ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

পরিবর্তনশীল সমাজের সামাজিক ব্যাধির শিকার সাদি মহম্মদ-ফাইরুজ অবন্তিকা

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২৪, ০৩:৫৮ পিএম
আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৪, ০৪:২২ পিএম
পরিবর্তনশীল সমাজের সামাজিক ব্যাধির শিকার সাদি মহম্মদ-ফাইরুজ অবন্তিকা
ড. মতিউর রহমান

সামাজিক ব্যাধি মোকাবিলা এবং ন্যায়বিচার ও সমতা বৃদ্ধির জন্য সরকার ও প্রতিষ্ঠানকে দায়বদ্ধ রাখতে সুশীল সমাজের সংগঠন, তৃণমূল কর্মী এবং অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জনসমর্থন জোগাড় করে, সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং নীতি পরিবর্তনের জন্য সমর্থন করে, এই গ্রুপগুলো অর্থপূর্ণ অগ্রগতি এবং পরিবর্তন চালাতে সাহায্য করতে পারে।…

বাংলাদেশ, একটি জাতি যা সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যে গৌরবান্বিত। যুগ যুগ ধরে, আমরা বারবার রূপান্তরিত হয়েছি, অগ্রসর হয়েছি এবং নতুন করে গড়ে উঠেছি। এই অবিরাম প্রবাহ আমাদের জাতীয় পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছি। প্রযুক্তির অগ্রগতি সমাজের সব স্তরে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, তথ্যের সহজলভ্যতা এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে প্রযুক্তি ব্যাপক অবদান রাখছে। নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু অধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। তা সত্ত্বেও সামাজিক ব্যাধি যেমন- দুর্নীতি, অসমতা এবং সামাজিক বৈষম্য আমাদের সমাজের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। রাজনৈতিক, সামাজিক অস্থিরতা এবং সহিংসতা আমাদের অগ্রগতিকে ব্যাহত করছে। পরিবর্তনের ধারায় অনেক দুর্বল মানুষ পিছিয়ে পড়ছে। অবিচার, অবহেলা এবং বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তারা।

সম্প্রতি প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্রী ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনা দেশবাসীকে হতবাক করেছে। তাদের অকালমৃত্যু কেবল ব্যক্তিগত শোকের বিষয় নয় বরং বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন।

এই দুটি ঘটনা আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের জটিলতার সঙ্গে জর্জরিত বাংলাদেশের সামনে অগণিত চ্যালেঞ্জের মর্মান্তিক অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে। একজন প্রতিভাবান শিল্পী হতাশার শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তার মৃত্যু সমাজের গভীরতম অন্ধকার দিকগুলো, যেমন- মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা, সামাজিক চাপ এবং শিল্পীদের জীবনে অনিশ্চয়তা তুলে ধরে। একজন তরুণী, সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে হতাশার শিকার হন। তার মৃত্যু নারীদের অধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কঠোর নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করে।

সাদি মহম্মদের আত্মহত্যা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে প্রবল ধাক্কা দিয়েছে। একজন প্রতিভাবান রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীর অকালমৃত্যু কেবল তার পরিবার ও বন্ধুদের জন্যই বেদনাদায়ক নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের জন্য একটি ক্ষতি। রবীন্দ্রসংগীত সংরক্ষণ ও প্রচারে সাদি মহম্মদের বিরাট অবদান ছিল। তিনি দীর্ঘদিন ধরে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করে আসছিলেন এবং তার সুমধুর কণ্ঠে অনেক গান জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
দুঃখজনকভাবে, সাদি মহম্মদকে কখনো একুশে পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি। এই পুরস্কারগুলো বাংলাদেশি সংস্কৃতি ও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ব্যক্তিদের দেওয়া হয়। সাদি মহম্মদের পুরস্কার না পাওয়া বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের একটি বেদনাদায়ক বাস্তবতা। সাদি মোহাম্মদের মৃত্যু শিল্পী ও সংগীতশিল্পীদের দুর্দশার কথা তুলে ধরে। অনেকেই সরকার ও সমাজের দ্বারা অস্বীকৃত এবং অপ্রশংসিত হন। সাদি মহম্মদের মৃত্যু আমাদের জাতির সংস্কৃতি ও সমাজের প্রতি গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করে।

সাদি মহম্মদের মতো একজন প্রতিভাবান শিল্পীর প্রতি সরকারের অবহেলা বাংলাদেশের শিল্প ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অবমূল্যায়ন করার একটি বৃহত্তর প্রবণতার প্রতীক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দেশ। সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, নাটক, চলচ্চিত্র- সব ক্ষেত্রেই আমাদের দেশের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই ঐতিহ্য ধারণ করে এমন শিল্পী ও সংগীতজ্ঞরা প্রায়শই জীবন ধারণ করতে এবং তাদের প্রাপ্য স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য লড়াই করে।

শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শিল্পীদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান, প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার ব্যবস্থা করা এবং তাদের জন্য পুরস্কার ও সম্মাননার ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। বাংলাদেশে শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ও বিনিয়োগের অভাব রয়েছে। এর ফলে শিল্পীরা তাদের প্রতিভা বিকশিত করতে এবং তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে সমস্যায় পড়েন।

প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার অভাবে শিল্পীরা জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্য পেশার ওপর নির্ভরশীল হন। এর ফলে তারা তাদের শিল্পকলার ওপর পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন না। প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার অভাবে এবং স্বীকৃতি না পাওয়ায় অনেক প্রতিভাবান শিল্পী হতাশায় ভোগেন এবং প্রান্তিক হয়ে পড়েন। সাদি মহম্মদের মৃত্যু এই বেদনাদায়ক বাস্তবতার একটি মর্মান্তিক প্রতিফলন।

অন্যদিকে, ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যা, যৌন হয়রানি এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ব্যাপক ইস্যুতে আলোকপাত করে যা বাংলাদেশি সমাজকে ক্রমাগত জর্জরিত করে চলেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্রী হিসেবে, ফাইরুজ আবন্তিকা তার সহপাঠী দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হন, এমন একটি অভিজ্ঞতা যা তাকে মানসিক আঘাত এবং দুর্বল করে রেখেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি জানানো সত্ত্বেও কোনো প্রতিকার পাননি, যা তার হতাশা এবং অসহায়ত্বের অনুভূতি আরও বাড়িয়ে তোলে। সমাজে নিজেকে পরিত্যক্ত ও অপ্রয়োজনীয় মনে করেন।

ফাইরুজ অবন্তিকার সুইসাইড নোট যেখানে তার আত্মহত্যাকে একটি ‘কৌশলগত হত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা এবং উদাসীনতার ছলনাময় প্রকৃতির কথা বলে। যদিও তার মৃত্যু হত্যার আইনি সংজ্ঞার সঙ্গে মানানসই নাও হতে পারে, এটি এমন একটি ব্যবস্থার জন্য একটি কঠোর অভিযোগ, যা তার অধিকার রক্ষা করতে এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। ‘কৌশলগত হত্যা’ শব্দটি যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার, যারা ন্যায়বিচার ও প্রতিকার থেকে বঞ্চিত, তাদের দ্বারা অনুভূত বিশ্বাসঘাতকতা এবং অবিচারের গভীর অনুভূতিকে অন্তর্ভুক্ত করে।

ফাইরুজ অবন্তিকা তার প্রতি সংঘটিত অপরাধের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের দোষারোপ করেছেন, যেটি বাংলাদেশে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এবং দায়মুক্তি অব্যাহত রাখার পদ্ধতিগত ব্যর্থতার ওপর জোর দেয়। যৌন হয়রানির শিকারদের জন্য জবাবদিহিতা এবং ন্যায়বিচারের অভাব একটি শীতল বার্তা পাঠায় যে, অপরাধীরা দায়মুক্তির সঙ্গে কাজ করতে পারে, যখন বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা নীরবতায় ভোগেন।

সাদি মহম্মদ এবং ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং বাংলাদেশে বৃহত্তর সামাজিক অসঙ্গতি এবং পদ্ধতিগত ব্যর্থতার লক্ষণ। সমাজ ও সংষ্কৃতির উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বদের প্রতি অবহেলা থেকে শুরু করে যৌন হয়রানি এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ব্যাপকতা, এই ট্র্যাজেডিগুলো ব্যবস্থাগত সংস্কার এবং সামাজিক পরিবর্তনের জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে এবং আরও ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনে সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শিল্প ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বিনিয়োগ করে, শিল্পী ও সংগীতজ্ঞদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং যৌন হয়রানি ও সহিংসতা থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সহায়তা ও সংস্থান প্রদান করে, সরকার এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে যেখানে সব ব্যক্তি তাদের সম্ভাবনাকে পূর্ণ করতে পারে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে, বিশেষ করে, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও মঙ্গল নিশ্চিত করতে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ঘটনাগুলো রিপোর্ট করার জন্য দৃঢ় নীতি ও পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা, অভিযোগের জবাব দেওয়ার বিষয়ে শিক্ষক এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ক্যাম্পাসে সম্মান ও সমতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।

সামাজিক ব্যাধি মোকাবিলা এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রচারের ক্ষেত্রেও সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা এবং ক্ষমতায়ন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যৌন হয়রানি এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, ক্ষতিকারক নিয়ম এবং মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করে এবং বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের সমর্থন করার মতো বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে, সম্প্রদায়গুলো সবার জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সামাজিক ব্যাধি মোকাবিলা এবং ন্যায়বিচার ও সমতা বৃদ্ধির জন্য সরকার ও প্রতিষ্ঠানকে দায়বদ্ধ রাখতে সুশীল সমাজের সংগঠন, তৃণমূল কর্মী এবং অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জনসমর্থন জোগাড় করে, সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং নীতি পরিবর্তনের জন্য সমর্থন করে, এই গ্রুপগুলো অর্থপূর্ণ অগ্রগতি এবং পরিবর্তন চালাতে সাহায্য করতে পারে।

সাদি মহম্মদ ও ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের জাতির মনোবলের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। আমাদের সবার উচিত এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য একসঙ্গে কাজ করা। সরকারের উচিত শিল্প ও সংস্কৃতির জন্য বাজেট বৃদ্ধি করা এবং শিল্পীদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা প্রদান করা। শিল্পীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার ব্যবস্থা করা। তাদের জন্য পুরস্কার ও সম্মাননার ব্যবস্থা করা। সমাজের সব স্তরে শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মানসিক স্বাস্থ্যের সেবাদানের ব্যবস্থা উন্নত করা। সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটানো। নারীদের অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করা। সবার জন্য ন্যায়বিচার ও সুযোগের সমান অধিকার নিশ্চিত করা।

সাদি মহম্মদ ও ফাইরুজ অবন্তিকার মৃত্যু আমাদের জাতির জন্য একটি বেদনাদায়ক ক্ষতি। তাদের মৃত্যু আমাদের সমাজের অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরে এবং আমাদের সবার জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য কাজ করার প্রেরণা জোগায়।

সামাজিক ব্যাধি মোকাবিলা করে এবং আরও ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনের জন্য একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে, বাংলাদেশ সাদি মহম্মদ এবং ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে পারে এবং তাদের জীবন দান যাতে বৃথা না যায় তা নিশ্চিত করতে পারে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

জাতীয় শিক্ষাক্রম ফ্রেমওয়ার্ক-২০২১ প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের মতামত কতটা গুরুত্ব পেল?

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৪:২৭ পিএম
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৫:০৫ পিএম
জাতীয় শিক্ষাক্রম ফ্রেমওয়ার্ক-২০২১ প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের মতামত কতটা গুরুত্ব পেল?
মো. হাবিবুর রহমান

গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য একটি কার্যকরী শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) প্রণয়ন অপরিহার্য। কারিকুলাম প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন জাতীয় কারিকুলাম প্রণয়নে শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের অংশগ্রহণ কতটা নিশ্চিত করা হয়েছে? বা কীভাবে করা হয়েছে? প্রণীত জাতীয় কারিকুলাম এখন বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে, এ বিষয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া কী বার্তা দেয়? 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুবাদে স্নাতক পর্যায়ে দুটি ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একটি কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। টারসিয়ারি পর্যায়ে বর্তমানে ওবিই (OBE, Outcome Based Education) পদ্ধতিতে কারিকুলাম প্রণয়নের জন্য ইউজিসি কর্তৃক নির্দেশনা রয়েছে। এই পদ্ধতিতে কারিকুলাম প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্টেকহোল্ডারদের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। মোটাদাগে এই স্টেইকহোল্ডাররা হলেন: বিষয় বিশেষজ্ঞ (Subject Experts); প্রাক্তন শিক্ষার্থী (Alumni); শিক্ষার্থীদের বা যাদের জন্য কারিকুলাম প্রণয়ন করা হচ্ছে তাদের প্রয়োজন  (Target Population's Needs); অভিভাবক  (Guardians); চাকরিদাতা (Employers); এডভাইজরি প্যানেল (বিভিন্ন পেশাজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত) এবং সমাজের সদস্য (Community Members)। আমি ও আমার সহকর্মীরা কারিকুলাম প্রণয়নের সময় উল্লিখিত এই স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাদা করে বসেছি, আলোচনায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছি এবং তাদের মতামতগুলো লিপিবদ্ধ করেছি। প্রণীত কারিকুলামেও এর যথাযথ প্রতিফলন ঘটেছে। 

জাতীয় শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) প্রনয়নের  ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন কমিটি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন। জাতীয় শিক্ষাক্রমের প্রভাব/ফলাফল জাতির জীবনে সুদূরপ্রসারী। সুতরাং শিক্ষাক্রম প্রণয়নের প্রক্রিয়াও যথাযথ ও সময়োপযোগী হওয়া বাঞ্চনীয়। কারিকুলাম প্রণয়নের ধাপসমুহ সঠিকভাবে অনুসরণ করলেই যে, প্রণীত কারিকুলাম ত্রুটিমুক্ত হবে একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারিকুলামের কার্যকারিতা ভালো বোঝা যাবে এর বাস্তবায়ন পর্যায়ে। তবে, কারিকুলামের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। কেন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না? বা দুর্বলতাগুলো কোথায়? তা চিহ্নিত করা জরুরি। কেননা এর মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অভিভাবকদের সাথে কথা বলেছি ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেছি। এই আলোকে অভিভাবকদের কাছ থেকে আমি অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ভালো নয়। অভিভাবকদের মাধ্যমে এই নেতিবাচক মনোভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে এবং তাদের মানসপটেও নতুন কারিকুলামের প্রতি তথা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি হতে পারে। যা আদতে নতুন প্রজন্মের জন্য এক অশনিসংকেত। সুতরাং শুরুতেই এই অনাস্থা দূর করা জরুরী। মোটাদাগে যে বিষয়গুলো অভিভাবকগণ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের সাথে আমার আলোচনায় উঠে এসেছে, সেগুলো হল: ক। নতুন কারিকুলাম প্রণীত সিলেবাস, বই-পুস্তক, শ্রেণী-শিখন পদ্ধতি ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় আস্থাহীনতা; খ। মূল্যায়ন প্রক্রিয়া স্পষ্ট ও চূড়ান্ত না হওয়া (অতিমাত্রায় পরীক্ষামূলক বা এক্সপেরিমেন্টাল); গ। নতুন কারিকুলাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের (দেশে ও বিদেশে) উচ্চ শিক্ষা পদ্ধতির বা কারিকুলামের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? এবং এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণার অভাব; ঘ। সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। 

নতুন কারিকুলামের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত, প্রতিক্রিয়া ও যৌক্তিক সমালোচনাকে গুরুত্ব দেওয়া অতীব জরুরি। কারিকুলাম প্রণয়নের প্রাইমারি স্টেইকহোল্ডারদের একদম বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সুবিবেচনাপ্রসূত হবে না এবং কোনো ভালো ফলাফলও বয়ে নিয়ে আসবে না। কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং একে ফলপ্রসূ করতে হলে স্টেইকহোল্ডারদের যৌক্তিক মতামত গ্রহণ ও তাদের সহযোগিতা অনস্বীকার্য।  

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা
[email protected]

একেই বলে ছাগলধরা!

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৪ পিএম
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৫:০৪ পিএম
একেই বলে ছাগলধরা!
ড. মো. আসাদুজ্জামান মিয়া (মুন্না)

আগের দিনে ছাগল নিয়ে যত প্রবাদ ছিল তা বর্তমান সময়ের একটি ছাগল পরিবর্তন করে দিয়েছে। ছাগলে কিনা খায়, পাগলে কিনা বলে? হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে! এসব প্রবাদ এখন উল্টে গেছে। এখনকার ছাগলরা উচ্চবংশীয়! যা তা খায় না। তথাকথিত ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা ইমরান হোসেনের প্রচেষ্টায় এবার বিরল কিছু গরু ও ছাগল কোরবানির বাজারে এসেছে। আমাদের সৌভাগ্য হয়েছে এসব বিরল গরু ও ছাগলের বিষয়ে জানার ও দেখার। সরাসরি নয়, ফেসবুকের কল্যাণে।

একটি গরুর দাম ১ কোটি আর একটি ছাগলের দাম ১৫ লাখ। শুনতে গল্প মনে হলেও এটাই বাস্তব। এগুলো সাধারণ কোনো গরু ও ছাগল নয় বরং এরা উচ্চবংশীয়, এদের পূর্বপুরুষরা এলিট শ্রেণির। এদের বিশেষ কেরামতি আছে। সত্যিই তাই। এরা এমন ভাইরাল গরু ও ছাগল যে এদের লালন-পালনকারী, ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই ইতোমধ্যে সুপার ভাইরাল হয়ে গেছে। যদিও এখন পর্যন্ত আমরা শুধু একটি ছাগলের কেরামতি দেখছি, কোটি টাকার গরুর কেরামতি দেখার অপেক্ষায় আছি।

বাংলাদেশের সর্বত্র এখন এই ভাইরাল ছাগল নিয়ে বেশ তুলকালাম চলছে। মজার বিষয় হলো ছাগলটি আমাদের সমাজের তথাকথিত ওপর শ্রেণির কিছু মানুষের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। যে কাজ কোনো দিন কেউ করতে পারত কি না সন্দেহ রয়েছে, তা একটি ছাগল অনায়েসে করে দেখিয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, এই ছাগলের ভয়ে এখন সবাই তটস্থ। রীতিমতো কারও কারও ঘুম হারাম করে দিয়েছে এই ছাগল। ছাগলকাণ্ডে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে এর ক্রেতা ইফাত। আবার ছাগলকাণ্ডে ক্রেতা ইফাতকে অস্বীকার করেছে তার জন্মদাতা বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমান (সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত)। পর্দার আড়ালে চলে গেছে পুরো মতিউর পরিবার। কী নিদারুণ পরিস্থিতি? যে ছাগল কাঁঠাল পাতা খায়, সে এখন আমাদের মানুষ চেনাচ্ছে। এই ছাগলকাণ্ডে আমরা মতিউর রহমান নামক একজন অতি ক্ষমতাধর, বিশাল সম্পদশালী অসৎ সরকারি অফিসার সম্পর্কে জানতে পেরেছি। তার ঠিকুজিকুষ্ঠি পুরোপুরি উদ্ধার হয়েছে। তার স্ত্রীরা, পুত্র ও কন্যারা কোথায় কী করছেন, কী কী অবৈধ সম্পদ ভোগদখল করছেন তা গোটা পৃথিবীর মানুষ জানতে পেরেছে।

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, যে মতিউর রহমানকে ইতিপূর্বে কেউ থামাতে পারেনি একটি ছাগল তা করে দেখিয়েছে। এই ছাগলের কল্যাণেই জানতে পারলাম যে, এই মতিউর রহমান ছিলেন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক সব ক্ষমতার ওপরে। বাংলাদেশের সব স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিল মতিউর রহমানের শক্ত নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশের যে কাউকে তিনি ম্যানেজ করার স্বক্ষমতা রাখতেন। তার দাপটে ভালো ও সৎ অফিসাররা ছিলেন অসহায়। মনে হচ্ছে মতিউর রহমান বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে খুব ছোট করে ফেলেছিলেন, যেখানে চাইলেই যা ইচ্ছে তা করা যায়। কীসের আইন, কীসের নিয়ম, কীসের শৃঙ্খলা। একটি দেশকে পিছিয়ে দিতে এরকম দু-একজন মতিউর রহমানই কি যথেষ্ট নয়? রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে মতিউর রহমানের মতো মানুষেরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেবে না, তা তো হতে পারে না। তাই তো একটি ছাগলের মাধ্যমে মতিউর রহমানকে বধ করা হয়েছে। এটা কি নিছক কাকতালীয়? নাকি দুর্ভ্যাগ্যবশত? নাকি অ্যাক্সিডেন্ট? সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা ধরা বড় দায়। 

উদ্বেগের বিষয় হলো, ছাগলটা কিন্তু এখনো আছে। ইমরান হোসেনের খামারে, গলার কাঁটা হয়ে! এই ছাগল দিয়ে সে কী করবে? বিক্রি করবে, কে কিনবে? ১৫ লাখ টাকার ছাগল নিজে জবাই করে খাবে, এই রকম ব্যবসায়ী তো সে নয়! তবে এই ছাগল নিয়ে সে যা করবে তাতেই কিন্তু নিউজ বের হবে। 

সাংবাদিকরা এই ছাগলের সংবাদ প্রকাশের জন্য রীতিমতো অপেক্ষা করছেন। তবে বাংলাদেশে প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোরবানিতে ১ কোটি টাকার একটি গরু আর ১৫ লাখ টাকার একটি ছাগল বিক্রি করে যে ব্রেক-থ্রো ঘটিয়েছে উদ্যোক্তা ইমরান হোসেন, তার বিড়ম্বনা তো তাকে পেতেই হবে। কোরবানি তো আর লোক দেখানোর বিষয় নয়। উচ্চবংশীয় গরু/ছাগল, এদের পূর্বপুরুষরা এলিট শ্রেণির সাধারণ মানুষের কাছে এসব বিষয়ের কি আদৌ কোনো গুরুত্ব আছে? ইমরান হোসেন বিভিন্ন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে যতই সাফাই গাক না কেন সাধারণ মানুষ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। তবে একটি কাজের জন্য ইমরান হোসেনকে ধন্যবাদ জানাতেই হয় যে, তার অতিদামি এসব গরু ও ছাগল অবৈধ টাকার মালিকদের ধরতে একটা টোপ হিসেবে কাজ করেছে। যে টোপে ধরাশায়ী হয়েছেন মতিউর রহমানের মতো অতি কৌশলী ও প্রতাপশালী অসৎ অফিসার। কে জানে এরকম উচ্চবংশীয় গরু/ছাগল আবার কোনো এক নতুন মতিউরকে ধরার জন্য বসে আছে কিনা?

বাংলাদেশে সরকারি চাকরি করে বড় চেয়ারে বসার সুযোগে চতুরতার সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যারা অবৈধ টাকার পাহাড় বানিয়েছেন, হাজার হাজার কোটি টাকা চুষেছেন বা চুষে যাচ্ছেন, তারা দয়া করে থামুন। সাবধান হোন। আপনাদের অবৈধ টাকা দিয়ে আপনারা সর্বোচ্চ কী করতে পারেন তা দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেন, বিদেশে বাড়ি কেনেন, দেশে অভিজাত এলাকায় নামে-বেনামে ফ্ল্যাট/বাড়ি ক্রয় করেন, কয়েক শ বিঘা জায়গার ওপর রিসোর্ট নির্মাণ করেন আর ছেলেমেয়েদেরে এসব অবৈধ টাকা অবাধে খরচ করতে দেন, এই তো? তাই সরকারি চাকুরে, যাদের কাছে এরকম হাজার হাজার কোটি টাকা রয়েছে তাদের জন্য একটা পরামর্শ- টাকাগুলো বিদেশে প্রাচার না করে বরং তা দিয়ে বঞ্চিত মানুষের জন্য কিছু করুন, দেশের টাকা দেশেই রাখুন, বাংলাদেশের হাজার হাজার বেকার তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুন, অনুন্নত গ্রামের উন্নয়নে ও প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ান। ভালো কাজে ব্যবহার করেন। তা না হলে আপনিও একদিন নিশ্চিত এরকম ছাগলবধ হবেন। যাদের সহযোগিতায় অপকর্ম করেছেন, স্বার্থ বিনিময় করেছেন তারা কেউ কিন্তু আপনার দায় নেবে না। আপনাকে ছিছি করবে গোটা জাতি। আপনার অর্থই হবে অনর্থের মূল। এরকমই এক ছাগলকাণ্ডে উন্মোচিত হবে আপনার সব কুকর্ম, তাসের ঘরের মতো ধ্বংস হবে আপনার অবৈধ টাকার পাহাড়।

লেখক: অধ্যাপক, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

প্রশ্নফাঁস: মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কোথায়?

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৪, ০৪:৪১ পিএম
আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৪, ০৪:৪১ পিএম
প্রশ্নফাঁস: মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কোথায়?
তৌহিদ-উল বারী

পড়াশোনা মানে যেন লাভ-ক্ষতির ব্যবসা। এমনটাই পরিলক্ষিত হয়, যখন ক’টা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন মিলে যায়। তাহলে তো আর কথা নেই। ব্যাস! এখন শুধু খাতায় গিয়ে লিখে দেওয়াটা বাকি। কি বা দরকার এত লেখাপড়া করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। যেখানে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পাওয়া যায় আর পরে মিলে যায় লোভনীয় সার্টিফিকেট। এভাবেই যেন গেঁথে দেওয়া হয়েছে বর্তমান শিক্ষার্থী আর অভিভাবকের মাথায়। একটি স্বল্প শিক্ষিত মানুষ নামের কুচক্রী মহল তাদের এই প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ের মধ্য দিয়েই পড়াশোনাকে বানিয়ে ফেলেছে একটি লাভ-ক্ষতির ব্যবসা।

প্রশ্নফাঁস একটি সভ্য জাতির জন্য কলঙ্ক বয়ে আনে নিঃসন্দেহে। যা আমরা শুনে এসেছি নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ‘If you want to destroy a nation, first destroy it’s education’ যদি তুমি একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চাও তাহলে প্রথমেই ওই জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস কর।

এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, এ যেন শত্রুপক্ষ বাঙালি জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার এক মহোৎসবে মেতে ওঠেছে। একটি স্বল্পশিক্ষিত মহল যেন শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করছে।

এসব স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মাথায় বিন্দুমাত্র কাজ করে না, প্রশ্ন ফাঁসের কারণে জাতির কত বড় সর্বনাশ হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হচ্ছে না বরং এরা তার থেকে বিমুখ হচ্ছে। যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা কোনোরকমে টেনেটুনে পাসের চিন্তা রাখে তাদের দলেই ধাবিত হচ্ছে মেধাবী শিক্ষার্থীরা। কারণ একটাই, এসব শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে পাশ করার চেষ্টা। যার প্রেক্ষিতে মেধাবীরা আজ পড়াশোনার প্রতি, মেধাচর্চার প্রতি বিমুখ হচ্ছে। 

কেমন জানি, প্রশ্নফাঁস করে অবৈধ টাকা কামানোর নেশায় নেমেছে সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র। ফলে গত ছয় বছরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এসব চক্রের প্রায় তিন শতাধিক সদস্য। এর মধ্যে রয়েছে ডাক্তার, শিক্ষক, ছাত্র, বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের পরিচালকসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। কেউ কেউ একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে ফের একই অপরাধ করছে। বিচার কার্যক্রমের ধীরগতির সুবিধাও নিচ্ছে এসব চক্রের সদস্যরা।

তবে এত এত গ্রেপ্তারের পরও কেমন জানি এই প্রশ্নফাঁস ঠেকানোই যায় না। কোনো না কোনো ভাবে এসব প্রশ্ন ফাঁস হয়েই যায়। কেন বারবার এমনটা হচ্ছে? এর পিছনে কারা দায়ী? কিসের ঘাটতি রয়েছে এই কুচক্রী মহলকে ঠেকানোর পেছনে? নাকি এভাবেই চলতে থাকবে ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো। প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে, পরীক্ষা দেবে, অপরাধীও শনাক্ত হবে। কিন্তু বিচারের কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকবে না। তাহলে এরকম হলে কেমন হবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবন? এটা নিয়ে কি আমরা মোটেও ভাবার বিষয় মনে করছি না! 

তবে আমরা এটা নিশ্চিত ভাবে জানি প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর ৪ নম্বর ধারায় এই শাস্তির বিধান আছে। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া অধিকাংশ আসামিদের অপরাধের শাস্তির রায় হয়নি। তাহলে কি এটাই হতে পারে একই ঘটনা পুনরাবৃত্তির কারণ? নাকি আরও কোনো অদৃশ্য কারণ রয়েছে এ প্রশ্নফাঁসের পেছনে। খতিয়ে দেখা হোক, চিরতরে বন্ধ হোক প্রশ্নফাঁসের এই দুর্নীতি-অনিয়ম। দিনশেষে মেধাবীরাই তাদের মেধার মেধার স্বাক্ষর রাখুক।

লেখক: শিক্ষার্থী ও কলামিস্ট 
[email protected]

মহুয়া পালায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র: সেকাল ও একাল

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৪:৫৫ পিএম
আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৪:৫৭ পিএম
মহুয়া পালায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র: সেকাল ও একাল
মো. রেজাউল করিম

‘মহুয়া’ পালা মৈমনসিংহ গীতিকার অন্যতম আলোচিত গীতিকাব্য। সাহিত্য সর্বদাই সমাজের ব্যক্তি-মানুষ ও সমাজের উপরিস্থিত ও অন্তস্থ আন্তসম্পর্কের বর্ণনাচিত্র। মৈমনসিংহ গীতিকায় কবিরা সরল লোকজ ভাষায় মানবজীবনের গান গেয়েছেন। চরিত্র-চিত্রণের নৈপুণ্যে নর-নারীর প্রেম অনুভূতির স্তর অতিক্রম করে স্পষ্ট বাস্তবতায় কাহিনিসমূহ অমরত্ব লাভ করেছে। মহুয়া পালা এমনই এক আখ্যানচিত্র যে পালা বা গাথায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র বিধৃত হলেও তা গোটা বাংলার, বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র হিসেবেই গণ্য করা যায়। মহুয়া পালায় বর্ণীত আখ্যানের সমাজচিত্র পৌনে চার শ বছর পরও চলমান বঙ্গীয় সমাজে অনেকাংশেই বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়।

মৈমনসিংহ গীতিকার প্রায় সব কাব্যই মানব-মানবীর প্রেমাখ্যানের মনোস্তত্ত্বকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। মহুয়া পালাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই পালার প্রধান দুই চরিত্র- নদের ছাঁদ ও মহুয়া সামাজিক অবস্থানের দুই মেরুতে অবস্থানকারী দুই যুবক-যুবতী। শুধু যে সামাজিক অবস্থান পৃথক তা-ই নয়, তাদের ধর্মও পৃথক। অথচ তারা একে অপরের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়। প্রেম, পরিবার ও সমাজসৃষ্ট ঘাত-প্রতিঘাত, মানোস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, প্রেমের প্রতি অকুণ্ঠ প্রতিশ্রুতি ও ত্যাগ- ফলে পরিবার ও সমাজসৃষ্ট আরোপিত নিগ্রহ এবং আরোপতি নিগ্রহের বিরুদ্ধে মনোস্তাত্ত্বিক দ্বৈরথের আখ্যান এই পালার উপজীব্য। পরিশেষে যার সমাপ্তি ঘটে ট্র্যাজিক পরিণতির মধ্য দিয়ে। 

নদের চাঁদ ও মহুয়া পালার চিত্রায়ন শুরু হয় গারো পাহাড়ের ওপারে হিমানী পর্বতে, যা কিনা ছয় মাসের দূরত্ব।  হিমানী পর্বতের ওপারে ঘন জঙ্গল যেখানে চন্দ্র কিংবা সূর্যের আলো পৌঁছে না- এমন ঘন জঙ্গলে বাস করে ডাকাত সর্দার হুমরা, তার বাহ্যিক পেশা সাপুড়ে তথা বেদে- ডাকাত সর্দার হুমরা ‘হুমরা বাইদ্যা’ নামেই পরিচিত। ষোলো বছর আগের ঘটনা- হুমরা বাইদ্যা কাঞ্চনপুর গ্রামের এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে ডাকাতি শেষে অপরূপ রূপ-মাধুর্যের অধিকারী ছয় মাসের এক কন্যাকে দেখে চুরি করে নিয়ে আসে। এই ঘটনা শুধু যে তৎকালীন সমাজচিত্র তা-ই নয়, পৌনে চার শ বছর পরও বর্তমান বেদে জনগোষ্ঠী কর্তৃক শিশু, বিশেষত শিশুকন্যা চুরির কথা শোনা যায়। 

চুরি করে আনা শিশুকন্য মহুয়া অন্তজ বেদে সমাজে বেড়ে উঠতে থাকে আরও দশটি মেয়ের মতো। সাপের খেলা, নাটকীয় সংলাপ, নদী থেকে জল আনা, এমনকি ঘোড়ায় চড়া- সব কাজেই সে পারদর্শী হয়ে ওঠে। ভাগ্য অন্বেষণে নদী, জলাশয়, পাহাড় অথবা গ্রামীণ লোকালয়ে মৌসুমভেদে ঘুরে বেড়ায় তারই পালক-পিতা বেদেসমাজের দলপতির সঙ্গে। যাযাবর শ্রেণির বেদেসমাজ দলপতির ‘বৈদেশেতে’ যেত- সেই পর্বের বর্ণনা পাওয়া যায় পালায় এভাবে: ‘ঘোড়া লইল গাধা লইল, কত কইবো আর- সঙ্গেতে করিয়া লইল রাও চণ্ডালের হাড়- শিকারি কুকুর লইল শিয়াল হেজে ধরে- মনের সুখেতে চলে বৈদেশ নগরে।’ উপরিউক্ত স্তবক থেকে জীবিকার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেদে সমাজের পরিভ্রমণের চিত্র জানা যায়, যা এখনো বিরাজমান। তবে বর্ণনায় আতিশয়োক্তি রয়েছে বলে মনে হয়। একই নৌকায় কুকুর আর শেয়াল বহনের ঘটনা বর্ণনার আতিশয়োক্তি বলেই প্রতীয়মান হয়।

এই স্তবকে সনাতন বাঙালি সমাজের আতিথেয়তার প্রমাণও পুরিস্ফুট। জমিদারের নায়েব প্রথম দর্শনেই মহুয়ার প্রেমে পড়ে। মহুয়াও তার প্রতি সমভাবে আকৃষ্ট হয়। সে নিজেদের আলয়ে নদেরকে নিমন্ত্রণ জানায়, যা পালায় এভাবে বর্ণীত হয়েছে: ‘আমার বাড়িত যাইওরে বন্ধু বইতে দিয়াম পিরা- জল পান করিতে দিয়াম সালি ধানের চিরা- সালি ধানের চিরা দিয়াম আরও সবরি কলা- ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা।’ পালার এই স্তবক এ দেশের সনাতন সমাজের লোকজ খাদ্য দিয়ে হাজার বছরের আতিথেয়তা প্রকাশ করে, যা আজও গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান।

তৎকালীন বেদে সমাজের নারীরা তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিষ অথবা ধারালো অস্ত্র সঙ্গে রাখত। পালার বিভিন্ন পর্বে তার বিবরণ পাওয়ায়। এ ছাড়া বিষের বিশেষ ব্যবহার লক্ষ্যণীয়, যা বেদে সমাজে সে-সময়ে ছিল, এখনো আছে এমন তথ্য প্রমাণিত। এই পালায় তক্ষকের বিষ অস্ত্র হিসেবে বিবৃত হয়েছে যখন মহুয়া তাকে অপহরণকারী সওদাগরের মাঝি-মাল্লাদের বানিয়ে দেওয়া পানের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেয়। এখানে দুটি দৃশ্যকল্প অবলোকন করা যায়। প্রথমত, বেদেকন্যা নিজের কাছে গোপনে বিষ রাখত। দ্বিতীয়ত, তারা সেই যুগে, এমনকি বর্তমানেও কথার জাদুতে মানুষকে মোহাবিষ্ট করতে পারে। তাই তো দেখা যায়- যারা তাকে অপহরণ করেছে, তার নাটকীয় কথার মাধুর্যে মোহাবিষ্ট হয়ে তারই সাজিয়ে দেওয়া পান খেয়ে সবাই অচেতন হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, বেদে সমাজে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া মাত্রই বিশেষত নারীরা পান খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যা এখনো বিদ্যমান। 

গোটা পালা নিবিড় অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, এই পালার পরতে পরতে ফুটে উঠেছে তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজচিত্র, যা পৌনে চার শ বছর পর আজও শুধু বেদে সমাজ নয়, বাংলার গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান। রক্ষণশীল সমাজের বেদেকন্যা মহুয়া সুন্দরী ও জমিদারের দেওয়ান সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদের ভালোবাসায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিন্ন ধর্ম এবং বিবাহ তথা সম্প্রদানের ব্যাপারে অভিভাবকের সিদ্ধান্তের প্রাধান্য। সে-যুগেও অভিভাবকের সিদ্ধান্তের বাইরে যুবক-যুবতী প্রণয়াসক্ত হতো, যা এই পালায় বিবৃত হয়েছে। তবে কোনো বাধাই দুজনের মধ্যে আত্মিক দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত দুজনে আত্মাহুতির মাধ্যমে প্রমাণ করেছে ভালোবাসা শাশ্বত। এমন চিত্র বাংলার গ্রামীণ সমাজই শুধু নয়, শহুরে সমাজেও এখন কদাচিৎ হলেও জানা যায়।  

হুমরা বাইদ্যা নদের চাঁদের প্রতি তার আদরের পালিত কন্যা মহুয়ার আসক্তি টের পেয়ে যায়। এই পর্যায়ে দেখা যায়, হুমরা বাইদ্যা ভাবে- কিছুদিনের মধ্যেই দেশের বাড়ির জমিতে ফসল উঠবে; ফসল তোলার টান, বাড়ির পুকুরের মাছ ধরার মৌসুম, অন্যদিকে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে মহুয়ার গোপন প্রণয়ের আশঙ্কা- তাকে কিছু একটা করতেই হবে। বেদে দলে মহুয়ার সখা পালঙ্ক হুমরা বাইদ্যার নিষ্ঠুরতার আশঙ্কায় মহুয়াকে পরামর্শ দেয় এক সপ্তাহ বাইরে বের না হওয়ার জন্য। ঠাকুরবাড়িতে সে পৌঁছে দেবে মহুয়ার মৃত্যুর খবর। মহুয়া রাজি হয় না, উল্টো ঠাকুরবাড়ির পানে চেয়ে চন্দ্র-সূর্য আর পালঙ্ক সখাকে সাক্ষী মেনে নদের চাঁদকে স্বামী বলে ঘোষণা করে। পালঙ্ককে বলে সে নদের চাঁদকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, অন্যথায় বিষপানে আত্মহত্যা করবে। হুমরা বেদে মহুয়ার অজান্তে দলবল নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ করে দলের অন্যদের সঙ্গে। হুমরা বাইদ্যা নদের চাঁদকে তক্ষকের বিষ প্রয়োগে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সে মহুয়ার হাতে বিষলক্ষার ছুরি দিয়ে নদের চাঁদকে হত্যা করতে বললে মহুয়া নদের চাঁদকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে পালিয়ে যায়। পালায় যা বলা হয়েছে: ‘আরে করে ঝিলিমিলি নদীর কূলে দিয়া, দুজনে চলিল ভালা ঘোড়া সুয়ার হইয়া’। 

ধর্মীয় বিশ্বাস, বাদ-মতবাদ গীতিকা-রচয়িতাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আচ্ছন্ন করেনি। জীবনবিরোধী সবকিছুই অস্বীকৃত হয়েছে এ কাব্যমালায়। মৈমনসিংহ গীতিকায় মূলত মুক্ত প্রেমের জয়গান বিবৃত হয়েছে। এ গীতিকার নারীরা ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করেছে কখনো বা অভিভাবকের অভিমতের বিরুদ্ধেও জীবনসাথী বেছে নেওয়ার লক্ষ্যে ঝুঁকি নিয়েছে, গৃহত্যাগ করেছে। এটা কোনোকালেই অলৌকিক, অসম্ভব বা অবাস্তব ছিল না। যে কারণে বলা যায়, মৈমনসিংহ গীতিকায় নারীর শক্তি, উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক মূল্যবোধের জয়গান বিবৃত হয়েছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক
[email protected]

পুলিশে সৃষ্ট অস্থিরতা

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৩:১৫ পিএম
আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৩:১৫ পিএম
পুলিশে সৃষ্ট অস্থিরতা
মো. সাখাওয়াত হোসেন

সম্প্রতি ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে এক পুলিশ সদস্য কর্তৃক অন্য এক পুলিশ সদস্য হত্যার ঘটনায় বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশে সৃষ্ট অস্থিরতা ও সংকট নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। গণমাধ্যম না যতটুকু তার থেকে কয়েক কাঠি এগিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিশেষ করে কনস্টেবল কর্তৃক কনস্টেবল হত্যায় অনেকেই সন্তুষ্টির ঢেঁকুড় তুলেছে। এই যে পুলিশকে নিজের করে না ভাবা, পুলিশের দুঃসময়ে পাশে না থাকা, পুলিশকে মানসিকভাবে সমর্থন না করা ইত্যাদি বিষয়ে এক ধরনের হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।

পুলিশের মধ্যকার যেকোনো ধরনের নেতিবাচক সংবাদে আমাদের উৎফুল্ল হওয়ার একটি ব্যতিক্রমী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ বিষয়গুলো পুলিশ সদস্যদেরও অজানা নয়। অথচ যখনই কোনো সংকটের মুখোমুখি হই কিংবা কোনোভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত বা আমাদের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে কেউ ক্রোক করে এবং অপরাধীদের দ্বারা কোনোরকম ভয়ভীতি প্রাপ্ত হলে আমরা তৎক্ষণাৎ পুলিশের দ্বারস্থ হই। তদুপরি পুলিশকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচার ও সৃষ্টকরণের ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। 

খবরে জানা যায়; রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে সহকর্মীকে গুলি করে হত্যা মামলার আসামি পুলিশ কনস্টেবল কাওসার আহমেদের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায়। কাওসারের স্ত্রী নিলুফারের ভাষ্যে; কাওসারের দুই সন্তান আছে। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন। সংসারে কোনো ঝামেলা বা কলহ ছিল না। তবে তিনি জানান, ‘কাওসারের মানসিক সমস্যা ছিল। রাঙামাটির বরকলে চাকরি করার সময় তিনি মানসিক সমস্যায় ভোগেন। এরপর বিভিন্ন সময় সরকারিভাবেই তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে অন্তত তিনবার চিকিৎসা করানো হয়েছিল। নিয়মিত ওষুধও সেবন করতেন। কাওসারের কাছে প্রেসক্রিপশনও আছে। সংসারে কোনো অভাব-অনটন ছিল না। তবে চাকরি নিয়ে খুবই টেনশন করেন তিনি। ছয় ঘণ্টার ডিউটি আট ঘণ্টা হতো।’

ইংল্যান্ডে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে শতকরা ৩০ জন মানসিক সমস্যায় ভোগেন- গবেষণা জরিপে এমন তথ্যের আভাস পাওয়া গেছে। কর্তৃপক্ষ যেহেতু তাদের সদস্যদের মানসিক সমস্যা নিয়ে কাজ শুরু করেছে কিংবা উদ্যোগ নিয়েছে তাহলে সমস্যা-পরবর্তী সমাধানের আভাসও পাওয়া গেছে। ইংল্যান্ডের মতো দেশে; যে দেশে পুলিশ পাবলিকের একটি চমৎকার সম্পর্ক বিদ্যমান, সেই দেশে পুলিশ সদস্যদের একটি বড় অংশের মানসিক সমস্যার উদাহরণ একটি বড় প্রশ্নের সামনে নিয়ে আসে আমাদের। বাংলাদেশ পুলিশ কি আদৌ তাদের সদস্যদের মানসিক অবস্থানকে তুলে ধরার কিংবা যাচাই করার কোনোরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে? অন্যান্য দেশে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ে প্রত্যেক ইউনিটে আলাদা করে সেন্টার স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার বিষয়ে সেন্ট্রালি পুলিশ হাসপাতাল রয়েছে, যেটি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল এবং ইউনিট কিংবা রেঞ্জভিত্তিক চিকিৎসা সেন্টার কিংবা ডাক্তারদের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার তেমন ব্যবস্থা নেই। 

বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যদের চাকরিতে নানা রকমের চাপকে মোকাবিলা করেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলমান চাপকে মোকাবিলা করেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। তথাপি এ ধরনের পেশাগত চাপকে ব্যবহারিকভাবে প্রশমনের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সঙ্গত কারণেই পেশাগত প্রতিকূলতার আকার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি অঘোষিত নেতিবাচকতাকে সব সময় পুলিশ সদস্যদের মোকাবিলা করতে হয়। বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের পেশাগত চাপকে মোকাবিলা করতে বিশেষ ধরনের সাপোর্ট সেন্টার নেই। সাধারণত পুলিশ সদস্যরা যে ধরনের চাপকে মোকাবিলা করে থাকেন তার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  

প্রথমত, পুলিশের চাকরিতে সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। সবসময়ই পুলিশকে সজাগ থাকতে হয়, কখন কোন নির্দেশনা চলে আসে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে; এ ধরনের একটা তাড়না সবসময়ই পুলিশ সদস্যদের মধ্যে থাকে। আমরা সবাই জানি, জরুরি যেকোনো পরিস্থিতিতে পুলিশের সব ধরনের ছুটিও বাতিল হয়ে যায়। পুলিশের মূল কাজই হচ্ছে জনসাধারণের নিরাপত্তা দেওয়া এবং জনগণের সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া। জায়গা থেকে পুলিশে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সারা দেশে ঈদের ছুটিকে সামনে রেখে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এবং হলফ করে বলা যায়, এ ইউনিটের সদস্যদের অধিকাংশ ঈদের ছুটি থেকে দায়িত্বের কারণে বঞ্চিত হন। 

দ্বিতীয়ত, সিনিয়র, জুনিয়র ও ব্যাচমেটদের সঙ্গে নানা বিষয়ে সম্পর্কের ঘাটতি একজন পুলিশ সদস্যের মানসিক বৈকল্যের কারণ হয়ে থাকে। বিসিএস অফিসারদের মধ্যে এমন দেখা যায়, কোনো এক ব্যাচের কর্মকর্তা ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন আবার ওই একই ব্যাচের কর্মকর্তা এখনো এসপি হতে পারেননি। এমন নজির ও উদাহরণ বাংলাদেশ পুলিশে রয়েছে। এ ব্যাপারগুলো একজন অফিসারকে মানসিকভাবে ট্রমার মধ্যে ফেলে রাখে, ফলে পুলিশিংসহ অন্যান্য কাজে তার একটি নমুনা পাওয়া যায়। পুলিশের অভ্যন্তরীণ পদোন্নতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাওয়ার বিষয়গুলোকে সামনে রেখে একই ব্যাচের সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ ও মতদ্বৈততার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া অনেক সময় দেখা যায়, জুনিয়র বিভিন্ন উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে বিশেষ করে ছুটি ও কর্মঘণ্টা ইত্যাদি বিষয়ে। উপরন্তু আলোচনার জায়গা থেকে ব্যাচভিত্তিক ও রেঞ্জভিত্তিক সুযোগ-সুবিধার রকমফেরের কারণে মানসিক ট্রমার মধ্যে থাকেন অনেকেই। সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পুলিশের পারফরম্যান্স ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবান্বিত করে থাকে। 

তৃতীয়ত, একঘেয়েমি কাজ। নিয়মিত একই কাজে অনেক পুলিশ সদস্যের মধ্যে বিরক্তিবোধ চলে আসে। সে কারণেই কাজের মধ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে আসার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এমনও দেখা যায়, কেউ সরাসরি পেট্রোল নিয়ে ব্যস্ত আবার অনেক পুলিশ সদস্য অফিস ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে থাকেন। আবার কেউ কেউ আছেন একই রেঞ্জ কিংবা একই ইউনিটে দীর্ঘদিন কাজ করায় তার কাজের মান ও কাজের ধরনে উন্নতি না হয়ে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে আসছে। এ বিষয়গুলোকে সমন্বয়ে করে পোস্টি ও পদায়ন করা জরুরি, তা না হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের কাজের মানে তেমন তারতম্য দেখা যাবে না। 

চতুর্থত, পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণা। দীর্ঘদিন ধরে নেতিবাচক ধারণার ব্যাপারটি পুলিশের মনে ও মগজে গেঁথে আছে এবং এ ব্যাপারগুলো পুলিশ কর্তৃক ইতিবাচক ও প্রো-অ্যাকটিভ কাজের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশের হাজার ভালো কাজ থাকলেও নেতিবাচক কাজটিকে সবার সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যাপারগুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পুলিশ একটি মানসিক অশান্তি নিয়ে দিনাতিপাত করে। বিপদে-আপদে পুলিশের সাহায্যের দ্বারস্থ হই এবং পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাই কিন্তু মূল্যায়নের সময় পুলিশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার লক্ষ্য নিয়েই যেন আমরা মতামত দিয়ে থাকি। এ ব্যাপারগুলো পুলিশ সদস্যদের গোচরীভূত এবং দায়িত্ব পালনের সময় উল্লিখিত বিষয়গুলো তাদের ট্রমার মধ্যে রাখে, যা পারফরমেন্সে প্রভাব ফেলে।  

পঞ্চমত, পদোন্নতি, বদলি ও পদকপ্রাপ্তিতে বৈষম্য ইত্যাদি কারণে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করে। পদোন্নতি নিয়ে সংস্থাটির বাইরে সরাসরি কোনো সদস্য কথা না বললেও তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও অভিমান বিরাজ করে। কমিউনিটিতে পরিচয় ও প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করে দেয় পদোন্নতি সংক্রান্ত ইস্যুগুলো, সে কারণেই পুলিশ সদস্যরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং অনেকেই নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে থাকে। এ ব্যাপারগুলো সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের পারিবারিক ও কর্মময় জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। 

ষষ্ঠত, রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কারণে স্বাধীনতা হরণ করা হয়, এ ধারণা রয়েছে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিনের। এ দোদুল্যমান অবস্থা থেকে পুলিশের অনেকেই বের হয়ে আসতে চান। পুলিশকে সংস্কারের ব্যাপারে প্রায় সবাই মতামত দেন। তথাপি কেন, কীসের জন্য পুলিশের সংস্কার আটকে গেছে, সেটি খুঁজে বের করে দ্রুততর সময়ে পুলিশকে স্বতন্ত্র ইউনিট হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে পুলিশের পারফরম্যান্স আশাব্যঞ্জক হবে নিশ্চিতভাবেই। আমরা মনে করি ও বিশ্বাস রাখি, পুলিশকে যদি আমরা যথাযথভাবে ধারণ করতে পারি তাহলে পুলিশের কাছ থেকে আরও ইতিবাচক ও প্রো-অ্যাকটিভ কর্মকাণ্ড প্রত্যাশা করতে পারি। যেমনটি দেখেছিলাম করোনার সময়ে। সর্বোপরি পুলিশের সংকটগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করে সামনের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশের মধ্যে সৃষ্ট অস্থিরতা অচিরেই সমাধান হয়ে আসবে।
    
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]