ঢাকা ১৬ বৈশাখ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

মহান স্বাধীনতা দিবসে সব শহিদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৪, ১২:১১ পিএম
মহান স্বাধীনতা দিবসে সব শহিদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা
মো. খসরু চৌধুরী

বাঙালি জাতির হাজার বছরের অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে আমাদের সংবিধান। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে শাসনতন্ত্রে প্রতিফলনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানে অটল থাকা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছাড়া বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনও সম্ভব নয়। তাই সর্বদা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অবিচল থাকতে হবে।...

২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্বের মানচিত্রে একটি নতুন রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে, যার নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। একাত্তরের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালির ওপর অতর্কিত হামলা চালালে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। ওই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয়। 

বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার মূল্যবান দলিলটি সেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে এভাবে- ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ, ১৯৭১।’ 

এ দেশের স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু আমাদের অনুভূতি ও অন্তরাত্মায় মিশে আছেন। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। শেখ মুজিব মানেই বাংলার মুক্ত আকাশ। শেখ মুজিব মানেই বাঙালি জাতির অস্তিত্ব। শেখ মুজিব মানেই বাঙালি জাতির আশ্রয়-ভরসা। শেখ মুজিব মানেই স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।

১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বেসামরিক লোকের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সব রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। প্রায় দুই যুগ ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেন।

বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। 

একাত্তরের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় ও বঙ্গবন্ধুকে মধ্যরাতে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী ৩০ লাখ শহিদ, সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের, স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও চার জাতীয় নেতাকে। স্বাধীনতার প্রথম লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলমুক্তি। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে তা অর্জিত হয়েছে। দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠন; যেখানে দেশের প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হবে। পাকিস্তানিরা এ দেশটাকে শুধু শোষণই করেছে, বাঙালির কোনো অধিকারের স্বীকৃতি ছিল না। তাদের অব্যাহত শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সত্তরের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানিরা বাঙালির হাতে ক্ষমতা না দিয়ে শুরু করেছিল বাঙালিনিধন। সেই গণহত্যায় দলগতভাবে অংশ নিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। গড়ে তুলেছিল রাজাকার, আলবদরের মতো বিভিন্ন বাহিনী। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামের নেতা-কর্মীরাও পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগিতায় নামে। কিন্তু বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহা তারা দমাতে পারেনি।

জাতি যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করবে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অগণিত শহিদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানানো হবে। একই সঙ্গে জাতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে মুক্তিযুদ্ধের যেসব স্বপ্ন এখনো অপূর্ণ রয়েছে সেসব স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। সেই সঙ্গে আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী সব অপশক্তিকে নির্মূল করার ব্যাপারেও। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে- এমনটাই প্রত্যাশা সবার। 

বাঙালি জাতির হাজার বছরের অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে আমাদের সংবিধান। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে শাসনতন্ত্রে প্রতিফলনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানে অটল থাকা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছাড়া বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনও সম্ভব নয়। তাই সর্বদা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অবিচল থাকতে হবে।

শেখ হাসিনার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো উন্নয়নসহ আর্থ-সামাজিক সব খাতে বাংলাদেশ অর্জন করেছে বিস্ময়কর অগ্রগতি। আর্থ-সামাজিক সব সূচকে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে তার দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের ‘বিস্ময়’ হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন ও বর্তমান মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশকে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবারও নিরঙ্কুশভাবে জয় পায় এবং পঞ্চমবারের মতো রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করে। বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে উন্নত দেশের রুটে তুলে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাতদিন পরিশ্রম করে চলেছেন। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও মানবতার বিশ্বজননী হিসেবে ইতোমধ্যেই তার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

পরিশেষে বলছি, শেখ হাসিনা আছেন বলেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। জনগণ স্বাধীনতার সুফল পাচ্ছেন। প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠী সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। দেশের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে।

লেখক: সংসদ সদস্য ঢাকা-১৮, সদস্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ

অতি লোভ কমান, নয়তো সর্বস্ব হারাতে হবে

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০১:১২ পিএম
অতি লোভ কমান, নয়তো সর্বস্ব হারাতে হবে
রিয়াজুল হক

এক শ টাকা ইনভেস্ট করলে দুই শ টাকা পাবেন। হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা টেলিগ্রামে এরকম টেক্সট পেলেন। ভাবলেন, এক শ টাকা! এ আর এমন কী? পাঠালেন এক শ টাকা। সাথে সাথে দুই শ টাকা পেয়ে গেলেন।

এরপর এক হাজার টাকা পেমেন্ট করলেন। সঙ্গে সঙ্গে দুই হাজার টাকা পেয়ে গেলেন। ভাবলেন, ভালোই তো। কোনো কিছু করা লাগে না। যা দেই, দ্বিগুণ ফেরত আসে। এরপর পাঁচ হাজার টাকা দিলেন, ১০ হাজার টাকা পেয়ে গেলেন। ২৫ হাজার টাকা দিলেন, ৫০ হাজার টাকা পেয়ে গেলেন। এক অদ্ভুত লোভের মধ্যে আপনি আটকে গেলেন। কাউকে জানাচ্ছেন না। কারণ এত লাভের কথা অন্য কাউকে জানালে সেও অতি লাভবান হওয়া শুরু করবে। সেটা তো করা যায় না! 

এরপর এক লাখ টাকা দিলেন কিছু সময় পর দেখলেন দুই লাখ টাকা পেয়ে গেছেন। বাহ! জীবনে আর কি দরকার। আপনি দুর্দান্ত প্রতাপে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করলেন। থামার কোনো নাম-গন্ধ নেই।

এরপর আর ২-৪ লাখ না করে, ধার দেনা করে একবারে ৩০ লাখ টাকা পাঠালেন। অপেক্ষায় আছেন ৬০ লাখ টাকা এখনই চলে আসবে। টাকা আসলে কী করবেন, সেই পরিকল্পনা তো অনেক আগেই করা শেষ।

যাই হোক, টাকা চলে আসলো বলে! সময় চলে যাচ্ছে। আপনার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, শীতের মধ্যে শরীর ঘামছে। কিন্তু সেই ৬০ লাখ টাকা আর আসে না।

এরপর যা হবার তাই হলো। আপনি খোলস থেকে বের হলেন। বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ জানানো শুরু করলেন। বলা শুরু করলেন যে, আপনার সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। 

এখানে আপনার সরল বিশ্বাস নিয়ে খেলা করা হয়নি। আপনার লোভ নিয়ে খেলা করা হয়েছে। অতি লোভ কমান। অনেক সমস্যা থেকে দূরে থাকতে পারবেন।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

এআই কি মানুষের ভবিষ্যৎ শাসক?

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:০৫ পিএম
আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৪৩ পিএম
এআই  কি মানুষের ভবিষ্যৎ শাসক?
প্রতীকী ছবি

প্রযুক্তিতে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত নাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (Artificial Intelligence)। একদিকে এই প্রযুক্তি যেমন বদলে দিয়েছে চিকিৎসা, শিক্ষা, কৃষি, শিল্পসহ নানা খাত; অন্যদিকে এটি তৈরি করছে উদ্বেগ। মানুষ কি ধীরে ধীরে এআই-এর নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে? আর ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য?

বর্তমান বাস্তবতা: নিয়ন্ত্রণ কি শুরু?

বিশ্বজুড়ে এআই এখন শুধু সহায়ক প্রযুক্তি নয়, বরং মানবিক আচরণ, সিদ্ধান্ত এবং বিশ্বাসকে প্রভাবিত করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি কোম্পানি Google, Facebook-এর অ্যালগোরিদম আমাদের দেখার জগৎ ও ভাবনার ধারা নির্ধারণ করছে। চীনের 'Social Credit System' নাগরিকদের আচরণের ওপর ভিত্তি করে তাদের সামাজিক সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করছে। একটি ভয়ঙ্কর সফট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে এটি।

এ ছাড়া, চ্যাটবট, ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট, এবং বিভিন্ন Recommendation System ব্যবহারকারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলছে, যা এক ধরণের অদৃশ্য ও নরম শাসনের প্রক্রিয়া।

নিয়ন্ত্রণের ধরণ: কেমনভাবে কাজ করছে এআই?

১. মানসিক নিয়ন্ত্রণ (Psychological Manipulation):

এআই আজ এমনভাবে তথ্য সাজায়, যাতে ব্যবহারকারী নিজের অজান্তেই নির্দিষ্ট একটি পথে চিন্তা করে। এর ফলে আমাদের স্বাধীন মত গঠনের ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

২. নীতিনির্ধারণে এআই:

আদালতের রায়, পুলিশি নজরদারি, এমনকি চাকরির আবেদন বাছাইয়ের মতো ক্ষেত্রেও এআই ব্যবহার হচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের পরিবর্তে মেশিনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

৩. মানবীয় কাজের বিকল্প:

রোবট ও অটোমেশন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে মানুষ তার কর্মক্ষমতা ও কাজের জায়গা হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে। এআই-এর অগ্রগতি ভবিষ্যতে মানুষের চেয়েও দক্ষ সিদ্ধান্তগ্রহণকারী হয়ে উঠতে পারে।

ভবিষ্যতের শঙ্কা: নিয়ন্ত্রণের সীমা কোথায়?

বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞদের মনে নানা শঙ্কা দানা বাঁধছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর সম্ভাবনাগুলো হলো:

স্বায়ত্তশাসিত এআই (Autonomous AI Systems):

এমন এআই যেটি নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় এবং নিজেকে উন্নত করতে পারে- তখন তা মানব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।

Superintelligence এর হুমকি:

বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী Stephen Hawking এবং প্রযুক্তি উদ্যোক্তা Elon Musk-এর মতে, যদি এআই মানুষের তুলনায় বেশি চিন্তাশক্তি অর্জন করে, তবে তা হতে পারে মানব সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

এআই-ভিত্তিক একনায়কতন্ত্র:

নজরদারি, তথ্য নিয়ন্ত্রণ ও জনমত প্রভাবিত করতে এআই ব্যবহার করলে ভবিষ্যতে কিছু সরকার ‘ডিজিটাল দাসত্ব’ তৈরি করতে পারে।

সমাধানের পথ: এখনই পদক্ষেপ জরুরি

বিশ্ববাসীর এখনই প্রয়োজন সচেতনতা এবং সুপরিকল্পিত কার্যক্রম। সম্ভাব্য করণীয়গুলো হলো:

* এআই নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন।
* Human-in-the-loop: এআই যেন সর্বদা মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
* স্বচ্ছতা ও ব্যাখ্যাযোগ্যতা নিশ্চিত করা।
* নৈতিকতা ও মানবাধিকারের প্রাধান্য দেওয়া।

নিয়ন্ত্রণ না সেবা? নির্ধারণ করবে মানুষই

এআই এখনও পুরোপুরি মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেনি, তবে এর সম্ভাবনা ও ঝুঁকি অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন সময় সচেতন হওয়ার, প্রযুক্তিকে শাসকের আসনে না বসিয়ে মানুষের সেবক হিসেবে রাখার।

মেহেদী/

মুজিবুল হায়দার চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫৪ এএম
মুজিবুল হায়দার চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুহাম্মদ হারুন আল-রশিদ

মুজিবুল হায়দার চৌধুরী- বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জগতের রূপান্তরের রূপকার এই অভিজন ২০২৪ সালের ১০ এপ্রিল বিকেল ৪টা ৫৩ মিনিটে ঢাকা এভার কেয়ার হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে তার স্বজন ও সুজনদের কাঁদিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলা আজিজ ফাজিলপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে ১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
 
চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ থেকে স্নাতক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষা সমাপনকারী চৌধুরী ১৯৫৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬১ বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত ইউনাইটেড ব্যাংকে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে সরকারি জনতা ব্যাংকে ডিজিএম পদে যোগদান করেন এবং পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে ১৯৮১ সালে সরকারি খাতের পূবালী ব্যাংকে জিএম পদে বদলি হন।

দেশের অর্থনীতিতে প্রয়াত মুজিবুল হায়দার চৌধুরীর ভূমিকা বহুমুখী। বেসরকারি খাতের প্রথম ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক পিএলসি ও প্রথম জীবন বিমা কোম্পানি ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্স পিএলসির তিনিই প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ। দেশের বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত লিজিং কোম্পানিও তার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে জন্ম হয়েছে। দেশের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রয়াত মুজিবুল হায়দার চৌধুরীর নাম। এসব প্রতিষ্ঠান ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ দশকে আক্ষরিক অর্থেই দেশের অর্থনীতিকে একটি মাত্রা দেওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ১৯৮৫ সালে বেসরকারি খাতে দেশের প্রথম অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ক্রেডিট লি. প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৩ সালে সেটি একটি পূর্ণ মাত্রায় বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে এখন স্বমহিমায় বিদ্যমান। দেশের বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি প্রতিষ্ঠায়ও তার অবদান রয়েছে।

বর্তমান সময়ে পোশাক খাতে যে উচ্চপ্রবৃদ্ধি, এর সূচনা ঘটে ১৯৮৩ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক লি.-এর প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক হায়দার চৌধুরীর মাধ্যমে। ঋণের সব ঝুঁকি উপেক্ষা করে, চাকরিপ্রত্যাশী যুবক ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের ডেকে এনে পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রায় শর্তহীন ও জামানতবিহীন ঋণ দিয়েছেন। তার সেই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকে ব্যাংকটির পরিচালক এমনকি তার ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তাদের বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল। মানস চোখে দুরবীন দূরত্বের ছবি পরিষ্কার দেখার অদ্ভুত দক্ষতাই মানুষটির সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল। যে কারণে বুঝেছিলেন সভ্য দুনিয়ার পোশাক খাতে লুকিয়ে থাকা এক অমিত সম্ভাবনার কথা। প্রায় শূন্য পর্যায়ের একটি খাত তার প্রণোদনা থেকেই পেয়েছিল গগনচুম্বী উল্লম্ফনের গতি। যে শিল্প আজ দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত, কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, সেই শিল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রণোদনার প্রাণপুরুষ এখন বিস্মৃতির অতলান্তে বিলীন। 

মুজিবুল হায়দার চৌধুরী

নিজ গ্রামসহ স্বীয় অর্থায়নে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহু স্কুল-মাদরাসা হিফজখানা ও রংপুরের বদরগঞ্জ এবং শরীয়তপুরের গহীন চর-মাঝির কান্দিতে প্রতিষ্ঠিত বিশাল মসজিদগুলো তার সৎকর্মের স্মারক হয়ে মানুষের কল্যাণ করবে অনাদিকাল। দক্ষিণ উপকূলের প্রত্যন্ত খরপানির অঞ্চলসহ বহু গ্রামে শত শত নলকূপে অর্থায়ন করে লক্ষ পিপাসিত মানুষের পানির ব্যবস্থা করেছেন।

১৯৮৪ সালে দ্য ডেইলি নিউজ এবং ১৯৯০ সালে দৈনিক জনপদ পত্রিকা প্রকাশনায় তার অবদান অনস্বীকার্য কীর্তি হয়ে থাকবে।

যে চিত্ত গভীরতা ও দেশপ্রেম নিয়ে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ও সম্পদ সৃষ্টির জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন, তার কর্মের প্রতিদান হিসেবে যেন বেহেশত নসিব হয়।

মুহাম্মদ হারুন আল-রশিদ:
বহু জাতিক পুঁজি বিনিয়োগ কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মুজিবুল হায়দার চৌধুরীর গুণমুগ্ধ সহকর্মী।

আমেরিকার ডিসকাউন্টেট রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:১৯ পিএম
আমেরিকার ডিসকাউন্টেট রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ
রিয়াজুল হক

বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর আমেরিকা ট্যারিফ বাড়িয়ে দিয়েছে। যে সিস্টেমে ট্যারিফ বাড়িয়েছে সেটাও দুর্দান্ত রকমের অদ্ভুত একটা ব্যাপার। 

যেমন- কম্বোডিয়া ৯৭ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ করতো আমেরিকার নির্ধারিত পণ্যের ওপর, এখন আমেরিকা ৪৯ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ নির্ধারণ করেছে। ভিয়েতনাম ৮৮ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ করতো আমেরিকার নির্ধারিত পণ্যের ওপর, এখন আমেরিকা ভিয়েতনামের ওপর ৪৪ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ নির্ধারণ করেছে। আর নাম দেওয়া হয়েছে ডিসকাউন্ট রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ।

তবে এই পদ্ধতিতে আমাদের পোশাক শিল্পের ওপর একটা প্রভাব আসতে পারে। আমাদের পোশাক খাতের ওপর এতদিন ট্যারিফ ছিল ১৫ শতাংশ, কিন্তু নতুন ট্যারিফের হার ৩৭ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে। অন্যদিকে পোশাক খাতে আমাদের প্রতিযোগী দেশ, যেমন চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, তুরস্কের ওপর ১০ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ হবে। আমেরিকার আমদানিকারকরা কম ট্যারিফ দেওয়ার সুযোগে হয়তো আমাদের প্রতিযোগী দেশের দিকেও ঝুঁকতে পারে। আমেরিকা আমাদের জন্য অনেক বড় মার্কেট। অথচ কম ট্যারিফের কারণে পোশাক খাতে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো আমাদের থেকে কম্পিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ পাবে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ আমেরিকায় ৭.২৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে এবং প্রায় ২.২১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্যে আমেরিকা থেকে আমদানি করে। আমেরিকায় আমাদের রপ্তানির পরিমাণ আমদানি থেকে প্রায় সাড়ে তিনগুণ বেশি। অর্থাৎ সেখানে আমাদের ট্রেড সারপ্লাস।

এখন আমাদের উচিত, কীভাবে আমাদের রপ্তানি পোশাক শিল্পের ওপর ট্যারিফ কমানো যায়, সেই বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করা। প্রয়োজনে আমরা আমেরিকার কিছু আমদানি করা পণ্যের ওপরও ট্যারিফ কমিয়ে দিতে পারি। যেহেতু আমেরিকা ডিসকাউন্টেট রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ ফলো করছে। 

কেউ কেউ বলতে পারেন, আমেরিকা আমদানি নিরুৎসাহিত করতে চাইছে। তারা নিজেরাই সবকিছু উৎপাদন করবে। এটা কি আদৌ সম্ভব? যেমন ধরুন, আমাদের মোংলা ইপিজেডের মধ্যে যেসব পোশাক কারখানা রয়েছে, সেখানে একজন ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা বেতনে সারা মাস চাকরি করেন‌। আমেরিকায় কাউকে পাবেন, যিনি ৫০ ডলার বেতনে সারা মাস চাকরি করবে? সুতরাং বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয়।

এটা ঠিক, ট্যারিফ বাড়িয়ে আমেরিকার সরকারের আয় বাড়বে। বাড়তি ট্যারিফ দিতে যেয়ে সেখানকার আমদানিকারকদের খরচ বাড়বে। আর সেই বাড়তি খরচের জন্য আমদানি করা পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। আলটিমেট প্রভাবটা পড়বে কাদের ওপর? ঠিক ধরেছেন, আমেরিকার জনগণের ওপর। তাদের বেশি মূল্যে আগের পণ্য কিনতে হবে।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইতিহাসের আড়ালে ৫৪ বছর একাত্তর সালের ডহরপাড়া গণহত্যা

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৯:৫৭ পিএম
ইতিহাসের আড়ালে ৫৪ বছর একাত্তর সালের ডহরপাড়া গণহত্যা

একাত্তর সালে বাংলাদেশের নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা বীভৎস গণহত্যা চালিয়েছিল। এই বর্বর গণহত্যা থেকে রক্ষা পায়নি এ দেশের শিশু ও নারীরা। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের সবুজে বেষ্টিত মেঠোপথের ডহরপাড়া গ্রামের সাধারণ মানুষও রক্ষা পায়নি সেই গণহত্যা থেকে। রক্তাক্ত সেই ভয়াল দিনের কথা বলতে গেলে এখনো গ্রামের লোক শিউরে ওঠে, কান্নায় কথা আটকে যায় স্বজনদের। একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর, মুক্তিযুদ্ধ কোষ এবং গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ গ্রন্থেও ডহরপাড়া গণহত্যার ওপর অত্যন্ত সংক্ষেপে আলোকপাত করা আছে।

ডহরপাড়া গ্রামের গণহত্যার দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার ১৯৭১ সালের ২০ মে। অনুসন্ধান, গবেষণা ও শহিদ পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয়দের ভাষ্য অনুসারে সেদিন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ১৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। বর্তমানে গ্রামটির যোগাযোগব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আজ থেকে ৫৪ বছর আগে ডহরপাড়া গ্রামের যোগাযোগব্যবস্থা ছিল খুবই অনুন্নত ও ভরগ্রাম। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এত ভিতরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবেশ করার সুযোগ ছিল না। গ্রামের শহিদ পরিবার ও এলাকাবাসীর ধারণা, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কিছুদিন আগে মারা গিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী মাধবপাশা এলাকার তৎকালীন স্বাধীনতাবিরোধী নেতা সিরাজ মাওলানা। ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে বরিশাল ত্রিশ গোডাউন ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লঞ্চে করে ভোরে এসে ভেড়ে গুঠিয়ার কালিজিরা নদীর পাড়ে। অপরিচিত এলাকা হওয়ার কারণে পথ ভুলে গুঠিয়ার এপাড়ে উঠে এসে বটতলা থেকে গণহত্যা শুরু করে ডহরপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এ সময় গ্রামের লোকজন ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। গ্রামের মুসলমানদের মধ্যে তাৎক্ষণিক ধারণা হয়েছিল যে, মুসলমান ভাই ভাই। এ কারণে অনেকেই টুপি, পাঞ্জাবি পরে কোরআন শরিফ পড়ছিল ঘরে বসে। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি অনেকের।

বটতলায় পাকিস্তানিদের হাতে প্রথম শহিদ হন ডহরপাড়ার গ্রামের জুম্মাত আলী ফকিরের ছেলে মালেক ফকির (২৭)। আব্দুল মালেক হাওলাদারের বাড়িতে হত্যা করে দুজনকে। গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা সাত্তার মোল্লার সামনেই হত্যা করে মেহের উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে বয়োজ্যেষ্ঠ আজিমউদ্দিন হাওলাদারকে (৮০)। এই বীভৎস্য গণহত্যা দেখে সাত্তার মোল্লার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয় এবং পরদিনই তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য দেশ ছাড়েন। এভাবেই গণহত্যা চালিয়ে হত্যা করে ডহরপাড়া গ্রামের তালুকদার বাড়ির গোলাম কাদেরের ছেলে কাশেম তালুকদার (৫৫), মেনাজ উদ্দিন হাওলাদারে ছেলে তুজুম্বর (৪৫), হাওলাদারবাড়ির সোবাহান হাওলাদারের ছেলে হাশেম হাওলাদার (৩২), আব্দুল আজিজ হাওলাদারের ছেলে নূর মোহাম্মদ হাওলাদার (৪৫), তোরাব হাওলাদারের ছেলে ওহাব হাওলাদার (৬৫), সাদেত আলী হাওলাদের ছেলে আশরাফ আলী (২৫), আজাহার আলী হাওলাদারের  ছেলে লতিফ আলী হাওলার (২৪), হাতেম আলী হাওলাদারের ছেলে আব্দুল মান্নান হাওলাদার মনা (২০), হাসেম আলী হাওলাদারের ছেলে নুরুল ইসলাম হাওলাদার (২৬), নিজামউদ্দিন হাওলাদারের ছেলে কদম আলী হাওলাদার (৪৬), আফসার উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে মোশারফ হোসেন হাওলাদার (৬০), ঝালকাঠি পরমহল নবগ্রামের ময়িজ উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে মোবারক হোসেন হাওলাদার (৬০), সিকদারবাড়ির কদম আলী সিকদারের ছেলে ইসমাইল সিকদার (৩৬) ও লস্করবাড়ির হামেদ লস্করের ছেলে মুজাহার লস্কর (৪৫) এবং ডহরপাড়া গ্রামের সবার কাছে মেহেন্দী গঞ্জের হুজুর নামে পরিচিত এক ব্যক্তিসহ মোট ১৭ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। স্থানীয়দের কাছে তিনি মেহেন্দি গঞ্জের হুজুর নামেই পরিচিত ছিলেন যার মূল বাড়ি ছিল হিজলা উপজেলায় এবং তিনিও স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতেন। শহিদ আশরাফ আলী সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এলাকায় এসে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে এলাকার মানুষকে সংগঠিত করে গ্রামের সামাদিয়া দারুল উলুম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দিতেন। শহিদ কদম আলী হাওলাদারও পেশায় শিক্ষকতা করতেন। 

ওইদিনের গণহত্যায় আহত হন হাওলাদার বাড়ির নিজাম উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে কাশেম আলী হাওলাদার (৩০), ইয়াছিন আলী হাওলাদারের ছেলে আজাহার আলী হাওলাদার (৫০) ও মৃত সাদেক আলী মুন্সির ছেলে আব্দুল ওহাব আলী হাওলাদার (২২), তালুকদার বাড়ির লেহাজ উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে আব্দুল হাই হাওলাদার (৩০)। আহতদের মধ্যে ওহাব আলী হাওলাদার ছিলেন পেশায় শিক্ষক।

 

এই গণহত্যার সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওইদিন পাকিস্তানি বাহিনীদের হাতে শহিদ হয়েছেন স্থানীয় শিক্ষক, চাকরিজীবী, মসজিদের ইমাম, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। ডহরপাড়া গ্রাম ও শহিদদের পরিবারের অনেক সদস্য স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। 

তবে ডহরপাড়ার এই গণহত্যা নিয়ে স্বাধীনতার এত বছরেও উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা কিংবা তথ্যচিত্র নির্মিত হয়নি। এত বছরে শহিদ পরিবারের সদস্যরা শহিদের মর্যাদা পাননি। শহিদদের স্মৃতিরক্ষার্থে কোনো শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়নি। বেশির ভাগ শহিদের স্থানীয়ভাবে কাফনের কাপড় সংগ্রহ করে কিংবা বাড়ির মহিলাদের পরনের সাদা কাপড় দিয়ে দ্রুত দাফন করা হয়েছিল। গণহত্যায় শহিদদের জানাজার নামাজ পড়িয়েছিলেন আবুল বাশার হুজুর ও ইস্কান্দার মৌলভী এবং চেরাগ আলী মুন্সি। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরাই নিজেদের মতো করে জানাজা ও দাফন-কাফন করেছিলেন। 

লেখক: রাইসা রহমান উর্মি, এমএড (প্রশিক্ষণার্থী), সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা ও ইমাম মেহেদী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, পিএস টু ভিসি, লালন বিজ্ঞান ও কলা বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া