সৌন্দর্য, গুণ ও কৌলীন্য অন্য সবার চেয়ে বিশিষ্ট ছিল। তার নাম যশোধারা। যেদিন শেষদিন এল, গৌতম দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে একে একে অতিথিদের কোনো না কোনো অসাধারণ বিদায় উপহার দিয়ে বিদায় জানালেন- কাউকে কল্কহার, কাউকে কঙ্কন, কাউকে বহুমূল্য রত্ন। যখন যশোধারার পালা এল তাকে দেওয়ার মতো একটি ফুল ছাড়া গৌতমের কাছে আর কিছু ছিল না। তিনি নিজের পোশাকের ভিতর থেকে একটি ফুল বের করে যশোধারার হাতে দিলেন। যারা দাঁড়িয়ে দেখছিলেন, মনে করলেন যশোধরাকে বুঝি তার পছন্দ নয়, তাই এই অবহেলা। যশোধরা নিজে ছাড়া আর সবাই খুব দুঃখিত হলেন। তার কাছে ওই একটি ফুল অন্য বান্ধবীদের মূল্যবান উপহারের চেয়েও আরও মূল্যবান বলে মনে হলো। পরদিন কপিলাবস্তুর রাজা যখন নিজে তার বাবার কাছে এসে ছেলের জন্য তাকে চাইলেন, তিনি একেবারেই  আশ্চর্য হলেন না। তার শুধুই এটাই অবাক লাগল যে সবকিছু যেন কী স্বাভাবিক ও সরল। তিনি মনে মনে হয়তো আবছাভাবে সচেতন ছিলেন যে, পূর্বতন বহু জীবনের শৃঙ্খলে তিনিই তো তার স্ত্রীর ছিলেন। কিন্তু যশোধারা এমনই একজন যার নামে বহু পাণিপ্রার্থী আকৃষ্ট হতো। এবং মর্যাদার রীতি অনুসারে গৌতমকে তার শৌর্য প্রমাণ করেই তাকে জয় করতে হবে। রাজবংশের এমনই ধারা ছিল। এই রীতি অনুযায়ী রাজপুত্রের প্রস্তাব কন্যার পিতা গ্রহণ করলেন।

গৌতম তার প্রস্তাব গ্রহণে উৎফুল্ল হলেন এবং সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্ধারিত দিনে প্রতিযোগিতার আহ্বান জানালেন। তার আত্মীয়রা বললেন, হায়! তুমি কী করবে? তুমি কোনোদিন উড়ন্ত পাখিকে বা পলায়মান হরিণকে নিশানা করোনি, কখনো দৌড়রত শূকর হত্যা করনি? তুমি কী করে বিশাল ধনুকে প্রসিদ্ধ তিরন্দাজদের পরাস্ত করবে? তিনি হাসি ছাড়া উত্তরে কিছু বললেন না। ভয় তার কাছে অজানা আর নিজের অন্তরে তিনি এক অদ্ভুত শক্তি অনুভব করছেন। নির্দিষ্ট সময়ে দেখা গেল তার আত্মবিশ্বাস সঠিক ছিল, কারণ তিনি সবার থেকে এগিয়ে সব পুরস্কার নিয়ে বিজয়ী হলেন।

রাজকুমার গৌতমের সঙ্গে যশোধারার বিয়ে হয়ে গেল। তাদের ভাবী বাসভবনকে পুরোনোটির চেয়েও বেশি সুন্দর করা হলো। নতুন রাজপ্রাসাদ একটি জলাধারের ওপর। প্রাসাদের খিলান সব গোলাপরাঙা পাথরের আর ঘন বাদামি রঙের কাঠের, বাগানের একপ্রান্তে শ্বেত পাথর নির্মিত এক দ্বীপ ঘিরে উচ্ছল একটি ঝরনা। সেই দ্বীপে গ্রীষ্মবাস- শ্বেত, শীতল, মর্মরকক্ষ তৈরি হলো। সারা প্রাসাদ ঘিরে নদীর বুকে গোপন ফোয়ারারা যখন ইচ্ছে তখন জল দান করে। জানালাগুলোতে হয় কাঠের জাফরি, নয় ছিদ্র করা মর্মরের ঝরোখা। যার ফলে আব্রু থাকবে, আলো থাকবে, ছায়া থাকবে। এই জানালা দিয়ে দেখা যাবে প্রসারিত ফুল গাছশোভিত বাগান, পুষ্পলতার বিভাজিকা। প্রতিটা বড় রাজকীয় হলঘরের কোনে ছাদের বর্গা থেকে লম্বা শিকলে ঝুলছে দুজনে বসে দোল খাওয়ার মতো দোলনা- তার তিন দিক ঘেরা, ভিতরে গদি, বালিশ।  গ্রীষ্মের দিনে এতে বসে দোল খাওয়া যায় ও শীতল বাতাসের স্পর্শ পাওয়া যায়, আবার মনে হলে অলসভাবে শুয়েও থাকা যায়। সেবিকারা ধীর লয়ে পাখা দুলিয়ে বাতাস করতে পারে। সিংহাসনে বসবেন যিনি সেই রাজকুমারকে ঘিরে যারা থাকবে, তাদের সযত্নে তাদের সুন্দর চেহারা বা প্রাণবন্ত দেখে নির্বাচন করলেন এক মন্ত্রী। রাজকুমারের কানে কোনো বিলাপ, কোনো অশ্রুমোচনের শব্দ যেন না পৌঁছায়। তিনি যেন কোনোভাবেই রোগ, জরা ক্ষয়ের সম্মুখীন না হন। তিনি যদি কখনো নগরীতে যেতে চান তাকে যেন তখনই নানা বিনোদন, আনন্দে অন্যমনস্ক করে দেওয়া হয়। এমনই ছিল রাজার কড়া হুকুম। কিন্তু অদৃষ্টের লিখন কে খণ্ডাবে? রাজা এই সত্যের কথা স্বপ্নেও ভাবেননি যে, তার সব প্রচেষ্টা নির্দিষ্ট সময়ে তার আশঙ্কাই আরও বাড়িয়ে দেবে। তিনি ছেলের জন্য যে জীবন সাজিয়েছেন, তা বাস্তব নয়- একটা স্বপ্ন, একটা নাটক। সত্য সর্বদাই মিথ্যার চেয়ে শ্রেয়, এবং কোনো না কোনো সময়ে কুমারের মনে সত্যের প্রতি আগ্রহ জাগবেই। ঠিক তাই হলো। একদিন গৌতম নিজের সারথীকে বললেন, প্রাসাদের পাঁচিলের বাইরে নিজের নগরী কপিলাবস্তুতে তাকে নিয়ে যেতে, তার ভবিষ্যৎ রাজ্যের রাজধানীতে। হতবাক সারথীর আদেশ পালন ছাড়া উপায় ছিল না। তার অমান্য করার কোনো সাধ্য নেই। কিন্তু রাজা জানতে পারলে কী হবে ভেবে রাজার ক্রোধকেও যেন ভয় পেল প্রচণ্ড।

তারা কপিলাবস্তু গেলেন এবং সেদিন প্রথমবারের জন্য গৌতম বাস্তব জীবনকে কাছ থেকে দেখলেন। ঘিঞ্জি রাস্তায় বাচ্চাদের খেলতে দেখলেন। বাজারে খোলা দোকানে ব্যবসায়ীরা বসে খদ্দেরদের সঙ্গে দরদাম করছে, সামনে পসরা সাজানো। সূচিশিল্পী, কুমোর, পিতলের কামার- সবাই নিজের নিজের পসরা সাজিয়ে বসে কাজে ব্যস্ত। তার সাগরেদ পাশে বসে হাঁপর টানছে, আগুন জ্বলে উঠে ধাতুকে গরম করছে। কুমারের সাগরেদ তার জন্য চাক ঘুরিয়ে চলেছে। মালবাহকরা মাল নিয়ে নিয়ে ক্লান্ত মুখে যাওয়া-আসা করছে। ছাইমাখা এক সাধু লম্বা লাঠি নিয়ে হেঁটে চলেছে। অর্ধভুক্ত কুকুরগুলো একে অন্যকে দেখে খাবার নিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে গজরাচ্ছে, গ্রাম থেকে আসা ফল, শস্য, তুলাভরা গরুর গাড়ি দেখেও সরছে না। খুব কম মহিলা চোখে পড়ল, তাও অল্পবয়সি নয়, কারণ দুপুর হয়ে এসেছে। সকালের স্নানের সময় শেষ হয়ে  গেছে অনেকক্ষণ, তবু এক-আধজন যুবতীকে দেখা যাচ্ছে- ঘোমটা টানা, মাথায় বড় পিতলের কলসি। বাড়িতে জল নিয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও রাস্তাঘাট রঙিন। কারণ পুবের মানুষদের পোশাকের অঙ্গ উজ্জ্বল রঙের রেশম বা পশমের শাল বা চাদর, বাঁ কাঁধের ওপর দিয়ে ফেলে ডান হাতের নিচ দিয়ে টানা। তাই শহরের ভিড়ে মেয়েদের পায়ের নুপুরের রুনুঝুনু ধ্বনি শোনা না গেলেও, প্রচুর ফিকে সবুজ, গোলাপি, বেগুনি, হলুদ, তুঁতে নীলের সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। জনবহুল রাস্তা উজ্জ্বল ও রঙিন দেখতে লাগে। গৌতম সারথির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি এখানে দেখছি শ্রম, দারিদ্র্য, ক্ষুধা- তাও কত সৌন্দর্য, প্রেম, আনন্দের মধ্যে মিশে আছে- সত্যি জীবন এতসব সত্ত্বেও কী মধুর!

তিনি নিজের মনেই এই কথাগুলো বললেন এবং ধীরে ধীরে সেই তিন অমোঘ শব্দের কাছাকাছি উপনীত হলেন- মানুষের তিনটি দুঃখ- ক্লান্তি, ব্যাধি ও মৃত্যু। গৌতমের জীবনে সেই মহাক্ষণটি এসে গেল। প্রথমে এল ক্লান্তি। এক বৃদ্ধ, অতি বৃদ্ধ মানুষ, তার মাথায় চুল নেই, মুখ দন্তহীন, হাত কাঁপছে- এই রূপ ধরে এল ক্লান্তি। ক্লান্তি তাকে জীবন্মৃত করে রেখেছে। লাঠিতে ভর দিয়ে সে তার শীর্ণ রোগগ্রস্ত হাত বাড়াল ভিক্ষার জন্য। রাজকুমার ঝুঁকে পড়ে ভিক্ষা দান করলেন আগ্রহভরে- বৃদ্ধ যা আশা করতে পারত তার চেয়ে অনেক বেশি। তার মনে হলো, তার নিজের আত্মাই বোধহয় ডুবে যাচ্ছে। ‘ও ছন্দক’ তিনি সারথিকে ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কী, এটা কী? এ কী? ওর কী হয়েছে?

ছন্দ সান্ত্বনার সুরে বলল, ‘না, সেরকম কিছু না। মানুষটি শুধু হয়েছে।’ ‘বৃদ্ধ!’ গৌতম বললেন, আর কল্পনা করতে লাগলেন পিতার পাকা চুল এবং রাজ্যের বৃদ্ধ মন্ত্রীদের কথা। ‘কিন্তু সব বৃদ্ধ তো এরকম হয় না।’ সারথি বলল, হ্যাঁ হয়, যদি যথেষ্ট বৃদ্ধ হয়। ‘আমার পিতা?’ কুমার বললেন, কিন্তু তার কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে এল, ‘পিতা? যশোধারা? আমরা সবাই এরকম?’ সারথি গম্ভীর হয়ে বলল, ‘সবাই বৃদ্ধ হবেন, আর কেউ যদি অতি বৃদ্ধ হয়, তার এই দশাই হবে।’ গৌতম নীরব হয়ে গেলেন, ভয় এবং করুণা দুই-ই তাকে আচ্ছন্ন করল। কিন্তু মাত্র এক মুহূর্তের জন্য, কারণ ততক্ষণে রথের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এমন একজন ভয়ংকরদর্শন মানুষ যার শরীরের চামড়ায় গোলাপি ছোপ- এবং যে হাত সে মেলে ধরেছে, তার অনেক গাঁট নেই। আমাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই দেখলে চোখ ঢেকে তাড়াতাড়ি সরে যেতাম। কিন্তু গৌতম সে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখালেন না- মায়াভরা কণ্ঠে বললেন,  ‘আমার ভাই!’ এবং করুণায় উদ্বেলিত হয়ে শ্রদ্ধাভরে তাকে একটি মুদ্রা দান করলেন। ‘ও কুষ্ঠরোগী’ ছন্দক বলে উঠল, ‘ও কুষ্ঠরোগী, আমরা এগিয়ে যাই।’ ইতোমধ্যে লোকটি গৌতমের কণ্ঠস্বরের কোমলতায় চমকে উঠেছে। ‘এর মানে কী ছন্দক?’ গৌতম জিজ্ঞেস করলেন। ‘এর অর্থ রোগ ওকে গ্রাস করেছে, প্রভু।’ ‘রোগ! রোগ! সেটা কী?’ কুমার আবার প্রশ্ন করলেন। ‘প্রভু, এ এক যাতনা যা শরীরকে আক্রমণ করে। কেউ জানে না কেন বা কীভাবে। এ আরামকে নষ্ট করে দেয়। চরম গ্রীষ্মে অসুস্থ মানুষের শীত করে, পাহাড়ি বরফেও গরম অনুভব করে। এর প্রকোপে কেউ পাথরের মতো ঘুমায়, কেউ উত্তেজনায় পাগল হয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শরীর গলে গলে পড়ে আবার কোনো ক্ষেত্রে শরীর আকৃতি ঠিক রাখে কিন্তু এমন শীর্ণ হতে থাকে যে হাড় গোনা যায়। আবার কখনো এমন ফুলে উঠে বীভৎস আকার ধারণ করে। রোগ এমনই হয়। কেউ জানে না কোথা থেকে হয়, কী থেকে হয় বা কখন আমাদের আক্রমণ করবে।

‘এই হলো জীবন- যে জীবনকে আমি মধুর ভাবতাম’, বললেন গৌতম। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর চোখ তুলে চাইলেন, ‘মানুষ কীভাবে জীবন থেকে নিষ্কৃতি পায়?’ তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘মানুষের কে এমন বন্ধু আছে যে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে?’

‘মৃত্যু’ বলল ছন্দক। ‘দেখুন, ওই আসছে শববাহীরা। নদীর ধারে নিয়ে যাবে শবদেহকে পোড়াতে।’

রাজকুমার তাকিয়ে দেখলেন চারজন বলশালী লোক, কাঁধে একটি নিচু চৌকি, তার ওপর শায়িত সাদা চাদরে ঢাকা একটি মনুষ্য আকৃতি। মানুষটি নড়ছে না, সে চাদরের তলায় স্থির এবং যদিও বাহকরা প্রত্যেক পদক্ষেপে বলে যাচ্ছে, ‘হরি বোল,’ যাকে তারা নিয়ে যাচ্ছে, সে এই প্রার্থনায় নিরুত্তর। সারথি বলল, ‘কিন্তু মানুষ মৃত্যু ভালোবাসে না। তাদের কাছে মৃত্যু বন্ধু নয়- বরং তারা আয়ু ও রোগের থেকেও মৃত্যুকে বড় শত্রু বলে মনে করে। মৃত্যু তাদের আচমকা হানা দেয় এবং তারা একে ঘৃণা করে ও প্রাণপণ এড়ানোর চেষ্টা করে।

গৌতম এবার শবযাত্রার মিছিলের দিকে ভালো করে তাকালেন। তার ভিতরে যেন অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেল, তিনি বুঝতে পারলেন মানুষ কেন মৃত্যুকে ঘৃণা করে। মনে হলো যেন তার চোখের সামনে দিয়ে ছবির সারি চলমান। তিনি দেখতে পেলেন যে, মৃত ওই মানুষটির আগে বহুবার মৃত্যু হয়েছে এবং প্রতিবারই তার নবজন্ম হয়েছে। তিনিও এও দেখলেন যে, এই মৃত্যুর পরও ব্যক্তিটি নিশ্চিত এই পৃথিবীতে ফিরবেন। ‘যার জন্ম হয়, তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, যার মৃত্যু হয় তার জন্ম অবশ্যম্ভাবী।’ তিনি বললেন, ‘এই জীবনচক্রের ঘূর্ণিতে কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই। ছন্দক, বাড়ি চলো।’

সারথি আদেশ পালন করল। রাজকুমার আর কোনো প্রশ্ন করলেন না, তিনি চিন্তার রাজ্যে হারিয়ে গেলেন। রাজপ্রাসাদে ফিরে- যা যা তার এতকাল মনোহর লাগত সব বিষময় মনে হতে লাগল। সবুজ মখমলি ঘাসের বাগিচা আর পুষ্পিত বৃক্ষ কীই-বা কাজের, এ সবই তো সত্য থেকে আড়াল করার খেলনা মাত্র। তিনি ও যশোধারা তো শিশুর মতো এসব খেলনা নিয়ে সেই বাগানে বসে খেলা করেন, যে বাগানের নিচে অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরি যে কোনো মুহূর্তে উদ্গিরণ করে তাদের ধ্বংস করবে। শুধু তারাই নন, অন্য সব মানুষই এই সত্য ভোলানো খেলা খেলে চলেছে, হয়তো-বা তাদের চেয়ে খেলা উপভোগ করার কিছু কম কারণ আছে তাদের। তার হৃদয় এক মহান উদ্বেলিত করুণার সাগরে পরিবর্তিত হয়েছে, শুধুমাত্র মানুষের জন্য নয়, সব জীবের জন্য ভালোবাসার ক্ষমতা আছে ও কষ্ট সহ্য করারও ক্ষমতা আছে। ‘জীবন ও মৃত্যু এক দুঃস্বপ্ন।’ তিনি নিজের মনে মনে বলছিলেন, ‘আমরা কী করে একে চূর্ণ করে জেগে উঠব?’

মানুষের জীবনের তিনটি মহান দুঃখ তাকে বিদ্ধ করল ঠিক যেমনটি তার জন্মের সময় সেই জ্ঞানী ব্যক্তিরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি খেতেও পারলেন না, বিশ্রাম নিতেও পারলেন না। প্রায় মাঝরাতে যখন পুরো রাজপ্রাসাদ ঘুমে মগ্ন, তিনি উঠে নিজের ঘরে পায়চারী করতে লাগলেন। একটি জানালা খুলে বাইরে ঘন অন্ধকার রাতের দিকে চেয়ে রইলেন। বাতাসের এক ঝটকা গাছের মাথার ওপর দিয়ে বয়ে গেল, মনে হলো মাটি যেন কেঁপে উঠল। এই বিশ্ব যেন তাকে বলল, ‘জাগো! তুমি যে জেগে উঠেছ, ওঠো, বিশ্বকে সাহায্য করো।’ কুমারের মন নিঃসন্দেহে এই অমোঘ ডাক শুনলেন এবং শব্দে উচ্চারিত না করেও এর মহাত্ম্য বুঝলেন। তিনি বাইরে রাতের তারার দিকে তাকিয়ে নিজের অন্তরে পথ খুঁজতে চাইলেন, কীভাবে এই জীবনের স্বপ্ন থেকে তিনি বেরিয়ে আসবেন ও তার নিয়তি নির্ধারিত স্থানে পৌঁছবেন। এভাবে ব্যাকুল মনে যখন তিনি দিশা হাতড়াচ্ছেন তখন তার হঠাৎ মনুষ্যজাতির প্রাচীন জ্ঞানী ঋষিদের কথা মনে এল। তিনি বলে উঠলেন, ‘এই খোঁজই তো সেই খোঁজ বা যুগে যুগে মানুষকে সংসার ত্যাগ করে গহন বনে, ভস্ম মেখে জীবনধারণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তারা নিশ্চয় কিছু জানতে পারেন। এই সেই উপায়। আমিও সেই রাস্তাতেই যাব। তারা তো অর্জিত জ্ঞান বিতরণ করার জন্য আর সংসারে ফেরেন না। তারা নিজেদের মধ্যেই সেই জ্ঞান সঞ্চিত রাখেন বা অন্য জ্ঞানীদের সঙ্গে বিনিময় করেন। আমি যখন এই গোপন রহস্যোদ্ধার করতে পারব, তখন আমি ফিরব, সব মানুষকে আমার জ্ঞানের কথা বলব। তখন নিম্ন থেকে নিম্নতম বর্গের যে সেও জানবে, উচ্চতম বর্গের যে সেও জানবে। মুক্তির উপায় গোটা বিশ্ব জানবে। এই কথা কয়টি নিজ মনে উচ্চারণ করে, জানালা বন্ধ করলেন এবং নিজের ঘুমন্ত পত্নীর শয্যাপাশে এলেন। ধীরে পর্দাগুলো সরিয়ে যশোধারার মুখপানে চাইলেন। এই সময়ই তার মনে প্রথম দ্বন্দ্ব শুরু হলো। তার কি যশোধারাকে পরিত্যাগ করার কোনো অধিকার আছে? তিনি আর কখনো নাও ফিরতে পারেন। একজন রমণীকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিধবা করা কি সাংঘাতিক ও নিষ্ঠুর কর্ম নয়? তার শিশু পুত্রকেও বড় হতে হবে পিতৃস্নেহ ছাড়া? জগতের জন্য আত্মত্যাগ ভালো কিন্তু অপরকে সেই ত্যাগে বাধ্য করা কি উচিত?

তিনি পর্দা আবার টানলেন এবং জানালার কাছে ফিরে গেলেন। তারপরই তার মধ্যে এক উপলব্ধি এল। মনে পড়ল যশোধারার মন সময়ে কত উচ্চ ও মহান মনে হয়েছে তার কাছে। তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি যা করতে চলেছেন তার মধ্যে যশোধারারও অংশ থাকবে। তাকে হারানোর যে তীব্র বেদনা, তাতে গৌতমের ত্যাগের অর্ধেক যশোধারার হয়ে উঠবে, আবার তিনি যে জ্ঞান ও আলোকপ্রাপ্ত হবেন তারও অর্ধেক যশোধারার হবে। তিনি আর দ্বিধা করলেন না। আবার বিদায় জানাতে কাছে গেলেন। রেশমের পরদাগুলো সরিয়ে নিচের দিকে তাকালেন। তাকে জাগাতে চাইলেন না, তাই সামনে ঝুঁকে তার পায়ের পাতায় চুম্বন করলেন। ঘুমের মধ্যে যশোধারা একটু আওয়াজ করে পা গুটিয়ে নিলেন। 

নিচে নেমে তিনি ঘুমন্ত ছন্দককে কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগালেন এবং বললেন, রথের সঙ্গে এক্ষুনি নিঃশব্দে ঘোড়া বাঁধতে। তারপর তারা চুপচাপ সিংহদ্বার থেকে বেরিয়ে বড়ো রাস্তায় পড়লেন এবং ঘোড়া দ্রুত ছুটতে লাগল। ধীরে ধীরে কুমার পিতৃগৃহ থেকে বহুদূর চলে গেলেন। ভোর হতে উনি থামলেন এবং রথ থেকে নামলেন। তারপর একের পর এক তার পোশাক ও আভরণ খুলতে লাগলেন। ছন্দকের হাত দিয়ে সব ফেরত পাঠালেন। সেগুলো প্রেমপূর্ণ উপহাররূপে একে-তাকে বার্তা দিয়ে পাঠালেন। তারপর নিজে ভিক্ষুকের পোশাক গোলাপি বস্ত্র পরলেন, গায়ে ভস্ম মাখলেন। হাতে নিলেন লাঠি আর ভিক্ষাপাত্র। ছন্দক অশ্রুপূর্ণ চোখে তার পায়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানালেন। গৌতম বললেন, ‘পিতাকে বলো, আমি ফিরে আসব।’ তারপর সংক্ষিপ্ত বিদায় জানিয়ে, জঙ্গলে মিলিয়ে গেলেন। ছন্দক সেই স্থানে রাজকুমার অদৃশ্য হওয়ার পরও অনকেক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ঝুঁকে শ্রদ্ধাবণত চিত্তে যেখানে কুমার দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানকার ধুলো তুলে মাথায় ঠেকালেন, তারপর রথ ঘুরিয়ে খবর দিতে গেলেন রাজাকে।

একটানা ছয় বছর রাজকুমার গৌতম তার সন্ধানে নিমগ্ন রইলেন। অবশেষে এক রাত্রে ধ্যানস্থ অবস্থায়, বোধিবৃক্ষের নিচে তিনি গভীর সত্য উপলব্ধি করলেন এবং সব জ্ঞানের উন্মেষ ঘটল। তখন থেকে তার আর সব নাম হারিয়ে গেল এবং তিনি পরিচিত হলেন ‘বুদ্ধ’ নামে। সেই আলোকপ্রাপ্তীর চরম মুহূর্তে তিনি উপলব্ধি করলেন যে জীবনের প্রতি তৃষ্ণাই সব দুঃখের কারণ। বাসনা থেকে মুক্ত হলে মানুষ সত্যেই মুক্তিপ্রাপ্ত হয়। এবং তিনি এই মুক্তির নাম দিলেন, ‘নির্বাণ’ এবং নির্বাণের প্রতিকূলতা ভরা এই পথকে তিনি আ্যখ্যা দিলেন ‘শান্তির’ পথ।

এই সবই ঘটেছিল সেই বনে, যার নাম আজ বুদ্ধগয়া, এবং আজও যেখানে সেই মহান বোধিবৃক্ষের পাশে একটি সুপ্রাচীন মন্দির আছে, যার প্রাচীনতা ঠিক বোধিবৃক্ষের পরই। বুদ্ধ সেখানে কিছুদিন থাকলেন, অনেক কথা ভাবলেন, তারপর সেই বন ছেড়ে বারাণসীতে এলেন এবং সেখানে মৃগবনে পাঁচজন সন্ন্যাসীর কাছে প্রথম বাণী প্রচার করলেন। এই সময় থেকেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল এবং বহু সংখ্যক মানুষ তার অনুগামী হলেন। দুই ব্যবসায়ী কপিলাবস্তু যাাচ্ছিলেন, তাদের মাধ্যমে তিনি পিতা ও যশোধারাকে খবর পাঠালেন যে তিনি নিশ্চয় বাড়ি যাবেন। অবশেষে বুদ্ধের খবর পেয়ে তাদের আর আনন্দের সীমা রইল না। বৃদ্ধ রাজা চাইছিলেন পুত্রের জন্য রাজকীয় অভ্যর্থনার আয়োজন করতে কিন্তু তিনি দেখলেন বহু লোকের ভিড় জমেছে, রাজদ্বারে সেনারা প্রস্তুত, অস্থির ঘোড়ারা হ্রেষারব তুলছে আর সেখানে আগত আপাদমস্তক হলুদ রঙে আবৃত এক ভিক্ষু, তিনি মানুষের ভিক্ষা গ্রহণ করছেন। মহারাজের তাঁবুর পাশ দিয়ে তিনি যখন যাচ্ছিলেন, রাজা দেখলেন এ তো তারই পুত্র। যিনি সাত বছর আগে গহিন রাতে রাজ্যে ত্যাগ করেছিলেন আর আজ বুদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছেন। কিন্তু ভিক্ষু বুদ্ধ কোথাও না থেমে সোজা এগিয়ে গেলেন নিজের প্রাসাদের দিকে এবং নিজের ঘরে স্ত্রী-পুত্রের সামনে এসে দাঁড়ালেন। যশোধারাও হলুদ বস্ত্র ধারণ করেছিলেন। যেদিন সকালে তিনি জেগে উঠে জেনেছিলেন তার স্বামী সংসার ত্যাগ করে বনে গেছেন, সেই দিন থেকে তিনি তার স্বামীর জীবনধারার অংশীদার হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি ফলমূল ছাড়া কিছু খাননি, ছাদ বা বারান্দার মেঝেতে ছাড়া আর কোথাও শয়ন করেননি। তিনি রাজকুমারীর সব আবরণ ও আভরণ দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনি শ্রদ্ধাভরে গৌতমের পায়ের কাছে বসলেন ও তার পরিহিত বস্ত্রের প্রান্তের বাঁ-দিকে চুম্বন করলেন। তারা প্রায় কোনো কথাই বললেন না। বুদ্ধ তাকে আশীর্বাদ করলেন ও চলে গেলেন। তখন যশোধারার মনে হলো তিনি স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলেন। তাড়াতাড়ি পুত্রকে ডেকে বললেন, ‘যাও পিতার কাছে, গিয়ে চাও তোমার উত্তরাধিকার। ‘মা, আমার বাবা কে?’ বালকটি ভীতুস্বরে মুণ্ডিত মস্তক, হলুদ পরিহিত ভিড়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু যশোধারা কোনো বর্ণনা দিলেন না, ‘তোমার পিতা’ তিনি বললেন, ‘ওই পুরুষসিংহ যিনি তোরণের দিকে যাচ্ছেন।’ বালকটি সোজা পিতার কাছে গিয়ে বলল, ‘পিতা, আমাকে পৈতৃক উত্তরাধিকার দিয়ে যান।’ সে কথা তিনবার বলার পর, বুদ্ধের প্রধান শিষ্য আনন্দ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি দিতে পারি?’ বুদ্ধ বললেন, ‘দাও’ এবং সেই হলুদ বস্ত্র বালকের গায়ে ফেলে দেওয়া হলো। তারা ফিরে দেখলেন, পেছনে মা আসছেন, তার মাথায় ঘোমটা টানা। তিনি নিশ্চিত স্বামীর সঙ্গে থাকতে চাইছেন। কোমল হৃদয় আনন্দ আবার জিজ্ঞেস করল, ‘প্রভু, কোনো নারী কী আমাদের সংঘে আসতে পারেন না? তিনি কি আমাদের একজন হতে পারেন না?’ বুদ্ধ বললেন, ‘মানুষের জীবনের তিন যন্ত্রণা কি পুরুষদের মতো নারীদের জীবনেও ঘটে না? তা হলে শান্তির পত্রে তাদের চরণচিহ্ন পড়বে না কেন? আমার সত্য, আমার সংঘ সবার জন্য। তবু এই অনুরোধ তোমরই করা ভবিতব্য ছিল, আনন্দ।’ যশোধারাও সংঘে গৃহিত হলেন। তিনি বুদ্ধের কাছাকাছি একই কাননে বাস করতে লাগলেন ও সংঘের ধর্মপালন করতে শুরু করলেন। তার দীর্ঘ বৈধব্যের অবসান ঘটল এবং অবশেষে তিনিও শান্তির পথে পা বাড়ালেন।

জগতের সব প্রাণী সুখী হোক

লেখক: অধ্যক্ষ, সিলেট বৌদ্ধবিহার

শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা: অস্তিত্বের সংকটে সমতলীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৪, ০৪:৩৬ পিএম
শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা: অস্তিত্বের সংকটে সমতলীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়
বিপ্লব বড়ুয়া

মহামানব গৌতম বুদ্ধ আজ থেকে আড়াই হাজারের বছর পূর্বে যে শান্তি ও মৈত্রীর বাণী প্রচার করেছিলেন, একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক এই বিশ্বজগতে এর কতটুকু প্রতিফলন ঘটছে, বিশ্বব্যাপী তা এখন অন্যতম গবেষণার বিষয়। তৎসময়ে ভগবান তথাগত গৌতম বুদ্ধ হিংসা, শত্রু, যুদ্ধ, বিদ্রোহ, সহনশীলতা, বৈরিতা, সুখ, দুঃখ, ভোগ, বিলাস থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে নিজে জয় করে মানবমুক্তির উদ্দেশ্যে মৈত্রী, শান্তি, সম্প্রীতির বাণী প্রচার করে মানুষের জীবনমানে এক আমুল পরিবর্ত ঘটিয়েছিলেন। আজ তার বাণী ও দর্শন বিশ্বের জ্ঞান-ভান্ডারকে আলোকিত করেছে। 

তিনি কোনো ধর্মপ্রচারক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবিক দর্শনের পুরোধা প্রবক্তা। যেটি নিজে আত্মস্থের মধ্য দিয়ে মানুষ হিসেবে প্রতিনিয়ত দুঃখ নিপীড়িত জর্জরিত জীবন থেকে মুক্তির পথে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি রক্ত মাংসের শরীরে গড়া মায়ের গর্বে জন্ম নেওয়া একজন অদ্ধিতীয় দৃশ্যমান ব্যক্তি মানবতার জয়গান গেয়ে মানুষের মনের গহীনে ঠাই করে নিয়েছেন। 

তিনি অলোকিকতা বিশ্বাস করতে নিষেধ করেছেন। শোনা কথায় কান দিতে নিষেধ করেছেন। যাচাই-বাচাই করে ভাল লাগলে গ্রহণের কথা বলেছেন, খারাপ লাগলে ত্যাগ করার কথা বলেগেছেন। ভগবান বুদ্ধ বলেছেন বলে গ্রহণ করতে হবে তারও সর্তকবাণী দিয়েছেন। প্রাণী হত্যা, মিথ্যা কথা, চুরি, ব্যভিচার, লোভ, স্বার্থপরতা, অন্যের ক্ষতিসাধন থেকে মুক্ত থাকার কথা যেমন তিনি বলেছেন, তেমনি বলেছেন শত্রুকে মৈত্রী দিয়ে জয় করার কথা।

কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বব্যাপী এখন ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা। নিরস্ত্র মানুষের সবলের প্রাণ সংহার, ধর্মের নামে মিথ্যার বসবাস। উগ্রবাদীদের প্রবল উন্মাদনায় সময়ে সময়ে বৌদ্ধ সংস্কৃতি হয়েছে আঘাতপ্রাপ্ত। অন্য ধর্মের মতবাদীদের দোষ দিই কেন! যেখানে এখন খোদ নিজ সম্প্রদায়েরর লাল কাপড় পরিহিতি গুটিকয়েক ছদ্মনামধারী ধর্মগুরুরা যখন ধর্মের নামে রাজনীতি-ব্যবসা খুলে সন্ত্রাসীদের সাথে উঠাবসা করে, ধর্মালয়ে সাধারণ গৃহীদের গায়ে হাত তুলে, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধ্বংযজ্ঞ, নারীর শাড়ি টেনে খুলে ফেলে নোংরা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা গুজব রটিয়ে পুরো দেশও সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তি খুন্ন করে এই সব ধর্মগুরুরা কোন আদর্শ বাস্থবায়ন করার পথে নেমেছে সাধারণ ধর্মপ্রাণ নর-নারীর বোধগম্য নয়! 

যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যে দিয়ে দেশকে বিশ্বের সামনে উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত করছে সে মুহুর্তে বৌদ্ধ উগ্রবাদী ধর্মগুরুদের এমন আস্ফালন দেশ ও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্র!

মহামানব সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে নেপালের দেবদেহ নগরের সীমান্ত অঞ্চলের লুম্বিনী কাননের উদ্যানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন কপিলাবস্তু নগরীর রাজা শুদ্ধোধন। মায়ের নাম রাণী মহামায়া। সিদ্ধার্থের জন্মের সাতদিন পর মা মহামায়া ইহলোক ত্যাগ করেন। মায়ের মৃত্যুর পর কুমার সিদ্ধার্থকে কোলেপিঠে লালন পালন করে আপন সন্তানের মায়ায় বড় করে তুলেন সৎমা মহাপ্রজাপতি গৌতমী।

গৌতমী এমন স্নেহ-আদরে মানুষ করেন এ কথা সন্তান সিদ্ধার্থকে কখনো বুঝার সুযোগ দেয়নি। সংসারের প্রতি ছিল উদাসীন কুমার সিদ্ধার্থকে সংসার অনুরাগী করার জন্য ১৬ বছর বয়সে যশোধরা নামের সুন্দরী এক রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়। সিদ্ধার্থ-যশোধরা দম্পতির কোল আলো করে একটি সন্তান পৃথিবীতে আসে। ছেলের নাম রাখলেন রাহুল। 

এদিকে সংসারচক্রে উদাসীন ছেলে সিদ্ধার্থকে খুশি রাখতে পিতা রাজা শুদ্ধোধন চার ঋতুর জন্য চারটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। যেখানে পুত্রের মনোজগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে সবরকম সুযোগ সুবিধা প্রদান করেন তাঁর পিতা। একদিন কুমার সিদ্ধার্থ রথে চড়ে নগর পরিভ্রমণের জন্য বের হন। ছেলের এমন মনোযোগে পিতা রাজা শুদ্ধোধন সারা কপিলাবস্তু নগরীতে সাধারণ মানুষদেরকে উৎসব করার নির্দেষ প্রদান করেন। বেশ কয়েকদিন ভ্রমণে বের হয়ে কিছু প্রশ্ন তাঁকে পেয়ে বসে। যে বিষয়গুলো রাজ সন্তানের জন্য কাঙ্খিত ছিল না।

প্রথম দিন পরিভ্রমণে বের হয়ে দেখেন এক বৃদ্ধ ব্যক্তি জীর্নশীর্ন অবস্থায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাফেরা করছেন। দ্বিতীয় দিন একজন অসুস্থ মানুষ রাস্তার ধারে কাঁতরাচ্ছেন। তৃতীয় দিন কিছু মানুষ এক মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য তাঁর দৃষ্টি গোচরীভূত হয়। চতুর্থদিন একজন সন্ন্যাসীকে হেঁটে যেতে দেখে তিনি তাঁর সঙ্গে থাকা সারথীকে প্রশ্ন করেন- হে সারথি, এই চার দিন একে একে আমি রক্তমাংসে গড়া মানুষদেরকে যে অবস্থায় দেখলাম, তাদের জীবনটা এরকম হলো কেন? সারথি সিদ্ধার্থকে বললেন, ‘হে রাজপুত্র- জগত দুঃখময়’।

আরও বললেন, সংসারের মায়া-মমতা, রাজ্য, ধন-সম্পদ কোনো কিছুই চিরকাল স্থায়ী নয়। এই সুন্দর অবিনশ্বর পৃথিবী থেকে সবকিছু একদিন মুছে যাবে। আপনজন বলতে কোনো কিছুই থাকবে না। এইভাবে কুমার সিদ্ধার্থ দুঃখের কারণ খুঁজতে গিয়ে ২৯ বছর বয়সে এক বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে পরিবারের সকলের অগোচরে গৃহ ত্যাগ করেন। পাহাড়-পর্বত, বনে-জঙ্গলে নীরব কোলোহল মুক্ত পরিবেশে দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনার পর ভারতের বিহার প্রদেশের বুদ্ধগয়া নামক স্থানে ৫৮৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ৩৫ বছর বয়সে বোধি বৃক্ষের নিচে বোধিজ্ঞান লাভ করে সম্যকসম্বুদ্ধ প্রাপ্ত হন। 

এরপর তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘ ৪৫ বছর তাঁর অর্জিত জ্ঞান মানুষের কল্যাণে প্রচার করেছিলেন। তাঁর এই বাণী ও দর্শন পরবর্তীকালে নামানুসের একটি সার্বজনীন মনস্কতাপূর্ন ধর্মে পরিণত হয়। 

৫৪৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মহামানব তথাগত বুদ্ধ আরেক বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে কুশিনগর নামক স্থানে শালবৃক্ষের নীচে ৮০ বছর বয়সে ইহধাম ত্যাগ করেন। 

পুরো পৃথিবীজুড়ে এই মহামানবের বাণী আজও সর্বজনীনভাবে সমাদৃত। 
 
আত্মশুদ্ধি, র্নিলোভ, নিরহংকর, ত্যাগময় জীবনের পথে উৎসর্গ করার সাধনাই হলো ধর্ম। কিন্তু বর্তমানে আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি সম্পূর্ণ তার বিপরীত চিত্র। গত ৮ ও ৯ মার্চ ২০২৪ এবং এরপর ১১ মে ২০২৪ তারিখে একাধিকবার একশত আটত্রিশ বছরের প্রাচীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারে সংগঠিত অপ্রীতিকর ঘটনার সূত্রধরে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দুটি বিবদমান গ্রুপের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং ঘটনা থেকে রটনার কীর্তিকলাপ, মারমার, কাটকাট অবস্থা যা দেখলাম তা রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি। 

এর একটি পক্ষে হচ্ছে বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি আর অপর পক্ষ হচ্ছে ব্যক্তি ভদন্ত ড. জিনবোধি ভিক্ষু। কেন এই তাণ্ডব ঘটানাে হলো এর উদ্দেশ্যই বা কি, সে বিষয়ে আমি ছোট্ট পরিপরে ঘটনার আলোকপাত করতে চাই। বিগত ১০/০৪/ ২০১২ সালে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের পুজনীয় শতবর্ষী অধ্যক্ষ, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদকে ভূষিত, বাংলাদেশি বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয়গুরু মহামান্য সংঘরাজ ড. জ্ঞানশ্রী মহাথের, বিহার পরিচালনা কমিটির যৌথ সিদ্ধান্তক্রমে ড. জিনবোধি ভিক্ষুকে ধর্মীয় বিধিবিধান লঙ্ঘন ও  নিয়ম বহির্ভূত আচরণের জন্য বিহারের উপাধ্যক্ষ পদ থেকে অপসারণ করা হয়। জিনবোধি ভিক্ষু ১০/০৫/২০১২ সালে অপসারণ আদেশের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম জজ আদালতে একটি মামলা করেন। 

দীর্ঘ দুই বছর দুই দিন পর অর্থাৎ ১২-০৫-২০১৪ তারিখ জিনবোধির করা মামলাটি আদালত তাঁর আবেদন নামঞ্জুর করেন। কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ৯৯৫৭/২০১৬ সালে রিট আবেদন করলে ২৯/০৫/২০১৭ সালে আগের দেওয়া রায় বহাল রাখেন। ২৮/০২/ ২০২১ এবং  ১৭/০৭/২০২৩ সালে দুইবার আপিল আদালত তা খারিজ করে দেন। তারপর একের পর তিনি দীর্ঘ ১৩ বছরে অসংখ্য মামলা করেন বৌদ্ধ সমিতির নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে। প্রথম ঘটনাটি  পুরো বৌদ্ধ সমাজকে ছাড়িয়ে সার্বজনীন সমাজে “ টপ অব দ্যা বড়ুয়া নিউজ”-এ পরিণত হয়। একইভাবে ঘটেছে শেষ ঘটনাটির ক্ষেত্রেও।

এ ঘটনায় কী এক পক্ষের দোষ? না উভয় পক্ষের দোষ? সমাজের নীতিনির্ধারণী মহলে এনিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। আমি কোনো পক্ষকে বড় করে দেখা বা দোষী সাব্যস্ত করা আমার লেখার প্রধান উপজীব্য নয়। এই চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার ব্যক্তি জিনবোধি কিংবা সংগঠন বৌদ্ধ সমিতি যেই পরিচালনা করুক সে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই। আমার বিষয়বস্তু হচ্ছে অন্যখানে।

ড. জিনবোধি ভিক্ষু ও বৌদ্ধ সমিতি কেন তর্কে জড়ালো এবং তর্ক থেকে একজন মহিলার শাড়ি টানাটানি হলো, শাড়ি টানা রোধ করতে গিয়ে নারীর স্বামী ভিক্ষুকে স্ত্রীর হাতে থাকা পার্স দিয়ে প্রতিরোধ করে। জিনবোধি ভিক্ষু নিজের মুখে জুতা দিয়ে আঘাত করেছে বলে মিথ্যা প্রপাগান্ডা প্রচার করলে তাঁর কিছু ভিক্ষু অনুসারী পরবর্তীতে বৌদ্ধ বিহারকে পরিণত করে নরক কুন্ডুলিতে। 

দুইবারের ঘটনা পুলিশের সামনে সংঘঠিত হয়েছে। প্রথম দিনের অপ্রীতিকর ঘটনা কারো কাম্য ছিল না। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ সমাজের মান ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করি। আমরা যদি একটু সুক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে দেখি ঘটনাটিকে সেদিন তাৎক্ষণিকভাবে কী মিটিয়ে ফেলা যেতো না? যদি প্রথমটি তাৎক্ষণিকভাবে মিটিয়ে ফেলা যেতো তাহলে পরের ঘটনাটি ঘটার কোনো সম্ভাবনা থাকতো না। দুটি ঘটনাই জিনবোধি ভিক্ষুর অনুসারী কিছু ধর্মান্ধ উগ্রবাদী উশৃঙ্খল ভিক্ষুদের কারণে সংঘঠিত হয়েছে বলে সাধারণ জনগণের ভাষ্য।

ভিক্ষুরা হবেন আত্মত্যাগী কিন্তু না ভিক্ষু সংঘের কাছ থেকে সামান্যতমও সংযম প্রদর্শন করতে দেখা যায়নি। রাগ-ক্রোধ মানুষকে যে কী রকম ভয়াবহ হিংস্ত্র করে তোলে তার জ্বলন্ত উদাহরণ পুরো বৌদ্ধ সমাজ এই তিন দিন স্বচক্ষে দেখেছে। যা বৌদ্ধ সমাজ একটি বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই ঘটনা উঠতি প্রজন্মের সন্তানদের বহু বছর ভোগাবে।

তথ্যসুত্রে জানতে পারি, ৮ মার্চ ২০২৪ তারিখ রাতে পুলিশ উভয়পক্ষকে ডেকে শান্তিশৃঙ্খলা বজার রাখার স্বার্থে পুলিশ দলগতভাবে বিহারে প্রবেশাধিকার নিষেধ করে। কিন্তু পরের দিন দুপুরে জিনবোধি ভিক্ষুর কিছু তরুণ ভিক্ষু ও গৃহী অতর্কিত বিহারে প্রবেশ করে যেভাবে আসবাবপত্র ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দিয়ে ধর্মীয় বই, বিহারের দলিল পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। 

এটা সত্য যে, এই বিষয়টিকে অনেকে ভাল চোখে গ্রহণ করেনি। কেন এরা এইরকম করল?  

প্রিয় পাঠক, আপনারা আমার মতের সাথে আপনাদের মতের মিল নাও হতে পারেন? পুলিশের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ড. জিনবোধি ভিক্ষুর অনুসারীরা বিনা বাধায় ৯ তারিখ যেভাবেই হোক বিহারে গেলেন তাতে কারো কোনো রকম আপত্তি নেই, কিন্তু ওইদিন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা যদি না ঘটাতো আপনাদের ওপর কারো আঙুল তোলার প্রশ্নই আসতো না। অতিউৎসাহীরা যে ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটালো তা সেদিন অন্যধর্মের হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।

ভিক্ষুরাই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালো ১১ মে ২০২৪ তারিখে। সেদিন বৌদ্ধ সমিতির নেতৃবৃন্দ প্রতিবছরের ন্যায় বুদ্ধপূর্ণিমা উদযাপন করার জন্য প্রস্তুতি সভার মিটিং আহ্বান করছিল। সেখানে বৌদ্ধ সমিতি ও বৌদ্ধ সমাজের অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবর্গরা যখন মিটিং করে এই ফাঁকে জিনবোধি ভিক্ষুর অনুসারী ভিক্ষুরা হামলা করে গৃহীদের রক্তাক্ত করে বৌদ্ধ বিহারকে রক্তে রঞ্জিত করে। 

ভিক্ষুরা যেখানে সাম্য মৈত্রী করুণার কথা বলবে সেখানে গৃহীদেরকে মেরে জখম করার এদৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। এনিয়ে মামলা হয়েছে। বৌদ্ধ সমিতির নেতৃবৃন্দরা তো আমাদের সমাজের মানুষ। কারো না কারো আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। সমাজের নেতৃস্থানীয় প্রবীন ব্যক্তিত্ব। যাদের অর্থ-বিত্ত মেধায় বৌদ্ধ সমাজ এগিয়েছে সেইসব ব্যক্তিদের ওপর আঘাত! সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন ভিক্ষুদের মারমুখি চেহারাগুলো দেখছিলাম তখন লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেছে। 

তাহলে দেখুন, এই যে ফাটল দেখা দিলো তা দিয়ে কী লাভ হলো, কার লাভ হলো। জিনবোধি ভিক্ষুর, সমিতির না বৌদ্ধ সমাজের? ঘটনার পর তৃতীয় কোনো পক্ষকেও সংকট নিরসনে উদ্যেগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। উল্টো একের পর এক মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ছে। তাহলে বৌদ্ধ সমাজ কী এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে? 

বিবেকের কাছে একবার প্রশ্ন করুন, ঘটনাকে কেন্দ্র করে যারা যেভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তৎপরবর্তী যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করেছিল, মিছিল-মানবন্ধন করেছিল, সোশ্যাল মিডিয়ায় অধিকাংশ ফেইক আইডি খুলে অশালীন ভাষায় গালাগাল ও সামাজিক ব্যক্তিত্বদের ছবিতে জুতার মালা, বিহার অঙ্গনে কুশপুত্তলিকা দাহ, টানানো, আগুন দেওয়া, ঝাড়ু ও লাথি মারা, ভিক্ষুরা গৃহী উপাসকদের মেরে রক্তাক্ত করে জখম এগুলো কি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাজ? 

যে ক্ষত সৃষ্টি হলো, সম্প্রদায়ের সম্মানে চুনকালি লাগল, এটির ক্ষত আগামী কত বছর পর্যন্ত বয়ে বেড়াবে কেউ চিন্তা করেছেন কি? এর দায়ভার কে নেবে? বৌদ্ধ সমাজ যে অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী, করুণা মুদিতার কথা বলা হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছ থেকে তার কোনো রকম অস্তিত্ব-নিশানা দেখতে পেলাম কী?

২০২৪ সালের বুদ্ধ পূর্ণিমার মহান দিন যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন হবে তার গ্যারান্টি কোথায়? ঘোর এই অমানিশায় গ্রাস করা অস্তিত্বের সংকট থেকে সমতলীয় বৌদ্ধ সমাজকে বাঁচাবে কে? আর কতবার বৌদ্ধ বিহার অপবিত্র হবে। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে এই উগ্রবাদ ধর্মান্ধ রাহুর কবল থেকে রক্ষা করুন।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিষ্ট
[email protected]

মিসেস গুলশান আরা বেগম স্মরণে ‘তুমি হাসিছো কাঁদিছি মোরা’

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৪, ০৮:২০ এএম
‘তুমি হাসিছো কাঁদিছি মোরা’
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

আজ বিশ্ব মা দিবস। মা দিবসে আমি লিখি অনেকটা নিয়মিতই। গত বছরও মা দিবসে আমার লেখা ছিল। তখনও আম্মা জীবিত ছিলেন। আজ যখন এ লেখা লিখছি তখন মাহীন আমি ও আমরা। মিসেস গুলশান আরা বেগম (লিলি) (জম্ম: ১ ডিসেম্বর ১৯৬২; মৃত্যু: ১২ অক্টোবর ২০২৩) ব্যক্তিগত দুঃখবোধ থেকেই আমার এ লেখা। আমদের যে পরিবার, তা মাকে ঘিরেই আবর্তিত। আমরা পাঁচ ভাই-বোন। যেকোন শুভ-অসুভ কাজ আমরা মাকে ছাড়া করতে পারি না। আম্মা মারা যাওয়ার পর আমরা মনে হয় তাকে ছাড়া চলতে শিখতে শুরু করেছি। আমাকে ছাড়াই এবারের একুশে বইমেলায় আমার পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে। আম্মা মারা যাওয়ার পর আমার ছোট ভাই ইলিয়াস বিন কাশেম খুব অসুস্থ। আম্মার স্মরণে খুব কান্নাটি করে। প্রতিদিন সে আম্মা যে রুমে থাকতেন সে রুমে অফিস থেকে এসে নামাজ পড়ে একাকী মোনাজাত করে।

মায়ের সাথে তার যে আত্মিক বন্ধন তা প্রতিনিয়ত পোড়াচ্ছে। আম্মার মৃত্যুর আগে আমিও চরম অসুস্থতার মধ্য দিয়ে সময় পার করছিলাম। হাসপাতালে ভর্তি হলে আমি আম্মার শয্যা পাশে গিয়েছি নামে মাত্র। তার কোন সেবা শুশ্রম্নষা করতে পারিনি। 

আম্মাকে ছাড়া আমরা কোন সুন্দর মুহুর্ত চিন্তা করতে পারি না। অথচ আমরা তাকে ছাড়াই দিব্যি আছি।

কিডনি, ডায়বেটিস ও নানা রোগব্যাধীতে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ রোগের সাথে যুদ্ধ করেছেন। তিনি পরাজিত হওয়ার মানুষ ছিলেন না। আম্মার জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে লিখতাম। উনাকে সেগুলো পড়ে শোনাতাম বা উনি নিজেই পড়ে হাসতেন।

কতো শত অভিমান, আনন্দ আর হাসি গানে আমরা দিন পার করেছি। আব্বা যখন ১৯৯০ সালে মারা যান আমরা ভাই-বোনর তখন খুব ছোট। রাজধানী ঢাকার জীবন ছেড়ে আমাদের জায়গা হয় জীবন ঈশ্বরের এক অপরিসীম দয়া। জীবন-মৃত্যু যে কতো কাছাকাছি তা আমরা দেখি। আমাদের মায়ের মৃত্যু আমাদের সকলকে এই ভাবনা মনকে নাড়িয়েছে। মাঝে মােঝে মনে হয় বেঁচে থাকাটাই এখন আল্লাহর একান্ত কৃপা। আমাদের আনন্দ বেদনা সব সাঙ্গ হবে যখন আমরা শেষ হয়ে যাবো।  
কবির ভাষায় বলতে হয়,
‘প্রথমো যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে
কেঁদেছিলে একা তুমি, হেসেছিলো সবে
এমনো জীবন তুমি করিবে গঠন
মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন’
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শব্দ 'মা'

দুই.
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর শ্রেষ্ঠ লাইন ‘হেরিলে মায়ের মুখ/দূরে যায় সব দুখ।’ মা হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শব্দ। কি যাদুময় শব্দ ‘মা’। রক্ত শুষে নিরাপদে ধীরে ধীরে মায়ের গর্ভদেশে সন্তান বড় হয়।প্রতিটি মা সন্তানদের ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে ধারণ করে অসহনীয় যন্ত্রণা সুখ হিসেবে হাসি মুখে সহ্য করেন। জগতের আলো দেখানোর পরও তিল তিল করে মা-ই তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে একটু একটু করে বড় করে আগামীর সম্ভাবনাময় একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে। 

প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালিত হয় ‘বিশ্ব মা দিবস’। যদিও মা’কে ভালোবাসতে কোনো নির্দিষ্ট দিন লাগে না। তবুও সমস্ত ব্যস্ততাকে ছুটি জানিয়ে মায়ের জন্য একটি দিন বিশেষ করা যায়ই। মায়ের কাছে সব দুঃখ, কষ্ট, হাসি, গল্প কথা সবই কতো সহজে আমরা বলতে পারি। কারণ মা ই আমাদের জন্য আপনার চেয়েও আপন। সন্তানের জীবনে মায়ের অবদান অপরিসীম। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেও অন্তিম ছোঁয়া অসম্ভব। মায়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিখ্যাত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বলেছেন। সমস্ত ধর্মেই মায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হয়েছে। 

মহানবী হজরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন, 'তোমাদের জন্য মায়ের পায়ের নিচেই রয়েছে তোমাদের জান্নাত।' অর্থ সম্পদের হিসাবে আমরা ধনী গরিবের হিসাব নির্ধারণ করি। কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন আসল ধনী বলেছেন তাকে, যার মা আছে সে কখনই গরীব নয়। আমাদের প্রিয় মানুষেরা স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলেই আমাদেরকে ছেড়ে যান। কারো অপছন্দের সংজ্ঞায় একবার সংজ্ঞায়িত হলেই ক্ষমার অযোগ্য ঘোষণা করা হয় কিন্তু সন্তান হাজার অন্যায় করলেও মা ক্ষমা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেখক লুসিয়া মে অরকটের ভাষায়, 'মা সব কিছু ক্ষমা করে দেন। পৃথিবীর সবাই ছেড়ে গেলেও মা কখনো সন্তানকে ছেড়ে যান না।'

চারপাশে হাজার মানুষ থাকে। হাজার ঘটনাপ্রবাহ থাকে।বুদ্ধি জ্ঞান হবার তা আমরা অনুধাবন করতে পারি। কিন্তু মায়ের সঙ্গ আমরা পৃথিবীতে আসার আগেই পায়। তাই মা ই আমাদের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। 'আমি যা হয়েছি বা ভবিষ্যতে যা হতে চাই তার সব কিছুর জন্য আমি আমার মায়ের কাছে ঋণী' আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছেন‌। নারীর জীবনে সবচেয়ে বড় সফলতা হয় মা হবার স্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে। কি অদ্ভুত সুন্দর একটা বিষয় যে একটা মায়ের থেকে আরেকটা নতুন মানুষ পৃথিবীতে আসছে। দারুণ ব্যাপার! অন্য কোনো কিছুতেই ভালোবাসার সুন্দর পরিমাপ সম্ভব হয় না যতটা অনুভব করা যায় মা হবার ফলে। ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ভাষায়, 'সব ভালোবাসার শুরু এবং শেষ হচ্ছে মার্তৃত্বে'। মায়ের বিশালতা হলো সুবিশাল প্রকৃতির মতো। উদারতায় মায়ের মন প্রাণ সুউচ্চ। সন্তানের সাফল্যে মায়ের প্রশংসা তৃপ্তির অনুভূতি যোগায়। আমেরিকান চিকিৎসক ও দার্শনিক ডা. দেবীদাস মৃধা বলেন,' মা হচ্ছেন প্রকৃতির মতো। যেকোন পরিস্থিতিতে তিনি তার সন্তানের প্রশংসা করেন'।

একজন আদর্শ মায়ের ক্ষমতা অনেক বেশি। তিনি সন্তানকে সঠিক দিক নির্দেশনায় সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দেয়ার সক্ষমতা পোষণ করেন। মায়ের পেটের এই সন্তান ই পৃথিবী শাসন করে। ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন বেনোপার্ট বলেছেন, 'আমাকে শিক্ষিত মা দাও। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, তোমাদের একটা সভ্য, শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।'

প্রকৃতির অন্য প্রাণি কিংবা মানুষ সবার ক্ষেত্রেই এটি সত্য বাণী যে সন্তানের জীবন এবং সেই জীবনের সমৃদ্ধির জন্য মা আসলেই পুরোটা দিয়ে নি:স্বার্থভাবে করেন। সন্তানের জন্য মা নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দেন। সন্তানের জন্য উদারতায় সুউচ্চ এক প্রাণি হলো মাকড়সা। ডিম ফুটে মাকড়সার বাচ্চা হয়। বাচ্চা না হওয়া অবধি সেই ডিম নিজের দেহে বহন করে  মা মাকড়সা। বাচ্চা হবার পর  তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য খাবারের প্রয়োজন হয়। মা মাকড়সা তখন নিজের শরীর বিলিয়ে দেয়। খাবারের জ্বালা মেটাতে বাচ্চা মাকড়সারা মা মাকড়সার দেহকে ঠুকরে ঠুকরে খেতে থাকে। সমস্ত কষ্ট আর যন্ত্রণা মা নীরবে সয়ে যায়। একটু একটু করে খেতে খেতে মা মাকড়সার পুরো দেহখানির গন্তব্য হয় তার সন্তানদের পেটের মধ্যে। বিশাল আত্মত্যাগের কারণে মাকড়সা ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা হিসেবে পরিগণিত।

তিন.
নেপোলিয়ান বলেছিলেন, ' Give me a good mother I will give you a good nation.' আমাকে একটি ভাল মা দাও, আমি তোমাদের একটি ভাল জাতি দেবো। একজন মা-ই পারে তাঁর সন্তানদের আদর্শবান করে গড়ে তুলতে। বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় সন্তানদের বাবা হয়তো থাকে জন্মদাতা হিসেবেই। সন্তানের লালন পালন, পড়াশোনা ও সার্বিক খোঁজ খবর মাকে-ই নিতে হয়। সন্তানের গতিপথ ও নব-নব সবই শেখে মায়ের কাছ থেকে। খুব ছোট বেলায় আমার মনে আছে যে আমি ভাবতাম আমার মা-ই বিশ্বের সব চাইতে জ্ঞানী মানুষ। অবশ্য বড় বেলায় এখনো আমার ভাবনা একই রকম রয়েছে। আমাদের সব ভাই-বোনের আজকের যে অর্জন সবই তাঁর কারণেই। 
আমার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা ছিলেন সংসার বৈরাগী মানুষ। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে কর্মকালীন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের করাচী থেকে দেশ মাতৃকার ক্রান্তিলগ্নে দেশে এসে সক্রিয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং স্থানীয়দের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। আমার ফুপাতো ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কমান্ডার মোহাসীন ভাই এর কাছ থেকে শুনি বাবার গল্প। কিভাবে দেশে পালিয়ে পাকিস্তান থেকে দেশে আসছিলেন আর একজন সৈনিক হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে কি করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে বিমান বাহিনী থেকে অবসর নেন। আমার বাবা বেঁচে থাকালীন সময়ে কখনো দেখিনি কারো সাথে বীরত্ব দেখাতে। সংসার বৈরগ্যের কারণে যতোদিন তিনি বেঁচে ছিলেন আমাদের নিয়ে তাঁর ভাবনা ছিলোনা বল্লেই চলে। আমার বাবার বাড়ী নারায়ণগঞ্জ এর সোনারগাঁও এর কাজিরগাঁও গ্রামে। ১৯৯০ সালে আমার বাবা মোঃ আবুল কাশেম মৃত্যুবরণ করলে আমার মা আমাদের সব ভাই-বোন কে নিয়ে যশোরের কেশবপুর উপজেলার মঙ্গলকোট গ্রামে নিয়ে আসেন। কেশবপুর উপজেলা শহরেও আমার নানার বাড়ী আছে। তবে তিনি সেখানে আমাদের রাখেননি যে আমরা বাজারের ছেলেদের সাথে মিশে বখে যাবো। 
রাজধানী ঢাকা থেকে মঙ্গলকোট গ্রামে এসে আমার মা অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়লেও আমাদেরকে কখনোই বুঝতে দেননি। প্রতিদিনই তিনি কাঁদতেন আমাদের অগোচরে। সেই সময় আমার মাকে আমি দেখেছি একদিকে তিন প্রচন্ড কড়া একজন মা, একজন সফল মালিক ও অভিভাবক। আমরা যে বাবাকে হারিয়ছি কখনো বুঝতে দেননি। বাবা থাকতেও আমরা যে আদর ভালবাসা পাইনি আম্মা তার সবটাই দিয়েছেন। বাবার পেনশন রেশন ইত্যাদির জন্য আমার বড় ভাইটাকে ও আমাকে নিয়ে যেতেন ঢাকাতে। আমার মায়ের খালু এক সময়ে যশোর-৬ এর সাংসদ গাজী এরশাদ আলী নানার মাধ্যমে একটি মালবাহী ট্রাক কেনা হয়েছিলো যা ট্রাক ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দেয়েছিলেন তিনি। আমার আম্মা প্রায় প্রতিদিনই কেশবপুরে নানার বাসায় যেতেন টাকা পয়সার হিসাব করতে। ছোট বেলায় আমার কখনো মনে পড়ে না আমাদের ভাই-বোন কাওকে তিনি টাকা আনতে পাঠিয়েছেন। তখন আমার নানার বাড়ীর গ্রামে জমিতে প্রচুর ফসল উৎপাদিত হতো। সেগুলো আমাদের নানীর ভাগরাদার ছিলো তাদের দিয়েই বিক্রি করাতেন। পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটবে এ কারণে কখনো আমাকে বা অন্য ভাইদের বাজারে পাঠাতেন না। তবে আমার ছোট ভাইটা ভাল বাজার করতে পারতো বলে সে মাঝে মাঝে বাজার করতো বিকেলে। আমাদের সন্ধ্যার পরে কখনো বাড়ীর বাইরে যেতে দিতেন না। আজ আমরা যখন আমাদের সেসব দিনের কথা ভাবি মা অনকটাই আপ্লুত হয়ে পড়েন! গ্রামে আসার পর আমাকে গ্রামের বাড়ীর পাশে একটা প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। ভর্তি করিয়ে দিলেন আমার ছোট ইলিয়াস বিন কাশেম রাসেলকেও। আমার ছোট বোন ফারহানা তখন খুব ছোট স্কুলে যাওয়ার মতো বয়স হয়নি। প্রতিদিনই নিজে আমাদের পড়াতেন এবং কড়া শাসনের মধ্যে জীবন চলতে লাগলো। আমি সে বছর গ্রামের ওই প্রাইমারীর মধ্যে মাত্র তিন মাস পরাশোনা করে রেকর্ড সংখ্যক মার্কস পেয়ে স্কুল ফার্স্ট হই। ক্লাস থ্রী থেকে সরাসরি ক্লাস ফাইভে। আমরা তিন ভাই-বোন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়েছি।

আমাদের ৫ ভাই-বোনের মধ্যে চারজনই সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী। আমার বড় ভাই মুহাম্মদ বিন কাশেম জুয়েল রাজধানীতে ঠিকাদারী করেন করেন। বড় বোন ছামিয়া খাতুন গরুর ফার্ম গড়ে তুলেছন। ছোট ভাই ভাই ইলিয়াস বিন কাশেম স্কয়ার গ্রুপের মাছরাঙা টেলিভিশনে কাজ করছে। ছোট বোন ফারহানা আফরোজ ঢাকা ব্যাংক এ কর্মরত। আজ আমরা যে যেখানেই আছি সব কিছুর কৃতিত্ব আমার মায়ের-ই। আজ আম্মা নেই। তারপরও মরন হয় সব কিছু তার ইশারায় চলে। মা-ই আমাদের পৃথিবী। বিশ্ব নারী দিবসে এমন একজন মহিয়সী মাকে জানাই শ্রোদ্ধা, ভালাবাসা, সালাম। 

বিল্লাল বিন কাশেম
লেখক, কবি ও গল্পকার

রবীন্দ্রনাথের কৃষি ভাবনা

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৪, ০৪:০৩ পিএম
রবীন্দ্রনাথের কৃষি ভাবনা
ছবি : সংগৃহীত

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে,
সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে-
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি॥’

জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে চাষিদের প্রতি যে গভীর ভালোবাসা ও পল্লীপ্রকৃতি সৌন্দর্যদৃশ্য ধ্বনির অপরূপরতার কাব্যিক বর্ণনা ‘আমার সোনার বাংলা’ কবিতায় স্পষ্ট দেখা যায়।

সময়টা ১৯৮০ সাল, দেবেন্দ্রনাথ তার কনিষ্ঠ ছেলে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারির কাজ পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেন। তখনো রবীন্দ্রনাথের ওপর জমিদারির সব দায়িত্ব অর্পণ হয়নি। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর কঠোর শিক্ষানবিশির কাজ শেষে ১৮৯৫ সালের ৮ আগস্ট ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নির’ মাধ্যমে পিতা দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে সমগ্র জমিদারি কর্তৃত্ব পান অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি জমিদার রূপে নিযুক্ত হন। জমিদার হয়ে রবীন্দ্রনাথ পুণ্যাহ উৎসব যোগ দিতে শিলাইদহে যান। সেখানে গিয়েই তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি তার পূর্বসূরিদের পথে হাঁটবেন না। উৎসবের শুরুতে ভাষণে বলেন, ‘সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচাতে হবে। এটাই আমার সর্বপ্রধান কাজ’। মহাজন অর্থে ‘সাহা’ শব্দের ব্যবহার করেছেন, দরিদ্র প্রজা বলতে তিনি ‘শেখ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন কারণ তার জমিদারিতে অধিকাংশ প্রজাই দরিদ্র মুসলমান। দরিদ্র প্রজার অসহায়ত্ব তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। তাই তো বলেছেন-

‘সে অন্ন যখন কেহ কাড়ে,
সে প্রাণে আঘাত দেয় গর্বান্ধ নিষ্ঠুর অত্যাচারে,
নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে-
দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে
মরে সে নীরবে। এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা- এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা- ডাকিয়া বলিতে হবে-
মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে’

রবীন্দ্রনাথ তার জমিদারিতে পল্লী উন্নয়নের দিকে নজর দেন এবং বুঝতে পারলেন কৃষি খাতের আধুনিকীকরণ ছাড়া পল্লী উন্নয়ন সম্ভব নয়। কৃষির উন্নতির জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টা ছিল অভিনব। তিনি বুঝতে পারেন নতুন চাষের প্রবর্তনের মাধ্যমে গ্রামের আর্থিক অবস্থার উন্নতিসাধন করতে হবে। তাই শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সংলগ্ন জমিতে নতুন ধরনের ধান চাষ, পাটনাই মটর, কপি চাষ শুরু করেন। ধান ও পাটের ওপর নির্ভরশীল না থেকে অন্যান্য অর্থকরী শস্যের দিকে কৃষকদের দৃষ্টি ফেরানোর চেষ্টা করেন। তাই পরগণায় মাছ চাষ, আলুর চাষ, খেতের আলে কলা আনারস চাষে উৎসাহিত করেন। ১৯০৮ সালে এক কর্মীকে কবি চিঠিতে লিখেছিলেন- ‘প্রজাদের বাস্তুবাড়ি, খেতের আইল প্রভৃতি স্থানে আনারস, কলা, খেজুর প্রভৃতি ফলের গাছ লাগাইবার জন্য তাহাদের উৎসাহিত করিও। আনারসের পাতা হইতে খুব মজবুত সুতা বাইর হয়। ফলও বিক্রয়যোগ্য। শিমুল, আঙ্গুর গাছ, বেড়া প্রভৃতির কাজে লাগাইয়া তার মূল হইতে কিরূপে খাদ্য বাইর করা যাইতে পারে তাহাও প্রজাদিগকে শিখানো আবশ্যক। আলুর চাষ প্রচলিত করিতে পারিলে বিশেষ লাভের হইবে।’

রাজশাহীতে রেশমচাষের অবস্থা বেশ রমরমা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভুট্টা এ দেশে চাষের উপযোগী করেন। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে চিঠিতে লিখেন: ‘আমার চাষাবাসের কাজ মন্দ চলিতেছে না। আমেরিকার ভুট্টার বীজ আনাইয়াছিলাম। তাহার গাছগুলি দ্রুতবেগে বাড়িয়া উঠিতেছে।’

রবীন্দ্রনাথের কৃষি বিষয়ে প্রবল জ্ঞান ছিল বলেই যখন পতিসর ও শিলাইদহে সারের অভাব দেখা দেয়, এ অভাব মেটানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ একটি উপায় বের করেন। তখন বেশ কয়েক বছর থেকে পদ্মা নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে, বেড়াজালে একসময় এত মাছ ওঠে যে শিকারিরা নিতে চায় না। দেখা যায় ডিম বের করে নিয়ে নুন দিয়ে তা রাখছে আর মাছগুলো নদীর জলে ফেলে দিচ্ছে। নামমাত্র মূল্যে কৃষকরা নৌকাবোঝাই মাছ কিনে নিয়ে তা চুন দিয়ে মাটির নিচে পুঁতে রাখেন। এক বছর পর মাটি খুঁড়ে দেখা যায় চমৎকার সার হয়েছে। তখন মাছের সার প্রচলন করা হয়।

‘মানুষ যেমন একদিন হাল লাঙল, চরকা তাঁত, তীর ধনুক, চক্রবান যানবাহনকে গ্রহণ করে তাকে নিজের জীবনযাত্রার অনুগত করেছিল, আধুনিক যন্ত্রকেও আমাদের সেইরকম করতে হবে। যন্ত্রে যারা পিছিয়ে আছে, যন্ত্রে অগ্রবর্তীদের সঙ্গে তারা কোনোমতেই পেরে উঠবে না।’- ‘পল্লীপ্রকৃতি’ প্রবন্ধে এমন লেখা কৃষিভাবনার সুদূরপ্রসারী চিন্তার প্রতিফলন।

কৃষিকাজকে আরও বেগবান করতে ১৯০৬ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধু পুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তার এক বছর পর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কেও ওই একই বিষয়ে শিক্ষালাভ করার জন্য আমেরিকায় পাঠান। রথীন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথের ব্যয়ভার বহন করতে স্ত্রীর গহনা, পুরীর বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে। ১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথ যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত এই তিনজকে লেখেন: ‘তোমরাও দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের অনুগ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ, ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্নগ্রাস কিছু পরিমাণে যদি বাড়িয়ে দিতে পার তাহলে এই ক্ষতি পূরণ হয়ে মনে সান্ত্বনা পাব। মনে রেখ এই টাকা চাষীর, এই চাষীরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যয়ভার নিজেরা আধাপেটা খেয়ে এবং না খেয়ে বহন করছে- এদের এই অংশ সম্পূর্ণ শোধ করার দায় তোমাদের উপর রইল।’

১৯০৯ সালে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরেন রথীন্দ্রনাথ। শুরু করেন পতিসরের মাটিতে বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষিকাজ। পতিসরের মাটিতে প্রথম ট্রাক্টর চাষাবাদ শুরু হয়, ট্রাক্টর চালান রথীন্দ্রনাথ নিজে। সে অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি লেখেন: ‘আমাদের দেশে তখনো ট্রাকটরের চলন হয়নি। ট্রাকটর তো পেলুম কিন্তু চালক পেলুম না। নিজেই চালাতে লাগলুম। কয়েকদিনের মধ্যে গ্রামের একটি ছোকরাকে চালানো শিখিয়ে দিলুম। হাজার হাজার লোক জমে গেল। ট্রাকটর নিয়ে আমি নেমে গেলুম ধান খেতে। তারা আশ্বাস দিল আপনি আলের ওপর দিয়ে চাষ দিয়ে যান, আমরা কোদাল নিয়ে থাকব, সঙ্গে সঙ্গে আল বসিয়ে নেব। ট্রাকটর দিয়ে চাষাবাদে কৃষকরা মহাখুশী।’

যে সময় মানুষ ব্যারিস্টারি, ডাক্তার ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য সন্তানদের বিদেশে পাঠানো হয়, জমিদার হয়েও রবীন্দ্রনাথ কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য তার নিজ পুত্রকে কৃষিতে শিক্ষা নিতে বিদেশে পাঠিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন চাষির একার পক্ষ্যে কৃষির উন্নয়ন সম্ভব না। তাই ‘ভূমিলক্ষ্মী’তে বলেছেন, ‘আজ শুধু একলা চাষীর চাষ করিবার দিন নাই, আজ তাহার সঙ্গে বিদ্বানকে, বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হইবে।’
‘শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন,‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’
কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই-
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।

কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, ‘করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!’

একজন জমিদার রবীন্দ্রনাথ কোনো এক ভূমিহারা কৃষকের হাহাকার তার মনোকষ্টের প্রকাশ ঘটিয়েছেন এমন ভাবেই ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ দরিদ্র কৃষকদের দুঃখ দুর্দশা বুঝতে পারতেন। কৃষকের হাহাকারের কারণ খুঁজতে গিয়ে ‘পল্লীপ্রকৃতি’ প্রবন্ধে বলেছেন- ‘জমিও পড়িয়া রহিল না, ফসলেরও দর বাড়িয়া চলিল, অথচ সম্বৎসর দুইবেলা পেট ভরিবার মতো খাবার জোটে না, আর চাষী ঋণে ডুবিয়া থাকে, ইহার কারণ কী ভাবিয়া দেখিতে হইবে। এমন কেন হয়- যখনই দুর্বৎসর আসে অমনি দেখা যায় কাহারো ঘরে উদ্বৃত্ত কিছুই নাই। কেন এক ফসল নষ্ট হইলেই আর এক ফসল না ওঠা পর্যন্ত হাহাকারের অন্ত থাকে না।’

তিনি দেখলেন দরিদ্র কৃষকদের কাছে অর্থ তো দূরের কথা, তারা সুদখোর মহাজনদের কবলে পড়ে সহায় সম্বলহীন হয়ে যাচ্ছে। কৃষকদের আর্থিক সমস্যা দূর করতে ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পতিসর কৃষি ব্যাংক। তখনো এই উপমহাদেশে লোন কোম্পানি বা ব্যাংক চালু হয়নি। বলা যায় পতিসর কৃষি ব্যাংক নতুন দিগন্ত। রবীন্দ্রনাথ এসব ব্যাংকের মূলধন সংগ্রহ করেন তার ধনী বন্ধুদের থেকে ধার করে। ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকে ঠাকুর পরিবারের অনেক সদস্য, আত্মীয়স্বজন টাকা জমা রাখেন। নোবেল পুরস্কারের ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে ১ লাখ ৮ হাজার টাকা তিনি পতিসর কৃষি ব্যাংকে বিনিয়োগ করেন। এই ব্যাংক থেকে কৃষক শতকরা তিন টাকা হারে সুদে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করত। ফসল ওঠার পর সুদসহ ঋণের টাকা পরিশোধ করে পরবর্তীতে আবার ঋণ নেওয়ার সুযোগ পেত। এই পদ্ধতি চালু হওয়ায় চাষিরা মহাজনের চক্রবৃদ্ধি হারে সর্বনাশা সুদের কবল থেকে রক্ষা পেতে থাকল।

১৩১৪ বঙ্গাব্দে পাবনায় অনুষ্ঠিত জাতীয় মহাসভার প্রাদেশিক সম্মেলনে পল্লীর উন্নয়নের যে ১৫ দফা কর্মসূচি পেশ করেন তাতে ছিল আধুনিক কৃষি, কুটিরশিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ব্যাংক ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের এক সমবায়ভিত্তিক রূপরেখা। তার এই কাজে যুক্ত হন সমাজকর্মী কালীমোহন ঘোষ। পরবর্তীতে আসেন বিপ্লবী অতুল সেন। তার সহকারী হিসেবে ছিলেন উপেন ভদ্র, বিশ্বেশ্বর বসুসহ আরও অনেকেই। অতুল সেনের কাঁধেই কৃষি ব্যাংকের কাজে ভার পড়ে। এই কৃষি ব্যাংকের আর্থিক সহায়তা ও প্রজাদের খাজনার সঙ্গে টাকা প্রতি এক আনা অতিরিক্তি অর্থ দিয়ে পতিসর, কমতা এবং রাতোয়ালে দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত হয়; যার উদ্দেশ্য দরিদ্র কৃষকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। একবার কালিগ্রামে মহামারিরূপে ওলাওঠা রোগ দেখা যায়। এই রোগ থেকে কৃষক ও প্রজাদের রক্ষার জন্য রবীন্দ্রনাথ অতুল সেনকে চিঠি লেখেন- ‘আমি কয়েকটি ওলাওঠার ওষুধের বাক্স পাঠাইতেছি এবং যদি হোমিয়োপ্যাথি ডাক্তার পাঠাইতে পারি, সেটা দেখবে।’

হোমিয়োপ্যাথি ঔষধের ওপর রবীন্দ্রনাথের ভরসা ও আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। রবীন্দ্রনাথকে লেখা শান্তি কবিরের একটা চিঠিতে বিষয়টি সহজেই জানা যায়। সেখানে ছিল- ‘সেবার বছর দুই আগে যখন শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম, তখন কথায় কথায় একদিন আপনি হোমিওপ্যাথি দিয়ে ভীষ্ণ সব রোগ কেমন করে আরোগ্য করেছেন, সে কথা বলেছিলেন। আপনি তো জানেনই আমাদের দেশে হোমিওপ্যাথদের কি দুর্দশা। সে সমস্ত কারণে আমরা চেষ্টা করছি যাতে বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথির একটা কেন্দ্রীয় সঙ্ঘ করে বিধি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বন্দোবস্ত করা হয়’।

‘কিন্তু এবারে রাশিয়া ঘুরে এসে সেই সৌন্দর্যের ছবি আমার মন থেকে মুছে গেছে। কেবলই ভাবছি আমাদের দেশজোড়া চাষীদের দুঃখের কথা। আমার যৌবনের আরম্ভকাল থেকেই বাংলাদেশের পল্লীগ্রামের সঙ্গে আমার নিকট-পরিচয় হয়েছে। তখন চাষীদের সঙ্গে আমার প্রত্যহ ছিল দেখাশোনা- ওদের সব নালিশ উঠেছে আমার কানে। আমি জানি, ওদের মতো নিঃসহায় জীব অল্পই আছে। ওরা সমাজের যে তলায় তলিয়ে, সেখানে জ্ঞানের আলো অল্পই পৌঁছায়, প্রাণের হাওয়া বয় না বললেই হয়’- রাশিয়ার চিঠিতে কবি এভাবেই চাষিদের দুঃখের কথা প্রকাশ করেন। তাই কৃষি ব্যাংক স্থাপন ও কৃষিতে উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতির পাশাপাশি তিনি ভেবেছিলেন সমবায়নীতি ও কৃষিক্ষেত্র একত্রীকরণ ছাড়া গ্রাম্যকৃষি ব্যবস্থার অগ্রগতি সম্ভব না। রাশিয়ায় গিয়ে সেখানকার কৃষিব্যবস্থা, যৌথখামার ইত্যাদি দেখে রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হয়েছিলেন।

‘চাষিকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে হবে, এই ছিল আমার অভিপ্রায়। এ সম্বন্ধে দুটো কথা সর্বদাই আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে- জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষির। দ্বিতীয়ত, সমবায়নীতি অনুসারে চাপের ক্ষেত্র একত্র করে চাষ না করতে পারলে কৃষির উন্নতি হতেই পারে না। মান্ধাতার আমলের হাল লাঙল নিয়ে আলবাধা টুকরো জমিতে ফসল ফলানো আর ফুটো কলসিতে জল আনা একই কথা।’ রাশিয়ার চিঠিতে তিনি এভাবেই কৃষিতে সমবায়নীতির কথা তুলে ধরেন। তারপরই রাশিয়ার অনুরূপ কৃষিক্ষেত্রে একত্রীকরণের পরিকল্পনাও করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিকে একত্রিত করে সমবায়ের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের কাজে হাত দেন।

‘রাশিয়ার চিঠি’তে নির্দ্বিধায় বলেছেন ‘আমাদের দেশে আমাদের পল্লীতে ধান উৎপাদন ও পরিচালনার কাজে সমবায়নীতির জয় হোক, এই আমি কামনা করি’। কৃষিতে সমবায়নীতির একটা অংশ হচ্ছে কৃষকরা যাতে ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় এবং সহজে উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করতে পারে সে জন্য তিনি ‘ট্যাগোর এন্ড কোম্পানি’ নামে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চালু করেন।

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, কাজের সঙ্গে আনন্দের মিশ্রণ করলে কৃষকরা কর্মে উজ্জীবিত হবে। গান-বাজনাসহ বিভিন্নি অনুষ্ঠান আয়োজন করলে কৃষকরা কাজে অনুপ্রেরণা পাবে, আত্মশক্তি জাগ্রত হবে। তাই কৃষি উন্নয়নের পাশাপাশি তিনি গ্রামবাংলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। সেসবের মাঝে ছিল গ্রামীণ মেলা, বাউল গান, যাত্রা, নাটক ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘গ্রামকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করতে হবে। সকলে শিক্ষা পাবে, গ্রামজুড়ে আনন্দের হাওয়া বইবে, গান-বাজনা-কীর্তন পাঠ চলবে, আগের দিনে যেমন ছিল’। তিনি জানতেন, কৃষকের মাঝে একতার জন্য সাংস্কৃতিক চর্চা অপরিহার্য। তাই ‘কাত্যায়নী’ মেলা, ‘রাক-রাজ্যেশ্বরী’ মেলার আয়োজনসহ বৃক্ষরোপণ উৎসব, পৌষমেলা, মাঘোৎসব আয়োজন করেন। শিলাইদহ, পতিসর ও শ্রীনিকেতনে ঋতুভিত্তিক উৎসবের আয়োজন করেন। ১৯২৮ সালে হলকর্ষণ নামে একটি উৎসবের আয়োজন করেন। হলকর্ষণ মানে জমি চাষের উৎসব। ‘পল্লীপ্রকৃতি’ প্রবন্ধে এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলেন- ‘আজকার অনুষ্ঠান পৃথিবীর সঙ্গে হিসাব-নিকাশের উপলক্ষ নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলবার, পৃথিবীর অনুসূত্রে একত্র হবার যে বিদ্যা মানবসভ্যতার মূলমন্ত্র যার মধ্যে, সেই কৃষিবিদ্যার প্রথম উদ্ভাবনের আনন্দস্মৃতিরূপে গ্রহণ করব এই অনুষ্ঠানকে।’ এইসব উৎসবে বিভিন্ন গান হয়। রবীন্দ্রনাথের লেখার সেসব গানেও কৃষি ও ফসলের কথাই উঠে আসে। যেমন:

‘আমরা চাষ করি আনন্দে।
মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে॥
রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, বাঁশের বনে পাতা নড়ে,
বাতাস ওঠে ভরে ভরে চষা মাটির গন্ধে॥’

ফসল কাটার উৎসবে কৃষকদের উৎসাহিত করতে লিখেন :
‘আয় রে মোরা ফসল কাটি
বাদল এসে রচেছিল ছায়ার মায়াঘর,
রোদ এসেছে সোনার জাদুকর-
মোরা নেব তারি দান, তাই-যে কাটি ধান,
ও সে সোনার জাদুকর’
এমন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কৃষকদের একত্রীকরণ করে কৃষির উন্নতি ও সমবায়নীতি সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ার, লুকোচুরি খেলারে ভাই, লুকোচুরির খেলা। নীল আকাশে কে ভাসাল, সাদা মেঘের ভেলারে ভাই, সাদা মেঘের ভেলা’। কৃষি উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথের অবদান অসামান্য এবং অনুসরণীয়।

আদর্শ কৃষিক্ষেত্র সম্প্রসারণে তার বহুমুখী কর্মসূচি প্রশংসার দাবিরার। তিনি নিবিড়ভাবে অনুধাবন করতেন যে, কৃষক বাঁচলেই গ্রাম বাচবে। আর তাহলেই ‘গ্রামগুলো বেঁচে উঠবে এবং সমস্ত দেশকে বাঁচাবে’। তাই বলেছিলেন- ‘আমি একলা সমস্ত ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারব না, আমি কেবল জয় করব একটি বা দুটি গ্রাম। আমি যদি কেবল দুটি-তিনটি গ্রামকেও মুক্তি দিতে পারি অজ্ঞতা, অক্ষমতার বন্ধন থেকে, তবে সেখানেই সমগ্র ভারতের একটি ছোট আদর্শ তৈরী হবে।’

রবীন্দ্রনাথের সে ভাবনাই আজ একুশ শতকে পৌঁছে বাংলাদেশে স্লোগান: ‘আটষট্টি হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’।