আর কখনো রেস্তোরাঁয় যাওয়া হবে না ভিকারুননিসার শিক্ষিকা ও তার কন্যার। অতিরিক্ত আইজির প্রাণপ্রিয় কন্যার শেষ আকুতি ‘বাবা আমাদের বাঁচাও’ আর শোনা যাবে না। নিজে মরে গিয়ে স্বামী এবং স্ত্রীর একে অপরকে বাঁচানোর অদম্য ইচ্ছাও আর প্রকাশ পাবে না। রেস্তোরাঁর কাচ ভেঙে সন্তানকে বাঁচিয়ে রেখে মা তানজিন এষার নিজের প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার বিরল দৃষ্টান্ত আর কত দেখা যাবে। ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত প্রায় পৌনে ১০টায় বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডে এভাবে কেড়ে নিল ৪৬ তরতাজা প্রাণ। অগ্নিদগ্ধ ২২ জন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে হচ্ছে। জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ৭৭ জনকে। আগুন লাগা সাততলা ভবনে রয়েছে কয়েকটি রেস্তোরাঁ। ভবনের নিচ থেকে ওপরের সবই বাণিজ্যিক দোকান, নানা রকম পণ্যে ঠাসা। ভবনের নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ওপরে। ভবনে কোনো ফায়ার এক্সিট ছিল না। একটি মাত্র সিঁড়ি ও দুটি লিফট থাকায় অনেকগুলো মানুষ তাড়াহুড়া করে নিচে নামতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রচণ্ড ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ভবনে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে করুণ মৃত্যু হয়েছে অনেকের।
এভাবে রাজধানীতে প্রায়ই আগুন লাগছে; অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে কেমিক্যাল গুদামে, গার্মেন্ট কারখানায়, বড় বড় শপিং কমপ্লেক্সে, সাধারণ মার্কেটে, ফ্ল্যাট-বাড়ি এমনকি বস্তিতে। জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে মানুষ। কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। পথে বসছে হাজারো পরিবার। কত স্বপ্ন পুড়ে ছাই হচ্ছে। এমনই এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ২২ তলা ভবন এফআর টাওয়ারে ২৬ জন নিহত ও ৭৩ জন আহত হয়েছেন। আগুনে এফআর টাওয়ারের চারটি ফ্লোর পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়। নিহত এবং আহতদের সবাই টাওয়ারের বিভিন্ন অফিসে কর্মরত ছিলেন। একই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় মজুত করা রাসায়নিক পদার্থের বিস্ফোরণে আগুন লাগে। পুড়ে অঙ্গার হলো ৭৯টি তরতাজা প্রাণ। গুরুতর আহত হন ৪১ জন। সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া পাঁচটি ভবনের একটি ওয়াহেদ ম্যানশনের বেসমেন্টে ছিল ড্রাম ও বস্তাভর্তি ১১ ধরনের কেমিক্যালের মজুত। ২০১০ সালের ৩ জুন ৩০ লাখের অধিক মানুষের বসতবাড়ি নিমতলীতে সংঘটিত স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নেয় ১২৫ জন মানুষের প্রাণ। পুরান ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক গুদামে দাহ্য পদার্থ মজুতের পরিণতি যে কত ভয়ংকর হতে পারে নিমতলী ট্র্যাজেডির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
একসময় গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। গাজীপুরের কাশিমপুরের একটি পোশাক কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে ৫০ জন পোশাকশ্রমিক মারা যান। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তোবা গ্রুপের তাজরিন ফ্যাশনসে ভয়াবহ আগুন লেগে ১২৪ জন এবং নরসিংহপুরে হামীম গ্রুপের একটি অত্যাধুনিক বহুতল পোশাকশিল্প কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা সংলগ্ন ভোগড়া শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত গরীব অ্যান্ড গরীব সোয়েটার কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুবরণ করেন ২১ জন শ্রমিক। মহাখালীর একটি নিটিং কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১২ জন শ্রমিক মারা যান, যার মধ্যে ১০ জনই ছিলেন নারী শ্রমিক। এ ছাড়া নরসিংদীর একটি তোয়ালে কারখানার আগুন লেগে ৪৬ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে। একের পর এক গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে অসংখ্য শ্রমিকের মৃত্যুর পর শ্রমিকের নিরাপত্তার ব্যাপারটি উপেক্ষিত থাকার কারণে গার্মেন্টস রপ্তানিতে ধস নামতে শুরু করে। এরপর শিল্পমালিকরা অগ্নিকাণ্ড ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করায় হ্রাস পায় গার্মেন্টসের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।
অন্যদিকে ২০১৭ সালের ঢাকার উত্তরায় ৪ নম্বর সেক্টরে চারতলা সি-শেল রেস্তোরাঁর তিনতলায় আগুন লাগায় দুজন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। ওই বছরের রাজধানীর গুলশান-১ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন মার্কেটের বড় একটি অংশ ভস্মীভূত হয়। অগ্নিকাণ্ডে কোনো প্রাণহানি না হলেও নিঃস্ব হয়ে গেছেন ছয় শতাধিক ব্যবসায়ী। একই স্থানে আগুন লাগে গত ২৯ মার্চ, এবারও কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও দুইশর বেশি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ছাড়া রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে ও অভিজাত বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি না হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেক মানুষ। টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরীতে ট্যাম্পাকো ফয়েল লিমিটেড নামের একটি ফয়েল পেপার কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে, আগুনে দগ্ধ হয়ে ও ভবন ধসে ৩৬ জন নিহত এবং শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছিলেন।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুসারে বর্তমানে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ১ হাজার ১৮৭টি, ঝুঁকিপূর্ণ ৩ হাজার ৫১৮টি স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতে রয়েছে ১ হাজার ৬৯টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং ২ হাজার ৫৮৩টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা। রাজধানী ঢাকায় এসব বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় গড়ে উঠেছে অফিস, গার্মেন্টস, শিল্প-কারখানা, মার্কেট ও শপিংমল। এর অনেকগুলোরই বৈধ অনুমোদন নেই। কারখানায় ছোট ছোট কক্ষে বসানো হয় ভারী ভারী যন্ত্রপাতি। অনেক অফিস ও কারখানায় আলাদা গুদাম না থাকায় ভবনের মধ্যেই বিভিন্ন তলায় মালামাল স্তূপ করে রাখা হয়। কখনো সেখানে থাকে না ওঠানামার জন্য প্রশস্ত সিঁড়ি ও জরুরি বহির্গমনের আলাদা কোনো পথ। অপরিকল্পিত অপ্রশস্ত সিঁড়ি অগ্নিকাণ্ডের সময় একটি ধোঁয়াভর্তি চিমনিতে রূপ নেয়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় মানুষ, যেমনটি এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের বেলায় হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের সময় অপ্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে একত্রে তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে পদদলিত হয়ে হতাহত হন কেউ কেউ।
ঢাকা মহানগরীতে প্রায় ৯৩ শতাংশ বহুতল আবাসিক ভবন, বিপণিকেন্দ্র, কল-কারখানায় অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। নেই পর্যাপ্ত সংরক্ষিত পানির আধার। কোথাও কোথাও সীমিত সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকলেও এর সঠিক ব্যবহার অনেকের জানা নেই। বহুতল আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এসব স্থাপনার জন্য বৈদ্যুতিক তার, ফিটিংস, ফিউজ, সার্কিট ব্রেকার মানসম্পন্ন নয়। নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারেও রয়েছে শৈথিল্য। দোকানপাটে, ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্রে, কল-কারখানায় ব্যবহৃত মালপত্র, দাহ্য পদার্থগুলো যত্রতত্র ফেলে রাখা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় আগুন নেভানোর জন্য স্থাপনায় নিজস্ব ফায়ার হাইড্রেন্ট, পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির ব্যবস্থাও না থাকার ফলে আগুন সহজে ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস এসে ঘটনাস্থল থেকে দূরের কোনো উৎস থেকে পানি এনে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগে যাওয়ায় অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহ রূপ নেয়। ফায়ার সার্ভিসেরও কর্মীদের পোশাক, পর্যাপ্ত উঁচু মই, জাম্পিং নেটসহ উদ্ধার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকার ৬৬ শতাংশ ভবনই নিয়মবহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদাসীনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনার কারণে রাজধানীতে এত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এজন্য রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও বিদ্যুৎ বিভাগের সমন্বয়হীনতায় অভাব রয়েছে। একটি দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়া ছাড়া এসব সংস্থা সহজে একত্রিত হয় না। দুর্ঘটনার পর তারা কিছু সুপারিশ করেন, কিন্তু সেসব সুপারিশ আদৌ বাস্তবায়িত হলো কি না, এর ওপর কোনো নজরদারি থাকে না। রাজউক কর্তৃক ভবনের নকশা অনুমোদনের পর যে যার খুশিমতো ভবন নির্মাণ করেন। ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন ছাড়াই বহুতল ভবনে অফিস, বাণিজ্যিক কেন্দ্র খুলে বসেন। আর এ ধরনের অব্যবস্থাপনার কারণেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েই চলেছে। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যানের মতে, ২০১৮ সালে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যার সংখ্যা ১৯ হাজার ৬৪২টি। ২০১২ থেকে ১০১৮ সাল পর্যন্ত সারা দেশে মোট ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৩৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭৩৬ জন, আহত ৩ হাজার ৭৬৫ জন এবং মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩ হাজার ৩৬১ কোটি ৮৩ লাখ ২৩ হাজার টাকা।
অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে প্রতিটি ভবন বিল্ডিং কোড, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মেনে নির্মাণের ব্যাপারে কঠোর নজরদারি থাকা দরকার। ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন ছাড়া কোনো ভবনের কার্যক্রম শুরু হতে দেওয়া যাবে না। যেকোনো বহুতল আবাসিক ভবন, ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র, কল-কারখানার জন্য উন্নত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার ও নিয়মিত মেরামত করা, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রাখা ও ড্রামভর্তি পানি সংরক্ষণ, প্রশস্ত সিঁড়ি ও বিকল্প জরুরি বহির্গমনের পথ রাখা, কর্মকালীন গেট বন্ধ না করা, সিঁড়িঘরে বা যত্রতত্র মালামাল না রেখে আলাদা গুদামে সংরক্ষণ, নিরাপত্তা প্রহরীর জন্য বিশেষ জরুরি টেলিফোন ব্যবস্থাসহ বিদ্যুৎ বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিসের টেলিফোন নম্বর শ্রমিকদের অবগত করা, কারখানায় প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ শ্রমিকদের অগ্নিনির্বাপণের প্রশিক্ষণ প্রদান জরুরি। স্থাপনা কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ত্রুটি ও দুর্বলতার দিকগুলো আমলে আনা আবশ্যক। যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি বহুতল ভবন, শপিং কমপ্লেক্স, গার্মেন্টসসহ অন্য শিল্প-কারখানা নির্মাণের পর যেসব সংস্থার ছাড়পত্রের ভিত্তিতে রাজউক ব্যবহারের সনদ দেয়, তার মধ্যে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ জরুরি। বর্তমানে বহুতল ভবন হিসেবে দশতলা ভবনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হলেও এর চেয়ে কম তলাবিশিষ্ট ভবনগুলোর নিরাপত্তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। মেগা সিটি ঢাকাকে কয়েকটি ব্লকে ভাগ করে সেখানে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বাহিনী, ভবন মালিক সমিতি, স্বেচ্ছাসেবক দল ও স্থানীয় জনগণকে নিয়ে একটি ইউনিট গঠনের মাধ্যমে অগ্নিনির্বাপণের দায়িত্বে নিয়োজিত করলে সুফল পাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের আধুনিক মানসম্পন্ন যন্ত্রপাতি সরবরাহসহ জনবল কাঠামো বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ বিভাগ, ওয়াসা ও তিতাসের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করে সমন্বিতভাবে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমিয়ে আনবে।