আমরা ভাগ্যবান যে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতা পেয়েছিলাম, যার বজ্রকণ্ঠ অনবদ্য সাহস ও অসাধারণ নেতৃত্ব না থাকলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারী-ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। কিন্তু তারা বোঝেনি, বঙ্গবন্ধু শুধু একজন ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি আদর্শ। ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়, কিন্তু আদর্শকে যায় না। বাংলার শোষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ও সমৃদ্ধিই ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য।...
পাকিস্তাানি ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, নির্যাতনের শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দখলদার পাকিস্তাানি বাহিনীকে পরাস্ত করে বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। এই দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে সর্বোচ্চ গৌরবের একটি অবিস্মরণীয় দিন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পরিবারের সদস্যসহ যেসব কীর্তিমান মানুষের আত্মত্যাগে এই স্বাধীনতা সম্ভব হয়েছিল তাদের প্রতি স্বাধীনতা দিবসে গভীর শ্রদ্ধা জানায় বিশ্ববাসী। বাংলাদেশ সেই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী দেশ, যেটি ২৪ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের পর রণাঙ্গনে শত্রুকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এ বিজয়কে অনিবার্য করে তুলেছিলেন, তাদের প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন। তার ত্যাগ ও সংগ্রাম আজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হয়ে ধরা দিয়েছে তরুণ প্রজন্মের সামনে।
বাঙালি জাতির ইতিহাস লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস, আত্মত্যাগের ইতিহাস। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, সে আগুন যেন ছড়িয়ে পড়ে বাংলার সর্বত্র। এরপর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা এবং উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে একাত্তরের মার্চ বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে নতুন বারতা। বছর ঘুরে এক অন্যরকম পরিবেশে এবার বাঙালির জীবনে এসেছে মার্চ। অগ্নিঝরা মার্চের শুরু। এই মাস হলো বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সাক্ষী। ১৯৭১ সালের এই মাসে তীব্র আন্দোলনের পরিণতিতে শুরু হয় মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ, সারা দেশই ছিল তখন অগ্নিগর্ভ। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে বলেছিলেন, পাকিস্তানের একটি প্রধান দল পিপলস পার্টি এবং অন্য কয়েকটি দল ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
বেতারে এ ঘোষণা প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ সময় তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) পাকিস্তান বনাম বিশ্ব একাদশের ক্রিকেট খেলা চলছিল। ইয়াহিয়া খানের ওই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দর্শক খেলা ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে হাজারো মানুষ পল্টন-গুলিস্তানে বিক্ষোভ শুরু করে দিয়েছে। সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। সেদিন মতিঝিল-দিলকুশা এলাকার পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। ক্ষুব্ধ ছাত্ররা সেখানে গিয়ে প্রথমবারের মতো স্লোগান দেয়, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ছাত্ররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কর্মসূচি ঘোষণার দাবি জানায়। বিক্ষোভ- স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকাসহ গোটা দেশ। এরপর একে একে পার হয় বিক্ষুব্ধ ২৫টি দিন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি হানাদার সামরিকবাহিনী শান্তিপ্রিয় নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। তিনি সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র সংগ্রামে। স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পর পাকিস্তানের দখলদার সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটক রাখে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তাানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ চালায়, শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এই পথ ধরে বাঙালি দামাল ছেলেরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনেন একটি স্বাধীন দেশ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হলেও চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল একাত্তরের ১ মার্চ থেকেই। বাঙালির জীবনে নানা কারণে মার্চ মাস অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস। এ মাসেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর আগে তিনি পাকিস্তাানি শাসকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। মরতে যখন শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি, আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব- ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
১৯৭১-এর ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী ময়দানে দেওয়া এই ঐতিহাসিক ভাষণের সময় মুহুর্মুহু গর্জনে উত্তাল ছিল জনসমুদ্র। লাখো কণ্ঠের একই আওয়াজ উচ্চারতি হতে থাকে দেশের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। ঢাকাসহ গোটা দেশে পত পত করে উড়ছিল সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের পতাকা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, মার্চে এসে সেই আগুন যেন ছড়িয়ে পড়ে বাংলার সর্বত্র। এরপর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা এবং উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে একাত্তরের মার্চ বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে নতুন বার্তা। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এর আগে ২৫ মার্চ রাত ১টার দিকে পাকিস্তাানি সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তাানিরা বাঙালির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বাঙালি নিধনে নামে। ঢাকার রাস্তায় সৈন্যরা নির্বিচারে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করে।
এর পরের ঘটনাপ্রবাহ প্রতিরোধের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা হয়। আবালবৃদ্ধবনিতা যোগ দেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে জাতি লাভ করে স্বাধীনতা।
মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে। লক্ষ্য স্থির করে, ধাপে ধাপে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন তিনি। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করা শুরু হয়েছিল মূলত ৬ দফার মধ্য দিয়েই। উনসত্তরের বিশাল গণ আন্দোলনে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন হলো। নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। বঙ্গবন্ধু সত্তরের নির্বাচনকে নিলেন তার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণভোট হিসেবে। আর ব্যালটে তিনি এমন অভাবিত বিজয় অর্জন করলেন যখন পাকিস্তানিদের বুলেট, ট্যাঙ্ক, কামান- সবই তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। এ নির্বাচনে বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাকে অভূতপূর্ব একটা বিজয় উপহার দিয়েছিল। বাঙালির রক্তের দামে কেনা স্বাধীনতার সূর্য পূর্ব দিগন্তে উদিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে।
বঙ্গবন্ধুর মধ্যে যে তেজস্বিতা, কাজের প্রতি একাগ্রতা, বিশ্বাসের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা, স্বপ্ন দেখার অসাধারণ ক্ষমতা, অনন্য ব্যক্তিত্ব এবং দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল, তা সবার জন্যই অনুকরণীয়। আমরা ভাগ্যবান যে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতা পেয়েছিলাম, যার বজ্রকণ্ঠ অনবদ্য সাহস ও অসাধারণ নেতৃত্ব না থাকলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারী-ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। কিন্তু তারা বোঝেনি, বঙ্গবন্ধু শুধু একজন ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি আদর্শ। ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়, কিন্তু আদর্শকে যায় না। বাংলার শোষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ও সমৃদ্ধিই ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য।
দেশের মানুষ আবারও নতুন করে শপথ নেবেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতির পিতার স্বপ্নের সুখী, সমৃদ্ধ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি তার আত্মপরিচয়ের সন্ধান পায় যে মাসে, তারই নাম মার্চ। একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এর আগে ২৫ শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তাানি সৈন্যরা গ্রেপ্তার করে তার বাড়ি থেকে। পাহাড়ের দৃঢ়তার চেয়ে দৃঢ় যাদের মনোবল সে জাতি কখনো পরাধীন থাকতে পারে না। বাঙালি জাতি এমনই এক বীরের জাতি।
লেখক: রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর